কপালে যা লেখা আছে তাই হবে ভেবে আমি দরজার কাছে এগিয়ে যাই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আবার থমকে গেলাম। চৌকাঠে হাত দিতেই এক অজানা আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করে। ভয়ে রীতিমতো আড়ষ্ট হয়ে পড়ি। মনের অস্থিরতা এসময় শতগুণ যায় বেড়ে। বুঝতে পারি যে নিজের হাত যেন নিজেরই নিয়ন্ত্রণে নেই। হাতের অস্থিরতার সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে চলে মন।মন অসম্ভব দুরুদুরু করতে থাকে।তার সঙ্গে অজানা ভয় মিলেমিশে আমার হাত পা যেন অবশ হয়ে আসে। যদিও আমার মনের এই দ্বিধা দ্বন্দ্বকে সমীহ করার মতো ফুরসত দরজার ওপাশের লোকদের ছিল না। তাই কয়েক মুহূর্ত দেরি হতেই দরজায় আচমকা পরপর কয়েকটি লাথির শব্দ বালির বাঁধের মতো আমার মনের যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্বকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়। এবার অবশ্য পড়ি মরি করে আমি দরজা খুলে দেই।
দরজা খোলা মাত্রই হুড়মুড়িয়ে একদল লোক ভেতরে ঢোকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন আমার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে রাখে।ঐ অবস্থায় আমি পিছোতে পিছোতে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। অপর দুজন শক্ত করে আমার দুই হাত ধরে ফেলে। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই বন্দুক ঠেকিয়ে রাখা লোকটি অমনি বন্দুকের নলটি আরো গভীরভাবে আমার কপালে পুঁতে দিয়ে চোখ বড় বড় করে এমন করে তাকিয়ে থাকে যেন পারলে এক্ষুনি আমার মাথাটাকে এফোড় ওফোড় করে দেয় ...
এতোজন লোকের মধ্যে আমি একা মেয়ে মানুষ।তার উপর বন্দুক ঠেকিয়ে এমন ভয় দেখানোয় আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠে। আমি ভয়ে কুঁকড়ে ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়ি। দুই হাটুর মধ্যে মাথা গুঁজে মনে-মনে উত্তর খুঁজতে থাকি কারা এরা?
শুরুতে অবশ্য উত্তর মেলাতে পারিনি। হয়তো বা মাথায় সারাক্ষণ মুজাহিদ বা মুজাহিদের কথা ঘুরপাক খাওয়ায় অন্য কোনো চিন্তা মাথায় আসছিল না। যাইহোক যে প্রশ্ন আমাকে ভাবিয়ে তোলে,এরা যদি মুজাহিদই হবে তাহলে এতদিন যাদেরকে দেখে আসছি তাদের সঙ্গে এদের মিল নেই কেন? কেনই বা এমন মাঝরাতে আমার সন্ধানে এখানে এলো? আপন মনে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে একটা বিষয় খেয়াল করি সাজপোশাকেও মুজাহিদদের সঙ্গে এদের যথেষ্ট অমিল আছে। আরেকটি বিষয় নজরে আসে,আমার প্রতি ওদের অতিসক্রিয়তা মুজাহিদদের আচরণের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। স্বভাবতই এসব থেকে অনুমান করি, এরা হয়তো মুজাহিদের বিরুদ্ধে পক্ষ হবে; যাদের কথা আমার স্বামী মুজাহিদের মুখে শুরু থেকেই শুনে আসছি।
লোকগুলো একটা অচেনা ভাষায় কথা বলছিলো। কি বলছিল তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কেবল মুখের শব্দটাই শুধু কানে আসছিলো। মুখের ভাষা না বুঝলেও মুজাহিদ শব্দটা ওদের কথাবার্তায় বেশ কয়েকবার কানে আসে। এক পর্যায়ে শব্দটি মনে গেঁথে যায়। অনুমান করি,এরা হয়তো শব্দটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে। কিন্তু তারই বা কি প্রমাণ আছে তাদের কাছে? তবে কারণ থাকুক বা নাই থাকুক ওটাই যে আসল কারণ সেটা অবশ্য বুঝে যাই।আর এই কারণে নিজে নিজেই উত্তর খুঁজে নেই।হ্যাঁ লোকগুলো ছিল বিদেশী সোভিয়েত সৈন্য। সঙ্গে কয়েকজন আফগান সেনা পুলিশও ছিল।পরের দিকে বুঝেছি আফগান সৈন্যরা বিদেশি সৈন্যদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলত। আগেই বলেছি, এদেশে আসার সময় এই বিদেশি সৈন্যদের অত্যাচারের কথা আমার স্বামী মুজাহিদের কাছে শুনেছিলাম। এক্ষণে সেই বিদেশি সৈন্যের কবলে আমি। জানিনা এরপরে আমার কপালে আরও কি অপেক্ষা করছে। ওদের প্রস্তুতি ও তৎপরতা দেখে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে আমার ধরতেই এতো আঁটঘাট বেঁধে এতো রাতে এখানে এসেছে। কিন্তু কাউকে ধরতে আসার জন্য তো নির্দিষ্ট কারণ থাকতে হবে।তাও আবার এতোটা গভীর রাতে! এক্ষেত্রে আমার অপরাধই বা কি? তার কিছুই মাথায় আসছিল না। যাইহোক ওদের ব্যস্ততা দেখে নিশ্চিত হই সামনে আরেক অনিশ্চিত ভবিষ্যত আমার জন্য অপেক্ষা করছে। জানিনা আরও কত দুর্ভোগ কপালে আছে...
মুজাহিদদের সাজ-পোশাকের সঙ্গে অনেকদিন ধরেই পরিচিত ছিলাম। আলখাল্লা বা লম্বা জুব্বা পরা দাঁড়িওয়ালা মুজাহিদদের সবাইকে আমার একজন ব্যক্তি বলেই মনে হতো। এবার দেখলাম প্যান্ট শার্ট পরা দাঁড়িহীন আরও ফর্সা সোভিয়েত সৈন্যদের। মূলত ওদের অত্যাচারের বিরুদ্ধেই ছিল মুজাহিদদের লড়াই। এতদিন ওদের সম্পর্কে এমন সব কথা শুনে আসছি। কিন্তু নাহা! বাস্তবের সঙ্গে প্রচলিত কথাবার্তার ফারাক হয় কখনো বা। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো সেটাই হয়েছিল।যদিও শুরুতে সোভিয়েত সৈন্যের খপ্পরে পড়লে তাই নিজেকে সান্ত্বনা দেই কিইবা নির্যাতনের বাকি আছে আর এই জীবনে। নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করি আসন্ন নির্যাতনে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে শেষ করার আরেকটি সুযোগ এসেছে। এই অভিশপ্ত জীবনকে এখানেই শেষ করতে হবে। যে করেই হোক তাকে কাজে লাগাতেই হবে।
মুজাহিদদের মতো আফগান সেনা-পুলিশ সম্পর্কেও আমার কোন ধারণা ছিল না। উভয়কেই সমান বলে মনে হতো; পুরুষ মাত্রই মেয়েলোকের শরীর চাই।আর আমার মতো কুড়িয়ে পাওয়া ঠিকানা হীন রাস্তার মেয়ে হলে তো কোন কথাই নেই।সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। হিজাব পড়লে দেখতে অসুবিধা হওয়ায় বারে বারে সরিয়ে দিতো। কয়েকজনের আবার চাওনি ছিল বিষাক্ত রাক্ষুসে চোখ যেন পারলে গিলে ফেলে এক্ষুনি। হিজাব সরানোর অছিলায় কেউবা নানাভাবে গায়ে হাত দিত। বুঝতে যে পারি না তা নয়। আসলে এই পোড়া শরীরটার দিকে নজর সবারই। লক্ষ্য একই। তাই মনের দিক থেকে ঠিক করেছিলাম, এবার আর একে রাখবোই না।যে করেই হোক এই পোড়া শরীরটাকে শেষ করতেই হবে। কিন্তু নাহা! আমাকে আর মরতে হয়নি। তিতার গভীরে যে মিষ্টি থাকে অন্তত আমার ক্ষেত্রে এই পর্বে সে কথা বলাই যায়। আসছি সে মিষ্টতার প্রসঙ্গে পরে।
জীবনের লড়াই বোধহয় এমনই হয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কখনো বা জীবনের পক্ষে অনুকূল হয়ে ওঠে।আর তখনই জীবন হয়ে ওঠে আমাদের কাছে মধুময়।স্বপ্নের ফানুস উড়িয়ে আমরা এক মহাবিশ্বের ছবি আঁকি। কিন্তু উল্টো দিকে কখনো বা এই জীবনই আমাদের সামনে মহাসমুদ্রের অতলান্ত জলরাশির ন্যায় সাক্ষাৎ মৃত্যু গহবর হিসেবেও দেখা দেয়। তুচ্ছ ভাসমান কোন কীটের পক্ষে তীরে পৌঁছানো যেখানে নিতান্তই দুঃস্বপ্নের ব্যাপার।এহেন অতলান্ত সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে কখনোবা আমরা কেউ কেউ নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলি দুঃস্বপ্নের চোরাবালিতে। চোখের সামনে ভেসে ওঠা স্বপ্নরা একটু একটু করে হাতছানি দিতে থাকে। ক্রমশ যা আমাদেরকে এগিয়ে দেয় মৃত্যু পুরীর দিকে। স্বভাবতই একপর্যায়ে আশার সঞ্চারকে হারিয়ে আমরা হয়ে পড়ি সেই মুহূর্তে পৃথিবীর নিঃসঙ্গ এক মৃত্যুপথযাত্রীতে। এভাবেই এই নিঃসঙ্গতা আমাদেরকে তিলে তিলে শেষ করে।অস্তমিত হয় আমাদের সাধের বেঁচে থাকার স্বপ্নের বুনিয়াদ। আমরা প্রমাদ গুনী জীবনের শেষ মুহূর্তের.....।আর তখনই অপ্রত্যাশিত ভাবে যদি ভেসে আসে একঝলক আশার আলোক একখণ্ড বরফের টুকরো কিম্বা সামান্য একটুকরো পোড়া কাঠ। মুহূর্তে মনে জেগে ওঠে বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি। ব্যপ্তিতে তখন সেই বরফখণ্ড নেহাতই এক টুকরো থাকে না।হয়ে ওঠে মনের আকাশের দিগন্তবিস্তৃত জ্যোতিষ প্রভার ন্যায়।কাবুলিওয়ালার দেশে রমিসা বুবুর জীবনে সেটাই ঘটেছিলো।মৃত্যুর সঙ্গে সহবাস করতে করতে মানুষটা যেন মরেই গিয়েছিল। জীবনের লাথ খেতে খেতে তাই ভুলে গিয়েছিল যে সেও একজন মানুষ;তারও বাঁচার অধিকার আছে। হাত বদল হয়ে বিদেশি সোভিয়েত সৈন্যের খপ্পরে পড়লে আর পাঁচজন বিপদগ্রস্তের ন্যায় সেও নিজেকে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন বুঝতে পারে মনুষ্যত্ব এখনও মরেনি। সব স্বপ্নরা শেষ হয়ে যায়নি। ফিকে হলেও এখনও তারা মনের মনিকোঠায় এখনো বেঁচে আছে-খ্য যদিও এই বোধ গড়ে তুলতে ততদিনে অনেকটাই সময় চলে যায়। মরু-পাহাড়ের দেশে অচেনা অজানা বিজাতীয় মানুষের মুখের ভাষা না বুঝলেও তাই রমিসা বুবু বিদেশি সৈন্যের মনের ভাষা যখন কিছুটা বুঝতে পারে, বুঝতে পারে যে তারা আর যাই হোক তার শরীরকে নিয়ে যথেচ্ছাচার করবে না তখন সে আবার নিজেকে মানুষ বলে ভাবতে শুরু করে। স্বপ্ন দেখে নতুন করে বেঁচে থাকার..
কিছুক্ষণ থেমে রমিসা বুবু আবার বলতে লাগলো,
-বেশ কয়েক সপ্তাহ আমাকে সেনার কবলে থাকতে হয়েছিল। অনেক ঘোরাঘুরি জিজ্ঞাসাবাদের পর অবশেষে মুক্তি মেলে। তবে এই মুক্তি সহজে মেলেনি। এই মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে আমার জীবনের উপর যেন সুপার সাইক্লোন প্রবাহিত হয়েছিল। আসছি সে প্রসঙ্গে পরে। তবে ঘটনা যাই ঘটুক সোভিয়েত সৈন্যরা যে আচার আচরণে আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছিল তা উল্লেখ না করলেই নয়। প্রায়ই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওরা নিয়ে যেত। প্রায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় থাকতে হতো। কাজেই ঘনঘন ঠিকানা পরিবর্তন এসময় দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিয়ম করে ঘন্টার পর ঘন্টা আমাকে বাইরে কাটাতে হতো। বিভিন্ন অফিসে বিভিন্ন অফিসারের সামনে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বসিয়ে দেওয়া হতো। ঠিকানা পরিবর্তনের মতোই জিজ্ঞাসাবাদের সময়েরও কোনো বাপ-মা ছিল না। যখন-তখন হুট হাট করে আমাকে ওরা তুলে নিয়ে যেত। ওদের কোনো কথা আমি বুঝতে পারতাম না। একইভাবে একইভাবে আমার কোনো কথা ওরাও বুঝতে পারতো বলে মনে হতো না। আর এই ভাষা বুঝতে না পারাটাই ছিলে আমার ভোগান্তির অন্যতম কারণ।বলা যেতে পারে এই ভাষা বুঝতে না পারাটাই এক্ষেত্রে আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওদের মুখের আকার-ইঙ্গিতে বুঝেছিলাম আমাকে ধরে ওরা যতটা উৎফুল্ল হয়েছিল বাস্তবে আমার মুখ থেকে আশার কোনো কথা বের না করতে পেরে ওরা ততটাই হতাশ হয়। বেশকিছুদিন সঙ্গে থাকে ওদের মুখ ভঙ্গি চালচলনের সঙ্গে পরিচিতি হই। আকার ইঙ্গিতে বুঝতে পারি প্রকাশ্যেই তারা নিজেদের হতাশা প্রকাশ করেছিল। তাই বলে সহজে ওরা হাল ছেড়ে দিতে তখনও রাজী ছিল না।ভিন্নভাবে ওরা আমাকে চাপ দিতে থাকে। অচেনা কত লোকের সামনে আমাকে মুখোমুখি বসায়। উদ্দেশ্য যেনতেনভাবে কোন আশার বাণী উদ্ধার করা। কিন্তু কোনভাবেই ওদের সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। ওদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে যে ভাষা বুঝতে না পারাকে প্রথমে নিজের ভোগান্তির কারণ বলে মনে করেছিলাম পরে সেটাই আমার আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে ওঠে।
তবুও ওদের চেষ্টা থেমে থাকে নি। আমাকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন জায়গায় হাজির করিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে বড় বড় অফিসারদের সামনে বসিয়েছে। ওদের উদ্দেশ্য আমার কাছ থেকে নতুন কোনো তথ্য বার করা। কিন্তু কদিন যেতেই ওদের সে উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়ায় ধরে নেই পরেও ওদের তেমন কোনো লাভ হবে না।মধ্যি পড়ে ওদের সঙ্গে এ অফিস ও অফিসে ঘুরতে আমার বেশ লাগছিল। মুখের কথা না বুঝলেও আচরণে অনুমান করতে পারি,আমাকে ওরা স্পেশাল খাতির করত। এমনি একদিন জালালাবাদের এক অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হতেই চমকে উঠি। আসলে লক আপের ভিতরের ব্যক্তিটি যে অন্য কেউ নন, আমারই পরিচিত রফিক ভাই। অস্বীকার করব না আচমকা রফিক ভাইকে দেখে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কিন্তু সেনা পুলিশের সামনে তাকে ধরা দেব কিনা কিম্বা ধরা আমাকে পড়তে হবে কিনা এসব ভেবে গভীর দুচিন্তায় পড়ি...
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুন, ২০২২ রাত ১০:৩০