সহযাত্রী বৌদিমনির রহস্যময়ী চাহনি আমাদেরকে খুব বেশিক্ষণ নিবৃত করতে পারেনি। বলা ভালো আমরা নিজেদেরকে খুব বেশি সময় যংযত রাখতে পারিনি। বেশ কয়েকবার বৌদিমনির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বুঝতে পারি ভদ্রমহিলাকে অতোটা পাত্তা দেওয়ার কারণ নেই। উনি দেখে কি মনে করবেন বলে খামোকা আমরা আমাদের মধুর যাত্রাকে শবযাত্রায় পরিণত করতে পারি না। মনের পৌরুষদীপ্ত মূহুর্তে সিংহের মতো জেগে ওঠে। প্রলুব্ধ করে বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে অচেনা অজানা দূর দেশে একটু না হয় ঘনিষ্ঠ হলেই বা।আর এমন নৈস্বর্গিক প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্যকে মনেপ্রাণে উপভোগ্য করে তুলতে হলে দুটি হৃদয়ের সঙ্গে একে অপরের হাতে হাত, আরো কাছাকাছি, একটু ঘনিষ্ঠতা আর এসবের মধ্যেই যে টয়ট্রেন যাত্রা উপভোগ্যের মাত্রা কানায় কানায় পূর্ণ হবে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার পৌরুষদীপ্ত সিংহ বিড়ালছানার মতো খেই হারিয়ে ভাবলেশহীন পড়ে। আশপাশে তাকিয়ে দেখি অন্য কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন কিনা..। কিন্তু নাহা আমাদেরকে ফলো করার মতো তেমন কাউকে দেখতে পেলাম না। সহযাত্রীরা সকলেই ভীষণ ভদ্র। সবাই বুঁদ হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু তার মধ্যেও নচ্ছার বৌদির দুষ্টভরা চাহনি আমাদেরকে রীতিমতো অস্বস্তির মধ্যে রাখে। সঙ্গে আছে এক রহস্যময়ী মুচকি হাসি।দেখে তো মনে হচ্ছে ইনি যেন আরেক কোনো মোনালিসা টিসা হবেন।যিনি তার রহস্যময়ী হাসিটা অকাতরে বিলিয়ে চলেছেন। কিন্তু আমার লক্ষ্য যে অন্য জায়গায়। সেকারণে বৌদিমনির লাস্যময়ী সুন্দর হাসিটাও এই সময় বিটকেল বলে মনে হয়। মনে হয় ওনার হাসিটা যেন আমাদেরকে বিদ্রুপ করছে; আমাদের সম্পর্ককে নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আর তাই ভেঙে যায় এতক্ষণ ধরে বয়ে বেড়ানো মনের ধৈর্য্যের বাঁধ। কাঁচের টুকরোর মতো ভেঙে খানখান হয়ে যায়। মনের বাঁধন হাট হয়ে যায় খুলে।ফলে মনের যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্বকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে, বেপরোয়া হয়ে এক হিচকাটানে শ্বেতাকে বাহুর মধ্যে আগলে ধরি।শ্বেতা কয়েক মূহুর্তের জন্য একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বুঝতে পারে নি আমার এমন অস্বাভাবিক আচরণের কারণ কি। কিন্তু পর মূহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকে। আমিও গায়ের শক্তিভর ওকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি।দেখে মনে হবে আমরা যেন কিছু একটা নিয়ে কাড়াকড়ি করছি। আমাদের কান্ডকারখানা দেখে পাশে বসা অন্য দুই যাত্রী হাসি হাসি মুখে তাকাতে থাকেন। আমরাও ওনাদের সঙ্গে হাসি বিনিময় করি। কিন্তু আবাক হই বৌদিমনিকে দেখে। ওনার মুখ থেকে এতোক্ষণ ধরে পরিচিত সেই মিষ্টি হাসি উধাও। শুধু তাই নয়, উনি মুখটা কিছুটা প্যাঁচার মতো গম্ভীর করে বাইরে তাকিয়ে থাকেন।
এতোক্ষণ ধরে বৌদিমনির দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম আমরা। হঠাৎ ওনার লক্ষ্য বাইরের পৃথিবীতে দেখে শ্বেতা আবাক হয়ে পড়ে।বলেও ফেলে সে কথা,
-আরে! এই মহিলাটা সেই প্রথম থেকেই হ্যাংলার মত আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন। একবার দুবার হলে তা না হয় এক কথা ছিলো। যতবার চোখ গেছে দেখেছি ততবারই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তো ভাবছিলাম কি জানি পাশে বসা বরকে নিয়ে তাহলে উনি খুশি নন?আর খুশি না হলে ঘুরতেই বা আসলেন কেন? উদ্দেশ্য কি তাহলে ছেলে চড়ানো?আর তাই বারেবারে আমার বরের দিকে লক্ষ্য দেওয়া। অবশ্য আমার উনিও তো কম যান না দেখছি। আমার পাশে বসেও চোখের খেলা খেলছে শাসালো বৌদির সঙ্গে। এখন দেখছি আমার অনুমান সঠিক।বুঝলে হে মশাই, উনি তোমার প্রেমে পড়েছেন।
শ্বেতা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল ঠিকই। কিন্তু শুনে তো আমি থ। বিশেষ করে শেষ কথাগুলো আমাকে পেরেক ফোটানোর মতো যন্ত্রণা দগ্ধ করে তোলে।
আমি আপত্তি সহকারে জানাই,
- আরে কি সব পাগলের মতো উল্টোপাল্টা বলছো? তুমি কি ভেবে বলছো যে আমি ওনার সঙ্গে চোখের খেলা খেলছি?
আমার কথা শেষ না হতেই শ্বেতা আবার বলল,
-আজ্ঞে স্যার ভেবেই বলছি।আর তা যদি না হবে তাহলে তুমি আমাকে জড়িয়ে বসেছো দেখে উনি রাগ করে বাইরে তাকিয়ে আছেন কেন?কৈ এতোক্ষণ তো দিব্বি তোমার সঙ্গে ওনার চোখাচোখির পর্ব চলছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরেছো দেখেই কি উনি হতাশায় কষ্টে বাইরে তাকিয়ে আছেন?
শ্বেতার প্রশ্ন করার ধরন দেখে আর উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করলাম না। আমি ভদ্রমহিলার দিকে দেখছিলাম ঠিকই কিন্তু সে দেখার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। কিন্তু কি করে বোঝাই ওকে সে কথা। একেই বলে মেয়েদের মন বোঝা বড় দায়। দুদিন আগে ব্লগার তপন ভাই নারীর মন বোঝা বড় দায় শিরোনামে ব্লগে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন। পোস্টটিতে ব্লগে কতোজন ব্লগারের অন্তরের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল জানিনা। কিন্তু এ যে আমার অন্তরের ছবি উনি তুলে ধরেছেন তা হলফ করেই বলতে পারি। তবে ঘটনাটা অনেক বছর আগেকার কিন্তু লেখাটা পেলাম সদ্য এই যা...। যাই হোক যে কথা বলছিলাম, আমি তো পাশে বসা প্রিয়তমা স্ত্রীকে কি করে একটু কাছে পাবো, তীর্থের কাকের মতো তার সুযোগের অপেক্ষায় বারে বারে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছিলাম। আর তাতেই কিনা দূরে বসা পাজি হতচ্ছাড়া মহিলার জন্য স্ত্রীর কাছে আমি অবিশ্বাসী হয়ে গেলাম? কি আর করার...। বুঝলাম কথা বাড়ালে ভয়ংকর প্রলয় আসতে পারে।রেগে গেলে শ্বেতার এমন চন্ডাল মূর্তির ছবি আগেই পেয়েছি। সেবার না হয় বাড়িতে দেখেছিলাম। কিন্তু এখন এই বিদেশবিভুঁইয়ে লোকজনের সামনে যদি অমন চন্ডাল মূর্তি ধারণ করে তাহলে সর্বনাশ। অগত্যা গুডবয়ের মতো নিজের দুহাতকে একে অপরের আঙ্গুলের মধ্যে আবদ্ধ রেখে প্রকৃতি অন্বেষণের ভান করে বাইরে তাকিয়ে থাকি।
একটু আগে শবযাত্রার কথা বলছিলাম। বাস্তবে এই মুহূর্তে আমি যেন তেমনি এক শবযাত্রীতে পরিণত হলাম।কতো স্বপ্ন সাধ আহ্লাদ নিয়ে হানিমুনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। শুরু থেকে উথাল পাতালের মধ্যে দিয়ে চললেও যাত্রা শুরু হতেই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই ছন্দবদ্ধতার অবসান ঘটলো। অবিশ্বাসীর তকমা নিয়ে ভাবনার রাজ্যে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। মনে হলো নিঃসঙ্গতার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। তাই বাইরে তাকিয়ে থাকলেও সে দৃষ্টি ছিল হাজার হাজার মাইল দূরের কোনো এক হতাশার অন্ধকারের ফেনিল সাগরের বুদবুদের ন্যায়। উল্লেখ্য আমার হঠাৎ এমন গুম হয়ে যাওয়ায় শ্বেতা নারীর স্বভাবজাত চপলতায় ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
- কি ব্যাপার হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে মশাই?
আমি একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলি,
- এই একটু প্রকৃতি দেখছি কিনা...
- আমার কথায় কি তুমি রাগ করেছো?
আমি দেখলাম দারুণ একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। ওকে দুকথা শোনাতেই হবে। কিন্তু পরক্ষণেই চেপে যাই। ভাবলাম আমিও যদি ওর সুরে কথা বলি তাহলে হানিমুন পর্বটাই না শেষ পর্যন্ত মাটি হয়ে যায়। কাজেই নিজেকে সামলে নিয়ে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করাই বরং বুদ্ধিমানের কাজ হবে বিবেচনা করে বলি,
-আমাকে তুমি ভুল বুঝেছো শ্বেতা। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা।সেটা তোমার নিজস্ব ব্যাপার। তবে আমার হৃদয়ের আনাচে কানাচে শুধুই শ্বেতা শ্বেতা আর শ্বেতা। সেখানে অন্য কোনো নারীর প্রবেশাধিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
আমার কথায় শ্বেতা আমোদিত হয়। চোখে মুখে ফুটে ওঠে তার অভিব্যক্তি। আহ্লাদিত হয়ে বলে,
- থাক থাক আর প্রেমের ফানুস উড়াতে হবেনা,বলেই ধরা দেয় আমার বাহুর মধ্যে।
এ যেন মেঘ না চাইতেই জল।
হঠাৎ দেখি আমার বুকের কাছে কান পেতে কিছু একটা শোনার ভান করছে।প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি।
জিজ্ঞেস করি,
- কি হয়েছে?
- শোনার চেষ্টা করছি তোমার হৃদয়ে নাকি আমার নাম লেখা আছে তার নিক্কন ধ্বনির।
এবার আমি আমোদিত হয়ে বলি,
- কি পেলে তো মম হৃদয়ে তোমার পদদয়ের নিক্কনের ঝংকার?
এক টয় ট্রেন যাত্রায় বুঝতে পারি কতো সহজেই আমাদের অবস্থার বদল ঘটে। কখনোবা সুখ সমৃদ্ধির ফানুস উড়িয়ে আমরা ধুমকেতুর মতো হঠাৎ হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে সাফল্যের সারণী বেয়ে উপরে উঠি আবার কখনোবা ব্যর্থতার অতল সাগরে ডুবতে ডুবতে মহাকালের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাই।
আমার বাহুতে ধরা দিয়ে একবার আমার মুখের দিকে আরেকবার ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে থাকে। আমি শ্বেতার কানে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলি,
-ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে তাকালেই আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসবো।
শ্বেতা আমার প্রস্তাবে অবাক হয়ে,
- তোমার মাথা ঠিক আছে তো?
- জ্বি ম্যাডাম ১০০% ঠিক আছে।
শ্বেতা কিছুটা খুশি হয় বটে তবে আমার বাহুর মধ্যে আবদ্ধ থেকেও আমার নাকটি আলতো করে চেপে ধরে বলে,
- না মশাই আমি এমন লোক দেখানো কাজ করতে পারবো না।
বলতে বলতেই উপস্থিত যাত্রীদের একটু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করি। আমরা ভদ্রভাবে বসে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করতে থাকি। বুঝতে পারি ট্রেনটি কালকা শিমলা রুটের বিখ্যাত বোরগ স্টেশনে ঢুকতে চলেছে।
বাইরে তাকিয়ে একের পর এক স্টেশনে আসা যাওয়া দেখতে দেখতেই চলে আসে বিখ্যাত একটি স্টেশন বোরোগ।বোরোগ সম্পর্কে আগে থেকেই কিছুটা খোঁজখবর নিয়ে রেখেছিলাম।ফলে মনে অনেক প্রশ্ন আগে থেকেই তৈরি ছিল। এখন সেগুলোর উত্তর মেলানোর পালা। তবে ট্রেনটি স্টেশনে ঢুকতেই আমাদের সকলকে স্টেশন নেমে ঘুরে দেখার জন্য টুর অপারেটর শতদলদা নির্দেশ দিলেন।আরও জানালেন, এখানে যাত্রীদের টিফিন করার সুযোগ দিতে ট্রেনটি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে। আমরা দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে টিফিন না করে বরং স্টেশনের বিভিন্ন স্থানকে নিদর্শন করে ফটোশুট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
চলবে...