এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত শুরু থেকেই অসাধারণ নৈপুণ্যতা দেখিয়ে ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু কথায় বলে সব ভালো যার শেষ ভালো; ভারতের ক্ষেত্রে বহু প্রচলিত এই প্রবাদ কাজ করেনি। ফাইনালে সব বিভাগেই অস্ট্রেলিয়া নৈপুণ্যতা দেখিয়ে শিরোপা অর্জন করেছেন।ফলে কোটি কোটি ভারতবাসী ও ভারত প্রেমীদের অন্তরে প্রতিধ্বনিত হয় কাপ না প্রাপ্তির নিদারুণ হাহাকার।
খেলা মানে হার জিত থাকবেই। জিতলে মধুর লাগে হারলে পরাজয়ের গ্লানি অন্তরে কুঠারঘাত করতে থাকে। কিন্তু কোনো বিষাদ চিরস্থায়ী নয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পর আবার আমরা স্বাভাবিক হয়ে উঠি। কাজেই আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা আবার বৈষয়িক বিষয়ে মেতে উঠবো।শুরু হবে ব্যস্ততাময় কর্মজীবন। কিন্তু গতদুদিনে ভারতের পরাজয়ের পর বাংলাদেশের বাঙালিদের একশ্রেণীর সমর্থক যেভাবে ভার্চুয়াল জগতে উল্লাসে ফেটে পড়ে ঈদ উৎসবে মেতে উঠেছেন সেটা দেখে একজন ক্রিকেটীয় ভক্ত, সচেতন নাগরিক হিসেবে যারপরনাই ব্যথিত ও আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। হতে পারে সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার কিন্তু আমরা অস্বীকার করতে পারিনা বাংলাদেশের সঙ্গে এপার বাংলার মানুষের একটা আত্মীক টান বিদ্যমান।ভূয়া ভাই সুদূর লন্ডনে থাকলেও ওনার সঙ্গে আমার অন্তরের টান অস্বীকার করি কেমনে? কিংবা শায়মাপুর সঙ্গে সোহানী আপুর সুন্দর সুন্দর রেসিপি দেখে একবার সামনাসামনি পরোখ করার লোভ অস্বীকার করি কেমনে? আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে দু চারটি কথা...
ফিরে যাই আবার খেলার জগতে।গত পরশু সব বিভাগেই অস্ট্রেলিয়া অসাধারণ নৈপুণ্যতা দেখিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা সকল অস্ট্রেলিয় প্রেমীদের। বাংলাদেশী অস্ট্রেলীয় প্রেমীদের সরাসরি শুভেচ্ছা জানানোর সুযোগ থাকায় তাদের জানাই স্পেশাল হার্দিক শুভেচ্ছা।
কিন্তু একটা বিষয়ে অবাক হলাম ভার্চুয়াল জগতে বাংলাদেশের একশ্রেণীর বাঙালিদের প্রবল ভারত বিদ্বেষমূলক মনোভাব ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমার কাছে সাপোর্ট যে কেউ তার পছন্দের দেশকে করতেই পারেন। আশা করি এটা নিয়ে কেউ দ্বিমত হবেন না। কাজেই সাপোর্টার হওয়া সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এখন কথা হলো, বাংলাদেশী বাঙালিদের সাপোর্ট নিলে যে ভারত চ্যাম্পিয়ন হতো আর না পেলে যে হতো না এমনটা নয়।আর এমনটি যদি হতো তাহলে মাঠের লক্ষাধিক দর্শকের সমর্থন নিয়েই ভারত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতো। কিন্তু বাস্তবে এই 'সমর্থন' তেমন কোনো কাজে আসে না।খেলার মাঠের মধ্যে বিশেষ করে বাইশ গজে একদল অপরকে টেক্কা দেবে খেলার বিভিন্ন দিকে- বলে, ব্যাটে ফিল্ডিংয়ে, মানসিক অদম্যমতায়, শারীরিক ভাষাতে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়ে।। এসবের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যারা এগিয়ে যাবে তারাই সাফল্য পাবে। কোনো দয়া দাক্ষিণ্যের স্থান এখানে নেই। অস্ট্রেলিয়া গতকাল দূরন্ত খেলে সব বিভাগেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমান দিয়েছেন।যোগ্য দল হিসেবে তারা শিরোপা অর্জন করেছেন।
কিন্তু দূর্ভাগ্যের যে গত পরশু থেকে ভার্চুয়াল জগতে একের পর এক প্রবল ভারত বিদ্বেষমূলক পোস্ট ও কমেন্টগুলোকে একেবারেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ভয়ংকর একটা 'আমরা ওরা' বিভাজন তৈরি হয়েছে।দুটি প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের মধ্যে তাহলে কি ভয়ানক বিষ বৃক্ষ প্রবল আকার ধারণ করেছে?অর্থাৎ খেলাটা কি আর খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই?
যদি একটু সাইডে তাকাই তাহলে চোখে পড়বে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর।দুটি দেশ নানা বিষয়ে একে অন্যের উপর নির্ভরশীল।হতে পারে সব চাওয়া পাওয়া পূর্ণ হচ্ছে না। যেমনটা হয় না আমাদের নিজস্ব ব্যক্তি জীবনের সমস্ত স্বপ্ন পূরণ। কিন্তু যা হচ্ছে সেটাও কম নয়। ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই, কলকাতা সহ ভারতে বাংলাদেশী নাগরিকরা চিকিৎসা পরিসেবা নিতে বছরভর আসেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এখানে উভয় পক্ষই উপকৃত হন না। যদিও সেখানে নানান প্রতিবন্ধকতা আছে। ব্লগিং করার সৌজন্যে ব্লগার মা. হাসান ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছি দুরারোগ্য ব্যাধির মতো ক্রনিক ডিজিজের ক্ষেত্রে এদেশের চিকিৎসা ওনাদের কাছে বেশ সাশ্রয়ী বটে। ভারতে সরকারী হাসপাতালেও ভারতীয়দের সঙ্গে একাসনে চিকিৎসা সুবিধা যে কোনো বিদেশি সহ বাংলাদেশীদের দেওয়া হয়। কিন্তু কম সময়ে আসায় তারা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা সেবা নিতেই পছন্দ করেন। জনপ্রিয় ব্লগার কবি প্রমানিক ভাই নিজে বা ছবি আপু দুলাভাইকে ভারতে চিকিৎসা করিয়ে উপরওয়ালার ইচ্ছায় সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন। এরকম হাজার হাজার বাঙালি ভারত থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়ে উপকৃত হচ্ছেন ।হ্যাঁ রাষ্ট্রনৈতিক বা কূটনৈতিক সম্পর্ককে বাংলাদেশের সরকারের অহেতুক ভারত নির্ভরতার জন্য জনমানসে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বা হবাটা স্বাভাবিক হতে পারে। এখানে মোদিজী যেমন আমার অপছন্দের। কিন্তু সেই অপছন্দের বিরোধিতা করার উপায়টা গনতান্ত্রিক পথেই হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। অশালীন ব্যক্তি আক্রমণের মধ্যে নয়। বাংলাদেশী বাঙালিদের তেমন সরকারের উপর ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু সেই দায় সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকারের উপর দেওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল। অনুকরণ হিসেবে তারা মালদ্বীপের পথে হেঁটে মসনদে এমন কোনো সরকারকে বসাতেই পারেন যারা ভারতের মুখাপেক্ষী হবেন না।
ব্যক্তিগত ভাবে এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের খারাপ পারফরম্যান্স আমাকে কষ্ট দিয়েছে।এর আগের বিশ্বকাপে তারা যথেষ্ট ভালো পারফরমেন্স করলেও এবার আশানুরূপ ফল করতে পারে নি।ফলে আমার মতো সেদেশের হাজার হাজার ভক্তের বাংলাদেশী ক্রিকেট দলের উপর ক্ষোভ হওয়াটা স্বাভাবিক।উল্টে কয়েকদিন আগে অধিনায়ক সাকিবকে শাসক দলের সাংসদ প্রার্থীর টিকিট কাটতে দেখে অবাক হয়েছি। রাজনীতি রাজনীতিকদের সাজে ঠিক যেমন খেলোয়াড়দের জায়গা খেলার মাঠ। সাকিব একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে রাজনীতি করার নিজস্ব অধিকার ওনার আছে ঠিকই। কিন্তু যে কাজ যার মানায়। আজকে যদি দেখি বিরাট কোহলি বা তেন্ডুলকর ক্রিকেট কোচিং বাদ দিয়ে ভাজপার প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়ান বা রাজনীতির ময়দানে অংশ নেন তাহলে ব্যক্তি হিসেবে উনি নিজের অধিকার ভোগ করলেও ক্রিকেটের পক্ষে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বিষয়টি সুখকর হবে না। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান যদি ট্রাক পরিবর্তন করেন তাতে ক্রিকেটের উন্নতির সম্ভাবনা বিনষ্ট হতে বাধ্য।
যাইহোক সবশেষে আবার বলবো, খেলা থাকুক খেলাতেই।দুই দেশের মধ্যে একটু একাত্মতা অনুভব করি; পরিহার করি হিংসা বিদ্বেষের। দুই বাংলার বাঙালিদের মধ্যে বন্ধন অটুট থাকুক। পাশাপাশি আরেকটু চেষ্টা করি ভার্চুয়াল জগতে একে অপরের প্রতি আরেকটু সৌজন্যশীল হয়ে উঠার।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৩২