আমরা প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ লাইফ পর্যন্ত টানা ১২ বছর ইংরেজী পড়ি। এর মাঝে আবার নবম থেকে একাদশ শ্রেণীতে ইংরেজী প্রথম পত্র আর ২য় পত্র ভাগ করা ছিল। প্রচুর ইংরেজী পড়তে হত, কিন্তু ১২ বছর ইংরেজী পড়ার পরও ১২ লাইন ইংরেজী লিখতে আমাদের ২৪টা ভুল হয়, গ্রামার ভুল হয়। এর কারণ গোড়াতেই রয়েছে। আমি আমার স্কুল লাইফ দিয়েই ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করেছি।
আমি পড়েছিলাম একদম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যেখানে সরকারী যে বই গুলো দেওয়া হয়, তার বাইরে কিছু পড়ানো হয় না। একদম ছোট বেলায় কি পড়েছিলাম মনে নাই, তবে পঞ্চম শ্রেণীতে পরীক্ষায় আসতো, গরু নিয়ে ১০টি বাক্য ইংরেজীতে লিখো, এই টাইপের রচনা। কিংবা আমি ভাত খাই, করিম স্কুলে যায়, রহিম ছোট ভাই, এই রকম কিছু ট্রান্সলেশন। তাও এইগুলো কখনো নিজের মাথা খাটিয়ে লিখতে পারতাম না। কারণ স্কুলে কখনো ঐভাবে পড়ানো হত না। স্কুলে শুধু মুখস্থ করানো হত। এইটা বলছি নব্বই এর দশকের শুরুর দিকের ঘটনা। তখন এস এস সি পাস করেই প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেত মানুষজন।
এরপর স্হান হল গৎবাঁধা একটা বেসরকারী হাইস্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ইংরেজীতে পেলাম এক বদমেজাজী শিক্ষককে, উনার ছিল বাংলায় ডিগ্রী আর ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াতেন ইংরেজী। সপ্তাহে ৩ দিন কি ৪ দিন ইংরেজী ক্লাস ছিল, তার মাঝে একদিন ছিল ডিকশোনারী ক্লাস। ছোট ছোট কিছু ডিকশোনারী পাওয়া যেত তখন। পকেট ডিকশোনারী। মাস্টার মশাই পড়া দিতেন "G" কিংবা "H" এই রকম ওয়ার্ড ধরে। আগামী ক্লাসে "G" এর প্রথম ৪ পাতা পড়ে আসবে। আর উনি ক্লাসে এসে লম্বা বেত নিয়ে একজন একজন করে শব্দের বাংলা অর্থ জিজ্ঞাসা করতেন। না পারলে দুই হাতে বেত্রঘাত। খুব বিভীষণ ছিল সেই ক্লাস। প্রায় প্রত্যেকদিনই বেত্রাঘাত পেতাম, শুধু একদিন পেরেছিলাম, nephew - ভাগ্নে, এটা বলতে পেরেছিলাম। তাই দুই যুগ পরেও এই শব্দটা মনে আছে এখনো।
সপ্তম শ্রেণীতে ইংরেজীতে ফেল করে বসলাম। প্রথম সাময়িকে ২৭ পেয়েছি, যেখানে ৩৩ পেলে পাস। বোর্ড থেকে টেস্ট কেস হিসাবে একটা নতুন বই দিয়েছে, আর আমরা ছিলাম ঐ বই এর গিনিপিগ এর সাথে আবার একজন নতুন স্যার ক্লাস নিচ্ছেন, যার ডিগ্রী হলো ইকোনোমিক্সের। স্যার আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন, উনার কাছে না পড়লে পাস করা যাবে না। পড়তে গেলাম, ২য় সাময়িকে পেলাম ৮৪। ব্যাপারটা আর কিছু না। মাষ্টারমশাই পরীক্ষার আগে সাজেশন দিতেন, আর ঐগুলোই পরীক্ষাতে আসতো। সপ্তম শ্রেণী শেষ, ঐ মাষ্টারের কাছে পড়াও শেষ।
অষ্টম শ্রেণীতে একজন বাংলার স্যার ইংরেজী ২য় পত্র পড়াতেন। ইংরেজী রচনা পড়া দিতেন। ক্লাসে এসে বলতেন, ঐ রচনাটার প্রথম দুই প্যারা দেখে দেখে লিখ। আমরা বসে বসে লিখতাম। মাষ্টারমশাই চেয়ারে বসে থাকতেন ঘন্টা পড়ার অপেক্ষায়। আমরা লিখা শেষ হলে মাষ্টার মশাইকে দেখাতাম, উনি লম্বা করে একটা রাইট সাইন দিতেন। বস্তুতপক্ষে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামার পড়া হয় নাই। তখন ইংরেজী মানে হলো, রচনা, দরখাস্ত, ট্রান্সলেশন এইসব।
নবম দশম শ্রেণীতে গিয়ে ২-১ জন ভালো শিক্ষককে পেয়েছিলাম, যারা ইংরেজীতে পড়ালেখা করেছিলেন, তারা গ্রামার পড়াতেন, ব্যাখ্যা করতেন ইংরেজীকে। কিন্তু গোড়াতে গলদ থাকায় বুঝে উঠতে কষ্ট হচ্ছিলো আমার।
বাংলা থেকে ইংরেজী ট্রান্সলেশন একটা বুঝার ব্যাপার, এটা স্কুল লাইফ কখনো বুঝতে পারি নাই, সবসময় মুখস্থই করে এসেছি।
তারপরও কিছু গ্রামার শিখা হয়েছে, পরীক্ষায় MCQ তে গ্রামার আসতো, তাই ২-১টা করে হলেও পড়েছি। কিন্তু আমাদের আগে যারা পরীক্ষা দিয়েছিল (এস এস সি ৯৪ কি ৯৬ পর্যন্ত মনে হয়) তাদের ছিল পোয়াবারো, বোর্ড থেকে ৫০০টা প্রশ্নের একটা প্রশ্ন ব্যাংক দিয়েছিলো, এই ৫০০টা থেকে ৫০টা প্রশ্ন আসতো।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি; যদি আমরা মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই, তবে ভালো বিষয় ভিত্তি শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বাংলায় কিংবা সমাজবিজ্ঞাসে পড়ালেখা করে কোন শিক্ষক স্কুলে ইংরেজী গ্রামার ভালো পড়াতে পারবেন না। ইংরেজীর জন্য ইংরেজীতে অন্তত ব্যাচেলর ডিগ্রীধারী শিক্ষক দরকার। স্কুলের কারিকুলাম তত উন্নত না। কমিউনিকেটিভ ইংরেজী নিয়ে আরো বেশি সচেতন হওয়া দরকার।
এটা হয়ত শহরের কিছু স্কুলে ফলো করছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত ৬০% ও অধিক স্কুলে এই রকম যোগ্য শিক্ষক নাই।
মেধাবীদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে, আর শিক্ষক পেশাটাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলকভাবে মেধাবী ছাত্রছাত্রী, তারা কেউ স্কুলের শিক্ষক হিসাবে যোগ দিতে চায় না, অন্তত তাদের প্রথম পছন্দের চাকুরী হিসাবে স্কুলের শিক্ষকতা লিস্টে রাখেন না। শিক্ষকতা পেশাটাকে আকর্ষণীয় করে না তুললে এর প্রতি ভালো ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী হয়ে উঠবে না। স্কুলের শিক্ষক শুনলে অনেক পিতা মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না, কত টাকা আর বেতন পায়, এই চিন্তা করে।
[২-১ জন ব্যাচ পড়িয়ে অনেক টাকা ইনকাম করে, কিন্তু এটা উদাহরণ না। এই পেশা আকর্ষণীয় হলে বিসিএস বা ব্যাংকের চাকুরী বাদ দিয়ে সবাই স্কুলের চাকুরীর জন্য হুমড়ী খেয়ে পড়ত। স্কুলের শিক্ষক শুনলে এখনো মানুষজন করুণার চোখে তাকায়। তারা পেট চালানোর জন্য প্রাইভেট পড়ায়। ]
এর ফলাফল, আমরা স্কুল কলেজে ১২ বছর টানা ইংরেজী পড়েও ইংরেজীতে ১২ মিনিট কথা বলতে পারি না।
" আমি এখনো ইংরেজীকে ভয় পাই"
আমি প্রায় ২০-২৫ বছর আগের আমার স্কুলের অভিজ্ঞতা লিখলাম, এখন যারা গত ৫-১০ বছরে পাস করেছেন, ইংরেজী শিক্ষা নিয়ে আপনাদের স্কুল লাইফের এক্সপেরিয়েন্স জানাবেন কি?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:২১