গত শুক্রবার বেশ ঝাঁকঝমকপুর্ণ বিবাহোত্তর সংবর্ধনা ও বৌভাত অনুষ্টানের মধ্য দিয়ে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ও তার নববধু হনুফা আক্তার রিক্তার সপ্তাহব্যাপী বিবাহ উৎসবের(!) পরিসমাপ্তি ঘটলো। এবার তাদের স্বাভাবিকভাবে সংসার নির্বাহ করার পালা। একটু পেছনে তাকালেই দেখা যায়, মুজিবুল হক সাহেবের বিবাহ উৎসবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা আয়োজনে সাধারণ জনগণ ও মিডিয়ার আগ্রহ এবং জল্পনা-কল্পনার কমতি ছিলোনা । ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সোশ্যাল সাইট বিশেষতঃ ফেসবুক, ব্লগ ও অনলাইন নিউজগুলোর বিস্তৃত হাত ধরে মন্ত্রী মহোদয়ের বিবাহের প্রায় অনেক খবর ও ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছে দেশের জনগণ। শুধু কৌতুহলের বিষয় নয়, বহুল আলোচনা-সমালোচনার খোরাকও হয়েছে মন্ত্রী মহোদয়ের এই বিখ্যাত বিবাহ উৎসব, যা বিভিন্নভাবে বিতর্ক ও কৌতুহলের তুঙ্গে আসার মুল কারণগুলো হলোঃ
১) দেশের সাধারন মানুষ মূলঃত মন্ত্রী-এম্পিদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, ভাই-বেরাদার কিম্বা আত্মীয়স্বজনের বিয়ে দেখলেও সরাসরি কোন মন্ত্রী বা এম্পির এই ধরনের উৎসবমুখর বিয়ে দেখার সুযোগ বলতে গেলে একটাও পায়নি। তাই হ্যালির ধূমকেতুর মতো আচমকা উড়ে আসা শতাব্দীর চমক মন্ত্রী মহোদয়ের এই বিবাহ উৎসব প্রখরভাবে আকৃষ্ট করেছে জনগণের নজর !
২) মন্ত্রী মহোদয়ের সদ্য বিদায় দেওয়া ' কুমারত্ব ' ও ' তার সাথে তার পত্নীর বয়স পার্থক্য ' ছিলো বিয়ের অন্যতম আকর্ষণ ! দুষ্ট লোকে বলে মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে তার স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য অনেকটা বাবা-মেয়ের বয়স পার্থক্যের কাছাকাছি ! তাছাড়া চিরকুমার থাকার পণ নিয়ে জীবনের একটা বিশাল অংশ কাটিয়ে দেওয়া মুজিবুল হক সাহেব যখন মানুষের কাছে আইকন বনে গিয়েছিলেন তখনই ভালোবাসার টোপটা ছুঁড়লেন হনুফা আক্তার ! প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সামাজিক প্রতিকূলতা ও বয়সের ব্যবধান পিছনে ফেলে বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেলেন প্রিয়তম মুজিবুল হকের সাথে । মন্ত্রী সাহেবের এই 'কুমার-নামা' ও স্ত্রীর সাথে বয়সের পার্থক্য সাধারণের মাঝে একইসাথে জম্ম দিয়েছে আগ্রহ , বিনোদন ও আলোচনা-সমালোচনার !!
(এখানে বলাবাহুল্য, 'হনুফা' মেয়েটির সাহস ও মনন অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। কারণ মুজিবুল হককে শেষ বয়সে সংসারের স্বাদ দিতে বিয়ের পিড়িতে বসেছে হনুফা। যে স্বাদ জাগতিক যেকোন বৃহত স্বার্থের কাছে নিতান্ত! জীবনের গোধুলীলগ্নে পতিত হওয়া মুজিবুল হকের সাথে কয়েক যুগের সংসার সে পাবেনা; হয়তো খুব সংক্ষিপ্ত কিছু সময় তারা একসাথে কাটাতে পারবে- তা জেনে ও বুঝে হনুফা আসন পেতেছে মুজিবুল হকের সংসারে। এতে করে অবশ্যই সে বিসর্জন দিয়েছে অনেকগুলো জমানো আশা ও যতনে লালিত কিছু স্বপ্ন । হনুফা তবে স্বার্থক, কারণ সে ভালোবাসা দিয়ে জীবিত করেছে মুজিবুল হকের মৃত কতক স্বপ্নকে )
৩) এটা পরিষ্কার যে, মুজিবল হক সাহেবের বিয়ে রেকর্ড করুক বা না করুক, অন্তত রাজকীয় পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে । হতে পারে সেটা তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ থেকে কিংবা বিলাসিতা ! মেহেদী অনুষ্ঠান থেকে বৌভাত সবকিছুতেই দেখা গেছে রাজকীয়তার ছাপ। মন্ত্রী মহোদয়ের গেট-আপ, ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন, বিয়ের সাজসজ্জা , এক্সক্লুসিভ লাইটিং , আমন্ত্রিত অথিতি, মিডিয়া টেলিকাস্ট , নামীদামী খাবার রেসিপি , সিকিউরিটি এরেঞ্জমেন্ট, সাজ-অলঙ্কার, ঢাকঢোল-বাদ্যবাজনাসহ প্রত্যন্ত বিষয় থেকে স্পষ্ট হয় তার বিবাহ উৎসবটা ছিলো বিলাসবহুল ও রাজকীয় প্রক্রিয়া।
৪) সবকিছুকে ছাপিয়ে যে বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃতভাবে উঠে এসেছে তা হলো মুজিবুল হক সাহেবের ব্যক্তিগত ইমেজ! ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান হিসেবে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে । দিনের অধিকাংশ সময় আমরা যখন আমাদের দুর্নীতিবাজ, চোর ও জনবিমুখ রাজনীতিবিদদের সমালোচনায় পঞ্চমুখর, তখন কেউ না কেউ যখন আমাদের কাছে সতজন হিসেবে ধরা দিয়েছে , তা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই। তার সততা , নিষ্ঠা , দেশপ্রেম ,জনসম্পৃক্ততা ও সাধাসিধে জীবনযাপন ও মিতব্যয়ীতার প্রশংসা জনমুখে প্রচলিত। আর একজন নিষ্ঠাবান মন্ত্রী যখন শেষ বয়সে বিয়ের পিড়িতে বসবেন তখন দেশের মানুষ ফাঁকফোকর দিয়ে হলেও একটু উঁকি মেরে দেখবে সেটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ।।
৫) কখনো কখনো আমাদের মিডিয়া এক্টিভিটিস দেখলে মনে হয় তারা টেলিকাস্ট স্পীডের দিক দিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া বিবিসি, সিএনএন কিংবা আল-জাজিরাকেও ছাড়িয়ে যাবে। ডেইলি-স্টারের মতো রিপুটেড নিউজপেপার ঘণ্টায় ঘণ্টায় মন্ত্রী-মহোদয়ের মেহেদী ও বিয়ের ইনস্ট্যান্ট আপডেটেড ছবি ফলাওভাবে তাদের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত করেছে। একইভাবে ছবি পাবলিশ করেছে যুগান্তর, সমকাল, বিডিনিউজ ও বাংলানিউজ তাদের অনলাইনে । আর তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সেই ছবি ও খবরগুলো কপি-পেস্ট হয়ে কাকমার্কা অনলাইন পোর্টালের হাত ধরে ছড়িয়ে গিয়েছিলো পুরো অনলাইন জুড়ে। ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারের প্রোফাইলে প্রোফাইলে ভরে গিয়েছিলো তাদের তোলা মুজিবুল হক ও তার স্ত্রীর খবর ও ছবিতে । ব্যাপারটা এমন হয়েছিলো যেনো কোন একটি সপ্তাচার্যের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো সেদিন , আর পুরো বাংলাদেশ ঝুঁকে পড়েছে সেইদিকে - উদ্ভুদ্ধ করেছে মিডিয়া !!
মুজিবুল হক সাহেব, তার স্ত্রী ও তার বিয়ে নিয়ে অনেক কথা হলো ।তাদের সুখময় দাম্পত্য জীবন কামনার পাশাপাশি আমরা সাধারন জনগন বিবাহ উৎসবসংক্রান্ত কয়েকটি সম্পূরক প্রশ্ন তুলতেই পারিঃ
প্রধানমন্ত্রী,মন্ত্রী মহোদয়গণ বাংলাদেশের বর্তমান অভিভাবক। আর একজন অভিভাবক যখন রাজার হালে বিয়ের আসরে বসেন তখন প্রশ্ন উঠে দেশের সাধারণ জনগণের বিয়ে ঠিক কিভাবে সম্পন্ন হচ্ছে ! আরও প্রশ্ন উঠে-
যেহেতু একটি স্বাভাবিক বিবাহ অনুষ্ঠানের চেয়েও অধিক পরিমাণ বিলাসিতা করা হয়েছে এই বিয়েতে, তাহলে সমগ্র বিয়ের অনুষ্ঠান , সজ্জা ,খাওয়াসহ আনুসাঙ্গিক সমগ্র খরচ কি মন্ত্রী একা বহন করেছেন? করলে সেটার উৎস কি ও জ্ঞাতবহির্ভুত আয়ে পরে কিনা ?
কিম্বা, অন্য কোন উৎস থেকে অর্থ আহরণ করা হলে সেটা কি , আহরিত অর্থের পরিমাণ কতো এবং সেখান থেকে মন্ত্রী অর্থ আহরণের ক্ষমতা রাখেন কিনা?
যেহেতু তিনি একটি মন্ত্রনালয়ের দ্বায়িত্ত্বে আছেন, বিয়েতে সেই মন্ত্রণালয়ের কোনরূপ অর্থ, যানবাহন বা জনবল বেআইনি ব্যবহার বা ক্ষতি সাধিত হয়েছে কিনা ? রাষ্ট্র(মন্ত্রনালয় বা অন্য কোন রাষ্ট্রীয় উৎস ) থেকে কোনরূপ অনুদান বা উপঢৌকনস্বরুপ মন্ত্রী মহোদয়কে কোন অর্থ বা মূল্যবান কিছু দেওয়া হয়েছে কিনা? দেওয়া হলে তা কতো?
তিনি কোনপ্রকার সরকারী বা বেসরকারি ব্যাংকে লোনের আশ্রয় নিয়েছেন কিনা? অথবা কোনপ্রকার লোন বহাল রেখেই তিনি এই মাজ মৌস্তি করছেন কিনা?
দুদক থেকে স্বেচ্ছায়-স্বপ্রনোদিত হয়ে মন্ত্রীর এতো বড় অনুষ্ঠান আয়োজনের পিছনের অর্থের যোগান ও পরিমাণ নিয়ে কোনপ্রকার তদন্ত করা হবে কিনা? রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক কেউ যখন এতো বড় ব্যক্তিগত ব্যয়ে অংশগ্রহণ করেন, তখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা রক্ষার্থে তাদের উপর কোনরূপ তদন্ত কি দুদক করবেনা? অথবা রাষ্ট্র কি দুদককে সেই তদন্তে অনুরোধ জানাবেনা?
নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় মন্ত্রী মহোদয় যে সম্পত্তি ও অর্থেরর সমুদয় বিবরণী দিয়েছিলেন, তার বাইরের কোন সম্পত্তি বা অর্থ বিবাহে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা তা ইসির খতিয়ে দেখা প্রয়োজন অথবা খতিয়ে দেখা জন্য ইসি দুদককে অনুরোধ করতে পারে ।
এই বিশাল পরিমাণ অর্থের উপর মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজনীয় রাজস্ব পরিশোধ করেছেন কিনা তা রাজস্ব বোর্ড কি খতিয়ে দেখবে না?
মিতব্যয়ী রেলমন্ত্রী ঠিক কতোটুকু মিতব্যয়ীতা প্রদর্শন করলো তা কি আওয়ামীলীগ যাচাই করবে?
এটাই নির্মম সত্য, হয়তো আজকের প্রেক্ষিতে একটা প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া যাবেনা ! চুপ থাকবে দন্তহীন বাঘ দুদক, উছিলা দেখাতে থাকবে ইসি , নীরবতা পালন করবে রাজস্ব বোর্ড -ঘুমিয়ে থাকবে বাংলাদেশ! ঘুমন্ত বাঙ্গালীর উপর দাড়িয়ে আমোদ প্রমোদ করবে আমাদের রাজনীতিবিদেরা । 'কুমারত্ত্ব' কিংবা 'বয়স পার্থক্য' কিংবা 'প্রতিষ্ঠিত সততা' নিয়ে তৈরি হওয়া আবেগকে পেছনে ফেলে সম্মুখ হতে হবে বাস্তবতার। আজকের দিনে যা ঘটছে আশেপাশে সেটাকেই আপেক্ষিক হিসেবে ধরে নির্নয় করতে হবে আজকের দিনে কারো ব্যক্তিত্ব। কারণ, মানুষ পরিবর্তনশীল!!! খুব দ্রুতই ঝেড়ে ফেলতে পারে বহু দিনের লালিত আদর্শকে !!
বি:দ্র: আজ ' পাখির বাপ ' নিকের ১ম জম্মদিন
ব্লগে নিয়মিত হওয়ার প্রত্যাশা।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:০৯