'সাম্প্রদায়িকতা' শব্দটি বিগত প্রায় একশ বছর যাবৎ আমাদের এই উপমহাদেশে খুব চেনা । প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের অনেকেরই জীবন এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে । সাম্প্রদায়িকতার প্রায়োগিক রূপ হয়তো আমরা অনেকেই দেখিনি অথবা কেউ কেউ দেখেছি, তবে ছাপার অক্ষরে তার নানাবিধ বিবরণ পড়েছি । পড়ে কোন একটা পক্ষ নিয়েছি, তর্ক করেছি, আমার কথাই শেষকথা, এটা প্রমাণ করার জন্য কেউ কেউ হাতাহাতি করেছি, কেউ কেউ আরো গভীর তত্ব ও তথ্যের খোঁজে নানান বই পত্র তছ নছ করেছি। অনেকেই এর মূল খুঁজতে গিয়ে বলেছি--এটা শিক্ষার অভাব থেকে হয়,এটা দারিদ্রের কারণে হয়, এটা ধর্মীয় কুসংস্কৃতির কারণে হয়,সম্পদের অসম বিকাশের কারণে হয়--কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে এটা শ্রেণী সংগ্রামের একটা রূপ পর্যন্ত বলেছেন, কারণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই নাকি অনেক সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত দেখতে হয়। আর ঘটনা ঘটলেই আমরা মিডিয়া কর্তৃক জারিত হয়ে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসি। শান্তির সময় ততটা ভাবিনা। শান্তির সময়টা এসব নিয়ে ভাবেন গবেষক,রাজনীতিক, এবং অবশ্যই দাঙ্গাবাজরা।
সাম্প্রদায়িকতা আসলেই একটা মনোভঙ্গী যা প্রাচীন । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রাচীনতাকে আমরা বর্জন করলেও কিছু কিছু ধরে রেখেছি । তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা অন্যতম। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল । আধুনিক যুগে আমরা এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি ধর্ম। তাতে এটার শক্তি অনেকগুন বৃদ্ধি পেয়ে নাম হয়ে গেছে 'ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা'। এটা এখন এক অদৃশ্য অস্ত্র । আর এর বৈশিষ্ট হল এই অস্ত্র চালনা করতে হয়না । এই অস্ত্রই তার বাহককে চালনা করে থাকে ।
'সাম্প্রদায়িকতা' শব্দটি এসেছে সম্প্রদায় থেকে । আমাদের সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি তা ঐ ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় দ্বারাই নির্মিত । আর এই সম্প্রদায় শুধু ধর্মেরই হবে তার কোন মানে নেই। সম্প্রদায় অনেক প্রকারেরই হয় বা হতে পারে । তা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দেখে এখন আমি যদি বলি, না আমি কোন সম্প্রদায়ে বিশ্বাস করি না ।--কথাটা কথার কথা হতে পারে । যার সবটুকু সত্য নয় । কারণ আমি চাই বা না চাই আমি সমাজের, সম্প্রদায়ের যে মানবযুথ তারই অংশ । এখন আমি যদি বলি, না আমি এই ভেদাভেদ থেকে মুক্তি চাই । এটাও একটা কথার কথা হয়ে যাবে । কারণ আমি মুক্তি পেলেও এই সমাজেই থাকব । ফলে কোন না কোন সম্প্রদায়ের হাতেই আমি পড়ব। আর কখনো সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অশান্তি তৈরি হলে আমি তার থেকে রেহাই পাবনা । তার অনেক নজির আছে । আমাদের দাঙ্গার ইতিহাস ঘাটলে জানা অজানা অনেক নিহত হৃদয়ের কথা যেন আজও কোন সচেতন পাঠক ঠিকই অনুভব করেন ।
আমাদের, মানে বাঙালিদের ধর্ম নিয়ে দাঙ্গার ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। মোটে কমবেশি একশ বছর । শুরুটা ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ দিয়েই বলা যায়। দেখা যায় বঙ্গভঙ্গ নিয়েই বাঙালি হিন্দু মুসলমান এই দু'ই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। আমার ধারণা এযাবৎ প্রকাশিত এ সম্পর্কিত ইতিহাস খুবই ঘোলাটে ও পক্ষপাতদুষ্ট । তবু তার ভেতর থেকে একটা বিষয় বের করে আনা যায় যে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে সাধারণ মানুষের কোন আগ্রহ বা মাথাব্যাথা ছিলনা । থাকার কথাও না । শাসকের কুটনীতির আঁতুড়ের খবর আম জনতার জানার কথা নয় । এছাড়া তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থাও তার একটা কারণ । অবশ্য তাদের আগ্রহ এবং মাথাব্যথা দুটোই তৈরী করে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছিল । আর পরে যখন হোতারা রণে ভঙ্গ দিলেন এবং নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরে গেলেন, তখন, ততদিনে আগ্রহ আর মাথাব্যাথা দেখা গেল মনে এবং মাথায় যুগপৎ ঘা'য়ে পরিণত হয়ে গেছে । অতঃপর ঘেয়ো বাঙালি স্বজন হত্যার নিগূঢ় অন্ধকারে মেতে উঠলেন উল্লাসে ।
আমাদের এই পারস্পরিক বিদ্বেষের ইন্ধন অবশ্য পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে । আর সেই আন্দোলনের মাধ্যমে যখন ক্ষমতার বীজ বপনের আয়োজন চলছে তখন সেই ক্ষমতাবীজের ভাগ নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল দর কষাকষি । অভ্যন্তরীণ নানা উপদলে তখন আন্দোলনকারীরা বিভক্ত । বৃটিশরাজ সেই সময়েই নেমে পড়লেন আসরে । শাসনের সুবিধার্থে সংস্কারমূলক আপাত নিরিহ 'বঙ্গভঙ্গ' প্রস্তাবটি আনলেন এবং বাজীমাত করলেন । পরবর্তীতে বঙ্গভঙ্গ রদও করলেন । কিন্তু ততদিনে আমাদের এই পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে ।
(চলবে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




