somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) এর বিধান (৪র্থ পর্ব)

২৪ শে মার্চ, ২০১২ রাত ৮:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মোটকথা, যাতে হাসিল হওয়া বা না-হওয়ার অনিশ্চয়তা রয়েছে তাই হচ্ছে আল-গারার। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী যে ব্যবসায় এ গারার পাওয়া যাবে তা অবৈধ ও নাজায়িয। আল্লামা ইবন কুদামাহ তার ‘আশ-শারহুল কাবীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইবরাহীম হারবীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, কোনো লোক যদি এ শর্তে মোরগ ভাড়া নিতে চায় যে, এ মোরগ তাকে সালাতের সময় ঘুম থেকে জাগাবে তবে এ ধরনের কারবার জায়িয হবে কি না? তিনি উত্তর দিলেন, না। কারণ এটি অনিশ্চিত কারবার। হতে পারে কখনো কখনো মোরগ ডাকবে না, আবার কখনো সালাতের সময়ের আগে ডাকবে বা পরে ডাকবে, আবার কখনো হয়তো তার মুখ থেকে ডাক বের করার জন্য প্রহারের প্রয়োজন হবে ইত্যাদি। সুতরাং নানাবিদ অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা থাকায় এ ধরনের চুক্তি জায়িয নেই। [খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৩১৯]

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির পদ্ধতির দিকে তাকালে অনুমেয় হয় যে, সেখানে বহু পদ্ধতিতে গারারের উপস্থিতি রয়েছে। একজন ডিস্ট্রিবিউটর যে চুক্তিতে কোম্পানির সাথে যুক্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো, লোকটি তার ডাউনলাইন থেকে কমিশন লাভ করতে থাকবে। অথচ তার নিজের বানানো দু’জন ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের বিষয়টি সম্পূর্ণই অনিশ্চিত এবং অন্যের কাজের ওপর নির্ভরশীল। কারণ তার নিম্নের নেটগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অগ্রসর না করলে লোকটি কমিশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে; যে কমিশনকে কেন্দ্র করেই সে মূলত এ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছে।

কোনো কোনো মাল্টি লেভেল কোম্পানিতে ‘ট্রি প্লান্টেশন’ নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে। বছরখানেক আগে এ প্রতারণা নিয়ে পত্রিকায় ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ৮০০০ (আট হাজার) টাকা নিয়ে ১২ বছর পর ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) টাকা অথবা সমপরিমাণ অর্থের গাছ প্রদানের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করা হয়। গাছ লাগানোর জন্য আদৌ কোনো জায়গা ক্রয়া করা হয়েছে কি না বা কতজন গাছ লাগানোর জন্য টাকা দিয়েছে— এসব বিষয়ে একটা অস্পষ্টতা থেকেই যাচ্ছে। এ সকল অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতার কারণে ইসলামি শরী‘আত এ লেনদেনকে বৈধ সাব্যস্ত করে না।



(ঘ) সুদের সাদৃশ্য ও দৃঢ় সন্দেহ (شبهة الربا) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং হালাল না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এতে শরী‘আত নিষিদ্ধ সুদের সাদৃশ্য ও সন্দেহ বিদ্যমান। ইসলামি আইন অনুযায়ী যে সকল কারবারে সুদের সাদৃশ্য ও সন্দেহ রয়েছে তা না জায়িয। ইসলামি আইনবিদগণ এ কারণে বহু কারবারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কারণ রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন,

«الْحَلالُ بَيِّنٌ وَالْحَرَامُ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ»

‘‘হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট। এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহ ও সাদৃশ্য বিষয় যা অধিকাংশ মানুষই জানে না। কাজেই যে সাদৃশ্য ও সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকে সে নিজের দ্বীন ও ইজ্জত রক্ষা করল। আর তাতে জড়ালো সে হারামে নিপতিত হলো’’ [সহীহ বুখারী : ৫২]।

অপর এক হাদীসে এসেছে,

«دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَالا يَرِيبُكَ»

‘‘তোমাকে যা সন্দেহে ফেলে তা ছেড়ে তুমি নিশ্চিত জিনিসের দিকে ধাবিত হও।’’ [সুনান তিরমিযী : ২৫১৮, হাদীসটি সহীহ]

ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,

إِنَّ آخِرَ مَا نَزَلَ مِنْ الْقُرْآنِ آيَةُ الرِّبَا وَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُبِضَ وَلَمْ يُفَسِّرْهَا فَدَعُوا الرِّبَا وَالرِّيبَةَ

‘‘কুরআনের সর্বশেষ আয়াত হচ্ছে রিবা (সুদ)-এর আয়াত। রাসূলুল্লাহ স.-এর মৃত্যু হয়ে গিয়েছে কিন্তু তিনি সুদের আয়াতের ব্যাখ্যা দেন নি। কাজেই তোমরা সুদ এবং এমন জিনিস যাতে সুদের সন্দেহ রয়েছে তা বর্জন করো’’ [মিশকাত : ২৮৩০, সুনান ইবন মাজাহ : ২৪৭, হাদীসটি সহীহ]।

উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘোষণা হলো, যেহেতু রাসূলুল্লাহ স. রিবার আয়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে যান নি সেহেতু যাতে সরাসরি রিবা রয়েছে তাতো বর্জন করতেই হবে পাশাপাশি যাতে রিবার সন্দেহ ও সাদৃশ্য রয়েছে তাও বর্জন করতে হবে।

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ সুদের সাদৃশ্য-এর বিবরণ এভাবে দেয়া যায় যে, এসব কোম্পানিগুলোতে ডিস্ট্রিবিউটররা পণ্য ক্রয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ হয় কমিশন পাওয়ার আশায়। এতে বুঝা যায়, সে পণ্য ক্রয় বাবদ যে টাকাটি দিয়েছে তা শুধু ঐ পণ্যের মূল্য হিসেবেই দেইনি বরং তা দেয়ার পেছনে তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ডাউনলাইনদের কাছ থেকে কমিশন ভোগ করা। পণ্যের মূল্য প্রদানের পাশাপশি কমিশনের যে সুযোগের আশায় সে এ কারবারটি করছে তাই ইসলামি শরী‘আতের পরিভাষায় সুদের সাদৃশ্য।

কারও নেট চলমান থাকার কারণে সে নির্দিষ্ট টাকার মোকাবেলায় কমিশন পাওয়ার বিষয়টি যেমনি সুদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তেমনি যার নেট একেবারেই অগ্রসর হয় নি তার বিষয়টিও সুদের সাদৃশ্য থেকে মুক্ত নয়। কারণ সে তো টাকা দিয়েছিল পণ্য এবং ডিস্ট্রিবিউটর হয়ে কমিশন ভোগ করার জন্য। অথচ ডিস্ট্রিবিউটরের কোনো সুবিধাই সে পায় নি। তথা কিছু টাকা বিনিময়ের অতিরিক্ত থেকেই যাচ্ছে যা ইসলামি আইনের দৃষ্টিতে সুদের সাদৃশ্য বা সন্দেহমূলক সুদ।

আর তাছাড়া উপরে আমরা পদ্ধতিগত দিকের প্রথম যে কারণ ‘শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম’ উল্লেখ করেছি তাও ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিতে সন্দেহমূলক সুদের আওতাভুক্ত। কারণ সেখানে শ্রম না দিয়ে বিনিময় নেয়াটি যেমন সুদ সাদৃশ্য তেমনি শ্রম নিয়ে বিনিময় না দেয়াটিও সুদ সাদৃশ্য।



(ঙ) জুয়ার সাদৃশ্য (شبهة الميسر) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসা না জায়িয হওয়ার আরও একটি কারণ হলো, এর সাথে জুয়ার সাদৃশ্য রয়েছে। ইসলামি পণ্ডিতগণ এ ব্যবসাকে জুয়ার সাথে তুলনা করে একে হারাম ফতোয়া দিয়েছেন। এ ব্যবসায় একজন ডিস্ট্রিবিউটর পণ্য ক্রয় করার পর সে যদি তার ডান ও বাম হাত উভয় দিকে সমান্তরাল ডিস্ট্রিবিউটর বাড়াতে পারে তবে সে কমিশন পাবে অন্যথায় সে কোনো কিছুই পাবে না। এটি জুয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর জুয়াকে ইসলামি আইন হারাম করেছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্‌ বলেছেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَٰمُ رِجۡسٞ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٩٠﴾ [المائدة: 90]

‘‘হে মু’মিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপুজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কার্য। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো— যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো’’ [সূরা মায়িদা, আয়াত নম্বর : ৯০]।

ইন্টারন্যাশনাল ফিকহ একাডেমি কর্তৃক প্রদত্ত এক ফতোয়ায় মাল্টি লেভেল মার্কেটিংকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। তারা এ সিস্টেমে আপলাইনের দালালদের যে কমিশন দেয়া হয়া তা বৈধ দালালির ফি’র মতো নয় বলে জানান। বরং তারা প্রমাণ করেন যে, এতে সুস্পষ্ট জুয়াবাজী নিহিত রয়েছে।



(চ) বাতিল পন্থায় মানুষের মাল ভক্ষণ (أكل أموال الناس بالباطل) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং হালাল না হওয়ার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো, এর মাধ্যমে ‘অন্যায়ভাবে অন্যের মাল ভক্ষণ’ করা হয় যা ইসলামি আইনে নিষিদ্ধ। এ ব্যবসায় আপলাইনের ডিস্ট্রিবিউটররা ডাউনলাইন ডিস্ট্রিবিউটরের বিক্রি থেকে ‘‘তত্ত্বাবধানের’’ নাম দিয়ে যে বিশাল কমিশন ভোগ করে, ইসলামি আইনের পণ্ডিতগণ সেটাকে ‘অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভোগ’-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ তাতে শ্রমবিহীন বিনিময় রয়েছে যা আমরা ইতোপূর্বের আলোচনায় সাব্যস্ত করে এসেছি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্‌ অন্যায়ভাবে অন্যের মাল ভক্ষণকে সম্পূর্ণভাবে হারাম করে ঘোষণা দিয়েছেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ﴾ [النساء:29]

‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা’’ [সূরা আন-নিসা : ২৯]। বিখ্যাত মুফাসসির আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এবং প্রখ্যাত তাবিঈ হাসান বসরী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘‘বিনিময়ের শর্তযুক্ত চুক্তিতে বিনিময়বিহীন উপার্জনই হল বাতিল পন্থায় উপার্জন’’ [আহকামুল কুরআন (জাসসাস) খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ১৭২]

মোটকথা: অত্র আয়াতে ‘‘অন্যায়ভাবে’’ বলতে এমন সব কারবারকে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষিদ্ধ করেছেন। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ উল্লেখ করেন, এখানে ‘‘অন্যায়ভাবে’’ বলতে ‘‘এমন সব পদ্ধতির কথা বুঝানো হয়েছে যা সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী এবং নৈতিক দিক দিয়ে ও শরী‘আতের দৃষ্টিতে নাজায়িয’’ [সূরা আন-নিসা, আয়াত ২৯]

ওআইসি‘র ইন্টারন্যাশনাল ফিকহ একাডেমির চীফ স্কলার প্রফেসর ড. আব্দুস সাত্তার আবু গুদ্দাহ এ সংক্রান্ত তার ফতোয়ায় বিষয়টি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, “...compound brokerage falls under the category of eating up another’s property unjustly and has an element of gambling in it. The main factor that contributes to this is the fact that compound brokerage automatically implies that a portion from the sales of the down line will be channeled to the up line.” [The Awakening, November 2008; http://theawakening.blogspot.com/2008 ]

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর কমিশন পদ্ধতিতে কিভাবে ‘‘জুয়াবাজী’’ ও ‘‘অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভোগ’’ জড়িয়ে আছে তার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে শেখ সালীম আল-হিলালী বলেন, “This type of business is pure gambling because the purpose is to develop continuous network of people. With this network, large number of people at the bottom of the pyramid (down line) pays money to a few people at the top (up line). In this scheme, no new wealth is created; the only wealth gained by any participation is wealth lost by other participants. Each new member pays for the chance to profit from payment of others who might join later.” [The Awakening, November 2008; http://theawakening.blogspot.com/2008 ]



(ছ) Business Fraud বা প্রতারণা (الغش) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং হালাল না হওয়ার আরো একটি কারণ হলো, তাতে রয়েছে বড় ধরনের প্রতারণা। অর্থনীতির হিসাবে কোনো অবস্থাতেই তাদের এ ব্যবসায় এক মাসে ১০ বা ২০ শতাংশ লাভ হতে পারে না। তাই এ ধরনের লাভ দিতে হলে কাউকে না কাউকে ঠকাতে হবেই। ফলে শর্তের মারপ্যাঁচ বুঝে উঠার আগেই প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এক শ্রেণীর লোকেরা। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي»

‘‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়’’ [সহীহ মুসলিম : ১৯৫]।

গ্রাম পর্যায়ে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখা গেছে এ সকল কোম্পানির অধিকাংশ ক্রেতাই আপলাইনের অগণিত মধ্যস্বত্বভোগীদের কমিশনের কথা জানে না। এ হিসেবে তো এটি সুস্পষ্ট প্রতারণার শামিল। পৃথিবীতে যত মাল্টি লেভেল ব্যবসা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ সফল হয়েছে মিশিগানের ‘অ্যামওয়ে’ নামের এমএলএম কোম্পানি। সেখানে ১০ শতাংশ ডিস্ট্রিবিউটর লাভ বা সফলতার মুখ দেখেছে, বাকী ৯০ শতাংশ তাদের কস্টার্জিত অর্থ কোম্পানির ওই ১০শতাংশের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেরা প্রতারিত হয়েছে।



(জ) বর্ধিত মূল্যে বিক্রয় (البيع بالسعر الغالي) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং না জায়িয হওয়ার আরও একটি কারণ হলো, এ সকল কোম্পানি পণ্যের যথাযথ মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে তা বিক্রয় করে থাকে। আর এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয় যা শরী‘আত অসঙ্গত। আমরা জানি, ট্রাডিশনাল মার্কেটিং-এ একটি পণ্য উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে উৎপাদক + এজেন্ট + পাইকার + খুচরা বিক্রেতা + ভোক্তা ইত্যাদি কতিপয় মধ্যস্বত্বভোগী থাকে। কিন্তু মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ এসকল মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের বাদ দিয়ে তারা নিজেরাই ডাউনলাইন ও আপলাইন নাম দিয়ে শত সহস্র মধ্যস্বত্ত্বভোগী সৃষ্টি করে চলছে। এ বিপুল সংখ্যক মধ্যস্বত্বভোগীকে কমিশন দিতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিকে বর্ধিত মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হয়। তাই তারা প্রচলিত পণ্যদ্রব্য পরিহার করে এমন পণ্য মার্কেটে নিয়ে আসে যেগুলো সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘‘নাইজেলা’’ নামক তৈল যার প্যাকেজ মূল্য ৬০০০ টাকা। মাত্র এ ৬০০০ টাকায় কোম্পানি ২৭৭৫ টাকা লাভ করে বলে স্বীকার করা হয়। এভাবে অন্যান্য পণ্যগুলোও দ্বিগুন বা তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হয়।

ইসলামি শরী‘আতে ক্রয়-বিক্রয় ও যাবতীয় চুক্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার প্রতি জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইসলামি আইনে পণ্যের গুণগত মান ও ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রিত হবে। ভিন্ন কোনো পদ্ধতিতে বাজার প্রভাবিত করা শরী‘আতে নিষিদ্ধ। সুতরাং পণ্যের মান বৃদ্ধি না করে কোনো কৌশল অবলম্বন করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করাকে ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। যে সব কৌশলের মাধ্যমে দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হয় তার প্রতিটিই ইসলাম হারাম করেছে। যেমন দাম বাড়ানোর জন্য দ্রব্য মজুত করা। যারা এরূপ করে ইসলামের পরিভাষায় তারা অভিশপ্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ»

‘‘যে ব্যক্তি বর্ধিত মূল্যে বিক্রির উদ্দেশ্যে পণ্য আটকে রাখে সে গুনাহগার’’ [সহীহ মুসলিম : ২১৬৪]।

অনুরূপ কৌশলে শহরের বাইরে থেকে আগত লোকদের থেকে অল্প মূল্যে মাল ক্রয় করে তা বেশি দামে বিক্রি করা হলে তা থেকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরত থাকতে বলেছেন। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- «نَهَى أَنْ يَبِيعَ حَاضِرٌ لِبَادٍ»

‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহরে বসবাসকারী কোনো ব্যক্তি শহরের বাইরে থেকে আগত কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পণ্য কিনে তা শহরের বাসিন্দাদের কাছে বিক্রি করা থেকে বারণ করেছেন’’ [সহীহ মুসলিম: ৩৫২৪] এ নিষেধাজ্ঞার ফলে শহরে বসবাসরত মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের অল্প পরিশ্রমে অধিক মুনাফা লাভের বিষয়টি বন্ধ হয়ে গেলে তারা একটু বেশি পরিশ্রম দেখানোর জন্য আগে-ভাগে শহরের বাইরে গিয়ে পথিমধ্যে বিক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করে তা শহরে এনে বেশি দামে বিক্রয় করার কৌশল অবলম্বন করলে সে ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- «نَهَى عَنِ التَّلَقِّى لِلرُّكْبَانِ»

‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহরবাসীকে শহরমুখী ব্যবসায়ীদের সাথে সাক্ষাৎ করে পণ্য ক্রয় করে তা শহরে এনে বেশি দামে বিক্রয় করতে বারণ করেছেন’’ [সহীহ মুসলিম : ৩৮৯১]

সুতরাং এটি সুস্পষ্ট যে, ইসলামি আইন দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি গুরুত্বসহ নিয়েছে। কোনো প্রকার কৌশল অবলম্বন বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা শরীআত সঙ্গত নয়। বৃহৎ অর্থনীতির অনিবার্য ক্ষেত্রসমূহে কিছু নিয়ন্ত্রিত মধ্যস্বত্বভোগীর অনুমতি দিলেও ভোক্তা ও উৎপাদকের মাঝে অনর্থক মধ্যস্বত্ত্বভোগীর সংখ্যা বাড়ানো ইসলামে নিষিদ্ধ।



(ঝ) ইজারা চুক্তির উসূলের পরিপন্থী (خلاف أصول عقد الإجارة) : এমএলএম অবৈধ হওয়ার আরও একটি কারণ হলো তাদের কোনো কোনো পদ্ধতি ইজারা চুক্তির মূলনীতির পরিপন্থী। আমরা জানি, এ সকল কোম্পানিগুলোর ব্যাখ্যা অনুযায়ী ডিস্ট্রিবিউটরশিপ চুক্তিটি শরী‘আতের দৃষ্টিতে ‘আকদুল ইজারাহ।’ আর ‘আকদুল ইজারাহ’-এর দু’টি মৌলিক দিক রয়েছে। ১. শ্রম বা সেবা, ২. পারিশ্রমিক বা বিনিময়। আকদুল ইজারাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য এ দু’টি শর্ত বিদ্যমান থাকতেই হয়। কিন্তু কোনো কারবারে যদি এ দু’টির কোনো একটি না থাকে তথা সেবা বা শ্রম পাওয়া গেল কিন্তু বিনিময় পাওয়া গেল না কিংবা সেবা বা শ্রম ছাড়াই বিনিময় পাওয়া গেল তবে সে কারবারটি ইসলামি আইনে বৈধ নয়।

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ যেহেতু দুটোরই সম্ভাবনাই রয়েছে সেহেতু এ কারবার ও ব্যবসা হালাল নয়।



আরও কতিপয় ত্রুটি : প্রাগুক্ত আলোচনায় আমরা শরী‘আতের নীতিমালার সাথে অসংগতিপূর্ণ বিষয়গুলোকে বিশেষভাবে পর্যালোচনা করেছি। নিম্নে তাদের আরো কতিপয় ত্রুটি তুলে ধরছি :

(ক) আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার স্বপ্ন : দারিদ্র পীড়িত ও বেকারত্বের এ দেশে অনেকেই বাকপটু পরিবেশকের কথার মারপেঁচে পড়ে অথবা সেমিনার দেখে কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও পণ্য ক্রয় করে পরিবেশক হয়ে যায়। পরবর্তীতে দেখা যায়, সে কোনক্রমেই অন্য কোনো ক্রেতা যোগাড় করতে পারে না। ফলে তার ধনী হওয়ার স্বপ্ন রূপান্তরিত হয় দুঃস্বপ্নে।

(খ) অন্যের ওপর চাপ সৃষ্টি : কখনো কখনো দেখা যায়, কোনো কোনো পরিবেশক তার নেট অগ্রসর করানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ফলে সে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে কোম্পানির সাথে যুক্ত করতে জোর আবদার করে। আবার কখনো নিজ থেকে টাকা ঋণ দিয়ে তাদের জন্য পণ্য সরবরাহ করে থাকে। তাদের পীড়াপিড়ির কারণে অনেকের ইচ্ছ না থাকা সত্ত্বেও পণ্যটি কিনতে বাধ্য হয়।

(গ) মূল পেশায় দায়িত্বশীলতা হ্রাস পাওয়া : এমএলএম-এর মূল কাজ যেহেতু ক্রেতা জোগাড় করা তাই অন্যান্য চাকুরির পাশাপাশি এটি করা খুবই সহজ। ফলে দেখা যায়, অনেকেই এ কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করার কারণে পেশাগত কাজের ফাঁকে ফাঁকে বা অফিস সময়ের পর ক্রেতার খোঁজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে বাধ্য হয়। এতে একদিকে পেশাগত কাজে ফাঁকি দেয়া হয় অন্যদিকে পেশাগত কাজে তার উদ্যম ও কর্মতৎপরতার ভাটা পড়ে। যা একসময় জাতীয় বিপর্যয়ও হতে পারে। (চলমান)
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×