somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পদবীনামা

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আগে তো মানুষের কোনও পদবী-টদবী ছিলনা। বেদ, পুরাণ, জাতক বা কথাসরিৎসাগরের পাতা তন্নতন্ন করে খুঁজলেও সেখানে পদবীর কোনও টিকি দেখা যাবেনা। উপনিষদে কোনও কোনও নামে অবশ্য দু'টি অংশ আছে। যেমন উদ্দালক আরণি, প্রাচীনশাল ঔপমানব। আরুণির অর্থ অরুনের পুত্র। অর্থাৎ নামের সঙ্গে ছিল পিতার পরিচয়। পিতৃপরিচয়ের মতো পুরাণ কালে মাতৃপরিচয়ও স্বীকৃত ছিল। যেমন সত্যকাম জাবালি। জাবালির অর্থ জবালার পুত্র। মহাভারতের দুর্যোধন-দুঃশাসনেরা নিজেদের পরিচয় দিতেন 'কৌরব' বলে আর যুধিষ্ঠির-অর্জুনেরা 'পান্ডব' বলে। এঁদের কারও কোনোও পদবি ছিল না।

যে নাম গুলো দুই অক্ষরের চেয়ে বেশি হত, সেগুলো উচ্চারণ করার সময় দুটো শব্দ হিসেবে উচ্চারিত হত। অনেক সময় মনে হত, দুটো পৃথক শব্দ। সেরকম নামের কেউ বিখ্যাত হয়ে গেলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মরা নিজেদের ওই বিখ্যাত লোকের উত্তরাধিকারী বোঝানোর জন্য নিজের নামের সঙ্গে সেই বিখ্যাত লোকের নামের শেষাংশটা জুড়ে দিতেন। যেমন বাণভট্ট, গোপালভট্ট বা আর্যভট্ট। এঁরা স্বনামধন্য হয়ে যাওয়ার পরে ছেলে মেয়ে নাতি-নাতনিরা তাদের নামের পাশে ভট্ট লিখতে শুরু করেন। ঘোষও তাই। যেমন অশ্বঘোষ, ঈশ্বরঘোষ বা অনন্তঘোষ। এখানে ঘোষ কিন্তু নামের একটা অংশ। নামের সঙ্গেই উচ্চারিত হত। পরে এঁরা প্রথিতযশা হয়ে যাওয়ার পরে এঁদের বংশধরেরা তাঁদের নামের পাশে ঘোষ লিখতে শুরু করেন। এভাবেই বিশ্ববসু বা পৃথ্বীবসু থেকেই 'বসু' পদবির উৎপত্তি। মহাবল, ইন্দ্রবল জাতীয় নাম থেকে 'বল' পদবি। অবশ্য দেবল থেকেও হতে পারে। বিষ্ণুশর্মা থেকে শর্মা, কৃষ্ণস্বামী থেকে স্বামী, চন্দ্রবর্মা থেকে বর্মা পদবির আবির্ভাব। পরহিতভদ্র, শান্তরক্ষিত, কমলশীল, বুদ্ধগুহ, বিশুদ্ধসিংহ, ধনগুপ্ত, কল্যাণমিত্র, জগৎমিত্র, বিমলমিত্র জাতিয় নামের শেষাংশ থেকেই এসেছে ভদ্র, রক্ষিত, শীল, গুহ, সিংহ, গুপ্ত, মিত্র পদবি। এসেছে ধর, দেব, দত্ত, সেন, সোম, চন্দ্র, যশ বা দাস।

এই ধরনের নাম অতীশ দীপঙ্করের সময়ে বহু বাঙালির মধ্যেই দেখা যেত। এঁদের অনেকেই ছিলেন বৌদ্ধ। তাঁরা জাতিভেদ মানতেন না। ফলে এই পদবিধারীদের জাত কী ছিল, তা আর জানা যায় না। তাঁদের নামের শেষাংশ তখনও তাঁদের নাম থেকে আলাদা হয়নি। মানে পদবি হয়ে ওঠেনি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার একটি নামের তিনটি অংশই পরবর্তী কালে তিনটি আলাদা আলাদা পদবি হয়ে উঠেছে। যেমন আদিত্যসেনগুপ্ত। এটা একটাই নাম। পরে আদিত্য, সেন এবং গুপ্ত নামে পৃথক পৃথক পদবি তৈরি হয়েছে। বিক্রমাদিত্য, ললিতাদিত্য জাতীয় নামের শেষাংশ থেকেও অবশ্য আদিত্য এসে থাকতে পারে। আদিত্যরই অপভ্রংশ আইচ। হুই পদবি এসেছে বিভূতি, দেবভূতি, ভবভূতি জাতীয় নামের শেষাংশ থেকে। ওই সব নামের শেষাংশ 'ভূতি'রই দেশজ উচ্চারণ হুই। প্রভাকর, সন্ধ্যাকর নামের শেষাংশ থেকে এসেছে 'কর' পদবি। উত্তর-পশ্চিম ভারতের শিলালিপি থেকে পাওয়া গেছে নহপান নাম। তা থেকেই সম্ভবত পান বা পাইন পদবির উৎপত্তি। এক অক্ষরের পদবিগুলি সবই অপভ্রংশ বলে মনে হয়। যেমন দাঁ, দে, শি, শা, তা, গোঁ।

বলছিলাম বাণভট্ট, গোপালভট্ট, আনন্দভট্টদের কথা। এদের বংশধরেরা নিজের নামের সঙ্গে ভট্ট ব্যবহার করতেন ঠিকই, এই ভট্টদেরই কোনও এক জন আচার্য হয়ে ওঠার পরে তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা ভট্টর সঙ্গে আচার্য যোগ করে 'ভট্টাচার্য' পদবির প্রচলন করেন।

কারও কারও মতে অবশ্য কারও নামের শেষাংশ থেকে নয়, 'ভারত' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'গল্প'। তা থেকে 'ভর্ত্ত'। পরে মুখে মুখে তা 'ভট্ট' হয়ে যায়। 'দেব' শব্দটি কিন্তু ইতিহাস-খ্যাত ক্ষত্রীয় রাজাদের নামেই দেখা যেত। এই দেব শব্দেরই অপভ্রংশ রূপ দে।

নামের লেজুড় ধরে যেমন পদবির সৃষ্টি হয়েছে, তেমনই সৃষ্টি হয়েছে গ্রামের নাম থেকেও। যিনি যে-গ্রামে জন্মাতেন বা বসবাস করতেন, তিনি কোথাকার, তার শিকড় কোথায়, তা জানান দিতেই নামের সঙ্গে উল্লেখ করা হত সেই জায়গার নাম। যেমন বটব্যাল ও বড়াল একই পদবি। এসেছে বোড়ো গ্রাম থেকে। কুশো গ্রাম থেকে এসেছে কুশারী। লোকমুখে পরে সেটা ঠাকুর পদবিতে রূপান্তরিত হয়। ঘোষাল এসেছে ঘোশ বা ঘোশাল গ্রাম থেকে। গড়গড়ে থেকে গড়গড়ি। বাঁকুড়ার মুকটি থেকে মুখটি। পাকুর বা পর্কট থেকে পাকড়াশি। অম্বলু থেকে অম্বলি। পলশা থেকে পলসাঁয়ী। পোষলা থেকে পুষালী। পোড়াবাড়ি থেকে পোড়ারি। চাটু বা চাটুতি থেকে চট্ট।

কেউ কেউ বলেন, চাটু গ্রামের সঙ্গে হিন্দি জী বা জীউ জুড়ে ধীরে ধীরে চাটুর-জীয়া, চাটুর্জ্যা, চাটুর্জ্যে, চাটুজ্যে হয়েছে। ১৭৬০ সালের পরে ইংরেজী রূপ হয় চ্যাটার্জি। বন্ডউরী, বাঁড়ুরি, রাঁড়বি গাঁই থেকে হয়েছে বাঁড়ুজ্যে। শান্ডিল্য গোত্রের বাঁড়ুরি গাঁইদের আর একটি নিবাস বন্দি-ঘটি। সেখান থেকে বন্দ। অন্য মতে, বাড়ব বা বাড়বি গ্রাম থেকে বাড়বি ও বন্দ্যো, মুখো গ্রাম থেকে মুখটি বা মুকুটি বা মুখড়া গ্রাম থেকে মুখুজ্যে। তেমনই 'গঙ্গাকুলির' থেকে গাঙ্গৌলি, গাঙ্গুলি। প্রায় দুশো ষাট বছর আগে, ১৭৫০ সালের পরে ইংরেজ আমলে এই পদবিধারীদের মনে হল, তাঁরা এক সময় ওঝা ছিলেন। ওঝা মানে উপাধ্যায়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাঁরা পড়াতেন, তাঁদের উপাধ্যায় বলা হত। সেটা ছিল খুব সন্মানজনক পদ। ফলে তাঁরা যে সন্মানিত ব্যক্তির বংশধর, সেটা বোঝানোর জন্যই তাঁরা তাঁদের পদবির সঙ্গে 'উপাধ্যায়' যোগ করে চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় হয়ে গেলেন। গঙ্গ বা গাঙ্গুর হলেন গঙ্গোপাধ্যায়।

ডিগ্রি থেকেও পদবির সৃষ্টি হয়েছে। এই কিছুকাল আগেও যেমন অনেকেই নামের পাশে বি এ, এম এ, বি এড লিখতেন, তেমনই তারও বহু আগে যাঁরা একটা বেদ পাঠ করতেন, তাঁদের বলা হত পন্ডিত। বাংলার বাইরে যা হয়ে যায় পান্ডে। যাঁরা দুটো বেদ পাঠ করতেন, তাঁদের বলা হত দ্বিবেদী। বাংলার বাইরে যারা দুবে হিসেবে পরিচিত। তিনটে বেদ পাঠ করতেন যারা, তাদের বলা হত ত্রিবেদী। বাংলার বাইরে এঁরাই হয়ে যান তেওয়ারি। চারটে বেদ যাঁরা পড়তেন, তাদের বলা হত চতুর্বেদী। বাংলার বাইরে তাঁরাই চৌবে। মজা হচ্ছে, বংশের কোনও এক জন পন্ডিত হলে, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কেউ চারটে বেদ পড়লেও তিনি কিন্তু আর চতুর্বেদী বা চৌবে হয়ে উঠতে পারতেন না। তাঁকে পন্ডিত পদবি নিয়েই ক্ষান্ত থাকতে হত। আবার উল্টো দিকে, তিন বা চারটে বেদ পড়া কারও বংশধর যদি একটিও বেদ না পড়তেন, তাঁরাও শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সুত্রেই ওই একই পদবি ব্যবহার করার অধিকারী হতেন।

জীবিকা বা বৃত্তি থেকেও অনেক পদবির উদ্ভব হয়েছে। যেমন উকিল, গায়েন, তন্তুবায়,কর্মকার, মোদক, যোগী, স্বর্ণকার, মালাকার, ঘটক, পাঠক, জ্যোতিষী, কবিরাজ, ঘরামি, বৈদ্য, বণিক ইত্যাদি। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মরা হয়তো বৃত্তি পালটে নিয়েছেন, কিন্তু পদবি ওই একই রয়ে গেছে। ঢাকি বিলেত ফেরৎ ডাক্তার হয়ে এলেও তিনি সেই ঢাকি-ই।

উপাধি থেকেও সৃষ্টি হয়েছে প্রচুর পদবি। যেমন রায়, চৌধুরী, সরকার, হাজারী, তালুকদার, হালদার, খাঁ। এই 'খাঁ' বলতেই আমার মনে পড়ে গেল একটি ছোট্ট ঘটনার কথা। আমার বিশিষ্ট বন্ধু, পদবি খাঁ, এক দিন নেমন্তন্ন করেছিলেন আমাকে। আমাদের পরিবার এখনও পুরনোপন্থী। মা বললেন, তুই যাস না, ওরা কী খাওয়াতে কী খাইয়ে দেবে। আমাদের পরিবারে মায়ের কথাই শেষ কথা। তবু মাকে না জানিয়ে আমি তাঁকে ফোন করলাম। কথায় কথায় বললাম , আমি কিন্তু বিফ-টিফ খাই না। উনি বলেন, বিফ? বিফ তো আমরাও খাই না। আমরা তো ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ? তোমাদের মধ্যেও আবার ব্রাহ্মণ আছে নাকি? ও প্রান্ত থেকে যা শুনলাম, আমি তাতে চমকে উঠলাম। উনি বললেন, আমরা হিন্দু ব্রাহ্মণ।

পরে জেনেছিলাম আগে যাঁরা রাজা বা মহারাজা ছিলেন, তাঁরা হিন্দুই হোন বা মুসলিম, কেউই সচরাচর জাতি বিচার করে শাসক বা রাজকর্মচারী নিয়োগ করতেন না। ফলে উপাধি থেকে তৈরি হওয়া পদবিধারীদের মধ্যে যেমন হিন্দু মুসলমান শিখ আছেন, তেমনই আছেন ব্রাহ্মণ, কায়স্হ, বৈশ্য, শূদ্র। চৌধুরী তো এ দেশের প্রায় সব জাতির মধ্যেই বিরাজমান। আসলে 'চৌধুরী' শব্দটা এসেছে চৌথ আদায়কারী শাসক বা রাজপ্রতিভূ থেকে। প্রথমে চৌথহারী। পরে তা মুখে মুখে রূপান্তরিত হ্য় চৌধুরীতে। যেমন মোঘল আমলের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের বলা হয় সরকার। সরকার শব্দটা এত সহজে উচ্চারণ করা যায় যে, এর আর কোনও বিকৃতি ঘটেনি।

ইংরেজ আমলেও অনেকগুলি উপাধির প্রচলন হয়েছিল পদবি হিসেবে। যেমন রায়বাহাদুর, নাইট বা স্যর। ছিল 'মহামহোপাধ্যায়' খেতাবও। এটা এতটাই লোভনীয় ও সন্মানজনক ছিল যে, নামের পরে পদবি হিসেবে নয়, প্রাপকরা তাঁদের নামের আগেই ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন এটা।

চাকরি সূ্ত্রেও বহু পদবি তৈরী হয়েছে। যেমন মৌজার অধিকর্তা যিনি হতেন, তাঁকে বলা হত 'মজুমদার'। যিনি দৈনিক হিসেব রাখতেন, তাঁকে বলা হত 'সেহানবীশ'। যিনি শান্তিরক্ষকের কাজ করতেন, তাঁকে বলা হত, 'শিকদার'।'শিকদার' আর 'সিকদার' একই পদবি। যিনি কেরানির কাজ করতেন, তাঁকে বলা হত 'মুনশি'। বড়বাবুর কাজ যিনি করতেন, তাঁকে বলা হত 'মুস্তাফি'। ব্যাঙ্কার বা মহাজনদের বলা হত 'পোদ্দার'। যাঁরা হাবিলদারের কাজ করতেন, তাঁদের বলা হত 'লস্কর'। দশ জন সেনার উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত 'পদিক'। মুখে মুখে যা হয়ে দাঁড়ায় 'শতিক'। দশ শতিকের উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত 'সেনাপতি'। দশ সেনাপতির উপরে যিনি থাকতেন, তাঁকে বলা হত 'নায়ক'। 'দলুই' এসেছে দলপতি থেকে। যিনি যে-এলাকায় থাকতেন, তিনি সেখানে ওই পদ-এর নামেই পরিচিত হতেন। ওটাই হয়ে উঠত তাঁদের প্রধান ও প্রথম পরিচয়। তাই তাঁর ছেলেমেয়েরা বাবার পরিচয় হিসেবে তাঁদের নামের পাশে ব্যবহার করতে লাগলেন চাকরি সূত্রে পাওয়া বাবার সেই পদটার নাম। এই ভাবেই একের পর এক সৃষ্টি হতে লাগল তালুকদার, চাকলাদার, মহলানবীশ, তরফদার,খাসনবীশ,পত্রনবীশ,বকশি পদবি।

উচ্চারণের ত্রুটিতেও সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন পদবি। যাঁরা লবনকে নবন বলেন, তাঁদের কাছে লস্কর হয়ে গেছে নস্কর। অন্য ভাবেও পদবি এসেছে। যেমন দাস। গৌরীয় বৈষ্ণবকালে সকল শিষ্যই নিজেদেরকে ঈশ্বরের দাস বলে মনে করতেন। তাই তারা নিজের পদবির বদলে 'দাস' লিখতে শুরু করেন। কায়স্থ, বৈদ্যদের মতো বহু ব্রাহ্মণও দাস পদবি গ্রহন করেন। অনেকের ধারনা, দাস এবং দাশ আলাদা। কিন্তু বানানের তফাত ছাড়া 'দাশ' আর 'দাস'-এর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।

তখনকার দিনে মুদ্রার নাম ছিল দাম। তা থেকেই দাম বা দাঁ পদবি। অনেকেরই মতে, দাম শব্দটি এসেছে গ্রিক 'দ্রখ্‌মা' থেকে। বখশালি ভূর্জপত্র থেকে জানা যায়, একটি মুদ্রার নাম ছিল দ্রক্ষ্ম। তা থেকেই নাকি দাম। কেউ কেউ আবার বলেন, দামরাজ্য বা দামদক্ থেকেই দাম পদবি। শী এসেছে শীল বা শ্রী থেকে। অনেকের মতে, শিব থেকে। শা এসেছে সাধু বা সাউ থেকে। সাধু-র সঙ্গে খাঁ উপাধি যুক্ত হয়ে সাধুখাঁ হয়েছে। 'তা' এসেছে হোতা থেকে।

হোমক্রিয়ার পুরোহিত, যার আদি রূপ হোত্রী। যেমন অগ্নিহোত্রী। গোঁ এসেছে গণ থেকে। গণাধীন রাজ্যের শাসকমন্ডলীর সদস্যদের বলা হত গণ।

ভড় শব্দের অর্থ মালবাহী বড় নৌকা বা বার্জ। আবার ভড় হচ্ছে প্রাচীন গৌড়ের একটি অঞ্চলের নাম। কারও কারও মতে, ভড় এসেছে ভদ্র থেকে। গড়ই বা গড়াই এসেছে কোনও কিছু গড়ার পটুতা থেকে। অথবা গড়ের কাছাকাছি বসবাস করার কারণে। 'পিল' শব্দের অর্থ হাতি। হাওড়ার পিলখানা একসময় হাতির আস্তাবল ছিল। গুঁই এসেছে গুণী থেকে। গুণ-ও তাই। নদী বা দিঘির পারে বসবাস করার জন্য পাড়ুই। গাতাঁইত মনে হয় গাথাবিৎ বা কবি থেকে। পূজো বা বিবাহ অনুষ্ঠানে কিংবা রাজ্যসভায় যাঁরা গোছগাছ করতেন, তাঁদের থেকে এসেছে গোছাইত বা গুছাইত।

সেই সময় ছোট-বড় রাজারা আত্মরক্ষার্থে অথবা রাজবংশ কিংবা রাজভান্ডারের গোপন সংবাদ কোনও কোনও বিশ্বস্ত বংশের কাছে গচ্ছিত রাখতেন। গুপ্ত হত্যায় রাজার মৃত্যু ঘটলে পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের কাছে সে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁরা ছিলেন ভীষণ বিশ্বস্ত। সেই বিশ্বস্ততা থেকেই এসেছে বিশ্বাস পদবি। ঢ্যাং পদবি ঢ্যাঙা বা লম্বা থেকে। ঢং থেকেও আসতে পারে। পারে ডাঙা থেকে ডাং, ঢাং, ঢ্যাং থেকেও।

'লাহা' এসেছে সুবর্ণরেখার নিকটবর্তী অঞ্চলে লাক্ষা চাষ করা থেকে। 'রাহা' বোধ হয় এরই অপভ্রংশ রূপ। 'নাহা' ও তাই। তবে নাহার আর এক অর্থ ছোট নদী বা খাল। তা থেকেও নাহা এসে থাকতে পারে।

একটি পদবি আছে জানোয়ার। জাহান মানে বিশ্ব। জান মানে প্রাণ, প্রিয়, বাঈজি, বারাঙ্গনা, আবার গায়িকাও। এই জান শব্দের সঙ্গে আনোয়ার শব্দের মিশ্রনের ফলেই সম্ভবত তৈরি হয়েছে এই পদবি। জানবাহার অর্থাৎ নৃত্যনটী বা গায়িকার বেশভূষাকারী থেকেও এসে থাকতে পারে।

পাঁজা এসেছে পাঞ্জা থেকে। মোঘল আমলে পাঞ্জা ছাপ দেওয়া কোনও বাদশাহি সনদপ্রাপ্তি বা ভূমি দানের স্মৃতিকেই বংশ গৌরব হিসেবে ধরে রাখার জন্য পাঞ্জা ছাপ থেকে পাঞ্জা এবং তা থেকে পাঁজা পদবির সৃষ্টি।

পায়রা মানে কিন্তু কবুতর নয়। শীতের প্রথমে খেজুর গাছের রস থেক গুড় বানাতে হলে গাছটির গুড়ি খানিকটা কেটে কলসি ঝুলিয়ে দিতে হয়। নিয়ম হল, পর পর তিন দিন গুড়ি কাটা যাবে ও রস গ্রহণ করা যাবে। তারপর তিন দিন বিশ্রাম।

এই বিশ্রামের পর প্রথম যেদিন আবার গুড়ি কাটা হবে, তার রস থেকে যে গুড় তৈরী হয়, তাকে বলা হয় পায়রা। অর্থাৎ পহেলা বা পয়লা শব্দ থেকেই পয়রা, পয়ড়্যা ও পায়রা।

মান্না এসেছঘে হয়তো মান্য থেকে। ধনবান বা ধনাঢ্য থেকে এসেছে আঢ্য।পরে আড্ডি। ভূঁইয়া হল ভৌমিকের অপভ্রংশ রূপ। কারন বাংলার বারো ভূঁইয়াকে সাধু ভাষায় বলা হয় দ্বাদশ ভৌমিক। গণেশ ও গণপতি থেকে এসেছে গনাই।

লাঙল দিয়ে জমিতে হাল দেওয়া বা নৌকার হাল ধরা থেকেই যে হালদার পদবির সৃষ্টি, এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই।হালদার তখনকার দিনে নিশ্চয়ই কোনও সন্মানজক পদ ছিল।না হলে কি কেউ সাধ করে ব্রাহ্মণ উপাধি ছেড়ে ওই পদবি গ্রহণ করত?

ঢোল পদবিধারীরা ছিলেন আসলে সান্যাল। এঁদের যৌথ পরিবারটি ছিল বিশাল। প্রায় দুশো জনের মতো। খাবারের সময় ঢোল বাজিয়ে সবাইকে ডাকা হত। অন্য পরিবার থেকে পৃথক ভাবে চিহ্নিতকরার জন্যই এঁদের নামকরণ হয় ঢোল-সান্যাল। পরে সান্যাল উঠে শুধু ঢোল হয়ে যায়।

আশানন্দ মুখটি মানে মুখোপাধ্যায় গায়ের অমানুষিক জোরের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি একবার ধান ভাঙ্গার ঢেঁকি তুলে ডাকাতদের ঘায়েল করে বিখ্যাত হয়ে গেলেন আশানন্দ ঢেঁকি নামে। পরে 'ঢেঁকি'ই তাদের বংশধরদের পদবি হয়ে দাঁড়াল। অনেকে মনে করেন নৈহাটি, পাত্রহাটি, ভান্ডারহাটি, আদবাহাটী, সেকবাহাটী, রানীহাটী, বালুবাটী, উমারহাটী, নলহাটী, সেনহাটী, গৌহাটীর মতো কোনও হাটী থেকেই হাটী থেকেই পদবির উদ্ভব। কেউ কেউ বলেন, আর্যভাষী আদি আলাপাইন গোষ্ঠীর যাঁরা এ দেশে বাণিজ্য করতে এসেছিলেন, তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিতেন হট্ট বলে। তা থেকেই নাকি হাট বাজার। এখান থেকেও হাটি-র উৎপত্তি হতে পারে। হাটি শব্দের ইংরেজি বানন দেখে অনেকে এটাকে হাতি মনে করেন।কিন্তু হাতি ও হাটি এক পদবি নয়।

কাঁঠাল বা কাঁটাল পদবি এসেছে কাটাল থেকে। সম্ভবত দিঘি বা পু্ষ্করিণী কাটানোর ভারপ্রাপ্ত ওভারসিয়ার পদ থেকে। পটল এসেছে হিন্দু যুগের পট্টকিল উপাধি থেকে। বাংলার বাইরে যার অপভ্রংশ রূপ পাটিল বা পটেল। কোনও পট্টকিল পদবিধারী হয়তো কোনও দুর্দশার কারণে পিছিয়ে পড়ে এক সময় পটল হয়ে গেছেন। আলু এসেছে আলাপী শব্দ থেকে। রাজারা সে যুগে প্রচুর গাল্পিক নিয়োগ করতেন। তাঁদের কাজ ছিল রাজবাড়ির লোকেদের গল্প বলা। মহিলা গাল্পিকও নিয়োগ করা হত। যাঁদের বলা হত 'আলাপনী’। এই আলাপনী বা ধনীদের আড্ডায় বেতনভুক্ত সঙ্গী-আলাপী থেকেও আলু পদবি এসে থাকতে পারে।

আমারা ছোটবেলায় কোথাও বেড়াতে গেলে বড়রা জিগ্গেস করতেন, তোমার নাম কী? বাবার নাম কী? এবং কোথায় থাকো? অর্থাৎ যে ভাবে পুরাকালে শুরু হয়েছিল পিতৃপরিচয়, এসেছিল গ্রামের নাম, ঠিক সেই পদ্ধতিতে। কিন্তু এখন তো সেটা বদলে গেছে। এখন নামের পরেই বাচ্চাদের জিগ্গেস করা হয় কিসে পড়ো? এবং তার পরেই অবধারিত প্রশ্ন- কোন স্কুল? এই স্কুলটা কিন্তু ভীষণ ইমপর্ট্যান্ট। এই স্কুলই বিভাজন করে দেয় সব কিছু। যে ছেলেটা কলকাতার সাউথ পয়েন্টে পড়ে, আর যে ছেলেটা গোবরডাঙা হাইস্কুলে পড়ে, এই স্কুলের নাম দুটোই পৃথক করে দেয় দু'জনকে। তৈরী করে দেয় দুটো ক্লাস।দুটো জগৎ। চিহ্ণিত করে দেয় দু'জনের আর্থিক অবস্থা। ভাল স্কুলে পড়লেই ভাল রেজাল্ট, ভাল কলেজ, ভাল চাকরি। ফলে তাঁরা বলছেন, নামের পরে পিতৃ-পদবি নয়, যে যে-স্কুলে পড়ে, সেই স্কুলের নামটাই ব্যবহার করা উচিত।যেমন, কারও নাম যদি শুভঙ্কর হয়, এবং সে যদি নবনালন্দা স্কুলে পড়ে, তা হলে তাঁর নাম হওয়া উচিত শুভঙ্কর নবনালন্দা।
.......................................................................................................
আনন্দ বাজার পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা থেকে দিলাম। আশা করি জনগণের ভালোই লাগবে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:১৬
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে যেই হত্যাকান্ড শুরু হয়েছে, ইহা কয়েক বছর চলবে।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭



সামুর সামনের পাতায় এখন মহামতি ব্লগার শ্রাবনধারার ১ খানা পোষ্ট ঝুলছে; উহাতে তিনি "জুলাই বেপ্লবের" ১ জল্লাদ বেপ্লবীকে কে বা কাহারা গুলি করতে পারে, সেটার উপর উনার অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকার হিসাবেই গর্ববোধ করবেন মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৮


একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা আজীবন মুক্তিযোদ্ধা নয় - হুমায়ুন আজাদের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যি হতে চলেছে। বিএনপি থেকে ৫ বার বহিস্কৃত নেতা মেজর আখতারুজ্জামান। আপাদমস্তক টাউট বাটপার একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭


ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে চাঁদগাজীর নাম দেখাচ্ছে। মুহূর্তেই আপনার দাঁত-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার মন্তব্য পড়ার আগেই আপনার মস্তিষ্ক সংকেত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×