somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লালনের গানের অর্থ: আসল লালনকে ধরতে

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লালনের গানের অর্থ জানা বের করা সহজ কাজ নয়। এর গভীর ভাব অনেক বিখ্যাত লোকের কথা বন্ধ করে দেবার জন্য যথেষ্ট। তবু চিন্তা চর্চার ভিতর দিয়ে পাঠককে এতে আগ্রহী করতে পারি কী না তার এক ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা এটা। আমি দাবি করছি না এটাই এর একমাত্র ভাল ব্যাখ্যা। নিশ্চয় অনেকে আরও ভাল ব্যাখ্যা করবেন। তর্কবিতর্ক হবে।
এটা তো কেবল শুরু মাত্র।
এখানে এটা এমন এক গান বেছে নিয়েছি যার দুলাইন পড়লে আধুনিক পাঠক মন ধর্মের বয়ান মনে করে উন্নাষিক হতে পারেন, কিন্তু আসলে তা নয়।
লালন সবসময়ই প্রচলিত ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বের মধ্যে নিজেকে বিদ্যমান রেখে ভিতর থেকে অর্থের রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়েছেন। এতে এর অন্তর্নিহিত ভাব পরিচ্ছন্ন হয়ে নতুন করে আমাদের কাছে হাজির হয়। মানুষের প্রচলিত বা বদ্ধমূল ধ্যানধারণার সাথে বাইরে থেকে সংঘাত সংঘর্ষ রাজনৈতিক দিক থেকে ইতিবাচক ফল আনে না। ফলে এই অনুমান থেকেই তাঁর চর্চা এমন।
আমি তাই তাদের ধৈর্য ধরে পড়ার পরামর্শ দিব, যেন আগেই সিদ্ধান্ত না নেই ।

লালনের মূল গান:
এলাহি আলমিন গো আল্লাহ বাদশা আলম পানাহ তুমি
তুমি ডুবাইয়া ভাসাইতে পার
ভাসায়ে কিনার দাও কারো
রাখ মার হাত তোমারো, তাইতো তোমায় ডাকি আমি।

নূহু নামে এক নবীরে, ভাসালে বিষম পাথারে
আবার তারে মেহের করে আপনি লাগাও কিনারে
জাহের আছে ত্রি-সংসারে, আমায় দয়া কর স্বামী।

নিজাম নামে (এক) বাটপাড় সে তো, পাপেতে ডুবিয়া রইত
তার মনে সুমতি দিলে, কুমতি তার গেল টলে
আউলিয়া নাম খাতায় লিখিলে, জানা গেল এই রহমী।

নবী না মানে যারা, মোয়াহেদ কাফের তারা
সেই মোয়াহেদ দায়মাল হবে, বেহিসাব দোজখে যাবে
আবার তারে খালাস দিবে,
লালন কয় মোর কী হয় জানি। ।

কেন লালনের গান ব্যাখ্যার আগ্রহ নিলাম:
লালন নিয়ে আগ্রহের বাজার এখন জমজমাট। সবাই যার যার চিন্তা, শ্রেণী অবস্হান, নিজের ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন লালনের নামে। লালনের ভাষ্কর্য বানিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কেউ দাড়িয়ে যাচ্ছেন, তো কেউ "অসাম্প্রদায়িক" শহুরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করছেন লালনের নামে, কেউ লোকধর্ম খুঁজতে নামছেন তো কেউ "ভ্যানগার্ড কমিউনিষ্টের" লালন বয়ান করছেন। বিখ্যাত লেখক সুনীল গাঙ্গুলী তো ঘোড়া চোর লালনের উপন্যাসই লিখে ফেললেন।
এসব কারবার আগেও আমরা কমবেশি দেখেছি। তখন লালন ছিল, মরমী, লোকশিল্পী, "মানবতাবাদী", আধ্যাত্মবাদী অথবা সুফিবাদী রহস্যের মত - যার যেভাবে মনপছন্দ - অন্ধের হাতি দেখার মত তাই করে গিয়েছি। শহুরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের হাতে পরে লালন লোকচর্চা গবেষণার এমনই কাচা মালমসলা যা থেকে লালন বের হতে পারেননি; গেরাম মফস্বলের পশ্চাদপদ চিন্তার একটা প্রকাশ হিসাবে থেকে গিয়েছেন। এভাবে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে, কলকাতার বিখ্যাত সব লোকেরা লালন সম্পর্কে কী বলে গেছেন, "হিতকরী" থেকে শুরু করে বৃটিশ আমলের পত্রিকাগুলো লালন সম্পর্কে কী লেখে গিয়েছিল, ঘোষনা দিয়ে নাস্তিক-কমিউনিষ্ট আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আহমদ শরীফ লালনকে কীভাবে বুঝতে বলে গেছেন, এমনকি হালআমলের শিক্ষক আবুল ইহসান চৌধুরির বিশাল ভলিয়্যুমের লালন সংক্রান্ত সংকলন - এগুলোই একালের আমাদের আবার লালন সম্পর্কে জানার সূত্র এবং লালন সংক্রান্ত কিছু লিখে কাউকে জানাবার তথ্যসূত্র।
গভীর আগ্রহে লক্ষ্য করেছি, লালন সম্পর্কে জানতে গেলেও লালনের লেখা অর্থাৎ গান থেকে কোন উদ্ধৃতি দিয়ে তার ব্যাখ্যা করার মুরোদে এসব লেখালেখি চলছে না। সবাই লেখালেখি করছেন পরের মুখে ঝাল খেয়ে। লালন সম্পর্কে বিখ্যাত সূধীজনেরা কে কী বুঝেছেন সেই সেকেন্ডারি বয়ান নিয়ে লালনেরই নামে জমজমাট আলোচনা করছেন। কোথাও লালন নাই, তাঁর গান নাই, তাঁর চিন্তা নাই - অথচ তাঁর নামে আলোচনা চলছে। কোথাওবা তাঁর গানের পুরা একটা লাইনও না - কিছু শব্দ নিয়ে লালন সম্পর্কে তাদের বিদ্যা আলোচনা চলছে। স্বভাবতই এই দুই নম্বর পদ্ধতি আমার পছন্দ হয়নি। অনেকের কাছে আমি এই প্রশ্ন তোলাতে তাঁরা অবশ্য বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করেছেন লালনের গান ব্যাখ্যা করার সামর্থ তাঁর নাই, তাই সেকেন্ডারি, পরের মুখে ঝাল খাওয়া। সুনীল গাঙ্গুলিও অবশ্য ওপথে হাটেন নাই। তিনি "সেইসময়" এর নায়ক রচয়িতা ওটা ভাল পারেন বলে ভেবে একটা "লালনের সেইসময়" লিখে ফেলেছেন। এতে ফল হয়েছে একই, পরের মুখে ঝাল খাওয়া, স্বভাবতই এই কৃতিত্ত্ব তার "সেইসময়" এর শক্তিশালী লেখক সুনীলকে চেনার সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।

এসব ভাবনা থেকে রেহাই পেতে, আমি মনে করি, সামর্থ জোগাড়ই একমাত্র পথ। লালনের মূল গান বুঝতে চেষ্টা করা, ব্যাখ্যা করার চর্চা শুরু করা। আসলেই যদি আমাদের লালন নিয়ে কোন আগ্রহ থাকে তা একমাত্র এভাবেই পূরণ হতে পারে। লালন গরীব ও গ্রামের মানুষ বলে এই অবজ্ঞা, অবিচার আমরা করছি বটে, কিন্তু এতে লালনের চেয়ে আমাদের ক্ষতিই বেশি। তাই সকলকে আহ্বান করব লালনের মূল গানে আগ্রহী হতে। এতে ব্যাখ্যা করতে যেয়ে আমাদের হয়ত ভুল হবে, কিন্তু পরস্পরের কাছে শিখার মত বিনয় ও উদারতা যদি থাকে তবে তর্কবিতর্কের ভিতর দিয়ে আমরা একটা পথ অবশই বের করতে পারব। আমাদের আসল লালনকেই চাই।

গানের সাদামাটা অর্থ:
এলাহি যার কোন ইলাহ নাই, আলামিন সত্য, আলমের সারা দুনিয়ার বাদশা তুমি, আবার তুমিই সকলের পানাহ আশ্রয়। তুমি চাইলে কাউকে ডুবাতে পার আবার ভাসিয়ে রাখতে পারে, ভাসিয়ে বাঁচানোর জন্য তাকে নদীর কিনারও দিতে পার। রাখতে চাও মারতে চাও সবই তোমার হাতে। সেই জন্যই আমি তোমাকে তোমাকেই কেবল ডাকি, স্মরণ করি।

আমাদের নূহ্‌ নবী, নূহ্‌ নামে এক নবী ছিল তাকে অথৈ প্লাবনে ডুবিয়ে ছিলে। সব ভাসতে ভাসতে তাঁর নৌকাই কোন মতে টিকে ছিল। আবার তারে মায়া করে এক নদীর কিনারের লাগিয়ে দিলে - তিন দুনিয়াতেই একথা প্রকাশিত হয়ে আছে। তাই আমাকে দয়া কর ক্ষমতাবান, স্বামী।

[পরের লাইনে যাবার আগে, নূহ্‌ নবী কথাটার তাৎপর্য একটা কেবল পাদটিকায় দিয়ে রাখব এখন। নূহ্‌ নবী, নূহের প্লাবন বা নূহের নৌকা বলে একথা প্রচলিত। নূহ নবী প্রাণের সমগ্র জোড়া তাঁর নৌকায় সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি প্রাণ সংগ্রহ করেছিলেন প্লাবনের ধ্বংসের হাত থেকে প্রাণকে বাঁচাতে। তিনি এটা না করলে দুনিয়া আজ প্রাণ শুন্য হয়ে থাকত। তিনি মানুষের এই দায় বুঝেছিলেন, তাই তিনি নবী। তিনি ও তাঁর নৌকা প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র্যের মর্মে প্রতীকাবদ্ধ।]

নিজাম নামের এক ডাকাত ছিল, চুরি-বাটপারি তার পেশা। [গুরুত্ত্বপূর্ণ হচ্ছে ফকির লালন নূহ নবীর সাথে উদাহরণ হিসাবে একজন ডাকাতের নজির আনছেন কেন? ডাকাত মানে ডাকাতি, প্রাণ সংহার বা ধ্বংস করা যার কাজ ছিল। সেই পাপ থেকে বিরত হয়ে সে জীব রক্ষার ধর্ম প্রত্যাবর্তন করেছে।] পাপকাজে সে একেবারে ডুবে গেছিল। তুমি তাঁর মনে সুমতি এনে দিলে। ফলে তাঁর কুমতি গতি সব হেরে গেল। সে এমন ভাল হয়ে গেল যে আউলিয়া নামের খাতায় তাঁর নাম জায়গা পেয়ে গেল। তোঁমার রহমতের এই কথা সবাই জানল।
যারা নবী মানে না তারা মোয়াহেদ কাফের [মোয়াহেদ মানে যারা "পরমে অবিশ্বাসী"। কাফের অর্থ যারা সত্য লুকিয়ে রাখে।], এর দায়ভার অবশ্যই তাদের উপর বর্তাবে। দোজখের সীমাহীন আগুনে তাঁরা জ্বলবে। আবার এদের তুমিই খালাস করে দিতে পার।
আমি লালন ভাবছি, আমার যে কী হয়! কী আছে আমার কপালে!

মোয়াহেদ মানে যারা "পরমে অবিশ্বাসী"। কাফের অর্থ যারা সত্য লুকিয়ে রাখে।

যারা নবী মানে না তারা মহা কাফের, এর দায়ভার অবশ্যই তাদের উপর বর্তাবে। দোজখের সীমাহীন আগুনে তাঁরা জ্বলবে। আবার এদের তুমিই খালাস করে দিতে পার।
আমি লালন ভাবছি, আমার যে কী হয়! কী আছে আমার কপালে!

এতক্ষণ যা বর্ণনা করলাম এটা আমাদের সবারই পরিচিত, ধর্মের এক ধর্মতাত্ত্বিক বয়ান। আমি এটা গদ্য করে লেখার আগেও এটা সবাই জানেন। এখন প্রশ্ন হল, এত সহজ ধর্মতাত্ত্বিক বয়ানের একটা গান রচনা করতে লালন আগিয়ে এলেন কেন? যতদূর অনুমান করত পারি লালন ধর্মতাত্ত্বিক বয়ান দেয়ার লোক নয়। দেহ ও ভাব একাকার করে যার দেহসাধন করণ চর্চা ধর্মতাত্ত্বিক বয়ান দেয়ার কাজ তাঁর নয়। তাহলে, এ'গানের লালনের বক্তব্য কী? অন্য আর কী অর্থ কী হতে পারে? যে লালনকে আমরা "অধরা", "পড়শী", "অপর" ধারণার ভিতরে পাই লালনের সেই অর্থ ধার নিয়ে কিছু কী বের করা যাবে ? সেসবের তালাশ করব এখন। [পরের পর্ব দেখুন]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:১২
৮টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×