somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘স্বাধীন’ সিকিম ও একজন লেন্দুপ দর্জি

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লেন্দুপ দর্জি একটি আলোচিত নাম। আলোচিত চরিত্র। বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক। ভারতীয় আধিপত্যবাদের সেবাদাস। সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। ২০০২ সালে ভূষিত হন ভারতের ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে। সিকিমের রাজ্য সরকার ২০০৪ সালে ‘সিকিমরতœ’ উপাধি দিয়েছিল তাকে। এক সময়ের জনপ্রিয় এই নেতাকে দেশের মানুষ ডাকতেন কাজী সাব বলে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লিতে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। কিন্তু শেষ জীবনে ভারতের দ্বিতীয় সারির নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেও তাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছে। বেঁচে ছিলেন ১০২ বছর। দীর্ঘদিন লিভারের জটিল রোগে ভুগছিলেন তিনি। কিন্তু হার্ট আ্যাটাকে একাকী, নিঃসঙ্গ, নিন্দিত ও ভীত সন্ত্রস্ত্র এক জীবনযাপন শেষে লেন্দুপ দর্জি নীরবে মৃত্যুবরণ করেন। পুরো নাম কাজী লেন্দুপ দর্জি খাং শেরপা। জন্মেছিলেন ১৯০৪ সালের ১১ অক্টোবর পূর্ব সিকিমের পাকিয়ং এলাকায়। মারা গেছেন ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই।
৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী স্বাধীন সিকিম এখন ভারতের দ্বিতীয় ুদ্রতম রাজ্য। আয়তন সাত হাজার ৯৬ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী লোকসংখ্যা ছয় লাখ সাত হাজার জন। সিকিমের ভূ-কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এ রাজ্যের উত্তরে চীন, পশ্চিমে নেপাল, পূর্বে ভূটান ও দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং। সিকিম-তিব্বত (চীন) বাণিজ্যপথ ‘না থুলা পাস’ আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বহন করে। সামরিক গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডোর সিকিমের কাছেই। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম দিকে সিকিমের অবস্থান। ঢাকা থেকে সড়ক পথে রাজধানী গ্যাংটকের দূরত্ব ৬৫৪ কিলোমিটার। লেন্দুপ দর্জি ও সিকিম ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের বিদায়ের পর মনিপুর, ত্রিপুরা, কুচবিহারসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করে অথবা যোগদানে বাধ্য করা হয়।

বৃটিশের কাছে সিকিম স্বাধীনতার নিশ্চয়তা লাভ করেছিল
সিকিমের স্বাধীন রাজাদের বলা হত চেগওয়াল। ভারতে বৃটিশ শাসন শুরুর পুর্বে সিকিম তার পার্শ্ববর্তী নেপাল আর ভুটানের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। বৃটিশরা আসার পর তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নেপালের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সিকিম। এসময় রাজা ছিলেন নামগয়াল। কিন্তু বৃটিশরা তিব্বতে যাওয়ার জন্য এক সময় সিকিম দখল করে নেয় এবং ১৮৮৮ সালে রাজা নামগয়াল আলোচনার জন্য কলকাতা গেলে তাঁকে বন্দি করা হয়।
পরবর্তী সময়ে ১৮৯২ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয় এবং সিকিমের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়া হয়। প্রিন্স চার্লস ১৯০৫ সালে ভারত সফরে এলে সিকিমের চেগওয়ালকে রাজার সম্মান দেয়া হয়। চোগওয়ালপুত্র সিডকং টুলকুকে অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করতে পাঠানো হয়। টুলকু নামগয়াল ক্ষমতায় বসে সিকিমের ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। বৃটিশের কাছে সিকিম তার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা লাভ করেছিল।

গণভোটে সিকিমের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে রায় দেয়
চগিওয়াল (রাজা) থাসী নামগয়ালের সময়ে বৃটিশরা ভারত ছেড়ে গেলে গণভোটে সিকিমের মানুষ ভারতের বিরুদ্ধে রায় দেন এবং ভারতের পন্ডিত নেহরু সিকিমকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হন। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের পর সিকিমের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৯৬৩ সালে থাসী নামগয়াল এবং ১৯৬৪ সালে নেহরু মারা গেলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। চগিওয়াল হন পাল্ডেন থন্ডুপ নামগয়াল। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সর্বশক্তি নিয়োগ করেন সিকিমকে দখল করার জন্য। তিনি কাজে লাগান সিকিমের প্রধানমন্ত্রী কাজী লেন্দুপ দর্জিকে।

একটি স্বাধীন দেশ হত্যা করে লেন্দুপ দর্জি হলেন মুখ্যমন্ত্রী
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির সময় বৃটেন সিকিমের স্বাধীনতার প্রতি উদার নীতি অবলম্বন করে। সিকিমের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তা বজায় থাকুক বৃটেনের এ প্রত্যাশায় ঘাটতি ছিল না। সিকিমের প্রটেক্টরটের মতা ব্রিটিশ রাজ ভারতের হাতে হস্তান্তর করে। কিন্তু অখণ্ড ভারতের স্বপ্নবিলাসী নেহরু গণভোটের মাধ্যমে সিকিমের ভারত অন্তর্ভূক্তির চেষ্টা সফল হয়নি। তবে প্রটেক্টরেট হিসেবে ভারত সিকিমের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। সাংবিধানিক সরকারের আদলে চগিয়ালের ভূটানে ১৯৫৫ সালে স্টেট কাউন্সিল গঠন করে, যা ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। ১৯৭০ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি পুনর্নির্বাচন এবং নেপালি জনগোষ্ঠীর অধিকতর প্রতিনিধিত্ব দাবি করে। ১৯৭৩ সালের ভোটের ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সে আন্দোলন সরাসরি রাজতন্ত্রের পতন আন্দোলনে পরিণত হয়। যার নেপথ্যে ছিল ভারত। সিকিম জনতা কংগ্রেস এবং সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস একীভূত হয়ে এ আন্দোলন পরিচালনা করে। ১৯৬৫ সাল থেকে রাজ্য শাসনরত রাজা চগিয়াল পলডেন থনডুপ নাম গয়াল বিক্ষোভ সংঘর্ষ থামানোর জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা কামনা করেন। আধিপত্যবাদী ভারত এ সুবর্ণ সুযোগের অপোয় ছিল দীর্ঘ দিন ধরে।
সিকিমের সেদিনের সকালটা ছিল অন্যরকম। পাঁচ হাজার ভারতীয় সৈন্য নিয়ে মিলিটারি কনভয় ঢুকে পড়ে রাজধানী গ্যাংটকে। চগিয়াল পালডেন ও সিকিমবাসীর জন্য সেটাই ছিল স্বাধীন রাজ্যের শেষ দিবস।
পরে সাজানো নির্বাচন হয়। রাজতন্ত্রের পতনের পর ১৯৭৪ সালের ওই নির্বাচনে লেন্দুপ দর্জির দল ৩২টি আসনের ৩১টিতেই জয়লাভ করে। ব্রুট মেজরিটি আর কাকে বলে। এ নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেটের ওপর ভর করে লেন্দুপ দর্জি নতুন গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা পান। চগিয়াল আর লেন্দুপ দর্জির সাপে নেউলে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ভারত পৃথিবীর মানচিত্র থেকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মানচিত্র মুছে ফেলার মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগাতে এক মুহূর্তও দেরি করেনি। কাউন্সিল অব মিনিস্টারের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জির ইচ্ছায় পার্লামেন্টে বিনা বিরোধিতায় রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক অবসান করা হয়। সিকিমের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লেন্দুপ দর্জি ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করার এবং স্টেটহুড স্ট্যাটাস পরিবর্তন করার আবেদন জানান। ১৪ এপ্রিল ১৯৭৫ সিকিমে ভারতীয় সেনাদের ছত্রছায়ায় এক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। লেন্দুপের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখানো হয় সাজানো গণভোটের ফলাফলে। ২৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সিকিম ভারতের ২২তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। মৃত্যু হয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। ১৬ মে ১৯৭৫ সরকারিভাবে ভারত ইউনিয়নভূক্ত হয় এবং লেন্দুপ দর্জিকে করা হয় সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী। রাজতন্ত্রের পতনের ফলে ‘চগিয়াল’ পদের অবসান ঘটে। চীন ছাড়া অন্যান্য বেশির ভাগ জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র সিকিমের এ পরিবর্তনকে দ্রুত অনুমোদন করে। একটি স্বাধীন দেশ হত্যা করে লেন্দুপ দর্জি প্রধানমন্ত্রী থেকে হলেন মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত লেন্দুপ দর্জি সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। আর ভারতের অঙ্গীভূত হওয়ার সাথে সাথে তার দলও ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস দলে বিলীন হয়ে যায়।

সিকিম দখলে ভারতীয় সেনাদের মুহুর্মুহু গুলি
সিকিম দখলে ভারতীয় সেনারা মুহুর্মুহু গুলি চালিয়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে সামরিক ট্রাকের গর্জন শুনে সিকিমের চগিয়াল দৌঁড়ে এসে দাঁড়ান জানালার পাশে। তিনি দেখেন, ভারতীয় সৈন্যরা রাজপ্রাসাদ ঘিরে ফেলেছে। মেশিনগানের মুহুর্মুহু গুলিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাজপ্রাসাদের ১৯ বছর বয়সী প্রহরী বসন্ত কুমার ছেত্রি ভারতীয় সেনাদের গুলিতে নিহত হন। আধা ঘণ্টার অপারেশনেই ২৪৩ প্রহরী আত্মসমর্পণ করে। বেলা পৌনে ১টার মধ্যেই অপারেশন সিকিম সমাপ্ত হয়। প্রহরীদের কাছে যে অস্ত্র ছিল তা দিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সময় লড়াই করা যেত। কিন্তু রাজা ভুগছিলেন সিদ্ধান্তহীনতায়। তিনি আরেকটি সুযোগ হারালেন। রাজাপ্রসাদে ট্রান্সমিটার বসানো ছিল, যাতে বেইজিং ও ইসলামাবাদের কাছে তিনি জরুরি সাহায্য চাইতে পারেন। সে ক্ষেত্রে চীনা সৈন্যরা প্রয়োজনে সিকিমে ঢুকে চগিয়াল লামডেনকে উদ্ধার করতে পারত। কিন্তু রাজা সেটাও করতে ব্যর্থ হন। আত্মসমর্পণকারী রাজপ্রহরীদের ভারতীয় সেনাদের ট্রাকে তোলা হয়। প্রহরীরা তখনো গাইছিল ‘ডেলা সিল লাই গি, গ্যাং চাংকা সিবো’ (আমার প্রিয় মাতৃভূমি ফুলের মতো ফুটে থাকুক)। কিন্তু ততক্ষণে সিকিমের রাজপ্রাসাদে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে ভারতীয় জাতীয় পতাকা। নামগিয়াল সাম্রাজ্যের ১২তম রাজা চগিয়াল লামডেন তখন প্রাসাদে বন্দি। চগিয়াল ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে করম চাঁদ গান্ধী ও জওহর লাল নেহরুর প্রতি ছিলেন খুবই শ্রদ্ধাশীল।

১৯৭১ সালেই সিকিম দখলের সিদ্ধান্ত ছিল ভারতের
চমকপ্রদ একটি বিষয় হলো সিকিম সেনাবাহিনীকে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতীয় সাংবাদিক সুধীর শর্মা ‘পেইন অব লুজিং এ নেশন’ (একটি জাতির হারিয়ে যাওয়ার বেদনা) নামে একটি প্রতিবেদনে জানান, ভারত তার স্বাধীনতার গোড়া থেকেই সিকিম দখলের পরিকল্পনা করেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু অনেকের সাথে কথোপকথনে তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাবেক পরিচালক অশোক রায়না তার বই ‘ইনসাইড স্টোরি অব ইন্ডিয়াস সিক্রেট সার্ভিস’-এ সিকিম সম্পর্কে লিখেন, ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৯৭১ সালেই সিকিম দখল করবে। সে লক্ষ্যে সিকিমে প্রয়োজনীয় অবস্থা সৃষ্টির জন্য আন্দোলন, হত্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। তারা ছোট ছোট ইস্যুকে বড় করার চেষ্টা করে এবং সফল হয়। তার মধ্যে হিন্দু-নেপালী ইস্যু অন্যতম। সাংবাদিক সুধীর শর্মা লিখেন, লেন্দুপ দর্জি নিজেই শর্মাকে বলেছেন, ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর লোকেরা বছরে দু’তিনবার তার সাথে দেখা করে পরামর্শ দিত কিভাবে আন্দোলন পরিচালনা করা যাবে। তাদের একজন অ্যাজেন্ট তেজপাল সেন ব্যক্তিগতভাবে তাকে অর্থ দিয়ে যেতো এ আন্দোলন পরিচালনার জন্য। এ অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস পরিচালিত হতো।’ শর্মা আরো লিখেছেন, এই ‘সিকিম মিশনের’ প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা, যা সর্বত্র ‘র’ নামে পরিচিত।

সিকিমের ঘটনা বিশ্বকে জানান এক মার্কিন পর্বতারোহী
নেহেরু প্রভাবিত সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসকে লেন্দুপ দর্জি ব্যবহার করে অরাজকতা সৃষ্টি করেন। রাজপ্রাসাদের সামনে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে ইন্দিরা সরকার রাজার নিরাপত্তার কথা বলে ভারতীয় বাহিনী পাঠায়। কিন্তু তারা রাজাকে গৃহবন্দি করে। বহির্বিশ্বের সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং বিএস দাশকে ভারত সরকার সিকিমের প্রধান প্রশাসক নিয়োগ করে। এই সময় আমেরিকান এক পর্বতারোহী গোপনে সিকিম প্রবেশ করেন এবং সিকিমের স্বাধীনতা হরণের খবর বিশ্বের নিকট তুলে ধরেন। কিন্তু ততণে অনেক দেরি হয়ে যায়। সিকিম জাতিসংঘের সদস্য পদভূক্তিরও প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

দ্বৈত খেলা খেলেছে ভারত
ভারত সিকিমের ক্ষেত্রে দ্বৈত খেলা খেলেছে। এক দিকে চগিয়াল লামডেনকে বলেছে, সিকিমে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হ্েব। অপরদিকে লেন্দুপ দর্জিকে বলেছে যেকোনো মূল্যে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করতে হবে। চগিয়ালকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনারারি মেজর জেনারেল পদবিও প্রদান করা হয়েছিল।

চীন, নেপাল ও পাকিস্তানের পরামর্শে কান দেননি চগিয়াল
ভারত অন্তর্ভূক্তির সময় সিকিমে কর্মরত তৎকালীন ভারতীয় দূত (পলিটিক্যাল অফিসার) বিএস দাস তার গ্রন্থ ‘ঞযব ঝরশশরস ঝধমধ’ এ লিখেছেন, ভারতের জাতীয় স্বার্থেই সিকিমের অন্তর্ভূুক্তি প্রয়োজন ছিল। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করেছি। চগিয়াল যদি বিচক্ষণ হতেন এবং তার কার্ডগুলো ভালোভাবে খেলতে পারতেন, তাহলে ঘটনা যেভাবে ঘটেছে তা না হয়ে ভিন্ন কিছু হতে পারতো।
চীন, নেপাল ও পাকিস্তানের পরামর্শে কান দেননি সিকিমের চগিয়াল। ১৯৭৪ সালে যখন সিকিমে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা চগিয়াল তখন কাঠমান্ডু গিয়েছিলেন নেপালের রাজা বীরেন্দ্রর অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রাজা বীরেন্দ্র, সফররত চীনা উপপ্রধানমন্ত্রী চেন লাই ইয়ান এবং পাকিস্তানি দূত চগিয়ালকে সিকিমে না ফিরতে পরামর্শ দেন। ক্যাপ্টেন সোনাম এ প্রসঙ্গে বলেন, এই তিন দেশের নেতৃবৃন্দ সিকিমকে ভারতীয় আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে একটি মাস্টার প্ল্যান উপস্থাপন করেন। কিন্তু চগিয়াল লামদেন তাতে সম্মতি দেননি। এর কারণ তিনি নাকি স্বপ্নেও ভাবেননি, ভারত সিকিম দখল করে নিতে পারে।

চীন সীমান্তে ৩ স্বাধীন রাষ্ট্র নয়াদিল্লির জন্য অস্বস্তিকর ছিল
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও ১৯৭৪ সালে ভারতের পারমাণবিক বোমার সফল বিস্ফোরণ ইন্দিরা গান্ধীর আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কংগ্রেস নেত্রী নয়াদিল্লিতে তার ক্ষমতাকে সুসংহত করেন। নয়াদিল্লি উদ্বিগ্ন ছিল সিকিমের স্বাধীন সত্তার বিকাশ নিয়ে। ভুটানের পথ ধরে সিকিম যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে ফেলত, তাহলে তা হতো নয়াদিল্লির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বড় রকম বাধা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীন সীমান্তে তিন হিমালয়ান স্বাধীন রাজ্য নেপাল, সিকিম ও ভুটান গায়ে গা লাগিয়ে অবস্থান করুক এটাও কৌশলগত কারণে দিল্লি নিরাপদ মনে করেনি।

লেন্দুপ দর্জির শেষ জীবন ছিল অভিশপ্তের
ভারতে যোগদানের পর লেন্দুপ দর্জি হন সিকিমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। রাজনৈতিক হাওয়া উল্টা দিকে বইতে থাকে। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে এ লেন্দুপ দর্জির এসএনসি একটি আসনও পায়নি। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে লেন্দুপ দর্জি দেখেন ভোটার তালিকায় তার নামটিও নেই। নেপথ্য শক্তি তার রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি টেনে দেয়।
সমকালীন ইতিহাসে সমালোচকদের কাছে লেন্দুপ দর্জি একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত। তার সমর্থকেরাও পরবর্তী সময়ে তাকে ত্যাগ করেন। ১৯৯৬ সালে কালিমপংয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসিত জীবন লেন্দুপ দর্জি দুঃখ করে বলেছিলেন, সবাই আমার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলছে, আমি নাকি নিজের মাতৃভূমি সিকিমকে বিক্রি করে দিয়েছি। তা যদি সত্যও হয় সে জন্য কি আমি একাই দায়ী?’ কিন্তু এই অভিযোগ এতই গুরুতর ছিল যে, লেন্দুপ দর্জি আর কখনোই সিকিমে সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে যেতে পারেননি। চাকুং হাউজে আমৃত্যু তাকে নিঃসঙ্গ দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয়। তার মৃত্যু সিকিমবাসীর মনেও কোনো সহানুভূতি বা বেদনার উদ্রেক করতে পারেনি।
লেন্দুপ দর্জি মনে করতেন কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দিল্লি তাকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তার আক্ষেপভরা মন্তব্য, ‘সিকিমকে ভারতের হাতে তুলে দিতে হেন চেষ্টা নেই যা আমি করিনি। কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর নয়দিল্লি আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে।’ সাপ্তাহিক জন আস্থা পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে লেন্দুপ দর্জি বলেন, ‘আগে নয়াদিল্লিতে আমাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করা হতো। এখন ভারতের দ্বিতীয় সারির নেতাদের সাথে সাাৎ করতেও আমাকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপো করতে হয়।

ভারতে অন্তর্ভূক্তি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত
ভারতের সিকিম দখলের বিরুদ্ধে চীন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সিকিমের রাজপথে কোনো গণপ্রতিরোধ দেখা যায়নি। তাই বেইজিংয়ের ভূমিকা সীমিত ছিল জাতিসঙ্ঘে প্রতিক্রিয়া জানানোর মধ্যেই। ১৯৭৭ সালে ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর টানা ১১ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ১৯৭৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সিকিম সম্পর্কে মুখ খোলেন। তার মতে, সিকিমের ভারতে অন্তর্ভূক্তি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। এমনকি সিকিমের যেসব রাজনৈতিক নেতা ভারতে যোগদানের পক্ষে কাজ করেছিলেন, তারাও বলেছেন এটা ছিল ঐতিহাসিক ভুল। কিন্তু তত দিনে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে।

ভারতের নেতৃবৃন্দ বরাবরই অখণ্ড ভারত গড়ার স্বপ্নে বিভোর
ভারতের নেতৃবৃন্দ বরাবরই অখণ্ড ভারত গড়ার স্বপ্নে বিভোর। আর সে ল্েয ভারত চায় এর প্রতিবেশী দেশগুলোকে নানাভাবে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে সেখানে লেন্দুপ দর্জির মতো তাঁবেদার সরকার বসিয়ে দেশটিকে ভারতের সাথে একীভূত করে নিতে। সিকিম তার বড় প্রমাণ। ভারতের প্রতিটি প্রতিবেশী দেশের মানুষকে এ অন্তর্নিহিত সত্যটি উপলব্ধিতে রেখে দেশ পরিচালনা করতে হবে। নইলে বিপর্যয় অবধারিত।

বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ‘সিকিমফোবিয়া’ কাজ করছে প্রবলভাবে
সিকিমের মত ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটতে পারে। কারণ, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের প্রতিরক্ষা ভারত দিনের পর দিন জোরদার করছে। এই কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশের সাথে যুক্ত সীমান্ত আউট পোস্টগুলোর (বিওপি) একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ৪-৫ কিলোমিটারে নিয়ে আসা হচ্ছে। এগুলোতে বিএসএফ-এর শক্তিও বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
বিএসএফ এই সীমান্তে থারমাল নাইটভিশন ডিভাইস, টেলিস্কোপিক বন্দুকসহ উচ্চমানের হাতিয়ার মোতায়েন রেখেছে। এই সাথে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার এলাকাকে কাঁটাতারের বেড়াসহ ফাড লাইটের আওতায় আনার এবং প্রশিক্ষিত কুকুর মোতায়েন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে অনেকটা এগিয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তের অধিকাংশ এলাকা ফাড লাইটের আওতায় আনা ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
১৯৭৪ সালের ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো প্রতিরক্ষা কাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও ভারত মানছে না। বলাবাহুল্য, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও সড়ক তৈরি প্রতিরক্ষা কাজের মধ্যেই পড়ে। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত দু’দেশের বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হলেও তা কোনো ফল দেয়নি। ভারতের বর্তমান প্রস্তুতি অনুযায়ী সীমান্ত সড়ক দিয়ে অনায়াসে সমর যানবাহন চলাচল করতে পারবে। এর ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভারত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও জোরদার করতে পারবে।
ভারতের বর্ডার আউট পোস্ট-বিওপি’র সংখ্যা পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এগুলোতে মোতায়েন জওয়ানের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে বলে জানা গেছে। একারণেই বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে ‘সিকিমফোবিয়া’ কাজ করছে প্রবলভাবে। ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অবিশ্বাসের অন্যতম কারণ হলো বাংলাদেশও সিকিমের পরিণতি বরণ করে কিনা।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×