বনের মধ্যে আপনমনে একটি মানুষ হাঁটতেছিলো
কাঠুরে কাঠ কাটতেছিলো
আসা-যাওয়ায় কাটতেছিলো
তার ভিতর অন্য মানুষ আপনমনে হাঁটতেছিলো
আমায় ভালোবাসতেছিল, ভীষণ ভালোবাসতেছিল।।
– শক্তি চট্টোপাধ্যায়
****************************************
সাদা রাত্রি :
'দিনের মধ্যে একটা সময় আছে, যা বিশেষভাবে প্রিয়, নাসতিয়েনকা। এটা সেই মুহূর্ত যখন অধিকাংশ কাজ, দায়িত্ব, কর্তব্য সম্পন্ন হয়েছে। সকলে বাড়ির দিকে ছুটছে রাতের খাবারের জন্য, যখন সবাই ছুটছে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য, বাড়ি ফিরতে ফিরতে যেমনটি পরিকল্পনা করছে, সেইভাবে সন্ধ্যাটি, রাতটি এবং অবসরের বাকি সময়টুকু বিভিন্ন রকম আনন্দময় কাজের মধ্যে কাটাবে বলে সকলে বাড়ির দিকে ছুটছে। সেই সময় আমাদের নায়কটিও নাসতিয়েনকা, গল্পটি আমাকে নিশ্চয়ই তৃতীয় পুরুষে বলার অনুমতি দেবেন। কারণ, তা উত্তম পুরুষে বলতে আমার ভয়ানক লজ্জা বোধ হচ্ছে। হ্যাঁ, আমাদের নায়কটি, যার দিন কোনোভাবেই অকর্মা অলস দিন নয়, অন্য যেকোনো জনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলে যায়। কিন্তু তার বিবর্ণ এবং কিছুটা ক্লান্ত মুখমন্ডলখানি আনন্দের এক কৌতূহলময় প্রকাশভঙ্গিতে দীপ্ত হয়ে ওঠে। সে লক্ষ করে, অন্যমনস্কভাবে নয়, সূর্যটা পিতেরবুর্গের ঠান্ডা আকাশে ধীরে ধীরে অস্ত য্চ্ছে। কিন্তু যখন বলছি যে, সে লক্ষ করে তখন আমার বলাটা মিথ্যা বলা হয়; সে লক্ষ করে না, সে তা আনমনে অবলোকন করে, যেন বা সে অন্য কোনো কিছুতে ক্লান্ত ও নিমগ্ন হয়ে আছে, অন্য অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কেনে কিছুতে, তাই তার চারপাশের জগতের জন্য যা সে খরচ করতে পারে তা হলো একটা হালকা, অমনোযোগী মুহূর্ত। সে আনন্দিত, কারণ আগামীকাল পর্যন্ত তার যন্ত্রণার অবসান হয়েছে এবং একটি স্কুল-বালকের মতো সে উল্লসিত, যে-বালক তার স্কুলঘর ছেড়ে চলে গিয়ে তার প্রিয় খেলা আর যতসব দুষ্টুমি করার সুযোগ পেয়েছে। একবার তার দিকে তাকান, নাসতিয়েনকা, সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাবেন, সে তার দুর্বল স্নায়ুতন্ত্রে এবং পীড়িত কল্পনায় কী আহ্লাদ উপভোগ করছে। এখন সে তার স্বপ্নলোকে হারিয়ে গেছে। আপনি কি ভাবছেন যে, সে তার রাতের খাবারের কথা ভেবে এত আনন্দিত? অথবা সন্ধ্যার আনন্দ-ফুর্তির কথা ভেবে? কিসের প্রতি সে এমন করে তাকিয়ে আছে? ওই জবরদস্ত চেহারার ভদ্ররোকের দিকে, যিনি প্রায় উড়ে চলা ঘোড়াগাড়িতে বসা মহিলাটির দিকে ছবির মতো শরীর ও মাথা নুয়ে আছেন? না নাসতিয়েনকা, তার কাছে এইসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসের কী অর্থই বা আছে এখন? এখন সে তার অদ্ভুত জগতের জমিদার, এইসব সমৃদ্ধির মধ্যে সে এসেছে সম্পূর্ণ হঠাৎ করে, অস্তগামী সূর্যের অপসৃয়মান রশ্মি বৃথাই তার সামনে এমন উল্লসিত হয়ে জ্বলে উঠে তার হৃদয়কে উষ্ম করে তোলে নি, রাশি রাশি কল্পনা জাগিয়ে তোলে নি। সে প্রায় লক্ষই করে নি যে, রাস্তায় যে কোনো তুচ্ছ জিনিসের আঘাতে সে আহত হতে পারত। কেননা, 'কল্পনার দেবী' ( যদি আপনি ঝুকোফস্কি পড়ে থাকেন, নাসতিয়েনকা ) ইতিমধ্যেই খেয়ালীর মতো তাঁর তাঁতে সোনালী সুতোরাশি ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং তার জন্য স্বপ্নরাশির একটা ঊর্ণাজাল বুর্নতে শুরু করে দিয়েছেন। একটা কল্পিত রুপকথার জীবনের স্বপ্নরাশি; এবং কে জানে হয়ত তিনি তাঁর যাদুর হাতে যে চমৎকার গ্র্যানাইটের ফুটপাত দিয়ে সে ঘরের দিকে চলছিল সেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে সপ্তম স্ফটিক স্বর্গে ফেলেছেন। যদি তাকে থামিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করা হয়, সে কোথায় এবং কোন রাস্তায় হাঁটছে, সম্ভবত সে স্মরণ করতে পারবে না সে কোথায় গিয়েছিল এবং কোথায়ই বা অবস্থান করছে এবং সেজন্য অস্বস্তিতে আরক্তিম হয়ে মান রক্ষার জন্য নির্ঘাত একটা গল্প ফেঁদে বসবে। তাই, এক অত্যন্ত মানী বৃদ্ধমহিলা যখন ফুটপাতের মাঝখানে নম্রভারে তাকে থামিয়ে পথ দেখাবার অনুরোধ করছিলেন, তখন সে চমকে গিয়ে প্রায় চিৎকার করেই উঠেছিল। বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে এগিয়ে গিয়েছিল। প্রায় জানতেই পারে নি যে পথিকেরা তার এই আচরণ দেখে হাসছে এবং তাকে দেখবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে; অথবা সে জানতেই পারে নি যে, একটা ছোট্ট মেয়ে তাকে অতিক্রম করে চলে গিয়েছিল এবং তার প্রশন্ত নিমগ্ন হাসি ও হাত নাড়ানো দেখে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। কিন্তু তারপর সেই কল্পনার দেবী বৃদ্ধা মহিলাটিকে তুলে নিয়ে যায়, কৌতূহলী পথচারীদের, খিলখিল হাস্যরত ছোট্ট মেয়েটিকে আর যেসব নৌকাচালক ইতিমধ্যে তাদের রাতের ভোজনপর্ব ফনতাকার ওই নদীতে বসে সম্পন্ন করে ফেলেছে, তাদেরকে ( অথাৎ আমাদের নায়কটি ওই সময় ফনতাকার নামক স্থানটি অতিক্রম করছিল ) তুলে নিয়ে যায়। কল্পনার সেই দেবী দুষ্টামী করে সবাইকে এবং সবকিছুকে তার সোনালী ট্যাপেস্ট্রিতে দোলাতে থাকে, তারপর যেমন করে মাকড়সার জালের মধ্যে মাছি আর ফড়িং-এর দল আটকা পড়ে দুলতে থাকে, তারপর সেই অদ্ভুত মানুষ তার আনন্দময় উৎফুল্ল এক নতুন সমৃদ্ধিময় স্তরে প্রবেশ করে; সে উঠে বসে, রাতের খাবার খায় এবং কেবল তখনই সে তার স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে, যখন তার বিষণ্ন আর চিরদুঃখী পরিচারিকা মাত্রিওনা টেবিলটা পরিষ্কার করার পর তার সামনে পাইপটা এনে ধরে। সে ওঠে এবং সবিস্ময়ে তার স্মরণ হয়যে সে ইতোমধ্যে রাতের আহার সম্পন্ন করেছে পুরোপুরি নিজের অজান্তেই। তখন ঘরটা অন্ধকার হয়ে আসে, শূন্যতা আর দুঃখবোধ তার হৃদয়কে পূর্ণ করে তোলে; তার চতুষ্পার্শ্বে কল্পনার সমগ্র জগৎটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, বিনা আঘাতে, সম্পূর্ণ নিঃশব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে, ধুলোয় পর্যবসিত হয়ে যায়, যেন একটা স্বপ্ন ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেল, কিন্তু সে মোটেই টের পায় না, স্মরণ হয় না তার, কিসের স্বপ্ন দেখছিল সে। কিন্তু তখন একটা দুর্বোধ্য অনুভূতি, এক নতুন আকাঙ্ক্ষা তার হৃদয়কে স্পন্দিত করে এবং একটু বেদনা জাগায়; সেই নতুন আকাঙ্ক্ষা উত্তেজনাময়, ক্রমশ ইন্দ্রিয়াতীতভাবে তার কল্পনারকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে, বেগবান করে তোলে, অজস্র অলীক ছায়ামূর্তিকে ডেকে আনে...ছোট্ট ঘরটিতে তখন নৈঃশব্দ্যের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়; অবসাদ আর নির্জনতার মধ্যে তার কল্পনা খেলা করে, কিন্তু আবার যখন পাশের দরজায় রান্নাঘরে মাত্রিওনার ব্যস্ততা শুরু হয়, জগতের সবকিছু ভুলে গিয়ে যখন সে কফি তৈরি শুরু করে তখন তার কল্পন আবার দপ করে জ্বলে ওঠে, বুড়ি মাত্রিওনার কফিপাত্রের জল ফুলে ফেঁপে যেমন হয়, তেমনি দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। ছোট ছোট অগ্নিশিখার মধ্যে তার কল্পনাগুলো ভেঙে ভেঙে যায়, আর লক্ষ্যহীনভাবে গতানুগতিক হাতে তুলে নেয়া বইটার একটি কি দুটি পৃষ্ঠা পড়া হতেই তা আমার স্বপ্নচারীর হাত থেকে খসে পড়ে যায়। আবার চাড়া দিয়ে ওঠে কল্পনা, আবার সুর সৃষ্ঠি হয় এবং অকস্মাৎ এক নতুন মোহনীয় জগৎ তার সকল চোখ ধাঁধানো সম্ভাব্যতা নিয়ে তার মনের মধ্যে জ্বলে ওঠ। এক নতুন স্বপ্ন, একটা নতুন সুখ ! গরলের এক নতুন মাত্রা, নিগূঢ় এবং ইন্দ্রিয়ঘন। আমাদের সত্য জীবনে কী এসে যায় তার! …........
….......হয়ত শুধাবেন, কিসের স্বপ্ন দেখে সে? কেন এ প্রশ্ন? সবকিছুর স্বপ্নই দেখে সে। কবি হবার, প্রথমে খ্যাতি না পেলেও পরে বিজয়মুকুটে শোভিত হবার, হোফমানের বন্ধু হবার, সেন্ট বার্থোলোমিউ-এর রাতের, দিয়ানা ভেরননের, জার ইভানের কাজান বিজয় অভিযানে এক বীরের ভূমিকা পালনের, ক্লারা মাউব্রে'র, ইফি ডিনসের, কাউন্সিল অব প্রিলেটস-এর সামনে হুসের, রবার্ট ডি ডেভিলে ( মনে আছে সেই সঙ্গীত? গোরস্থানের সেই গন্ধ ) সেই মৃতের পুনরুজ্জীবনের, মিন্না ও ব্রেড্নার, বেরেজনিয়ার লড়াইয়ের, কাউন্টেস ভিডি'র সভায় কবিতা পড়ার, দাঁতঁর, ক্লিওপেট্রা ei suoi amanti'র, কলোমনায় একটা ছোট্ট বাড়ির-সব, সবকিছুর স্বপ্নই সে দেখে। তার একান্ত আপনার একটি গৃহকোণ এবং পাশে প্রিয়জনের স্বপ্ন, যে-প্রিয়জন, এখন ঠিক আপনি যেমন আমার কথা শুনচ্ছেন, তেমনি করে শীতের রাতে তার পাশে বসে এইভাবে চোখদু'টি বড় বড় করে প্রসারিত ঠোঁট মেলে তার কথা শুনবে। না নাসতিয়েনকা, না, আপনি-আমি যে-জীবনের স্বাদ পেতে এত উদ্বিগ্ন তার জন্য সেই ভোগবালাসী অলস কোনো মাথাব্যথা নেই। সে মনে করে এমন জীবন নগণ্য, হীন একটা জীবন, এমন পতিত জীবনকে সে নিজের জন্য জানতে চায় না, পারে না। তবু একদিন দুঃখের সাথে ঘণ্টাটি বেজে উঠতে পারে যখন সে হীন জীবনের একটা মুহূর্তের জন্য তার কল্পনার সবগুলো বছর দিয়ে দিতে পারে, কিন্তু আনন্দ বা সুখের বিনিময় করতে নয়, এমনকি দুঃখ, অনুশোচনা ওঅপ্রতিরোধ্য বেদনার সেই লগ্নে সে কিছুই পছন্দ করতে চাইবে না। সেই ভয়ংকর ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত সে কিছুই আকাঙ্ক্ষা করে না। কারণ, সে আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে, ইতোমধ্যে সবকিছু পাওয়া হয়ে গেছে তার। সে সম্পর্ণরুপে পরিতৃপ্ত, কারণ সে নিজেই নিজের স্রষ্টা, এমন এক নতুন জগৎ সে নির্মাণ করে নিয়েছে যেখানে সে যে-কোনো নতুন ইচ্ছার আহ্বানে সাড়া দিতে সক্ষম...................
.......নাটকীয়ভাবে আমি বিরতি টানলাম, আমার নাটকীয় কাহিনীটি শেষ হয়ে এসেছে। আমার মনে পড়ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমি হেসে ওঠার জন্য কি কঠিন চেষ্টাই না করেছিলাম কারণ ইতিমধ্যেই আমি টের পাচ্ছিলাম আমার হৃদয়ে একটা বারুপ ক্ষুদে শয়তান জেগে উঠেছিল। আমার নিঃশ্বাস আটকে গেল গলায়, চিবুক কাঁপতে শুরু করল এবং চোখ দু'টি ঘুরপাক খেতে লাগল। আমার ভয় হল, যে-নাসতিয়েনকা তার বুদ্ধিমান চোখ দু'টি বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আমার কথা শুনছে- সে হয়তো তার স্বতঃস্ফুর্ত শিশুসুলভ অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে। আর আমার দুঃখ বোধ হল এই ভেবে যে, আমি অনেক দুর পর্যন্ত বলে ফেলেছি, অযাথাই আমি তাকে সেই কথা বলেছি যা আমার হৃদয়ে অতিরিক্ত ভার হয়ে চিপে রয়েছে, যা আমি মুখস্থ করা একটা অধ্যায়ের মতো আবৃত্তি করতে পারি। কারণ, আমি অনেকদিন আগে নিজের জন্য একটা রায় তৈরি করেছি এবং আমি তাকে তা পড়ে শোনানোর মনস্থ করেছি, যদিও আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে, আমাকে সে বুঝতে পারবে বলে আমি আশা করি নি। কিন্তু অবাক ব্যপার, সে নীরব রইল, হাসল না এবং একটু পরে নম্রভাবে আমার হাতে চাপ দিয়ে একটা নরম আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করল; 'আপনি কি সতি্য আপনার সারা জীবন এইভাবে কাটিয়েছেন?'
উত্তরে আমি বললাম, 'সারা জীবন নাসতিয়েনকা, আমার সারা জীবন। এবং মনে হয় শেষ দিন পর্যন্ত আমার এভাবেই কাটবে।'........
বি. দ্র.
♦ আমার এই পোষ্টগুলো সাদা রাত- ফিওদর দস্তইয়েফস্কির বইয়ের ধারাবাহিক প্রকাশনা নয়। আমার খেয়ালি মনে যায় ভালো লাগছে তা শেয়ার করা।
♦ অনুবাদক হচ্ছেন মশিউল আলাম। সাংবাদিকতায় এম.এ ( প্যাট্রিস লুমুম্বা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া )
*******************************************
এবং গান :
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:৫২