অনেকদিন পর দেখা। চেহারায় সেই লাবণ্য আর নেই। চামড়ায় ভাজ পড়েছে, চুলে পাক ধরছে, চোখের নিচে কালি। পরিশ্রমের ছাপটাও হালকা হয়ে গেছে, মনেহয় ভেতর থেকে ভেঙ্গে পড়েছে। এতদিন পর হটাৎ কী মনেকরে ডেকে পাঠালো! কাছে যেতেই মৃদু হেসে বলল-
: তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না!
আমার হাড্ডিসার শরীরে মাংস জমেছে, ভুঁড়ি বেড়িয়েছে। মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে চিনতে পারি না। ভুঁড়ি নাকি সুখের প্রতীক! সে দিকেই ইঙ্গিত করলো কি! আমি হাসি ফেরত দিয়ে বললাম-
: আপনাকেও।
জিঙ্গেস করল-
: কেমন আছো?
বললাম-
: ভালো, আপনি?
: চলছে..
: অনেকদিন পর, হটাৎ?
: মনেহল।
: মনে রেখেছিলেন তাহলে?
: রেখে- দিয়েছিলাম।
আমি মৃদু হেসে বললাম-
: বুড়িয়ে গেছেন।
উনি মুখটা সরিয়ে নিলেন-
: চলো ঐ টেবিলটাই বসি।
দুজনে কফি শপে মুখোমুখি। কফি শপ ভীষণ ব্যাস্ত। কে জানে! কত গল্প জমছে?
: কী করছো?
: ছোটখাটো একটা ব্যবসা, অনলাইনে চালাই।
: কীসের?
: টি-শার্ট।
: সেই টিশার্টের টা শেষ পর্যন্ত করলেই তাহলে?
: হ্যা।
: শুধু আমাকেই আর পার্টনার করলে না।
অনুযোগের কোন প্রতি উত্তর করলাম না। একটু পর আবার বলল-
: বিয়ে করেছো?
: হুম।
: বউ, সুন্দরী?
: আপনার মত না।
উনি কথা ঘুরিয়ে বললেন-
: কী খাবে? কফি দিতে বলি?
: ঠীক আছে।
: এদের কফি খুব ভালো।
দু পাশেই স্তব্ধতা, নিরবতা কাটার শব্দ খুজে পাচ্ছি না।
: আপনি কিছু শুরু করেছেন?
: নাহ..। ভাঙনের কপাল, পার বাধে না।
: আপনার সেই জুসের দোকানটা, কী হল?
: তুমিও থাকলে না, চালাতে পারলাম না।
: আপনার ফ্যামিলির ঝামেলা মিটেছে? মা'র সাথে কথা হয়?
: মা, মারা গেছে।
সান্তনার বাক্য আমি দিতে পারি না, আমার আসেই না। আমি এড়িয়ে গেলাম।
: ভাই? দেখা হয়? যোগাযোগ আছে?
: আছে, ভালোয় আছে। আমি খবর রাখি।
: আপনার গল্প কিন্তু বললেন না!
: কীসের গল্প?
: অতীতের, আপনার বাবার মৃত্যুর কারণ?
: অনেকদিন পর দেখা, সুখের গল্প বলো।
: এখোনো সেই হোস্টেলেই আছেন?
: হ্যা।
: কিছু ভেবেছেন?
: কীসের?
: বেলা তো ফুরিয়ে এলো, এরপর কী করবেন? চলবে কীভাবে?
: তুমি পার্টনার করে নাও। আমাদের তো হবার কথা ছিলো।
: অনলাইনে চালাই, কাগজ-পত্র কিছু নাই। বিশ্বাস করতে পারবেন?
: তোমাকে বিশ্বাস করে সব দিতে পারি।
: হাত চেয়েছিলাম, ভরসা পাননি।
: ছিঃ, আমাদের হাত কী ধরতে আছে।
মুখোমুখি নিরবতা বড় অসহ্যকর।
: আমাকে উঠতে হবে?
: এখন-ই চলে যাবে?
: হ্যা, রাতের বাসেই ফিরতে হবে।
: বউ বলে দিয়েছে?
আমি কিছুই বললাম না, চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম। একটু পর নিজে থেকেই বললেন-
: ভালোবাসো?
আমি এরও কোন জবাব দিলাম না, বাসি কি? যাকে বুকে রেখেছিলাম সে আজ পড়ন্ত সময়ে চোখের সামনে। যে ঘরে আছে? সে বুকে আছে কি!
: ঠিক আছে চলো উঠি।
: আপনাকে পৌছে দেই?
: দরকার হবে না, যেতে পারব।
: আপনার আস্তানা চিনে আসি।
: লাভ কী?
: আমি নিশ্চুপ।
: আর কী দেখা হবে?
: কথা তো হবেই, আমরা তো পার্টনার হচ্ছি।
উঠতে গিয়ে হোচট খেল, আমি বললাম-
: একী....
উনি নিজেকে সামলিয়ে বললেন-
: ঠীক আছি।
: হাতটা ধরবো?
: না।
এত দৃঢ় ভাবে বললেন, যে থমকে গেলাম। আচ্ছা- জীবনের কালো অধ্যায়ের কালী গুলো কি শরীরে লেগে থাকে?
_কথোপকথন
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:১৬