সব শিল্পেরই কিছু নিয়ম আছে, যেমন কবিতার ছন্দ আছে, গানের সুর আছে (সারগাম)। তেমনি মুভির ও কিছু রুলস আছে। কিন্তু শিল্প তো কোন নিয়মে বাঁধা থাকে না, বিষয়টা এই রকম 'রুলস দিয়েই আপনাকে রুলস ভাঙ্গতে হবে।'
সব শিল্পের মাঝেই গল্প আছে, আপনি যদি চেষ্টাও করেন গল্প ছাড়া কোন শিল্প করতে, পারবেন না। গল্প অটোমেটিক তৈরী হয়ে যাবে, নয়তো ওটা কোন শিল্প হবে না। শিল্পটা গল্প না, গল্প প্রকাশের মাধ্যম।
প্রকাশ ভঙ্গি যত ভালো, শিল্প তত উন্নত, গল্প না। চিলড্রেন অফ হ্যাভেন নামে একটা মুভি আছে। আহামরি কোন গল্প না, তবুও সেটা অসাধারণ একটা শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
রেহানা মরিয়ম নূর এই জায়গায় সফল। এই মুভির বিরুদ্ধে যে তিনটা সব চেয়ে বড় দোষ ধরা হয়, তার মধ্যে একটা, সমস্ত ফিল্মটা নীল কালারের। সম্ভবত বিষাদের রং নীল হিসাবে ধরা হয়। এছাড়া মুভির ডিরেক্টর নিজেই এর ব্যাখা দিয়েছেন। আমি উনার থেকে ভালো বলতে পারবো না, যেহেতু উনি নিজেই ফিল্মটা বানিয়েছেন। আমি বাকি দুইটা নিয়ে বলি, এর মধ্যে একটা ক্যামেরা শেক (সমস্ত মুভিটাতেই ক্যামেরা কেঁপেছে), আর একটা জাম্প কাট (কখন কোথায় সিন কাটা হয়েছে ঠিক নাই)।
এই দুইটা রুলসই সাধারণত ব্যাবহার করা হয় কোন মারামারি দৃশ্যে। যেখানে পরিচালক দর্শকদের জানতে দিতে চান না কী হতে চলেছে। একটা মারামারির দৃশ্যে যেকোন সময় যে কোন কিছু হতে পারে। কেবল এই দুইটা রুলস দিয়ে যে সমস্ত রুলস কে ভাঙ্গা যায়, সেটাই দেখিয়েছে রেহানা মরিয়ম নূর। খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখবেন, মুভির শুরুতেই যখন রেহানা কে দেখানো হয় তখন রেহানা চলতে চলতে হটাৎ থমকে যায়, ফিছনে ফিরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কিছু একটা জানার চেষ্টা করে, বোঝার চেষ্টা করে। এখান থেকে রেহানার মানষিক স্থিতি বোঝানো হয়েছে। একই সাথে যেমন রেহেনার চরিত্র দৃঢ়, একঘুয়ে, তেমনি অস্থিতিশীল। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। যেমন, পরীক্ষার হলে নকল করা ছাত্রী কে বের করে দেওয়া। শিক্ষক এসে বললেও, রেহেনা তাকে এক্সফেল করে দেয়। তেমনি ঘরের দরজা হাঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া, আবার এমনিতেই খুলে যাওয়া।
একবার চিন্তা করেন, একই চরিত্র, যেমনি দৃঢ়, তেমনি একঘুয়ে, তেমনি অস্থিতিশীল। এমন একটা চরিত্র কখন কী করবে সেটা আপনি প্রেডিক্ট করতে পারবেন? রেহনা মরিয়ম নূরে পরিচালক আপনাকে গল্প দেখাতে চায়নি, চেয়েছে রেহানা চরিত্র দেখাতে। রেহানা চরিত্র কে ফুটিয়ে তুলতেই, জাম্প কাট আর ক্যামেরা শেকিং দেওয়া হয়েছে৷ রেহানা কিন্তু নিজের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছিলো না মুভিতে, বরং যে ছাত্রী কে সে এক্সফেল করিয়ে দেয়, সেই ছাত্রীর হয়ে সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে লড়ছিলো যে শিক্ষক ঐ ছাত্রীকে এক্সফেল করতে নিষেধ করেছিলো। এবং সে একাই লড়ছিলো।
পথের পাঁচালীর মুভি জার্নি নিয়ে একটা মুভি হয়েছে, কীভাবে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী হয়ে উঠলো। সেখানে দেখানো হয়েছে, পথের পাঁচালী রিলিজ হওয়ার পর প্রথম সপ্তাতেই মুভি হল থেকে নেমে যায়৷ এরপর যখন কান এওর্য়াড জিতে আসে, তখন আবার হলে চালানো হয় এবং মুভিটি সুপারহিট হয়। সেখানে দেখানো হয়, স্বামী স্ত্রী কে বলছে, চলো মুভি দেখে আসি। স্ত্রী উত্তরে বলে, কী মুভি? স্বামী বললো, পথের পাঁচালী। স্ত্রী চোখ-মুখ কুঁচকে বললে, ধুর ম্যারম্যারে, তারচেয়ে উত্তম কুমারের দেওয়া নেওয়া আর একবার দেখে আসি। স্বামী তখন বললো, এই কথা বলো না। লোকে শুনলে বলবে আমাদের টেস্ট নেই। এই মুভি নিয়ে এখন প্রচুর হইচই হচ্ছে, না দেখলে জাতে থাকা যাবে না (হুবহু ডায়লগ মনে নাই, তবে এই রকমই ছিলো।)
তখনকার মানুষের অন্তত চোখের লজ্জা ছিলো, আজকাল চামড়ার চোখের কোন পর্দা নেই। তাই আমরা পুরুষ্কারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছি। অস্কার দেওয়া হয় দর্শকের ভোটের উপর, চয়েজের উপর। আর গনতন্ত্র কতটা বেহুদা, সেটা আমার ভোট এলেই বুঝি। কিন্তু সমালোচক কিম্বা জুড়ি বোর্ড এওর্য়াড দর্শকের চয়েজের উপর দেওয়া হয় না। কান ফেস্টিভ্যাল ও সেই রকমই। এই এওর্য়াড গুলো দেওয়া হয়, মুভি মেকিং এর জন্য৷ কতটা স্বার্থক ভাবে পরিচালক, গল্পটা অথবা চরিত্রটা তুলে ধরেছে তার উপর।
আমি বলছি না যে, 'রেহনা মরিয়ম নূর' 'পথের পাঁচালীর' মত বা তার চেয়েও ভালো মুভি। মেকিং এর দিক থেকে যেমন পথের পাঁচালী একটা যুগান্তকারী মুভি হয়ে আছে, রেহানা মরিয়ম নূর ও তেমনি একটা ভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। বাংলাদেশী মুভি হিসাবে যেটা কল্পনাও করা যায় না।
আমার জানা মতে, তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না'ও কান ফেস্টিভালে এওর্য়াড পায়নি।