এয়ারক্রাশ ইনভেস্টিগেশন ~ ভুতের কবলে বিমান
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
(সিনফ্লিক্স প্রডাকশন কর্তৃক নির্মিত "মেডে - ফলিং ফ্রম স্কাই" অবলম্বনে)
১৯৮২ সালের ২৪ শে জুন। ভারত মহাসাগরের ১০ মাইল উপরে, নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে একটি বিমান ছুটে চলছে পূর্বদিকে। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৪৭ বিমান। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। একটু আগে সেটি জাকার্তা সিটি পেরিয়ে এসেছে। আর ঘন্টাখানেকের ভেতরে বিমানটি পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থে অবতরণ করবে।
বেশ রিলাক্সে বিমান চালাচ্ছেন ক্যাপ্টেন এরিক মুডি। তার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে কোন সন্দেহ নাই। আকাশে উড়তে শিখেছিলেন ১৬ বছর বয়সে গ্লাইডিংয়ের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন বৃটিশ এয়ারওয়েজের অন্যতম প্রশিক্ষণার্থী যারা সর্বপ্রথম বোয়িং ৭৪৭ বিমানের প্রশিক্ষণ লাভ করেন। আজ রাতে তাকে সহয়তা করছেন ফার্স্ট অফিসার রজার গ্রিভস, ও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার বেরি ট্যানলি ফ্রিম্যান। ক্যাপ্টেন মুডি রাডার চেক করে দেখলেন পরবর্তী ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত আবহাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
যাত্রীরা সবাই ক্লান্তশ্রান্ত। মোট ২৬৩ জন যাত্রী বিমানে। অনেকেই কানেকটিং যাত্রী। কেউ কেউ দুইদিন ধরে ফ্লাই করছেন। তাদের একজন চার্লস কেপওয়েল ও তার ছোট দুই ছেলে চ্যাজ ও স্টিভেন। লন্ডন থেকে তারা তাদের পার্থের বাড়িতে ফিরছেন। তাদের পেছনে বসা বেটি টটেল ফার্গুসন ও তার মা। বোম্বে থেকে তারা কুয়ালালামপুর হয়ে পার্থ যাচ্ছেন।
অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ পর কেবিন ক্রুরা ভেতরে ধোঁয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করলেন। সেই সাথে পোড়া গন্ধ। সেসময় বিমানে ধুমপান নিষিদ্ধ ছিলনা। ক্রুরা সন্দেহ করলেন কোথাও কেউ সিগারেট খেয়ে উচ্ছিষ্ট ফেলে দিয়েছে, হয়তো সেখান থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ৩৭ হাজার ফুট উঁচুতে আগুন ভয়াবহ বিপদের কারণ হতে পারে। তারা অনেক খুঁজলেন, কিন্তু কোন আগুনের চিহ্ন পেলেন না।
পিচ কালো অন্ধকার রাত। পাইলটরা নিরুদ্বিগ্নভাবে বিমান চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাদের সামনে আলোর খেলা শুরু হলো। তারা দেখলেন উইন্ডশিল্ড বা সামনের গ্লাসে যেন আতশবাজি জ্বলছে। হাজার হাজার আগুনের স্ফুলিঙ্গ গ্লাসের সামনে ধাক্কা মেরে চলেছে। এরকম পরিস্থিতির সাথে পাইলটরা পরিচিত। যখন প্লেন প্রচন্ড বজ্রপাতের ভেতর দিয়ে যায়, তখন এরকমটা হতে দেখা যায়। এটা বিদ্যুতের ডিসচার্জ, বিমানের কোন ক্ষতি হয়না এতে। কিন্তু সেরাতে কোথাও বজ্রবৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া বজ্রপাতের স্ফুলিঙ্গ ক্ষণস্থায়ী হয়। কিন্তু এখানে স্ফুলিঙ্গের খেলা যেন থামছেই না। ফার্স্ট অফিসার রজার বিমানের অর্ধেক ল্যান্ডিং লাইট বন্ধ করে বাইরে পাতলা মেঘের আস্তরণ দেখতে পেলেন, যদিও রাডারে মেঘের কোন অস্তিত্ব দেখতে পেলেন না।
কেবিনের ভেতরে ধোঁয়া গাঢ় হতে লাগলো। কেবিন ক্রুরা অনেক খুঁজেও কিছু পেলেন না। পেছনের দিকে বসা বেটি টটেল ফার্গুসন জানালা দিয়ে দেখলেন, বিমানের ডানা খুব উজ্জল সাদা আলোর রশ্মিতে জ্বলজ্বল করছে, যেন সেখানে আগুন ধরে গেছে। তিনি আরও দেখতে পেলেন জানালার উপরে ভেন্টিলেটর দিয়ে গাঢ় ধোয়া বিমানের ভেতরে প্রবেশ করছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কেবিনে দারুন হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেল। সবাই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে দেখলেন ইঞ্জিনের পেছনের দিকে প্রচন্ড আগুন জ্বলছে। রকেট উড়ার সময় পেছনের দিকে যেভাবে আগুন জ্বলে, বিমানের ইঞ্জিনের পেছন থেকে সেরকম ঠিকরে আগুন বেরোচ্ছে। ভেতরে প্রচন্ড ধোঁয়া। কেউ আর ঘুমিয়ে নেই। সবাই কাশছে, সবার চোখ জ্বলছে, নাকেমুখে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে কেউ কেউ। সবার জিজ্ঞাসা কি হয়েছে। স্টুয়ার্ডরা কিছু বলছেনা। তারা ভয় পেলেন, মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়লে বিপদ আরো বাড়বে। তারা এটাকে স্বাভাবিক বলে নিশ্চিন্ত থাকতে বললেন। যদিও তাদের কথা বিশ্বাস করলো খুব কম লোকেই।
ওদিকে পাইলটরা তখনো এত কিছু জানেন না। তারা চিন্তিত আলোর রশ্মি নিয়ে। এটা কেন হচ্ছে তারা বুঝতে পারছেন না। ধোঁয়ার পোড়া গন্ধ তারাও পাচ্ছিলেন। কোথাও কি আগুন ধরে গেছে ? ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার বেরি চেক করে দেখলেন সব যন্ত্রপাতি ঠিকমতো চলছে, কোথাও আগুনের কোন লক্ষণ নেই। এরপর ইঞ্জিনের দিকে তাকিয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল তাদের। চার আর দুই নম্বর ইঞ্জিন আগুনের আস্তর দিয়ে ঢাকা। বিস্মিত হয়ে গেলন তারা। ইঞ্জিনে আগুন আসলো কোথা থেকে ?
এটা ছিল মাত্র শুরু। আরো সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার বেরি জানালেন, চারনম্বর ইঞ্জিন বিকল হয়ে হয়েছে। ক্যাপ্টেন মুডি তাড়াতাড়ি চারনম্বর ইঞ্জিন বন্ধ করলেন। ভয় পেলেন না, তিনি জানেন তিনটি ইঞ্জিন নিয়েও বিমান চলতে পারে। কিছুক্ষণ পর বেরি জানালেন দুইনম্বর ইঞ্জিন বিকল। বলে একমুহুর্তও থামতে পারলেন না, সাথে সাথে সবগুলো ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল। ৩৭ হাজার ফুট উপরে উড়তে থাকা বিমান সম্পূর্ণ অচল হয়ে থেমে গেল। ইঞ্জিনের ফ্যান কাতরাতে কাতরাতে থেমে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলেন ইঞ্জিনের পাশে বসা যাত্রীরা। বিস্মিত পাইলটরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ আগেও চারটি ইঞ্জিন চলছিল, কেন চারটিই একসাথে বিকল হয়ে গেল তারা বুঝতে পারলেন না। এটা একদম নতুন তাদের কাছে। এরকম পরিস্থিতিতে তারা আগে কখনো পড়েননি। সবচেয়ে বড় কথা, এখন কি করবেন সেটাও তারা জানেন না।
কোন ইঞ্জিনের শক্তি ছাড়া বিমান মাঝআকাশে হ্যান্ডগ্লাইডারের মতো ঝুলতে লাগলো। দ্রুতগতিতে উড়তে থাকার কারণে সাথেসাথে পড়ে গেলনা, আকাশে ভেসে থাকলো, আর আস্তে আস্তে সমুদ্রে দিকে গড়িয়ে নামতে লাগলো। যেভাবে ঘুড়ি কেটে গেলে ভেসে ভেসে তা অনেকদুর গিয়ে মাটিতে পড়ে। যাত্রীদের মনে হলো তারা যেন মহাশুণ্যে ভেসে রয়েছেন। ফাস্ট অফিসার রজার রেডিওতে ঘোষণা করলেন পাইলটদের বহু অনাকাঙ্খিত জরুরী বার্তা - “মেডে মেডে মেডে”।
বেতার যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটায় তাদের ম্যাসেজ ক্যাচ করতে কষ্ট হলো জাকার্তার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের। নিকটস্থ আরেকটা বিমান তাদের মেডে বার্তা শুনে তা জাকার্তার কন্ট্রোলারকে জানালেন। শুনে তারাও বিস্মিত হয়ে গেল। কোন বোয়িং ৭৪৭ বিমান এর আগে উড়ন্ত অবস্থায় চারটি ইঞ্জিন এভাবে ফেল করেনি। ক্যাপ্টেন মুডি অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি কি ভুল করেছিলেন। তিনি দ্রুতগতিতে হিসাব করে দেখলেন আধা ঘন্টার মধ্যেই তারা বিমানসহ সমুদ্রে পতিত হবেন যদি এর মধ্যে ইঞ্জিন রিস্টার্ট না নেয়। স্ট্যান্ডর্ড রিস্টার্ট প্রসিডিউর ফলো করতে তিন মিনিট সময় নেয়। সেই হিসাবে তাদের হাতে ১০ টি বা তারো কম সুযোগ আছে ইঞ্জিনকে পুনরায় চালু করার। তিনি বিমানকে পশ্চিমদিকে ঘুরিয়ে জাকার্তার কাছে হালিম বিমানবন্দরে অবতরনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তা করতে হলেও কিছুটা ইঞ্জিন শক্তির প্রয়োজন।
সমস্যা আরো প্রকট হলো যখন ক্যাপ্টেন দেখলেন স্পিড ইন্ডিকেটর কাজ করছে না। তিনি ইঞ্জিন রিস্টার্ট করতে পারবেন না যদি ২৫০ থেকে ২৭০ নট স্পিডে বিমান না চালান। কিন্তু স্পিড ইন্ডিকেটর ছাড়া তিনি কত স্পিডে যাচ্ছেন বুঝতে পারছেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন বিমানকে দ্রুতগতিতে নিচের দিকে নামাতে থাকবেন। এতে স্পিড বাড়বে, কোন এক পর্যায়ে তারা ২৫০ নট স্পিডে পৌছবেন, আর তখন রিস্টার্ট নিলে ইঞ্জিন সচল হবে। এটা যে কি পরিমাণ দু:সাহসিক কাজ ছিলো, তা তখনো তিনি জানতেন না।
তিনি বিমানের অটোপাইলট অফ করলেন, বিমানের নাককে একটু উচুতে উঠালেন, পরক্ষণেই তা দ্রুতগতিতে নিচে নামাতে থাকলেন। এক মিনিটেই বিমান নেমে গেল ৬ হাজার ফুট নিচে। ভেতরের সবাই রোলার কোস্টরে চড়ার আমেজ অনুভব করলেন। এই অনুভূতি রূপান্তরিত হলো আতঙ্কে। কারণ বিমানের ভেতরে বাতাসের প্রেসার কমে গিযে শ্বাসরোধের মতো অবস্থ তৈরী হলো। ইঞ্জিন যখন চালু থাকে তখন তা বিমানকে চালানোর পাশাপাশি কেবিনের ভেতরে বাতাসের প্রেসার ঠিক রাখে। যেহেতু কোন ইঞ্জিনই কাজ করছে না, সেহেতু ভেতরে কোন বাতাস ঢুকছেনা। তার উপর দ্রুতগতিতে বিমান নিচের দিকে নামার কারণে কেবিনের ভেতরের সকল বাতাস বেরিয়ে গিয়ে অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিলো। সাথে সাথে অক্সিজেন মাস্ক খুলে এলো সবার সামনে। সবাই মাস্ক করে শ্বাস নিতে থাকলেন। এই প্রথম তারা জানলেন সত্যি সত্যি খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন তারা। কিন্তু কেবিন ক্রুরা তারপরও কিছুতেই মুখ খুললেন না।
পাইলটরাও মাস্ক পরে নিয়েছেন। এই মাস্ক পরা নিয়ে আরেক নাটক মঞ্চস্থ হলো। ফার্স্ট অফিসার রজারের মাস্ক টিউব থেকে খুলে আলাদা হয়ে গেল। বহুকষ্টে সেটাকে জোড়া লাগাতে পারলেন তিনি। সর্বশক্তি দিয়ে তারা চেষ্টা করতে লাগলেন ইঞ্জিন রিস্টার্ট করতে। একবার, দুইবার, তিনবার.... চেষ্টা করতেই থাকলেন, কিন্তু কোন কাজ হলো না। ইঞ্জিন সাড়া দিচ্ছেনা। এবার আরেক বিপদ এসে উপস্থিত হলো। জাভার সন্নিকটে একটা বিশাল উঁচু পর্বতের কাছে এসে পড়লেন তারা। অন্তত ৩৫০০ মিটার উপরে দিয়ে উড়তে হবে পর্বতের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে হলে। খুব দ্রুত যদি ইঞ্জিন স্টার্ট না নেয়, তাহলে সমুদ্রে ডুবে মরতে হবেনা, পাহাড়ের সাথে বাড়ি খেয়ে তাদের ভাবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। ক্যাপ্টেন এরিক এখন সিরিয়াসলি চিন্তা করছেন সমুদ্রেই বিমান ল্যান্ড করাবেন কিনা। জরুরী পরিস্থিতে সেটাও করা যায়। কিন্তু তা এতই অনিশ্চিত ও বিপদজনক, তার মতো অভিজ্ঞ পাইলটও ভয় পেলেন তার পরিণতি ভেবে।
মাইকে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে কথা বলে উঠলেন তিনি - ‘একটা ছোট্ট সমস্যা হয়েছে। সবগুলো ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার চালু হয়ে যাবে। আশাকরি আপনারা ভয় পাবেন না।’ তার এই ঘোষণা সবার মধ্যে ভীতির সঞ্চার করলো। কেবিনে নেমে এল পিনপতন নিস্তব্ধতা। সবাই যেন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। ইতিমধ্যেই লাইফ জ্যাকেট পরে নিয়েছেন তারা। চার্লস কেপওয়েল তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বিদায়ী নোট লিখে ফেললেন, ‘ বিপদে আছি, প্লেন আকাশ থেকে পড়ে যাচ্ছে, ছেলেদের জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করছি, আমরা তোমাকে ভালবাসি’।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। বিমান নেমে এসেছে ১২ হাজার ফুটে। ফার্স্ট অফিসার ও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার মরিয়া হয়ে রিস্টার্ট করার চেষ্টা করছেন। তারা এখন শর্টকার্ট মারছেন, যাতে বেশী সুযোগ নেয়া যায়। এবার ঘটলো এক আলৌলিক কান্ড । প্রায় ১৬ মিনিট পর, যেভাবে হঠাৎ চতুর্থ ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তেমনিভাবে হঠাৎ আবার চালু হয়ে গেল।
সশব্দে কেঁপে উঠলো নিস্তেজ বিমানটি। দুম করে উপরের দিকে উঠে গেল কিছুটা। যাত্রীদের মনে হলো কেউ যেন ঘুষি দিয়ে বিমানকে উপরে তুলে দিয়েছে। চমকে উঠলেন ক্যাপ্টেন। কলিজায় পানি ফিরে আসলো তার। লড়াই করার মতো কিছু পুঁজি পেয়েছেন তিনি। যদিও একটা ইঞ্জিন তাকে পর্বতকে অতিক্রম করার মতো যথেষ্ট উপরে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবেনা, তাই তিনি সমগ্র জাভাদ্বীপ চক্কর দিয়ে অন্যপাশে যাবেন ঠিক করলেন।
কিন্তু আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তার জন্য। চার হাজার মিটার উচ্চতায় উঠার পর একে একে ২য়, ৩য় ও ১ম ইঞ্জিন আবার জীবন্ত হয়ে বিমানকে সাঁই সাঁই করে উপারে উঠাতে লাগলো। বিমান ছুটতে লাগলো পূর্ণগতিতে, যেন এতক্ষণ কিছুই হয়নি তার। ভেতরের সবাই গতির এই পরিবর্তন অনুভব করলেন। বিস্মিত হয়ে গেলেন পাইলটরা। এ কোন ম্যাজিক ? কিছুক্ষণ আগেও তারা সমুদ্রে ল্যান্ড করানোর চিন্তা করছিলেন। তড়িৎগতিতে তারা জাকার্তার কন্ট্রোলারকে জানালেন। এবার তাদের ম্যাসেজ বুঝতে কোন সমস্যা হলো না কন্ট্রোলারের। জানালেন জরুরী অবতরণের জন্য হালিম বিমানবন্দর প্রস্তুত করা হচ্ছে। ১৫ মিনিটেই তারা সেখানে পৌছে যাবেন। সুখবরটা যাত্রীদের জানালেন ক্যাপ্টেন। সবাই স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন। ভাবলেন হয়তো এই যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যাবে।
প্রায় নিশ্চিত পতন থেকে রক্ষা পেয়ে বিমান আবার পূর্ণগতিতে চলতে শুরু করলো। ক্যাপ্টেন এরিক পর্বত থেকে যথেষ্ট উঁচুতে বিমান চালিয়ে নিলেন। কিন্তু যেই না পর্বতের উপর উঠলেন, আবার বিপর্যয় পিছু নিল। একটু আগে যেরকম উইন্ডশিল্ড দিয়ে অঙ্গিস্ফুলিঙ্গ জ্বলতে দেখেছিলেন, পর্বতের উপর উঠামাত্র আবার সেই আলোর নাচন ফিরে এলো। আবারো সারা বিমান আগুনের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে গেল। সারা বিমান থরথর করে কাঁপতে লাগলো। এ যেন কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার হুবহু পুনরাবৃত্তি। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার বেরি জানালেন, দুইনম্বর ইঞ্জিন জ্বলছে। একমুহুর্ত অপেক্ষা করলেননা ক্যাপ্টেন। সাথে সাথে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন। স্বাভাবিক অবস্থায় এই কাজটি করার আগে একজন পাইলট পঞ্চাশবার চিন্তা করবেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন এরিক জানেন কিছুক্ষণ আগে কি ঘটেছিল। এতক্ষণে তার নার্ভ যথেষ্ট শক্ত হয়ে গিয়েছে। আবারো চারটি ইঞ্জিন হারানোর ঝুকিঁ নিলেন না। তিনি ভেবে উঠতে পারছেন না কেন এমন হচ্ছে। ভাগ্যবিধাতা তাকে বেশী সময় অপেক্ষায় রাখলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে জাভার উপুকূলরেখা ফুটে উঠলো, বিমানবন্দরের আলো দেখা গেল।
এবার পাইলটরা সর্বশেষ সারপ্রাইজের সম্মুখীন হলেন। বিমানবন্দরের কাছাকাছি আসতে তারা দেখলেন উইন্ডশিল্ড ঘোলা, বাইরে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। হয়তো কুয়াশা। ওয়াইপার দিয়ে কাঁচ মোছা হলো, ব্লোয়ার ব্যবহার করা হলো কিন্তু কিছুতেই কাজ হলোনা, ঘোলা কাঁচ পরিষ্কার হলোনা। ক্যাপ্টেন এরিক সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে তিনি দেখলেন, তার সামনের গ্লাসে দুই ইঞ্চি লম্বা একটি অংশ দিয়ে বাইরের কিছুটা দেখা যাচ্ছে, এছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। শীরদাড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল তার। উইন্ডশীল্ড ঘোলা থাকার মানে তাকে এখন ল্যান্ড করাতে হবে প্রায় না দেখে, অন্ধের মতো অনুমান করে। নইলে এতক্ষণ ধরে সাফল্যের সাথে সকল বিপদ মোকাবেলা করার কৃতিত্ব কোন কাজে আসবেনা। আর ল্যান্ডিং যে কত স্পর্শকাতর, সামান্য হেরফেরের কারণে অতীতে কত বিমান ধ্বংস হয়েছে তার ইয়াত্তা নাই।
বিপদের এই শেষ না। তারা আবিষ্কার করলেন, যে যন্ত্র সঠিক এ্যঙ্গেলে বিমান অবতরণে সাহায্য করে সেটা কাজ করছেনা। যন্ত্রটি রানওয়ের এঙ্গেল ঠিক রাখতে ডানে বা বামে যাবার নিদের্শ দিচ্ছে; কিন্তু গ্লাইড স্লোপ, বা যেটা রানওয়ের দূরত্বের সাথে বিমানের উচ্চতার সামঞ্জস্য করে, সেটা কাজ করছেনা। আকাশে প্রচন্ডগতিতে উড়তে থাকা বিমান রানওয়ের কাছাকাছি আসলে উচ্চতা ও গতি আস্তে আস্তে কমতে থাকে, এই উচ্চতা ও গতির ব্যালেন্স করে যন্ত্রটি। যেহেতু যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছেনা, আবার ঘোলা উইন্ডশিল্ড দিয়ে বাইরের দৃশ্যও দেখা যাচ্ছেনা, তারা আসলেই বুঝতে পারছেন না কিভাবে ল্যান্ডিং করবেন।
ক্যাপ্টেন এরিক মুডির অভিজ্ঞতা এবার ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হলো। তিনি জানেন, কতটুকু উচ্চতায় কত গতিতে চলতে হবে। এক্ষেত্রে তিনি ম্যানুয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করলেন। তিনি ফার্স্ট অফিসার রজারকে নির্দেশ দিলেন ফ্লাইট লেভেল বা উচ্চতা জোরে জোরে পড়তে, আর নিজে জানালার দুই ইঞ্চি ফোকর দিয়ে রানওয়ের মাটি খুঁজতে লাগলেন, আর সেই উচ্চতার সাথে এডজাস্ট করে তিনি গতি কমাতে থাকলেন।
রজার ঘোষণা দিলেন, ৩০০ ফিট, ক্যাপ্টেন মুডি গতি কমালেন
২০০ ফিট, বিমানের গতি আরেকটু কমলো
১০০ ফিট, গতি আরো কমলো
৫০ ফিট
৩০ ফিট
দ্রিম.....বিশাল বোয়িং বিমান সারা গায়ে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে রানওয়ের মাটি স্পর্শ করলো। দ্রুতগতিতে রানওয়ে অতিক্রম করতে লাগলো। ক্যাপ্টেন এরিক রিভার্স থ্রটল চেপে এর গতিরোধ করলেন। দ্রুতগামি বিমানের গতি কমতে থাকলো ধীরে ধীরে। ৯০ নট, ৮০ নট, ৭০ নট.... একসময় গতি অনেক কমে গিয়ে নিরাপদে ট্যাক্সিওয়েতে পার্ক হলো। পারফেক্ট ল্যান্ডিং। ক্যাপ্টেন সোল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন – উই আর ডাউন। উচ্ছাসে ফেটে পড়লেন যাত্রীরা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ! কয়েকবার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার অনুভূতি ছিল অভূতপূর্ব। সৃষ্টিকর্তার কাছে ধন্যবাদ জানালেন জীবন রক্ষার জন্য । কেবিন ক্রুরা ভান্ডার উজাড় করে মদ খাওয়ালেন সবাইকে।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে তারা অবাক হয়ে গেলেন সবাই। সারা বিমানের রং উধাও। যেন কেউ বাইরে থেকে ঘষে ঘষে রং তুলে ফেলেছে। উইন্ডশিল্ডে মারাত্মক স্ক্রাচ পড়েছে। এজন্যই তারা বাইরের কিছু দেখতে পারেননি। সামনের নাক আর ডানা বালুর আস্তরে ঢাকা। যেন একটা পরিত্যাক্ত যুদ্ধবিমান। এটাতে করেই তারা এতক্ষণ এসেছেন। তারা কোন কুলকিনারা করতে পারলেননা কেন এমনটা হয়েছে।
আসলে কি হয়েছিল ? কোন আগুন খুঁজে পাওয়া যায়নি পরে। তাহলে কেন সারা বিমান আগুনের আস্তর দিয়ে ঢেকে গিয়েছিল ? কেন চারটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে গিয়েছিল ? আগুন না থাকলে ধোঁয়া আসলো কোথা থেকে ? উইন্ডশিল্ডের সামনে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখেছিলেন, সেটাই বা কি ? তাহলে কি এসব জিন, ভুতের আছর ? ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় উপজাতীয়দের মধ্যে এরকম উড়ন্ত জিন, ভুতের বিশ্বাস প্রচলিত আছে। তাহলে কি ভুতের পাল্লায় পড়েছিল তারা ? জানতে হলে পরবর্তী পর্ব পড়ুন। প্রকাশিত হবে আগামীকাল।
একটি প্রতিবাদ
এয়ারক্র্যাশ ইনভেস্টিগেশন সিরিজের আমার প্রথম লেখা "মধ্য আকাশে দুই বিমানের সংঘর্ষ " প্রকাশিত হয় সোনার বাংলাদেশ ব্লগে ২ রা ফেব্রুয়ারী। সামেহায়ারইন ব্লগেও এটি প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু কোন কারণে প্রকাশ করা হয়নি। সেই লেখাটি সামহোয়ারইন ব্লগের "ফেরারী..." নামের একজন ব্লগার চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। আমার লেখার হুবহু কপি করে, কিছু কথা বাদ দিয়ে, নিজের দুইএকটা লাইন ঢুকিয়ে, গুগল থেকে কিছু ছবি বসিয়ে, কিছু লিঙ্ক দিয়ে, সবশেষে ইউটিউবের ভিডিও ফুটেজ দিয়ে নিজের কাজ বলে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। এই ব্যাপারে উক্ত ব্লগারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করেন, এবং এটাকে তার নিজের মৌলিক লেখা বলে দাবী করেন। পরে তা জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় তিনি সেই লেখাটিকে কেটে ছিড়ে, প্যারা উলট পালট করে একরকম জগাখিচুড়ির মতো করে লেখাটিকে আবার এডিট করেন। এমনকি চুরির অভিযোগ করায় কয়েক জনের কমেন্টও ডিলিট করেন ঐ পোস্টে।
১১টি মন্তব্য ১০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কর কাজ নাহি লাজ
রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।
হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?
নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন
তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল
সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন
নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?
১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।
আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?
অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন