সময় বয়ে যায়।
অপেক্ষা করে মিলি। যতই অপেক্ষা করে ততই নীরব থাকে হতচ্ছাড়া ফোনটা। ঘড়িটা টিক টিক করে চলেছে। এবার মিলির মনটা খারাপ হবার এভারেস্টে উঠতে থাকে। কেন কিছুই ভালো লাগেনা?
একবার ভাবে ফোনটা তুলে নিয়ে তাকে ফোন করবে। আবার চিন্তা করে, নাহ, এসময় যদি সে খেতে বসে, বা ল্যাবে থাকে। কিংবা রোডে গাড়িও তো চালাতে থাকতে পারে। থাক, এসময়ে কখনোই ফোন করেনি মিলি। যে জীবনটা একেবারে ঘড়ির কাঁটার দমে দমে চলতে চলতে দম ফেলবার ফুরসত পায়না, সেখানে তার এই হঠাৎ ফোনকল হয়ত সেই জীবনটার ছন্দ কেটে দেবে, বিরক্তি সৃষ্টি করবে।
ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে টিভির পর্দায় চোখ রাখে মিলি। খবরের চ্যানেল পাল্টে পাশের চ্যানেলে যায়। এক মাল্টিস্টোরিড শপিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন হচ্ছে। অসহ্য লাগে তার। ঝলমলে সব কিছুই আজ তার অসহ্য লাগে। আবারো চ্যানেল পাল্টায়। এবার এখানে এক বিখ্যাত শেফ কী সব নারকেল দিয়ে শাকপাতা রান্না করে দেখাচ্ছে। হাস্যকর!
সে কি ফোন করেই দেখবে? আচ্ছা, এমন যদি হয়, মিলিও ফোন করলো, আর ওদিকে সেও ফোন করে বসলো, তখন তখন? লাইন পাবেনা তো।
রীতিমত বিরক্ত লাগে তার এ ধরনের চিন্তা মাথায় আসায়। ধ্যাৎ, কোথায় ও? সব কিছু চুলোয় যাক, কার কি? তার কোনকিছুতেই কিছু এসে যায়না, কিসসু না।
চাঁদটাকে কেমন যেন বেখাপ্পা দেখায়, যেন এমন সন্ধ্যেবেলা এভাবে তার উঠে আসাটা ঠিক হয়নি। আজ গরমটা একটু কম। খোলা জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে মাঝে মাঝেই। কোথাও কি বৃষ্টি হয়েছে? কেমন যেন একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ। হবে হয়তো।
চেয়ার ছেড়ে ড্রেসিং টেবলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মিলি। মাথার ব্যান্ডটা খুলে লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দেয়। আনমনে চিরুনি চালাতে থাকে। চিরুনিটা টেবলের ওপর রাখতেই খোলা জানালার পর্দা উড়িয়ে এক বাতাস এসে তার চুলগুলোকে এলো করে দিয়ে যায়। চোখ ঢেকে যাওয়া চুল সরাতেই চোখ পড়ে আয়নার দিকে, নিজের দিকে। মুহূর্তেই স্মৃতি তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় সেই স্টিকি ফিংগারস এর দিনগুলোতে। এখন সেখানে ইবনে সীনার এক সুবিশাল বিল্ডিং, সেদিন দেখেছে সে। সেই তুমুল ঝড়ের রাতে রিকশাতে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দু'জনে মিলে স্টিকি ফিংগারসে আশ্রয় নেয়া আর মোমের আলোতে বাজিতে হেরে তাকে দেয়া প্রথম চুম্বন--সব মনে পড়ে যায়, যেন আয়নার ঐ প্রতিবিম্বে সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, প্রতিটি মুহূর্ত, ক্ষণ। মনটা ভালো হয়ে যেতে থাকে মিলির।
নাহ,আর না। ঠিক করে ফেলে সে। এক ঝটকায় আনন্দআলোর কপিটা বিছানাতে ছুঁড়ে ফেলে ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করে বসে একটি নাম্বারে।
একবার, দুবার, তিনবার--পায়না মিলি। প্রতিবারই এক দুর্বোধ্য ভাষায় ওপাশে এক মহিলা কর্কশ স্বরে তাকে কী যেন বলছে, যার অর্থ মিলি সহজেই ধরে নিতে পারে, "এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। অনুগ্রহপূর্বক আবার চেষ্টা করুন"।
অপেক্ষার প্রহরটা আরো বাড়লো তার।
মিলির অপেক্ষার এই পালা ফুরোতো যদি সে জানতে পারতো ঐ মুহূর্তে হাজার মাইল দূরে কালদোনাজ্জো লেকের পাশ দিয়ে ছুটে চলা হাইওয়েতে উল্টে থাকা গাড়ির চাকার ঘূর্ণন, পুলিশের গাড়ি আর এম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া গাড়ির কাঁচের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে থাকা নিশ্চল হাত আর তার পাশে পড়ে থাকা মোবাইলের টাচস্ক্রিনটা রক্তের আঁচড়ে চিরদিনের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেছে!