চারপাশে অনেক মানুষ, অনেক। তারপরও আমি বিবশ, বিষন্ন। কী যেন এক ঘোরের মাঝে আমি। বৃষ্টিদগ্ধ গাছের পাতাতে রূঢ় সূর্যটা তার বাতি মেলে দিয়ে চমকাচ্ছে। ব্ল্যাকবোর্ডে খসখস করে চক ঘসবার আওয়াজ কোনভাবেই এই বিবশতাকে স্পর্শ করতে পারছেনা। মুখ তুলে জানালার বাইরে তাকালাম। একটা কদম ফুল লাগবে আমার, মাত্র একটা। কিন্তু সিগন্যাল পড়লেই একমুঠো কদমফুল নিয়ে ছুটে আসা ছিন্ন মলিনবস্ত্র সেই কিশোরীর চোখে যে ঘন, গভীর অশ্রুবর্ষা দেখেছি, তার কাছে অন্য কোন বর্ষা অর্থহীন, শব্দহীন। যে চাতকপাখি ঘোর বর্ষার জন্যে হাহাকার করে মরতো, সে এখন ঠিক এখানে-আমার মনের এই শুন্য শুকনো মরূভূমিতে। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দের সুর তো বিথোফেনের কম্পোজিশন থেকেও অনেক বেশি আপন, বেশি কাছের।
সে রাতে খুব ঝড় হচ্ছিল, শেকড় উপড়ে ফেলা ঝড়। মোমবাতির আলোটাকে দু'হাত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে যাচ্ছিলাম। অদ্ভুত এক আলোয় দেখেছিলাম তার মুখ। সেই মুখেও তখন অঝোর বৃষ্টি।
বের হতে যাবো, ঠিক সে সময়ে ঝুম করে বৃষ্টি নামলো। আকাশের তারাকে বলতেই সে হাসি দিয়ে বললো, " ছাতা নিয়ে বের হয়ো।" আমি বললাম, "হ্যাঁ, বের হবো। একা একা, অলিগলি দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরবো।" সে বললো, "হুমম, তোমার একাকীত্বকে উপভোগ করো।" নৈঃশব্দ্যের বন্ধুটি একবার বলেছিল, "ছাতা পৃথিবীর অশ্লীলতম জিনিসের একটি।" আমিও ভাবছি।
ছোট্ট ঘরটাতে একটাই কামরা। বাতি নেভানো। আর আমি হাতজোড়াকে বালিশ বানিয়ে অপলক চেয়ে আছি ঐ সাদা সিলিং এর দিকে। নিজে নিজেই কথোপকথন চালাচ্ছি, কিন্তু দুটো চরিত্রে। একজন আমি, আরেকটা আমার আমি। সিলিংয়ের টিকটিকিটার লেজ খসে পড়তে দেখলাম, ঐ আলো-আঁধারিতেই। একটা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্হ হয়ে গেলো আমার আপনা-বলা কথার মাঝেই।
এক তরুণ হেঁটে যাচ্ছে বিবর্ণ সংকীর্ণ ধুলোমাখা রাস্তা দিয়ে, কাঁধে তার ঝুড়ি, বাজারে বেচবার। তার ছায়াটা দীর্ঘান্বিত শীত-শীত লাগা এই দিনের সূর্যের আলোয়। পথ চলতে চলতে ছায়ার দরকার পড়ে। নইলে রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণটা কৃষ্ণকালো হয়ে যাবে।তার চাইতে বড় হলো, তেষ্টার কষ্টটা। আচ্ছা, বর্ষার একটা দ্রোহী রূপ আছে না? তপ্ত মরূকে শান্ত, সবুজ করে দেবার সেই বিদ্রোহ!
ভেবেছিলাম আপন মনে রোজনামচা লেখাটাই সার। কিন্তু সময়ে সময়ে উপলব্ধির খাতায় আঁকা হলো অনেকগুলো মুখ, লেখা হলো অনেকগুলো আব্দার, আশা। তাই রোজনামচাটা হয়ে গেল একটা বিশাল স্বাক্ষরবই। আর তাতে অনেক আনন্দ, অশ্রু, আলো, ছায়া--আরো অনেক, অনেক কিছু। কিন্তু কখনো ভাবিনি আমার খেরোখাতার পাতা, যেটা শুধু আমার-ই, সেটা অন্য কেউ ছিঁড়ে ফেলতে পারে, অনাদরে, অবহেলায়, প্রতিহিংসায়। ভাবছি এখন নতুন করে।
----------------------------------------------------------------------------------
পুনশ্চঃ আমার এক বন্ধু আছে, এখানেই, আকাশ নাম। আকাশ অম্বর। আমি তাকে এর আগের পোস্টে বলেছিলাম আমার পরের পোস্টটি সাজাবো কিছু ছবি দিয়ে। খুব দুঃখিত বন্ধু, খুব। আমি এও ভেবেছিলাম প্রতিটি পোস্টের শেষে একটা-দু'টো গান দেবো এখন থেকে। ঐ যে বললাম, সব নতুন করে ভাবতে হচ্ছে!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১১:৪৬