somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিকিৎসক সাংবাদিক বিসম্বাদঃ সমস্যা কোথায়?

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা নিয়ে দেশের মানুষদের হতাশা বাড়ছে। চিন্তাশীল চিকিৎসকেরাও এই বিষয়টা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন। এই হতাশা মাঝে মাঝে বিস্ফোরক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। কয়েকদিন আগে দেশের তিনটি প্রধান হাসপাতালে দুঃখজনক ঘটনার মধ্যে দিয়ে চিকিৎসকদের ধারাবাহিক ধর্মঘট এবং চিকিৎসক ও সাংবাদিক পেশার বিসম্বাদ ও দুই পেশার তরুণদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় পারস্পরিক বিষোদগার দেশবাসী বেদনার সাথে প্রত্যক্ষ করেছে।

ঘটনায় কার দায় ছিল সেটা বিবেচনার চাইতে, কেন এমন ঘটনা দেশবাসীদের বারবার দেখতে হচ্ছে সেই বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চিকিৎসার মতো একটি জন সম্পৃক্ত ও অতি সংবেদনশীল পেশার জন্য আত্ম অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে কেন সামগ্রিকভাবে জনগণের সাথে এই পেশার দূরত্ব বাড়ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে সরকারী ও বেসরকারি হাসপাতাল গুলোর সেবার বিষয়ে জনগণের আস্থার সংকট বেড়েছে। এবং এই কারণেই বিপুল সংখ্যক রোগী দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। (Health Policy Plan. 2007Jul;22(4):263-73) গবেষণায় দেশের চিকিৎসকদের সার্ভিস ওরিয়েন্টেশনের দুর্বলতাই রোগীদের হতাশার পিছনে মুল কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে। সার্ভিস ওরিয়েন্টেশন বলতে বুঝায় বিশ্বস্ততা, সংবেদনশীলতা, আশ্বাসন,সহানুভূতি, সমাযোজন বা কমিউনিকেশন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সার্ভিস ওরিয়েন্টেশন টা কেন বাংলাদেশের চিকিৎসকদের মাঝে গড়ে উঠছে না? যেখানে দেশের বাইরে গিয়ে এই দেশের মানুষেরাই ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন ভাষার একই পেশার মানুষদের কাছে তুলনামুলকভাবে তৃপ্ত হয়ে ফিরে আসছেন? এর কারণ হয়তো অনেক, কিন্তু আজকে শুধু বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষার আলোকে এই সমস্যায় উপরে আলোকপাত করতে চাই। চিকিৎসা বিদ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় মানের পাঁচ বছর মেয়াদী গ্রাজুয়েশন আর আরো কমপক্ষে গড়ে চার বছর মেয়াদী পোস্ট গ্রাজুয়েশনে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপকতা আর ব্যাপ্তি আনতে পেরেছি কিনা সেটা বিশ্লেষণের দাবী রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাঠনিক সুবিধা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরণের বিশ্ব বিক্ষা জন্ম দেয়, সেই সুবিধা বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষার্থীরা কি নিতে পারছে?

বর্তমানের চিকিৎসা শিক্ষা কাগজে কলমে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সাথে যুক্ত থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সার্টিফিকেইট ইস্যু করা ছাড়া এই চিকিৎসা শিক্ষায় কোন অবদান ই রাখে না। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা শিক্ষায় প্রত্যক্ষ সংপৃক্ততার অভাবে সেই বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর বিপুল ব্যাপ্তির সুযোগ কাজে লাগিয়ে সমাজের নানা অংশের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ ও চিকিৎসা শিক্ষার্থীরা পায় না। ফলে শিক্ষাজীবনের প্রথমেই বৃহত্তর সমাজের চিন্তা এবং সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে শিক্ষার্থীরা। অনেকটা সামরিক বাহিনীর মধ্যে থাকা সৈনিকদের মতো একই পেশার একই চিন্তার মানুষদের মধ্যে থাকেন ফলে তাঁরা এক ধরণের ইন্ডক্ট্রিনেশন বা মতদীক্ষা দানের চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকেন।

ঔপনিবেশিক কাল থেকেই এই উপমহাদেশে কিছুটা ভিন্নভাবে মেডিক্যাল কলেজ কাঠামো গড়ে উঠেছে। সেই কাঠামোতে ইউরোপের প্রতিনিধিত্ব শীল মেডিক্যাল শিক্ষা কাঠামোকে অনুসরণ করা হয়নি। স্বাধীনতার পরেও আমরা সেই ধারাকে অব্যাহত রেখেছি শুধু তাই নয় আমরা একই ধারায় একক বিষয় নিয়ে (সিঙ্গেল ডিসিপ্লিন) বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির অদ্ভুত চিন্তা কাঠামোর মধ্যে আটকে পরেছি। এটা যেশুধু চিকিৎসা বিদ্যায় হচ্ছে সেটা নয়। সিঙ্গেল ডিসিপ্লিন বিষয়ের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ধারাতেই বিশেষায়িত শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটবে বলে আমরা আশা করছি।

চিকিৎসা শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান সিঙ্গেল সাবজেক্ট ইউনিভার্সিটি; বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো এবং কর্ম ব্যাপ্তির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও গবেষকদের একটি উল্লেখযোগ্য সময় পরীক্ষা, প্রশ্ন পত্র ও টেবুলেশন নিয়ে ব্যাস্ত থাকতে হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে এই প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ পরিগ্রহ করছে।

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপের প্রতিনিধিত্ব শীল মেডিক্যাল শিক্ষা কাঠামোর অনুসরনে অন্যান্য অনুষদের মতো মেডিসিন অনুষদ যদি একই ক্যাম্পাসে চলতো তাহলে অনেক স্বল্প খরচে উন্নতমানের চিকিৎসাশিক্ষার আয়োজন করা যেত। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত পড়ানোর জন্য প্রায় সব বিষয়ের ই দক্ষ শিক্ষক থাকে। বায়োকেমিস্ট্রি, পরিসংখ্যান, মাইক্রোবায়োলজি, জুরিস প্রুডেন্স, ফার্মাকোলজি, পাবলিক হেলথ এই সব বিষয় ই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষকেরাই পড়াতে পারেন। একই ক্লাস রুম ব্যবহার করে শিক্ষা প্রদান চলতে পারে। এমনকি চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষার্থীদের সাথে সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট বিষয়ের অন্য অনুষদের শিক্ষার্থীরা একই ক্লাসে বসে শিক্ষা নিতে পারে যারা এই বিষয়টি নিয়ে পড়ছেন।এভাবেই একজন আইনের ছাত্রের সঙ্গে অথবা অংক শাস্ত্রের ছাত্রের সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই পদ্ধতিতেই বিশ্বখ্যাত মেডিসিন ফ্যাকাল্টি গুলো শিক্ষা প্রদান করে। ফলে একজন চিকিৎসা শিক্ষার্থীর সঙ্গে সমাজের বৃহত্তর অংশের সাথে পারস্পরিক বোঝাপড়ার শর্ত তৈরি হয়ে যায়, সহমর্মিতা বাড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যে ধরণের কালেক্টিভ ভ্যালুজ তৈরি হয়, একজন চিকিৎসক সেই ভ্যালুজ শেয়ার করেন, একজন শিক্ষার্থী যিনি ভবিষ্যৎ চিকিৎসক হিসেবে তৈরি হচ্ছেন, তিনি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পান, পেশার ভিতরে গোষ্ঠী চিন্তার সম্ভাবনা কমে।

আমি বলছিনা যে সব মেডিক্যাল কলেজকে এই ব্যবস্থায় রুপান্তর করতে হবে, বরং বিশ্ববিদ্যালয় গুলো এক বা একাধিক অক্সফৌর্ড বা হার্ভার্ড বা উপসালা র মেডিক্যাল ফ্যক্যাল্টির মতো ফ্যাক্যাল্টি খুলতে পারে। নিজস্ব রিসোর্সকে কিঞ্চিৎ বর্ধিত করলেই এই ধরণের ফ্যক্যাল্টি শুরু করাযেতে পারে। ক্লিনিক্যাল বিষয়ের শিক্ষাদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাহায্য নিতে পারে। আমাদের হাসপাতাল গুলোতে রোগীর সংখ্যা প্রচুর। সম্প্রতি প্রায় সকল চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে হয় রোগীর আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে অথবা বৃদ্ধির প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে।

আমরা টেস্ট কেইস হিসেবেও দেখতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রস্তাবিত ফ্যাক্যাল্টি গুলো প্রত্যাশা অনুসারে চিকিৎসক তৈরি করতে পারছে কিনা? যারা সার্ভিস ওরিয়েন্টেশনে আগের প্রজন্মের চাইতে সবল এবং রোগীদের প্রত্যাশা পূরণে অধিক পারঙ্গম।

(লেখাটি ১৩ ই মে বণিক বার্তায় উপ সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়। লিঙ্ক ঃ Click This Link)
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×