শামচুল হক
সোহাগী জীবনের প্রথম একটি লোকের সেবা করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করতে লাগল। সেবা করার মাঝেও যে আনন্দ আছে আগে সে জানতো না। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে এসে এমন একটি সুযোগ পাবে এটা সে কল্পনাও করে নাই। বিপদের মাঝেও যে অনেক ভালো কাজের সুযোগ আসে এটা যেন তাই। মুমুর্ষ লোকের সেবা করার আনন্দে নিজের দুঃখ কষ্টের কথা ভুলেই গেল।
এদিকে অসুস্থ্য লোকটি ঘুমিয়ে পড়ায় পুরো বাড়িটাই সুনসান হয়ে গেল। বাইরের কোলাহল খুব একটা শোনা যায় না। লোকটির শুয়ে থাকা খাটের পাশের চেয়ারে বসে অনেক কিছু ভাবতে লাগল। মুহুর্তেই তার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। একবার তার খুব জ্বর হয়েছিল, মা তার মাথাটা কোলে নিয়ে সারা রাত বসে ছিল। মা বেঁচে থাকতে নিজেকে কখনও অসহায় মনে হয় নাই। আপদে বিপদে মা সব সময় রক্ষা করেছে। নিজে না খেয়ে তাকে পেট ভরে খাইয়েছে। রাতে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে আরামে ঘুমিয়েছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে অসহায়। না পায় পেট ভরে ভাত, না পায় শান্তি মত কোথাও ঘুমাতে। রাস্তার কুকুরের চেয়েও অনিরাপদ জীবন যাপন করছে।
অনেকক্ষণ পর অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই টেবিলে রাখা পাউরুটির উপর চোখ পড়ে গেল। এতক্ষণ তার ক্ষুধার কথা মনেই ছিল না। পাউরুটি দেখে পেটের ক্ষুধা মোচর দিয়ে উঠল। চেয়ার থেকে উঠে পাশের টেবিলে রাখা পাউরুটির একটি টুকরা মুখে পুরে চিবালেও গিলতে পারল না, অনাহারে গলা শুকিয়ে কাঠ, গ্লাসের পানিতে পাউরুটি চুবিয়ে নরম করে খেতে লাগল। অনাহারী পেটে পাউরুটি আর পানি পড়ায় শরীর কিছুটা চাঙা হলেও ভাতের ক্ষুধা মিটল না। ভাতের ক্ষুধা না মিটলেও উপায় নেই, বাইরে বেরোনোর উপায় নেই, বের হলেই পুলিশ থাপা দিয়ে ধরে নিয়ে যাবে। অগত্যা এই রুটি খেয়েই রাতের মত নিজের মনকে শান্ত করতে হচ্ছে, সাহস করে ঘরে না ঢুকলে এই রুটি কলাও তার ভাগ্যে জুটতো না। রাত জাগা শরীরে এতটুকু খাবারের পরেই দেহে অলস ভাব চলে আসে। অন্যায়ভাবে ঘরে ঢুকলেও নিরাপদ জায়গা ছেড়ে বাইরে যেতে মন চায় না। ঘরে ঢোকার অপরাধে কপালে কি দুর্গতি আছে তা বিধাতাই ভালো জানেন। মারধোর খাওয়ার আশঙ্কা সত্বেও নিয়তির উপর পরবর্তী পরিস্থিতি ছেড়ে দিয়ে পাশের রুম থেকে একটি মাদুর এনে লোকটির রুমের মেঝেতেই শুয়ে পড়ল। দীর্ঘদিনের অনিদ্রা অনাহারের শরীর। কোলাহল মুক্ত নিরিবিলি পরিবেশে মাদুরে গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন বেলা দশটা। ঘুম ভাঙতেই সেই রাতের শব্দ সোহাগীর কানে এলো। লোকটি আবার পানি পানি করছে। ঘুম থেকে উঠে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে লোকটির জন্য গ্লাস ভরে পানি নিয়ে এলো। এক হাত দিয়ে মাথা উঁচু করে ধরে আরেক হাতে গ্লাসের পানি মুখে দিতেই লোকটি চোখ মেলে তাকালো। সোহাগীকে দেখেই আশ্চার্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, কে?
এমনিতেই রাস্তার মেয়ে তারোপর অন্যায়ভাবে ঘরে ঢুকেছে, এমতোবস্থায় লোকটির প্রশ্নের উত্তরে কি জবাব দিবে সোহাগী ভেবে পায় না, আবার চুপ করে থাকলেও বিপদ হতে পারে। কিছু করতে না পারলেও রাস্তার মেয়ে হয়ে মরনাপন্ন অবস্থায় রাতে তাকে পানি খাইয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। এই সাহসের উপর ভর করেই সোহাগী সাদামাটা উত্তর দিল, মিয়া ভাই, আমি সোহাগী, আপনি কিছু খাইবেন?
সোহাগীর সাদামাটা উত্তর ও কিছু খেতে বলায় লোকটি আপন কোন লোক হবে মনে করেই কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। মুখটি অপরিচিত হলেও ঝটপট নাম বলে কিছু খেতে বলায় খুশি হলো। খাওয়ার কথা শুনে মাথা নেড়ে উত্তর দিল, খাবো।
টেবিল থেকে কয়েক পিচ পাউরুটি এনে লোকটির হাতে দিল। জ্বরের ঘোরে খেতে পারল না। একটু মুখে দিয়েই পানি চাইল। সোহাগী পানি দিলেও রুটি গিলতে কষ্ট হচ্ছিল। তার এ অবস্থা দেখে সোহাগী রুটি টুকরা করে পানিতে ভিজিয়ে নিজ হাতে মুুখে তুলে দিল। ভিজা রুটি মুখে তুলে দেয়ায় লোকটি কয়েক টুকরা খেয়ে আবার চোখ বন্ধ করল, কোন কথা বলল না।
লোকটির শুয়ে থাকা বিছানাটি এলোমেলো হয়ে আছে। সোহাগী এলোমেলো বিছানাটি ঠিকঠাক করতে গিয়ে বালিশের পাশে কিছু ঔষধ দেখতে পেল। কিছুদিন আগে সোহাগীর জ্বর হয়েছিল। তার জ্বরের সময় ডিসপেনসেরির লোকেরা পাঁচ টাকায় যেরকম ট্যাবলেট দিয়েছিল সেরকম ট্যাবলেট দেখতে পেল। মনে মনে ভাবল-- আমার জ্বারের সময় এরকম ট্যাবলেট খেয়েই তো জ্বর সেরে গিয়েছিল। এ লোকটিরও তো সেরকম জ্বরই মনে হয়। হয়তো এই ট্যাবলেট খাওয়ালেই জ্বর সেরে যেতে পারে। জ্বরের ট্যাবলেট অনুমান করেই সোহাগী একটি ট্যাবলেট হাতে নিয়ে লোকটির মুখের কাছে ধরে বলল, মিয়া ভাই, ওষুধ খান।
জ্বরের ঘোরেই লোকটি হা করল। সোহাগী ট্যাবলেট মুখের মধ্যে দিয়ে গ্লাস থেকে পানি ঢেলে দিল। লোকটি ট্যাবলেট আর পানি খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকল।
সোহাগী রাস্তার মেয়ে হলেও ট্যাবলেট নির্বাচনে ভুল করে নাই। ট্যাবলেটটি ছিল নাপা। ট্যাবলেট খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়। মাথা ধরাও কমে। একটু সুস্থ্য বোধ করায় চোখ মেলে তাকায়। এতক্ষণ তার হুস ছিল না। ট্যাবলেট খেয়ে জ্বর ছাড়ায় হুশ হলো। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ময়লা জামা পরিহিতা একটি মেয়ে তার মাথার কাছে চেয়েরে বসে আছে।
বালিশে মাথা রেখেই আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
সোহাগী এবারও সাদামাটা উত্তর দিল, আমি সোহাগী।
-- তোমাকে কে দিয়ে গেল?
-- কেউ দেয় নাই মিয়া ভাই, আমি একলাই আইছি।
কেউ দেয় নাই একলাই আইছি এই কথার কোন অর্থ বুঝতে পারল না। তবে পাল্টা কোন প্রশ্নও করল না। বরঞ্চ উল্টো আরো বলল, আমাকে খাবার দাও। আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
সোহাগী টেবিল থেকে তিনপিচ রুটি এনে আগের মতই পানিতে ভিজিয়ে মুখে তুলে দিতে লাগল। লোকটি তিন পিচ রুটি খাওয়ার পর আরো খেতে চাইলে সোহাগী বলল, মিয়া ভাই, এই তিনপিচ রুটিই আছিল, আর নাই।
রুটি নাই শুনে শুয়ে থাকা অবস্থায় চোখ বন্ধ করেই বলল, ঠিক আছে-- টাকা নিয়ে যাও, দোকান থেকে রুটি আর কলা নিয়ে আস।
বলিশের নিচ থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে দিলো। সোহাগী টাকা নিয়ে দ্রুত দোকানের দিকে চলে গেল কিন্তু বাহিরের গেটে তালাবন্ধ থাকায় আবার ফিরে এলো। লোকটিকে ডেকে বলল, মিয়া ভাই, গেটে তালা দেওয়া, চাবি দ্যান।
বালিশের কোনায় হাত দিয়ে গেটের চাবি বের করে দিল। সোহাগী বাসা থেকে অল্প দূরে রাস্তার ওপারে গিয়ে মুদি দোকান থেকে বড় একটি পাউরুটি আর দুই হালি কলা কিনে নিয়ে এলো। লোকটি কলা রুটি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
রুগির সাথে কথা বলতে পেরে সোহাগীর ভয় ভেঙে গেল। সকালে মনে করেছিল রুগিকে কিছু না বলেই চলে যাবে। কিন্তু রুগি পানি খেতে চাওয়ায় চলে যেতে চেয়েও চলে যাওয়া হয়নি। নাম পরিচয় জানার পরও অপরিচিত হিসাবে ঘর থেকে বের করে না দিয়ে উল্টো তাকে দিয়ে কলা রুটি কিনিয়ে আনায় সোহাগীর ভয় অনেকটাই কমে গেছে। নিজেকে অনেকটা নিরাপদ মনে করছে। রুগির বেচে যাওয়া কলা রুটি আবারো দু'টুকরা খেয়ে রুগির পাশেই বসে থাকল।
দুপুরের দিকেও লোকটি ঘুম থেকে উঠল না। তার ঘুমানোর সুযোগে সোহাগী সবগুলো রুম ঘুরে ঘুরে দেখে নিল। বিশাল বাড়ি। তিনটি শোবার ঘর, একটি বৈঠক খানা, একটি খাবার ঘর, একটি রান্না ঘর, রান্না ঘরের পশ্চিম পার্শ্বেও বারান্দা। দু’টি গোসল খানা, তিনটি টয়লেট। গোসল খানায় গিয়ে কল ঘুরাতেই গলগল করে পানি পড়ে। পরিস্কার পানি আর নিরিবিলি গোসল খানা দেখে সোহাগীর খুব গোসল করতে ইচ্ছে করল। অনেক দিন হলো গোসল করে না। গোসলের অভাবে শরীর জ্বালা করছে।
সোহাগীর গোসল করার খুব ইচ্ছে জাগলেও পরক্ষণেই সে ইচ্ছে মরে গেল। গোসল করবে কি করে? পরনের জামা ছাড়া অন্য কোন বাড়তি জামা নেই। আরেক সেট আধা ছিঁড়া জামা ছিল। কয়েক দিন আগে লেকের পানিতে গোসল করে সরকারী দেয়ালের উপর শুকিয়ে দিয়েছিল। মিউনিসিপ্যালিটির লোকজন ময়লা নিতে এসে জামাগুলোও ময়লার গাড়িতে ফেলে নিয়ে গেছে। দেখেও না করতে পারে নাই। পাশেই পুলিশ দাঁড়ানো ছিল। না করলে যদি পুলিশ পেটন দেয় সেই ভয়ে না করে নাই, শুধু অসহায়ের মত দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখেছে। সেইদিন থেকে জামার অভাবে আর গোসল করা হয় না।
গোসল করার জন্য ছিঁড়া কাপড় চোপড় খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। রান্না ঘরের কোনায় একটি ছিঁড়া লুঙ্গি আর একটি ছিঁড়া পাঞ্জাবী পড়েছিল। সেই কাপড় দু'টি নিয়েই গোসল খানায় ঢুকল। নিজের জামা ভিজিয়ে কল ছেড়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে অনেকক্ষণ গোসল করল। ইচ্ছামত গোসল করায় খুব আরাম বোধ হচ্ছে। লেকের পানিতে ডুবে ডুবে অনেক গোসল করেছে। বৃস্টিতে ভিজেও অনেক গোসল করেছে কিন্তু আজকের মত এত শান্তি কখনও পায়নি। জীবনের প্রথম টাইলস করা গোসলখানায় গোসল করল। এত সুন্দর আর এত নিরিবিলি গোসলখানা কখনও চোখে দেখেনি। ছন্নছাড়া জীবনে এরকম সুন্দর গোসলখানায় গোসল করবে এটা সে কল্পনাও করে নাই। গোসল করার মধ্যেও যে চরম তৃপ্তি পাওয়া যায় কিশোরী জীবনে আজকেই সে প্রথম অনুভব করল।
গোসল শেষে নিজের ভিজা কাপড় খুলে ছেড়া লুঙ্গি আর ছেঁড়া পাঞ্জাবী পরে নিল। ময়লা জামা গোসল খানায় রাখা সাবান দিয়ে খুব করে পরিস্কার করতে লাগল। জামা থেকে সাবানের ফেনাসহ কালো কালো অনেক ময়লা বের হচ্ছে। অনেক দিন হলো জামা কাপড় ধোয়া হয় না। তারোপর এই জামা পরেই ফুটপাতের ধুলাবালির উপর শুয়ে থাকতে হয়। রাস্তার ধুলাবালি আর নোংরা ময়লা লেগে জামায় এক ইঞ্চি চর পরেছিল। ভালো করে পরিস্কার করায় জামাগুলো যেমন হালকা হয়েছে তেমনি ওজনও অর্ধেক কমে গেছে। জামা ধুয়ে দু'হাত দিয়ে চিপে চিপে পানি ঝরিয়ে রান্না ঘরের পিছনের বারান্দায় শুকিয়ে দিল।
বিকালের দিকে লোকটির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সেই মেয়েটি তার ফেলে দেওয়া ছেঁড়া লুঙি, ছেঁড়া পাঞ্জাবী পরে তারই মাথার কাছে চেয়ারে বসে আছে। পানি খেতে চাইলে এক গ্লাস পানি এনে দিল। পানি খেয়ে মেয়েটির দিকে আবার তাকাতেই পাঞ্জাবীর ছেঁড়া ফাঁক ফোকর দিয়ে পেটের কিছু অংশ চোখে পড়ল। সোহাগীর দিকে একবার তাকিয়েই আর তাকালো না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে মুখ করে কাতরাতে কাতরাতে বলল, এগুলো পরছো কেন?
লোকটির প্রশ্ন শুনে সোহাগী ভাবল, তার লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরায় সে হয়তো রাগ করেছে। অপরাধীর মত ভয়ে ভয়ে জবাব দিল, মিয়া ভাই, আমার তো আর কোন জামা-কাপড় নাই, পরনের কাপড় ধুইয়া দিছি, শুকাইলেই আপনার কাপড় খুইলা দিমু।
তার এই সহজ সরল জবাবে লোকটি খুব খুশি হলো। আস্তে আস্তে বলল, আলনায় আমার ভাল পাঞ্জাবী আছে, তুমি ওইগুলা পর।
-- না মিয়া ভাই, লাগবো না, আমার জামা শুকাইলেই আমি আপনার জামা খুইলা ফালামু।
(ক্রমশ)
(ছবিঃ ইন্টারনেট)
প্রথম পর্ব পড়তে নিচে ক্লিক করুন-- -
গল্প ঃ সোহাগী
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:৩৪