somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফ - গ্লোবাল অর্থনীতি (৩)

১০ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১০:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্বের জন্য: Click This Link
দ্বিতীয় পর্বের জন্য:
Click This Link


অনেক কদিন সময় দিতে পারিনি। এর মধ্যে প্রসঙ্গ অনেক জমে গেছে। পরিস্হিতিটা এমন হয়েছে যে আমার লেখার নিজস্ব পরিক্পল্নার উপর দিয়ে নতুন কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে লেখার দাবী জোড়ালো হয়ে গেছে। তাই এই পর্বের উপস্হাপন একটু অন্যভাবে করব। আগের পর্বে নিক "ওস্তাসাঁই" বিশ্বব্যাঙ্ক নিয়ে Click This Link নয়া দিগন্ত পত্রিকার এই খবরটা নিয়ে আমাকে মন্তব্য করতে বলেছিলেন। সেই কাজের ছলে এই পর্বে আমার কথা সাজাবো।

নয়া দিগন্তের খবরটার ছিল "বিশ্বব্যাঙ্ক এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে"। খবরের মূল সোর্স খুঁজলাম বিশ্বব্যাঙ্কের ওয়েব সাইট থেকে শুরু করে লন্ডন টেলিগ্রাফ পর্যন্ত, পেলাম না। হতে পারে এটা কোন মন্তব্য প্রতিবেদন যেখানে সাধারণত অনানুষ্ঠানিক অনেক বক্তব্যের রেফারেন্স থাকে। হয়্ত ভিতরের খবরও তাই। তবে অফিশিয়াল খবর বলে এখনও মেনে নিচ্ছি না। বড় জোড় মনে হচ্ছে এটা তাঁর তহবিল সঙ্কটের কথা জোড় দিতেই একটা কথা। যাই হোক মূল সোর্সে খবরটা কিভাবে ছিল এটা পাবারও চেষ্টা করছি।

প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক ইস্তাম্বুলে বিশ্বব্যাঙ্কের বার্ষিক সভায় ৬ অক্টোবর ২০০৯, "The World Bank Group Beyond the Crisis" শিরোনামে যে বক্তৃতা দিয়েছেন http://go.worldbank.org/RK4MV3K5R0 তাতে, নয়াদিগন্ত রিপোর্টের অনেক তথ্যই ওখানে আছে, মিল পাওয়া যায়; কেবল "বিশ্বব্যাঙ্ক এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে" এমন কোন নেতি বক্তব্য ওখানে নাই। বিশ্বব্যাঙ্কের অনেক সঙ্কট সমস্যা, সমস্যার গোড়াটা কোথায়, ভবিষ্যতে কি হতে পারে, কী করা উচিত ইত্যাদির কথা আছে সেখানে।
এখন ধরা যাক, নয়াদিগন্তের রিপোর্টের কথা সত্যি, "বিশ্বব্যাঙ্ক এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে" - সেক্ষেত্রে এই বাক্যের মানে আমাদের পড়তে হবে, বিশ্বব্যাঙ্ক এক বছরের মধ্যে বড় ধরণের সঙ্কটে পড়তে পারে, বন্ধ নয়।

কেন "বন্ধ" নয়। কীসের উপরে দাঁড়িয়ে জোড়ের সঙ্গে আমি একথা বলছি? প্রথমত: আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক "বন্ধ" হয়ে যাবার কোন সম্ভবনা নাই। তবে অবশ্যই সংস্কার হবে। এমনিতেই একটা সংস্কারের কর্মসূচী ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বমন্দা সঙ্কট শুরুর আগে থেকেই নেয়া হয়েছিল, চলছে। নতুন পরিচালনা নীতি বিশেষত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে "গরীবদেশের আওয়াজ" একটু অন্তর্ভুক্ত করা যায় কী না, selective capital increase linked to changes in “voice” -জোয়েলিকের এই ফর্মুলা এই ভাষণেই আছে।
দ্বিতীয়ত: , এই দ্বিতীয় কারণ একটু বড় করে সময় নিয়ে বলব, সম্পূর্ণ ইস্যুটাতে পাঠকের একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে পারি। যাতে আমাদের পুরা ধারণাটায় একটা সামগ্রিক চিত্র হাজির করতে পারি। এখানে বেশির ভাগ রেফারেন্স ইস্তাম্বুল বার্ষিক সভায় জোয়েলিকের ভাষণ থেকে টানব। একটু লম্বা তবু একটা অংশ তুলে ধরছি, "What is the Role for the Bank Group in a New Post-Crisis World?" - এই সাব-হেডিং থেকে: বলছেন,
Of course the future is uncertain. If the recovery falters, or simply struggles slowly, should we risk a World Bank Group already stretched to the limit and unable to lead? In the face of the next crisis – another food emergency, the next epidemic – can we afford to have a World Bank Group that has to hold back? I thank the Development
Committee for committing yesterday that it will ensure that the World Bank Group has sufficient resources to meet further development challenges, and that it will reach a decision on this issue by Spring 2010. This is an important step forward in the first General Capital Increase for the World Bank in twenty years.
thank the Development Committee for committing yesterday that it will ensure that the World Bank Group has sufficient resources to meet further development challenges, and that it will reach a decision on this issue by Spring 2010"।
বাংলায় সার করে বললে, জোয়েলিক বলছেন, "অবশ্যই ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বিশ্বমন্দা থেকে পুনরুদ্ধার যদি পা হড়কে পিছলায় পড়ে অথবা নিদেনপক্ষে যদি শুধু গতি স্লথ করে আমরা কী বিশ্বব্যাঙ্ককে রিস্কের মধ্যে ফেলে দিতে পারি, যেখানে ইতোমধ্যে সে সঙ্কট-ধারণে ক্ষমতাসীমার বাইরে ও নেতৃত্ত্বদানে প্রায় অক্ষমতার জায়গায় পৌছে আছে? পরবর্তী কোন সঙ্কটের মুখে - কোন খাদ্য সঙ্কট বা কোন মহামারি - বিশ্বব্যাঙ্ক দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখবে এটা কী মেনে নিবার অবস্হায় আমরা আছি? আমি Development Committee [ব্যাঙ্কের পক্ষে তহবিল জোগাড় ও তার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রজেক্টে বরাদ্দ বিতরণ যার কাজ] এর শুকুর গুজার করি। তারা গতকাল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আসন্ন উন্নয়ন চাহিদার মেটানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাঙ্ক গ্রুপের জন্য যথেষ্ট তহবিল তারা নিশ্চিত করবে এবং ২০১০ সালের বসন্তের আগে এই ইস্যুতে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারবে"।

অর্থাৎ সঙ্কট আছে বিশেষত তহবিল সঙ্কট, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত - এটাও মানছেন। কিন্তু সঙ্কটকে পজিটিভ ঢঙয়ে (approach) উপস্হাপনে কেবল তহবিল যোগান দাতাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন (চাবুকও লাগাচ্ছেন) বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাঙ্ক ব্যার্থতার মানে কী। একথা থেকে একটা মানে বুঝা যাচ্ছে, প্রায়ই আমরা যে দাতা বা ডোনার এর কথা শুনি, সেই তহবিল দাতাদের "দাতা" সেজে আবির্ভাবে দান-গ্রহিতার (উন্নয়নের নামে টাকা- দান নেয়ার) চেয়ে দাতার স্বার্থই ওতে নিহিত বেশি। এটা এমনকি প্রচুর মুনাফা কামানো দেশী কোন ব্যবসায়ীর দানধ্যান করার মত দান খয়রাত নয়। এমনকি পরকালের সোয়াব হাসিল করার স্বার্থে দান খয়রাত ধরণের কারও দানও নয়। বড়লোক দেশ তহবিলে "দান" করলে সেই "দান" বিশ্বব্যাঙ্কের উন্নয়ন প্রজেক্ট চালাবে, চালু রাখবে - চালু থাকলে বিশ্বমন্দায় আক্রান্ত সব দেশ (ওর মধ্যে আবার ঐ বড়লোক দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্হ হয়ে আছে) সীমাহীন মন্দা থেকে বের হয়ে পুনরুদ্ধার পাওয়ার সম্ভবনা স্বার্থ লুকিয়ে আছে - এই হলো সেই পুরা চক্র।
আমার পোষ্টের প্রথম পর্বে আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ককে একটা টাকা লগ্নির বা টাকা খাটিয়ে মুনাফা কামানোর প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিত্রিত না করতে বলেছিলাম; ওর সুদের হার ১% এর নীচে উল্লেখ করে এই লগ্নি-সুদের ধারণা করা ভুল বলেছিলাম। জোয়েলিকের কথা থেকে এখানেও আমরা দেখছি আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের এটা লগ্নি-সুদের কারবারের ব্যাপার না। তাহলে কী? এখন সেখানে যাব।

একটা ছোট্ট কাল্পনিক উদাহরণ সাজাই। ধরা যাক একটা যুদ্ধ পীড়িত দেশে রাষ্ট্র ভেঙ্গে পরেছে, সরকার ব্যবস্হা বলতে কিছু নাই। কিন্তু ঐ দেশ আবার কাঁচামালের সম্ভার, আল্লায় তামার খনি দিয়েছে প্রচুর; সারা দুনিয়ার ৪৫ % ভাগ তামা একা ঐদেশেই পাওয়া যায়। এছাড়াও কম কসরতে খরচে তা তোলা যায়। দৈত্যের মত কাঁচামাল তামার চাহিদা নিয়ে চীন হাজির। তামার তারে প্রস্তুত চীনা প্রডাক্টের চাহিদা নিয়ে আমেরিকার বাজারও প্রস্তুত। এই পরিস্হিতিতে বিশ্ববাজারে তামার দাম দ্বিগুণ হয়ে আছে। সমাধান: জাতিসংঘ শন্তি মিশন।

দ্বিতীয় উদাহরণ: সাভারে একটা শিল্প এলাকা গড়তে হবে। মানে জমির দাম, মাটি ফেলে এলাকা ডেভলপ করা, ভিতরে প্লট মেপে আলাদা করে রাস্তাঘাট, পানি কারখানার হাই ভোল্টেজ বিদ্যুত ব্যবস্হা, মুল শিল্প এলাকাকে হাইওয়ের সাথে সংযোগের রাস্তা ইত্যাদির যে কাজ - ডেভলপমেন্ট, এটা নিজেও তো আসলে একটা ব্যবসা বিনিয়োগ মুনাফার ব্যাপার হতে পারে। একটা কোম্পানী ধরা যাক তার নাম 'কখগ', তার টাকা খাটানো, সুদসহ-ব্যঙ্কঋণ (লগ্নিপুজি) পরিশোধ ইত্যাদি করে মুনাফা কামাতে চায় । কখগ কোম্পানীর কাজটাকে এককথায় বলা যায় ইনফ্রাষ্টাকচার বা অবকাঠামো তৈরি তার কাজ বা পণ্য তৈরি। শিল্প এলাকা গড়ার ইনফ্রাষ্টাকচার কাজ শেষে এবার ওখানে কারখানা বসাতে ইচ্ছুক যারা, ইনফ্রাষ্টাকচার কোম্পানীর কাস্টমার, পার্টি - বলা যাক এরা উৎপাদন কোম্পানী। এখন ইনফ্রাষ্টাকচার কোম্পানী যে ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে ব্যবসায় নেমেছিল তার সুদ, কম করে ধরি, ১৩ % আর তার নিজের মুনাফা ১০% ধরলে মোট ২৩% মুনাফার নীচে সে কারখানা বসাতে ইচ্ছুক উৎপাদন কোম্পানী, ধরি "চছঝ", কে প্লট দিতে পারবে না। "চছঝ" কোম্পানী আবার তার উৎপাদিত পণ্যের আয় থেকে এই ইনফ্রাষ্টাকচার কোম্পানীর বিনিয়োগ+২৩% অংশের দায় পরিশোধ করবে। "চছঝ" কোম্পানী হিসাব করে দেখল তার নিজের ব্যঙ্কঋণ ১৩% সুদে + নিজের মুনাফা ১০% মোট ২৩% এর উপরে কখগ কোম্পানীর বিনিয়োগ+২৩% অংশের দায় যোগ করতে হবে। এতে তার পণ্যের দাম এত বেশি রাখতে হবে যে পণ্য বিক্রি করা মুশকিল, রিস্কি বিনিয়োগও বটে। সে আগ্রহ করল না।
এখন যদি ইনফ্রাষ্টাকচার তৈরির কাজটাকেও একটা ব্যবসা-বিনিয়োগ -মুনাফা হিসাবে না করে স্রেফ কষ্ট বেসিস, ইনফ্রাষ্টাকচার তৈরি করতে যা খরচ হয়েছে তাই সাথে একটা নামমাত্র সুদ (১% এর নীচে) যোগ করে সম্পন্ন করা যায় তাহলে "চছঝ" টাইপের অনেক কোম্পানীকে আগ্রহী হয়ে ছুটে আসতে দেখা যাবে। পুঁজিবিনিয়োগের সামগ্রিক চিত্রের দিক থেকে যদি দেখি তাহলে এঘটনায় মানে দাড়ালো, মোট পুঁজি ইনফ্রাষ্টাকচার অংশে ১% আর উৎপাদন কোম্পানীর (চছঝ কোম্পানীর ব্যঙ্কঋণ ১৩% ) অংশটা নিশ্চিত করতে পারলে পুঁজি বিনিয়োগ নিজেকে সচল রাখতে পারে। সেই সাথে ঐ লগ্নিপুঁজির ব্যঙ্ককেও যারা উৎপাদন কোম্পানীকে ঋণ দাতা। এতে সামগ্রিক পুঁজির মোট মুনাফা কম হলেও তার সচল জীবিত থাকার রাস্তা এতে খুলে যায়। স্হবির হয়ে ক্ষয় পাবার চেয়ে এটা বেঁচে থাকার ভাল রাস্তা বটে। সামগ্রিক পুঁজির তৎপরতায় ইনফ্রাষ্টাকচার অংশটার দায় মালিকানার ধরণ রাষ্টীয় আর "উৎপাদন" কোম্পানীর অংশের মালিকানা ব্যক্তিগত; পুঁজির আকারে প্রথমটা বিশাল দ্বিতীয়টা ক্ষুদ্র।
বিশ্বব্যাঙ্কের কাজ হলো ইনফ্রাষ্টাকচার অংশটা। যার দায় যেটার মালিকানার ধরণ রাষ্টীয় বলেছি এটাকে রাষ্টীয় সীমানার বাইরে ছড়িয়ে দেয়া, পুজির বিচলন অবাধ করে ছড়িয়ে দেয়া; পুজির স্বভাবধর্ম গ্লোবাল হতে চাওয়া, একে গ্লোবাল হতে সাহায্য করা। নামমাত্র সুদে (কেবল Operational Cost) ইনফ্রাষ্টাকচার গড়ার কাজে বিনিয়োগ - এটাই বিশ্বব্যাঙ্ক ও তার কাজ। আর তাহলে যেটাকে আমরা "দাতা" বা ডোনারদের দান খয়রাত হিসাবে জানতে অভ্যস্ত, বিশ্বব্যাংকের কেতাবি ভাষাতেও যারা "দাতা"- এরা তার মানে আসলে নিজেদেরকেই দাতা, সামগ্রিক পুঁজি তৎপরতাকে সচল রাখতে দান; বিশ্বব্যাঙ্কের মাধ্যমে সুবিন্যস্তভাবে ইনফ্রাষ্টাকচার খাতে বিনিয়োগের দাতা। কারণ এই বিনিয়োগই একমাত্র ব্যক্তি বা শেয়ার কোম্পানীর হাতে থাকা পুজির অংশসহ ব্যবসা মুনাফা বা লুটপাট করে সামগ্রিক পুঁজিকে জীবন্ত সচল করতে পারে, গ্লোবাল হয়ে উঠতে পারে।
তাহলে বিশ্বমন্দা মানে কী দাঁড়াল? মানে পুঁজির একটা সামগ্রিক সঙ্কট। যখন পুঁজি খাটানোর পর তা আর আত্মস্ফিত হয়ে মুনাফাসহ ফিরে আসে না। শুধু তাই নয় খোদ পুঁজিপাট্টাই গায়েব, এক নিরন্তর ক্ষয়। প্রতিক্রিয়ায় শিল্প কারখানা বন্ধ, চাকরি হারানো, আবার চাকরি হারানোর ফলে মজুরের ক্রয়ক্ষমতা হারানো, ক্রয়ক্ষমতা হারানো মানে বিক্রি নাই, মানে কারখানা উৎপাদন কম, কারখানা বন্ধ - এক চক্রকার সমস্যার ঘুর্ণির আবর্তে সারা দুনিয়া। সামগ্রিক পুঁজি ক্রম মৃত অচল হবার সম্ভবনা, পুঁজির গ্লোবাল হয়ে উঠার স্বভাব রুদ্ধ হওয়া।
বিশ্বব্যাঙ্কের স্বভাব হলো, বিশ্বমন্দাকে কেবল চাকরি হারানো, কারখানা বন্ধের দিক থেকে শিহরণ জাগিয়ে ইস্যুটাকে উপস্হাপন করা। এটা যে পুঁজির নিজেরই খাসিলত, সঙ্কট সে দিকটা প্রকাশ্য কথাবার্তা, কেতাবি কাগজে এই স্বার্থ বিষয়ক দিকটাকে আড়াল রাখা। আড়ালে রাখার কাজটা আরও সহজ করে দিয়েছে অন্য আর একটা ঘটনা। ১৯৪৪ সালে জন্মের সময় ওর আসল নাম ছিল, IBRD (International Bank for Reconstruction and Development) যা সংক্ষেপে World Bank । Reconstruction শব্দটা যদি খেয়াল করি এটাই উপরে আলোচনা করা ইনফ্রাষ্টাকচার অংশে পুঁজির কায়কারবার। Reconstruction এর Re যোগ করার দরকার পরেছিল যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউরোপের Re- বা পুনরায় ইনফ্রাষ্টাকচার গঠনের কালে। সেই সাধারণ অর্থ এর Development। এভাবে এটা টানা চলেছিল ১৯৬০ সাল পর্যন্ত।
ফলে "স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে সহায়তা দেবার জন্য ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বব্যাংক" - নয়াদিগন্ত যেমন লিখেছে, এই কথাটা ফ্যাক্টস বা সত্যি না। ইউরোপের বাইরে কোন তৎপরতা চিন্তা ১৯৬০ সালের আগে বিশ্বব্যাঙ্কের চিন্তাতে দানা পাকে নাই। ১৯৪৪ সালে আইএমএফের পাশাপাশি বিশ্বব্যাঙ্ক খোলার তাগিদ এসেছিল কেবল ইউরোপের কথা ভেবে, এর "পুণর্গঠন ও উন্নয়নের " লক্ষ্য নিয়ে। তবে পুঁজির নিজেরই খাসিলত, সঙ্কট গ্লোবাল হয়ে উঠার সমস্যা, রাষ্ট্রের সীমানা তাকে অবাধ হতে না দেবার সমস্যা- যেগুলো উপরে আলোচনা করেছি সেটা শুরু থেকেই উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠাতা (Founder father) অর্থনীতিবিদ সবার কাছে এটা উপলব্দিতে ছিল। আর শুধু ইউরোপই কেন লক্ষ্যবস্তু হলো, এটাও একটা বড় প্রশ্ন -এই প্রশ্নের জবার পরের কোন পর্বে দিব।

১৯৬০ সালের পরে একটা বোধোদয় ঘটে, পুঁজিকে গ্লোবাল চরিত্রে দেখতে চাওয়ার ঈপ্সিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছিল না দেখে। কারণ ততদিনে ইউরোপের বাজার saturated হয়ে গিয়েছে, আর বাড়ছিল না। এসব লক্ষণ আগাম দেখতে পাওয়া যেত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের পৃথিবীর চেয়ে তখন অনেক সহজেই। কারণ আগে বিভিন্ন দেশ-রাষ্ট্র জাতীয় অর্থনীতির কথা বলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক, তথ্য বাইরের অন্য কারও সাথে শেয়ার করত না, ফলে পাওয়া সম্ভব ছিল না। এছাড়া মনিটরিং ব্যবস্হাও সবল ছিল না। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একএক দেশে জাতীয় অর্থনীতির নামে কায়কারবার চলত। পুঁজির সামগ্রিক গ্লোবাল বিকাশের প্লানিং এর দরকারে এসব তথ্য গুরুত্ত্বপূর্ণ। বেশির ভাগ সময়ে বিশ্বব্যাঙ্কের নিজ উদ্যোগে গবেষণায় এসব তথ্য, সূচক, বেজ ফ্যাক্টস ও ফিগার নিজেরাই যোগাড় করেছে। এইজন্য বলা যায়, আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক জন্মানোর পরেপরেই একমাত্র গ্লোবাল পুঁজি একটা সামগ্রিক প্লানিং এর আওতায় পরিচালিত হতে পেরেছে, গবেষণা করে তথ্য, সূচক, বেজ ফ্যাক্টস ও ফিগার যোগাড় করেছে। কান্টি বেজ ফ্যাক্টস ও ফিগার নামে এখন তা আরও সমৃদ্ধ, ওদের ওয়েব সাইটে সর্ব-গম্যও।
ফলে গ্লোবাল পুঁজি একটা সামগ্রিক প্লানিং এর কথা মাথায় রেখে বিশ্বব্যাঙ্ককে আবার ঢেলে সাজানো হয়। ১৩ বছর বিশ্বব্যঙ্কের প্রেসিডেন্টের রবার্ট ম্যকনামারার আমলে (১৯৬৮-৮১) এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। ইউরোপের বাইরে এশিয়া ও সদ্য স্বাধীন আফ্রিকার দেশে বিশ্বব্যাঙ্কের কর্মসূচীর সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন। এই আমলে বিশ্বব্যাঙ্কের খোলনলচের বহু কিছু ঢেলে সাজানো হয়। জোয়েলিক ইস্তাম্বুল বার্ষিক সভা বক্তৃতায় ম্যাকনামারার ভূয়সী প্রসংশা করেছেন। তিনি সম্ভবত বিশ্বব্যাঙ্কের আবার খোলনলচের বহু কিছু ঢেলে সাজানো দরকার টের পেয়ে ম্যকনামারা কে স্মরণ করেছেন।
ম্যকনামারার আমলের আর একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো "ইনফ্রাষ্টাকচার" ধারণার সংজ্ঞা বদলে ফেলা। সেই সাথে অনুসঙ্গে ডেভলপমেন্ট কথাটারও অর্থে বদল। আগে ইনফ্রাষ্টাকচার বলতে ধারণায় উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট শ্রমকে ইনফ্রাষ্টাকচারে অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হত না। পুঁজির আত্মস্ফীতি ঘটানোর জন্য দরকারী নিয়ামক শক্তি বলেও বিবেচনা করা হত না। শ্রম - "ও তো কিছু না করতেই পাওয়া যায়" - ধরণের একটা ধারণা কাজ করত। অথবা বলা যায় শ্রমের ইনফ্রাষ্টাকচার বলে কোন ধারণা ছিল না। শ্রমের ইনফ্রাষ্টাকচার মানে কেউ কারখানা কারবার চালাতে গেলে ১. বিভিন্ন মাত্রার শিক্ষা, দক্ষতার যে শ্রম দরকার তা কোথা থেকে পাবে, ২. প্রতিদিন যেন এসব শ্রম কারখানা, কারবারের দরজায় সুস্হ সবল হাজির পাওয়া যাবে, তা কীভাবে, ৩. বুড়া কর্মক্ষম হয়ে গেলে সমাজের বড় আপদ না হয়ে যায়, ৪. এ আবার যদি বাচ্চা পয়দা না করে, পেলে পুষে বড় না করে তাহলে সামাজিকভাবে নতুন নিরন্তর শ্রম কোথা থেকে হাজির পাওয়া যাবে ইত্যাদি - সবকিছু যেন নিশ্চিত পাওয়া যায় এমন "শ্রমের ইনফ্রাষ্টাকচার" ও তার জন্য একটা পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ - এটাই পুঁজির দিক থেকে দেখা শ্রমের ইনফ্রাষ্টাকচার। ম্যকনামারার আমলে "শ্রমের ইনফ্রাষ্টাকচার" পুঁজির স্বার্থ বিবেচনায় দরকারি জিনিষ মনে করে বিশ্বব্যাঙ্কের কেতাবে আগের ইনফ্রাষ্টাকচার ধারণায় শ্রমকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ফলে তখন থেকেই "ইনফ্রাষ্টাকচার" উন্নয়নের ধারণা বদলে গিয়ে আগে যেখানে কেবল উৎপাদনের জন্য ফিজিক্যাল কাঠামো ইট কাঠ পাথর বুঝা হতো এবার তার সাথে যুক্ত হয় - মানব কাঠমোর উন্নয়ন। শ্রমের ইনফ্রাষ্টাকচার ও ফিজিক্যাল ইনফ্রাষ্টাকচার উভয়ে মিলে ইনফ্রাষ্টাকচার ও তার ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়ন। তবে মানুষ সবসময়ই রক্ত মাংসের সংবেদে সক্রিয় মানুষ হলেও তখনও বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় মানুষ ইট কাঠ পাথরের মত বস্তুই; সেই বস্তুজ্ঞানে শ্রমের উন্নয়ন। এবার উন্নয়ন শব্দটা জগতজুড়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ফেলতে লাগল, আজও চলছে। উন্নয়ন মানে স্বাস্হ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো রাস্তাঘাট উপজেলা বানানো, প্রজেক্ট, কর্মসূচি...... কী না! এখন কী খোদ রাষ্ট্রটাই। বাংলাদেশে এর প্রথম গুছানো প্রবেশ ঘটেছিল শেখের আমলে, ওটা একই সাথে ঘটনা চক্রে বাকশাল ঘোষণার পরপরই। শেখ মুজিব Structural Adjustment Programme এর চুক্তি সই করে যেতে পারলেও ওর ভাল মন্দ কিছুই দেখে যেতে পারেন নি, তাঁকে মেরে ফেলা হয়।
এই শেষ প্যারাটা বলতে একটু লম্বা করে ফেললাম "উন্নয়ন" কথাটা বুঝাবার জন্য, এর সাথে "ইনফ্রাষ্টাকচার" কথাটার সম্পর্ক ও সর্বোপরি "দাতা" - কে কাকে দিচ্ছে এগুলো বুঝাবার জন্য।

তাহলে এবার কথা সাজাই সারকথায় । রাস্ট্রের খরচে "ইনফ্রাষ্টাকচার" ছাড়া -ওদেরই বিচারে- দেশী বা বিদেশী প্রাইভেট কোম্পানীগুলোর দখলে থাকা পুঁজির কোন ব্যবসা মুনাফা কারবার অসম্ভব। কাজেই "ইনফ্রাষ্টাকচার", "উন্নয়নের" কারবারী বিশ্বব্যাঙ্কের তৎপরতা ওর অনুষঙ্গ, তার লাগবেই। অতএব, "বিশ্বব্যাঙ্ক এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে" - এই কথার ভিত্তি নাই। বিশেষ করে "বন্ধ" তো হতেই পারে না। আমরা কথাটাকে অন্যভাবে পড়তে পারি। আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের বিশ্বমন্দা সঙ্কটে আছে, ফলে তহবিল সঙ্কট। ফলে সংস্কার হবে। নতুন করে খোলনলচে বদলে নতুন করে হাজির হবার পায়তারা করছে সে। জোয়েলিকের ইস্তাম্বুল বক্তৃতায় সেইসবের স্মরণ, হুশিয়ারি আছে। কয়েকবার তিনি ১৯৪৪ সালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্কের জন্মের ২১ দিনের নিগোশিয়েশনের উল্লেখ করে বলছেন এবার হয়ত আরও বেশি লাগবে। তবে আমেরিকার বদলে এবার নতুন শক্তি হিসাবে চীনকে মেনে নিতে যে তার অস্বস্তি নাই তার স্বীকারোক্তিও আছে। কিন্তু পুঁজিকে গ্লোবাল করার দায়িত্ত্ব থেকে পিছপা হতে জোয়েলিক রাজি না। সকলকে হুশিয়ারি দিয়ে "Responsible Globalization" পক্ষে তিনি সকলকে হাজির চেয়েছেন।

বিশ্বমন্দার পাশপাশি সারা দুনিয়া জুড়ে কোন বিপ্লবী পরিস্হিতি জারি থাকত তবে "বিশ্বব্যাঙ্ক এক বছরের মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতে পারে" - এই কথার একটা মানে হত থাকত হয়ত। বুদ্ধিমান জোয়েলিক সে সম্ভবনা নাকচ করে দেননি। গতমাসে G-২০ এর সভার কথা উল্লেখ করে বলছেন, It should be connected to our G-186 here in this room.

গ্লোবাল অর্থনীতিতে চীনের উত্থান ও ডলারের পতন লক্ষ্য করে সম্ভবত বলছেন, "The old order is gone. We should not waste our time and tears lamenting it. Today we must build anew". আমেরিকার দিকে তাকিয়ে সম্ভবত তিনি বলছেন, Understanding shifting power relations is fundamental for shaping the future।
সার কথায় যেন বা G-১৮৬ জাতির বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় তিনি নিজেকে দেখতে চান। কিন্তু সেক্ষেত্রে সেটা কী বিশ্বব্যাঙ্ক থাকবে? আমরা জানি না।

বিশ্বব্যাঙ্কের প্রসঙ্গ শেষ হয় নাই। কেবল ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ও উন্নয়নের দিকটা বলা শেষ করেছি। এর নেতিবাচক দিক এখনও কিছুই আসেনি। এছাড়া আইএমএফ প্রসঙ্গ একেবারেই বাদ পরে আছে এই পর্বে। পরবর্তী পর্বে দেখা হবে।

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১০:৩৫
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×