somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কনষ্টিটিউশন পর্যালোচনাঃ সুরঞ্জিতের বক্তব্য অনুযায়ী বাকশাল চতুর্থ সংশোধনীও অবৈধ (পর্ব-৩)

২২ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ১১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কনষ্টিটিউশন সংশোধনী পর্যালোচনার গত দুই পর্বে একটা পটভুমি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি, এরপর এবার মুল পর্ব।
প্রথম পর্বঃ Click This Link
দ্বিতীয় পর্বঃ Click This Link


প্রথম আলোর সাক্ষাতকারে জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী (১৯৭৯) প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একটা নতুন ও গুরুত্ত্বপূর্ণ আপত্তি তুলে বলছেন, “প্রতিটি দেশের সংবিধানে কিছু মৌলিক নীতি থাকে। সাংবিধানিক পরিষদে যা প্রণীত হয়। পঞ্চম সংশোধনী কি সে ধরনের কোনো পরিষদে হয়েছে? হয়নি” । ওর সারকথা হলো, সুরঞ্জিতের সাংবিধানিক পরিষদে মানে কনষ্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলী বা গণপরিষদের সভা বসানো ছাড়া জাতীয় সংসদে বসে কনষ্টিটিউশন ও এর মৌলিক নীতি কায়েমও করা যায় না, বদলও করা যায় না।

আমরা সুরঞ্জিতের বক্তব্য সমর্থন করে আকড়ে ধরতে চাই। কিন্তু সুরঞ্জিত কী তাঁর বক্তব্যে অনড় থাকবেন? আমাদের সন্দেহ করার কারণ আছে।
কনষ্টিটিউশনের পঞ্চম সংশোধনী (১৯৭৯) এর আগের সংশোধনী হলো শেখ মুজিবের বিখ্যাত বাকশাল বা কনষ্টিটিউশনের চতুর্থ সংশোধনী। আমাদের প্রথম জাতীয় সংসদে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী কনষ্টিটিউশনের এই সংশোধনী আনা হয়েছিল।
সুরঞ্জিতের বক্তব্যের মাপকাঠিতে বাকশাল চতুর্থ সংশোধনীও পঞ্চম সংশোধনীর মত কনষ্টিটিউশনে মৌলিক পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তন শেখ মুজিব জাতীয় সংসদে বসেই ঘটিয়ে ছিলেন, কোন গণপরিষদে নয়। ফলে বাকশাল বা কনষ্টিটিউশনের চতুর্থ সংশোধনীও অবৈধ। এখন সুরঞ্জিত কী সেকথা মানবেন? পাঠকের সন্দেহ করার কারণ আছে।

শুধু তাই নয়, মৌলিক নীতিতে পরিবর্তন বলতে সুরঞ্জিত (বাঙ্গালি)জাতীয়তাবাদ, গনতন্ত্র, ধর্মনিরেপক্ষতা ও সমাজতন্ত্র – এই চার নীতিতে পরিবর্তন আনা বুঝিয়েছেন। এগুলোকে আমরা কনষ্টিটিউশনের কোন মৌলিক নীতি নয় বড় জোড় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসুচী বলতে পারি। কিন্তু শেখ মুজিবের বাকশাল চতুর্থ সংশোধনী চার নীতির মত অকেজো দলীয় কর্মসুচী নয়, সত্যিকার অর্থেই এটা কনষ্টিটিউশনের প্রাইমারী মৌলিক ভিত্তি অস্তিত্ত্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল যা আরও মারাত্মক এবং তা সংসদে বসেই ঘটিয়েছেন।

এই দুটো বিষয় নিয়ে এখানে কথা বলব, বিচার বিবেচনা করব। আর, কনষ্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলী বা গণপরিষদের সভা ডেকে সংশোধনী আনা অথবা জাতীয় সংসদে বসে সংশোধনী আনা – এই দুইয়ের তফাৎ বিষয়টাকে গভীরে তত্ত্বীয় দিক বুঝতে পাঠককে আগের দুই পর্বে যেতে হতে পারে।

কনষ্টিটিউশনে চতুর্থ সংশোধনীর হামলা:
আমাদের কনষ্টিটিউশন মোট এগার অধ্যায়ে (Part XI) ভাগ করে গ্রন্থিত। এর ষষ্ট অধ্যায় (Part VI) জুডিশিয়ারী বা বিচার বিভাগ শিরোনামে। চতুর্থ সংশোধনী বাকশাল এই ষষ্ট অধ্যায়ে নতুন করে এক সংযুক্তি এনেছিল কুখ্যাত Part VI A উপ-অধ্যায় হিসাবে, শিরোনাম ছিল ষষ্ঠ-ক ভাগ জাতীয় দল। এখানে বলা হয়েছিল, দেশে একটাই দল থাকবে জাতীয় দল, বাকি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। শেখ মুজিব সেই একমাত্র জাতীয় দলের নাম দেন “বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ” বা সংক্ষেপে বাকশাল। স্বভাবতই Part VI A এই উপ-অধ্যায়টা এখন কনষ্টিটিউশনে বিলুপ্ত।
চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ষষ্ট অধ্যায়ে এই Part VI A আনা হয়েছিল ২৫ জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে। অর্থাৎ এরপর থেকে বাকশাল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কেবল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেই চতুর্থ সংশোধনী শেষ হয় নাই, কনষ্টিটিউশনের গুরুত্ত্বপুর্ণ আরও অনেক অনুচ্ছেদে বদল আনা বা বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। এছাড়া এই সংশোধনীর সুবিধা নিয়ে আরও কিছু আইন জারি করা হয় যেমন,

১। The District Administration Act 1975 জারি করা হয় ১০ জুলাই ১৯৭৫
২। The Newspapers (Amendment of Declaration) Act 1975, জারি করা হয় ১৯ জুলাই ১৯৭৫

এর প্রথমটা বাকশালী গভর্ণর প্রথা বলে পরিচিত। ইতোমধ্যে সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছিল। এই আইন বলে, এবার প্রত্যেকে জেলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অথবা কোন এমপি নেতাকে ঐ জেলার গভর্ণর ঘোষণা করা হয়েছিল। ঐ জেলার রাজনৈতিক প্রশাসনিক সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ছিল গভর্ণরের হাতে।
দ্বিতীয়টা হলো, ব্যক্তি মালিকানাধীন চারটি পত্রিকা এখন থেকে মালিকানা সরকারের বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। আর বাকি সমস্ত পত্রিকা প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ মানে বাকশালের বিরুদ্ধে পাবলিক প্রচারণার জগতে সবচেয়ে বেশী আলোচিত ঘটনা ছিল উপরের দুই আইন ও বাকশাল একমাত্র দল বলে ঘোষণা । তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা হিসাবে এরচেয়েও বেশী তাৎপর্যপূর্ণ ছিল খোদ চতুর্থ সংশোধনীতে আনা কনষ্টিটিউশনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে রদবদল। এককথায় বললে, বাংলাদেশের ১৯৭২ সালে প্রণীত খোদ কনষ্টিটিউশনই আততায়ী শেখ মুজিবের হাতে খুন ও মৃত হয়ে যায় সেদিন ২৫ জানুয়ারী ১৯৭৫।

চতুর্থ সংশোধনী গুরুত্ত্বপুর্ণ দুটো অনুচ্ছেদে হামলা করে। এর প্রথমটা হলো অনুচ্ছেদ ৪৪; কনষ্টিটিউশনের তৃতীয় অধ্যায়ে নাগরিক মৌলিক অধিকার শিরোনামের এক অনুচ্ছেদ এটা। এটা রাষ্ট্রের কোন নতুন আইন চালু করা অথবা অন্য যেকোন উপায়ে নাগরিক জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করার বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টের কাছে নালিশ, মামলা রুজু করার অধিকার প্রসঙ্গে। চতুর্থ সংশোধনী এই মৌলিক নাগরিক অধিকার রদ করে দেয়। আইনী ভাষায় একে নাগরিকের move to High Court এর মৌলিক অধিকার বলা হয়।
দ্বিতীয়টা অনুচ্ছেদ-১০২, কনষ্টিটিউশনে হাইকোর্টকে জাতীয় সংসদে প্রণীত যে কোন আইনের উপরে হাইকোর্টের নজরদারী, আদেশ, নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা বিষয়ক এই অনুচ্ছেদে। এটা আগের ৪৪ অনুচ্ছেদের পরিপূরক। ৪৪ অনুচ্ছেদে সংরক্ষিত নাগরিকের move to High Court এর অধিকার আমলে নিয়ে প্রতিকার দিতে গিয়ে হাইকোর্ট বাস্তবে যাতে সরকার বা জাতীয় সংসদের উপর কর্তৃত্ত্ব খাটাতে পারে, প্রয়োজনে কোন আইন বাতিল ঘোষণা পারে, সরকারের নেয়া কোন কাজ পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে পারে সেজন্যই ১০২ অনুচ্ছেদে আলাদা করে লিখে কোর্টকে স্পষ্ট করে এই ক্ষমতা দিয়েছে। আইনের ভাষায় অনুচ্ছেদ-১০২ কে হাইকোর্টের enforcement of any the fundamental rights বলা হয়।
অনুচ্ছেদ-৪৪ জনগণের মৌলিক অধিকারের দিক থেকে উপস্থাপিত আর অনুচ্ছেদ-১০২ একই প্রসঙ্গে হাইকোর্টকে দেয়া জাতীয় সংসদে প্রণীত যে কোন আইনের উপরে (জুডিশিয়াল রিভিউয়ের জন্য) ক্ষমতা। অনুচ্ছেদ-৪৪ ও অনুচ্ছেদ-১০২ মিলিতভাবে কনষ্টিটিউশনের মৌলিক নীতিগত দিক। কোর্টের মাধ্যমে প্রয়োগ করা সম্ভব জনগণের এই ক্ষমতা সরকার, রাষ্ট্র, সংসদের আইন কাউকেই ক্ষুন্ন করার অধিকার দেয়া হয় নাই। বরং সবার উপরে এর প্রয়োগ, প্রাধান্য। এটাই জনগণের প্রাণভোমরা, ফলে কনষ্টিটিউশনেরও প্রাণভোমরা, রাষ্ট্রের জীবিত থাকার লক্ষণ। শেখ মুজিবের চতুর্থ সংশোধনী ১৯৭৫ সেই প্রাণভোমরাকেই গলা টিপে হত্যা করেছিল।

অনুচ্ছেদ-৪৪ খুবই গুরুত্ত্বপুর্ণ একটা প্রসঙ্গ। আগের পর্ব ২ তে, আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলাম, যে কোন কনষ্টিটিউশন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে দিয়েছে শর্ত সাপেক্ষে; কনষ্টিটিউশনের যেসব জায়গায় আইন প্রণয়নের সুযোগ রাখা হয়েছে কেবল সেসব জায়গায় (Article 65) subject to the provisions of this Constitution। কোন কনষ্টিটিউশন এর বাইরে, নিজের বিরোধী বা সাংঘর্ষিক কোন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে দেয় না, দিতে পারে না। এটাই গণপরিষদ আর জাতীয় সংসদের মৌলিক পার্থক্য অথবা বলা যায় কনষ্টিটিউশন ও আইনের মৌলিক ফারাক। গণপরিষদ পরবর্তীকালে সংসদে কীভাবে, কী কী আইন হতে পারবে না কেবল সে কথাই লিখে রাখে, আগেই যার গাইড লাইন বা সীমা নির্দেশ করে দেয় কনষ্টিটিউশন। আমাদের কনষ্টিটিউশনের (Article 65) subject to the provisions of this Constitution , ও (Article 7(2)) এর ......... if any other law is inconsistent with this Constitution and other law shall, to the extent of the inconsistency, be void - এই কথাগুলো তাই নির্দেশ করে। এভাবে স্পষ্ট করে বলে না দেয়ার অর্থ নিজের ফাঁসির অর্ডারে নিজেই স্বাক্ষর করার মত। জাতীয় সংসদের যে কোন আইন বানাবার ক্ষমতা থাকলে সবার আগে সে তো খোদ কনষ্টিটিউশনই বাতিল বলার ক্ষমতা পেয়ে যাবে বা নতুন আইন পাশ করে বসবে।
তাই দুনিয়ার যে কোন কনষ্টিটিউশনের প্রথম বৈশিষ্ট হলো সে নিজের বিরোধী সাংঘর্ষিক আইন প্রণয়নে বাধা দিয়ে রাখবে।

আসলে জনগণ সংঘবদ্ধ হয়ে সংগঠিত হতে চায় একটা রাষ্ট্রে। কথাটা অন্যভাবে বললে, জনগণ সংঘবদ্ধ হয়ে সংগঠিত হবার ভিত্তি কী তাই নিয়ে আলোচনা ও লিখতে বসে, কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন করতে বসে। পরস্পরের সাথে আলোচিত সেই আন্ডারষ্টান্ডিংয়ের ভিত্তি যাতে কেউ পরবর্তীতে বদলে ফেলতে না পারে, কোন আইন না চালু করে ফেলতে পারে সেজন্য রক্ষাকবচ দরকার। সেই আন্ডারষ্টান্ডিংয়ের ভিত্তিটাকে গোছা করে এক বাঞ্চে মৌলিক অধিকার শিরোনামে কনষ্টিটিউশনে রাখা হয়। কনষ্টিটিউশনের এই মৌলিক অধিকারের অধ্যায় (আমাদের কনষ্টিটিউশনের তৃতীয় অধ্যায়) ও এর বাস্তবায়নে আনুষাঙ্গিক অনুচ্ছেদ (যেমন অনুচ্ছেদ ৭, ৬৫ কনষ্টিটিউশনের সুপ্রিমেসী, কর্তৃত্ত্ব এবং ৪৪, ১০২ ইত্যাদি যা মূলত জাতীয় সংসদের উপর কর্ত্তত্বশালী বা জাতীয় সংসদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার প্রচেষ্টা) –এগুলো সবমিলিয়ে কনষ্টিটিউশনের মৌলিক ভিত্তি গণ্য করা হয়। দুনিয়ার যে কোন কনষ্টিটিউশনে এগুলো মৌলিক ভিত্তি গণ্য হতে বাধ্য। এটাই কনষ্টিটিউশনের প্রাইমারী মৌলিক ভিত্তি। এই প্রাণভোমরাকে রক্ষা করা না গেলে শুরুতে জনগোষ্ঠি সংঘবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রে সংগঠিত হতে চাই বলে পরস্পরের সাথে আলোচিত সেই আন্ডারষ্টান্ডিংয়ের ভিত্তিটাই আর নাই, ভেঙ্গে গেছে মানতে হবে।

সেই ঘটনাই ঘটে গিয়েছিল শেখ মুজিবের বাকশাল বা কনষ্টিটিউশনের চতুর্থ সংশোধনীতে। এই সংশোধনীতে মুল কনষ্টিটিউশনের প্রদত্ত হাইকোর্টের enforcement of any the fundamental rights (অনুচ্ছেদ-১০২) কেড়ে নেয়া হয়েছিল। অথচ কেড়ে নেবার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের না থাকা সত্ত্বেও চতুর্থ সংশোধনীতে তা অবৈধভাবে স্রেফ গায়ের জোড়ে তা করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য, কনষ্টিটিউশনের এই একটা অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদের প্রণীত আইনের উপরে হাইকোর্টের নজরদারী, প্রাধান্য ও ওভাররুল করার এক্তিয়ার দেয়া ছিল। আর সংসদে কনষ্টিটিউশনের চতুর্থ সংশোধনী এনে হাইকোর্টের সে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আইন পাশ করে ফেললো। মানে দাঁড়াল চতুর্থ সংশোধনীকে অবৈধ বা তা বাতিল বলে ঘোষণা করা, কোন নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা হাইকোর্টের নাই – গায়ের জোড়ে শেখ মুজিব সেই কাজটাই করেছেন। শুধু সেখানেই থেমে থেকে তিনি শান্তি পান নি। বিচারপতিদের চাকুরিচ্যুত করার হুমকি তিনি তাদের সবার গলায় লটকে দেন। যাতে কেউ অন্তত ভয়ে মুখ না খুলেন। মুল কনষ্টিটিউশনের ৯৬ (২) অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের চাকুরিচ্যুতি করতে গেলে আইনটা ছিল সংসদের দুই – তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট বরখাস্তের আদেশ দিতে পারতেন। বাকশাল বা চতুর্থ সংশোধনীতে ৯৬ (২) অনুচ্ছেদ বদলে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট নিজেই নির্দেশ দিয়ে বরখাস্ত করতে পারবেন কেবল আগে একটা শোকজ নোটিশ দিয়ে নিতে হবে।

এই প্রসঙ্গ শেষ করার আগে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারীর ঐ সময়ের আরও কিছু পটভুমি পাঠককে মনে করিয়ে দেই।

প্রথম জরুরী আইনের শাসনঃ জরুরী আইন ও সামরিক আইনসদ্য বিগত ২০০৭ সালের ১/১১ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জরুরী অবস্থার দাপটের কথা চলতি প্রজন্মের সকলের মনে থাকার কথা। কামেল কামলা ও বিশিষ্ট “সংবিধান প্রণেতা” ডঃ কামাল হোসেন ছিলেন ১/১১ সরকারের জরুরী আইনের আইনগত কারিগর, ড্রাফটসম্যান বা প্রণেতা। অনেকের মনে হতে পারে এটাই বাংলাদেশের প্রথম জরুরী আইনের শাসন। ভুল হচ্ছে, ওটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় জরুরী আইন। আর দুইবারই কালো জরুরী আইনের প্রণেতা পুরুষ ছিলেন বিরল ক্ষণজন্মা কামেল কারিগর কামাল হোসেন। শেখের আমলে ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম জরুরী আইনের ফরমান জারি করা হয়।
আমরা সবাই সামরিক শাসনকে খুবই ঘৃণার চোখে দেখে থাকি। স্বভাবতই দেখব। জঘণ্য ঘৃণ্য শাসনকে এই চোখে না দেখাটাই অস্বাভাবিক। অথচ তুলনায় ঐ সামরিক শাসনের শরীরের উপরটা জরুরী অবস্থার চাদর দিয়ে ঢাকা থাকলে সুশীলসহ আমাদের অনেক রাজনীতিকের ঘৃণা হারিয়ে দুর্বল হয়ে যায়, রি রি করে আর ঘৃণা জাগতে দেখা যায় না। ওকালতি পাড়ার বিচারকসহ সকলে সামরিক শাসনকে সহজেই এক্সট্রা-কনষ্টিটিউশনাল পাওয়ার বা কনষ্টিটিউশনের উপর জুড়ে বসা ক্ষমতা বলে তা অবৈধ বলেন। অথচ দুটোর মধ্যে কোন পার্থক্য নাই, বরং মারাত্মক বিপদজনক ও মৌলিক মিল আছে। উভয়েই প্রথম যে কাজটা করেন তা হলো, কনষ্টিটিউশনে দেয়া নাগরিক মৌলিক অধিকারগুলো এখন থেকে অকেজো, স্থগিত করা হলো মর্মে একটা ঘোষণা জারি করা। অনুচ্ছেদ ৪৪ সহ সব মৌলিক অধিকার ও ১০২ অকেজো, নট নরনচরন।
চতুর্থ সংশোধনী ১৯৭৫ যখন জারি করা হচ্ছিল তখন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ থেকে জরুরী আইনের কবলে ছিল। আমাদের কনষ্টিটিউশনে তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনামসহ পুরাটাই মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গে, অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে শুরু হয়ে অনুচ্ছেদ ৪৭ পর্যন্ত সবগুলোই এই তৃতীয় অধ্যায়ের অন্তর্গত। শুধু তাই নয়, প্রথম অনুচ্ছেদ ২৬ এ স্পষ্ট করে বলা হয়েছে The State shall not make any law inconsistent with any provisions of this Part, and any law so made shall, to the extent of such inconsistency, be void। অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে শুরু হয়ে অনুচ্ছেদ ৪৭ পর্যন্ত তৃতীয় অধ্যায়ের কোন কিছুর সাথে বিরোধী সাংঘর্ষিক কিছু করা যাবে না, করলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। অথচ জরুরী আইন এবং সামরিক শাসন উভয়েরই আগমনের পর প্রথম কমন ফরমান হলো নাগরিক মৌলিক অধিকারগুলো এখন থেকে অকেজো, স্থগিত করা হলো মর্মে একটা ঘোষণা জারি করা। এককথায় কনষ্টিটিউশনের জানাজা পরিয়ে দেয়া হয়।

তার মানে, শেখ মুজিব ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ থেকে জারি থাকা জরুরী আইনের কারণে সমস্ত মৌলিক অধিকার স্হগিত ছিল। এত অসীম ক্ষমতা পেয়েও তাঁর কাছে এটা কম মনে হয়েছিল। তাই এর এক মাস না পার হতেই ২৫ জানুয়ারী ১৯৭৫ চতুর্থ সংশোধনী কনষ্টিটিউশনে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। এ যেন আগেই মৃত কনষ্টিটিউশনের জানাজা হয়ে যাবার পর এবার কনষ্টিটিউশনের কবরের উপর নাচানাচি করে লাথি মেরে মনের ধর্ষকামী সুখ মেটানো।

সুরঞ্জিতের ভাষ্য অমান্য করে তাঁর দলের প্রাণপুরুষ জাতির পিতা কোন গণপরিষদের সভা বসানো ছাড়াই জাতীয় সংসদে বসে কনষ্টিটিউশন ও এর মৌলিক নীতি যা ইচ্ছা তাই ভাবে বদল করেছেন। প্রথম অবৈধ কাজ সুচনা ঘটেছিল। বাংলাদেশের কনষ্টিটিউশনের জানাজা ঐদিনই সম্পন্ন হয়ে যায়।
[পরের অংশ ও শেষ পর্ব ঘন্টা খানেকের মধ্যে পোষ্ট করছি। বড় হয়ে যাওয়াতে আলাদা পর্বে পোষ্ট করছি।]

৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×