somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যশপ্রার্থী লেখক, প্রকাশনা শিল্পের সংকট ও রাষ্ট্রের দায় ::বোরহান বীজান্ত::

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৪:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যশপ্রার্থী লেখক, প্রকাশনা শিল্পের সংকট ও রাষ্ট্রের দায়
বোরহান বীজান্ত
**************************************************
ভোরের কাগজ : বুধবার, ৩০ জানুয়ারি ২০১৩


সামনেই একুশের বইমেলা। প্রকাশরা লেখক বাগাতে ব্যস্ত। না, এমনটি হবার কথা ছিল না। আমরা দেখেছি মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা লেখক খুঁজে বের করে বই প্রকাশ করতেন। বাংলাদেশের অনেক (আজ প্রতিষ্ঠিত) লেখককের বই বের করেছিলেন চিত্ত বাবু। সেই সময় এখন নেই কেন? সেই প্রকাশক এখন নেই কেন? যাদের বই দরদাম করে বের করা হয় তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। আর বাকিরা! বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও চলছে এখন প্রকাশনা বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের প্রধান খদ্দের- দেশের যশপ্রার্থী নতুন কবি, প্রাক্তন আমলা, প্রাক্তন সেনা অফিসার, আর বিদেশে অবস্থানরত এক শ্রেণীর লেখক-কবি। এছাড়াও কিছু মিডিয়ার সাংবাদিক বন্ধুরা মাথা বিক্রি করেছেন, কিছু তথাকথিত ‘প্রকাশক’দের কাছে। তারা কাউকে তুলছেন। কাউকে নামাচ্ছেন। সততার খুবই অভাব সর্বত্র। আজকাল বই প্রকাশের যে দরদাম চলছে, তার কিছু নমুনা পেশ করা যাক।

খ-চিত্র-১ : প্রকাশক বলবেন, লেখককে ২০০/৩০০ বই কিনে নিতে হবে। এর দাম আগাম দিতে হবে। ২৮/৩০ হাজার টাকা। আদতে কতো কপি ছাপা হবে তা আল্লাহ মালুম। প্রকাশক বলবেন, বই আমরা বাজারজাত করবো। ছাপবো ৮০০ কপি।

খ-চিত্র-২ : (প্রবাসী লেখকদের বেলায় বেশি প্রযোজ্য)। প্রকাশক বলবেন, ৩৫/৪০ হাজার টাকা দেবেন। বই করে দেবো প্রথম কোয়ালিটি। লেখক তাতেই খুশি। বই বেরুচ্ছে! লেখক ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ব্লগ, ফেসবুক, ইমেজ প্রচারণায়। আর প্রকাশক টাকা কামাই করে ১০০ কপি বই প্রবাসী লেখককে ধরিয়ে দিয়ে তাকাবেন ‘নেক্সট টার্গেট’ এর দিকে।

খ-চিত্র-৩ : বাংলাদেশের কোনো বড় চাকুরে ছিলেন। টাকার অভাব নেই। বৈধ অবৈধ আয় এখনো বিদ্যমান। বই লিখবেন। ৪০/৫০ হাজার ব্যাপার না। টাকা তুলে দেন। দরকার মতো ‘অনুলিখন’ হয় বই। লেখক হওয়াই মূল লক্ষ্য। এভাবে বেড়ে যায় তার নিজের লেখা বইয়ের তাক।

খ-চিত্র-৪ : (কলকাতায় যা হালে খুব চলছে) প্রকাশক বলবেন, বইয়ের সব খরচ লেখকের। বিক্রি হলে ‘কমিশন’ রেখে বাকি টাকা লেখককে বুঝিয়ে দিই আমরা। প্রতি ছয় মাস অন্তর হিসেব বুঝিয়ে দিই। বাহ, সততা। এভাবেই চলে প্রকাশনা ব্যবসা।

তাই বলে বাংলাদেশে পেশাদার প্রকাশক যে নেই, তা আমি বলছি না। এমন অনেক প্রকাশক আছেন, যারা লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে নিজেদের অবস্থান দাঁড় করাতে চাইছেন। এদের কেউ কেউ কোনোমতে টিকে আছেন। কেউ কেউ এই পেশা থেকে সরে দাঁড়াবার কথাও ভাবছেন। প্রকাশনা জগতে এখন চলছে আরেক ধরনের সন্ত্রাস। কিছু কিছু প্রকাশনী ভারতীয় নামকরা লেখকদের বই তাদের অনুমতি না নিয়েই সস্তা কাগজে ছেপে বাজারে ছেড়ে টাকা কামাচ্ছে। আবার কিছু প্রকাশক, বিভিন্ন অনুবাদকের বই তাদের অনুমতি না নিয়েই ছেপে টাকা কামাই করছে। এরা অনুবাদকের অনুমতি নেয়া, কিংবা রয়্যালিটি দেয়াÑ দুটোর কোনোটাই করছে না। কে রুখবে এদের?

প্রকাশনা শিল্পের আরেকটি দুঃখজনক অধ্যায় হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় উদারতার অভাব। দেখা যায় যখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকে তখন তারা নিজ দল ও মতের কিছু লেখকের বই কিনে সরকারি উদ্যোগে। আবার আওয়ামী লীগ এলে তারাও নিজ নিজ মতাদর্শের গুরুত্ব দিয়ে কিছু বই কেনে। প্রকৃতপক্ষে যে পরিমাণ বই সরকারি পর্যায়ে কেনা হয়, তা কোনো মতেই পর্যাপ্ত নয়। বিশ্বের প্রতিটি উন্নত দেশে ‘পাবলিক লাইব্রেরি’ রয়েছে জমজমাট পসরা নিয়ে। যেসব দেশের সরকার এসব লাইব্রেরির জন্য বই কিনে বড় বাজেটের। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি শক্তভাবে গড়ে ওঠেনি। দুচারটি এনজিও কিছু বই কিনলেও সরকারি উদ্যোগ হতাশাজনক। সরকার চাইলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বই কেনার একটা বড় বাজেট রাখতে পারতো। বিভিন্ন লাইব্রেরিতে তারা বই কিনে ডোনেট করতে পারতো। যে কাজটি একইভাবে করতে পারেন দেশের চিত্তবান-বিত্তবান ব্যক্তিরাও। তারা নিজ নিজ উদ্যোগে বই কিনে স্থানীয় স্কুল-কলেজ লাইব্রেরিতে উপহার দিতে পারেন। মনে রাখা দরকার সরকার এবং সমাজের বৈভবশালীদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া প্রকৃত প্রকাশকদের বেঁচে থাকা কঠিন কাজ।

আমরা দেখছি, প্রকাশনা শিল্পটি বাংলাদেশে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়ায়, বাংলাদেশে এখন ফুলে ফেঁপে উঠছে কিছু মৌসুমিদের ‘প্রকাশনা বাণিজ্য’। লিটল ম্যাগের সম্পাদক থেকে শুরু করে মুদি দোকানদার অনেকেই প্রকাশক। বাংলাবাজার-শাহবাগ থেকে কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামে এখন প্রকাশকদের মেলা। টার্গেট কতোটা ‘শিকার’ পাওয়া যায়। এমন অনেক প্রকাশকদের আবার এজেন্ট আছে বিদেশেও। পাওয়া যায় কমিশন। পা-ুলিপি আর পাউন্ড-ডলার-ইউরো-রিয়াল-দিনার জোগাড় করে দিতে পারলেই কমিশন! এসব প্রকাশকদের কারো কারো আবার ‘লেফাফা দুরস্থ’ আছে। নামকরা দুএকজন লেখকের জন্মদিনে তাদের বই বের করে শান দিয়ে নেয় তারা ছুরি! আসল কথা হচ্ছে, এই যে ‘প্রকাশনা বাণিজ্য’ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে, তাতে বাংলা সাহিত্যের লাভ হচ্ছে কতোটুকু? আদৌ লাভ হচ্ছে কি? শিল্প-সাহিত্যের চর্চা আসে বিবেক থেকে। বাংলা সাহিত্যের সমাজ ও মানসে এই বিবেকের পরিশুদ্ধ চর্চা চলছে বলে মনে হয় না। না হলে, ‘মোড়ক উন্মোচন’ এর নামে লাখ টাকার বাজেট কেউ রাখতে পারে? প্রকাশনা উৎসবের নামে কেউ জিয়াফত খাওয়ায়? বিশ্বের বড় বড় লেখকরা কি তা করেছেন কখনো? মুদ্রাবিলাসের দাপট দেখানো ভালো। তবে তা হওয়া উচিত সৎ-মহৎ কাজের জন্য। কারো কাছে টাকা থাকলে তিনি একজন অসচ্ছল অথচ মেধাবী তরুণ কবির বই বের করে দিতে পারেন। তা না করে তিনি নিজেই কিভাবে লেখক হবেন- সে চিন্তায় অস্থির থাকছেন দিনরাত। হায় সমাজ! হায় লেখক বাণিজ্য প্রকল্প!

আমাদের লেখালেখির আরেক মাধ্যম এখন ফেসবুক। স্ট্যাটাসগুলোই হয়ে উঠছে ‘কাব্যমালা’। নির্মলেন্দু গুণ ‘মুঠোফোনে’ কবিতা লিখে নাম দিয়েছিলেন মুঠোফোনের কাব্য। হ্যাঁ, স্ট্যাটাসগুচ্ছও কাব্য হতে পারে। কিন্তু এর মাঝে তো মাল-মশল্লা থাকতে হবে। আমরা জানি কম লিখেও কবি হওয়া যায়। হেলাল হাফিজকে কে-না জানে। তার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থ ৩০টি মুদ্রণ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। কবি শহীদ কাদরীর কাব্যগ্রন্থ সংখ্যা-৪। একুশে পদকের পালক লেগেছে তাঁর আস্তিনে। বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্পে যে মাশরুম কাল চলছে এর প্রতিকার দরকার। আমি জানি না ‘সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা’ নামের সংগঠনটি আদৌ কোনো কিছু করে, করতে পারে কিংবা পারবে কি না! টাকা দিয়ে বই করার চেয়ে অলেখক হয়ে থাকাই শ্রেয়। এমন একটা সেøাগানের জন্য অপেক্ষা করছে বাংলাদেশ। মফস্বল থেকে জমি বিক্রি করে টাকা এনে ঢাকায় প্রকাশকের হাতে তুলে দিচ্ছে যে তরুণ কবি, তার বোধোদয় দরকার। এটা চলতে পারে না। বই প্রকাশের যোগ্য হলে তা প্রকাশ কারা করবে, কারা করতে পারবে- বাংলাদেশ এমন প্রকাশকের অপেক্ষায়। সেদিন আসবে কি? না-কি এই ‘প্রকাশক বেপারী’রা শুধু ফুলে ফেঁপেই উঠবে একুশের বইমেলাকে পুঁজি করে?

বোরহান বীজান্ত : লেখক।

Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৪:৪৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×