somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রোদ পাহাড়ের নিরব গান: সাজেক ট্যুরের অদ্যপান্ত- শেষপর্ব

২১ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাঝে মাঝে সাজেকের মেঘ এরকম সাগর হয়ে যায়

মেঘকাব্যের সংলাপে পাবেন সাজেক ভ্রমণ গাইডিংয়ের প্রথমপর্ব। ফেইসবুকে থাকার প্রধানতম কুফল হিসেবে একসময় দেখলাম কিছু লিখতে গেলেই পাঁচ লাইনের বেশি লিখতে পারি না। আমি লেখাকে যতই চিউইংগাম ভাবি, সে ততই সিগারেট হয়ে যায়। অগত্যা বছর দুই আগে ফেইসবুক ডিঅ্যাক্টিভেটেড করে দিলাম পার্মানেন্টলি। তারপর থেকেই লেখা বড় করার চেষ্টা করছি। হচ্ছেও। ভালো খবর, কিন্তু সাজেকের এই লেখাটা আবার বেশি বড় হয়ে সামুর স্ট্যান্ডার্ড পার হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে তাই দু’বারে দিচ্ছি।

যাই হোক, সাজেকে খাওয়াদাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা আছে। এই ২০০০ ফিট উপরে তো চাইলেই আর আলু-টমেটোর বাগান করা যায় না, খাবারের অতিরিক্ত যোগান নেই তাই। খাবারের জন্য রেস্টুরেন্টগুলোতে আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে। রেস্টুরেন্টগুলো অর্ডার না পেলে কোনো ধরনের খাবার বা নাশতা প্রস্তুত করবে না। বাঁশের মধ্যে ঢুকিয়ে রান্না করা এক ধরনের মেন্যু এখানে পাওয়া যায়, ট্রাই করে দেখতে পারেন।

ব্যবহার্য পানিরও খামতি রয়েছে সাজেকে। অনেক নিচের একটা ঝরনা (এরা বলে ছড়া) থেকে গাজী ট্যাংকে করে পানি আনা হয়। রিসোর্টগুলো এই পানি প্রতি ট্যাংকি ১০০০ টাকা করে কেনে। তাই পানির ব্যবহারে সতর্ক থাকা ভালো। তবে খাবার পানির কোন সমস্যা নেই। দোকান থেকে ইচ্ছেমত কিনতে পারবেন।

স্থানীয় পরিশ্রমী কিশোরীরা অনেক নিচের ঝরণা থেকে পানি আনতে যাচ্ছে

আরেকটা ব্যাপার। এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। স্থানীয় সেনাপ্রসাশন ও রিসোর্টগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জেনারেটর এবং সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে এলাকাটা আলোকিত করার ব্যবস্থা করেছে। এ সব কারণে এখানে থাকার কস্টিংটা তুলনামূলকভাবে বেশি পড়ে। আর ভুলেও এখানে এসির জন্য আবদার করবেন না। সরকারী দুই রিসোর্ট ছাড়া কোথাও পাবেন না। কিন্তু সুখের কথা হলো, সাজেকে দিনের বেলা রোদ্রের প্রখরতা থাকলেও সূর্য ডোবার সাথে সাথেই আবহাওয়া শীতল হয়ে যায়, তাই রাতে এসির কোন প্রয়োজনই হয় না। আর দিনের তাপ কমাতেই এখানকার রিসোর্টগুলো অধিকাংশই কাঠের তৈরী। রিসোর্টগুলোয় আড়াই হাজার থেকে আকার ভেদে ছয় হাজার টাকায় ঘর ভাড়া পাবেন।

এখানে আসার সবচেয়ে ভালো সময় হলো বর্ষার পরপর। সেপ্টেম্বর অক্টোবর। এ সময় ঢল নামার সম্ভাবনা কম থাকে কিন্তু পাহাড় থাকে মেঘের চাদরে মোড়ানো, গাছপালা থাকে খুবই সবুজ। এক অদ্ভুত সুন্দর। ভয়ংকর সুন্দর। হুমায়ুন আহমেদ এর ছোট ছেলে নিনিত এর ভাষায় ভয়মকর সুন্দর।

সাজেক সরাসরি সেনানিয়ন্ত্রণে থাকায় এখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা খুবই ভালো। চাঁদনি রাতে আপনি তাই সারারাত রাস্তায় বসে দল বেঁধে গান গাইতে পারেন-তুমি চাইলে জ্যোছনা, স্বপ্নীল কোনো এক রাতে, আকাশটা ঘিরে প্রার্থনা.... কেউ আপনাকে আটকাবে না, আপনি কোনো বিপদেও পড়বেন না। রাতে এখানে রাস্তার ওপরই গাড়িগুলো পড়ে থাকে। কেউ হাত দেয় না। আসলে এখানে ঢোকার মুখেই আপনাকে টিকেট করে নিজের এন্ট্রি করাতে হবে, আবার ফিরতি পথে ওই টিকেট ফেরত দেওয়ার মাধ্যমে আপনার নির্গমন নিশ্চিত করতে হবে, তাই আল্লার কোন বান্দারই এখান থেকে কিছু নিয়ে ভাগার সুযোগ নেই।

অনেকের ধারণা সাজেকে সেনাবাহিনীর রিসোর্টটাই সবচেয়ে সুন্দর বা নিরাপত্তা এখানেই সবচেয়ে বেশি। এ কারণে সাজেক যাওয়ার পরিকল্পনার মুখে সবাই খালি এই রিসোর্টের বুকিং পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করে। সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তার লিংক খুঁজতে থাকে। আর না পেলে মনে করে, ধুর! যামুই না! আমার এক ট্যুরমেট যেমন প্রস্তুতিপর্বে বলেছিল- রুনময় হলো একেবারে পাহাড়ের ভেতরে, রাতে রুনময়ের উঠানে বসে না থাকতে পারলে সাজেক যাওয়া বৃথা! কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন সাজেকে অসংখ্য সুন্দর সুন্দর রিসোর্ট তৈরী হয়েছে। আর সবগুলোই রুইলুইপাড়া থেকে কংলাকপাড়া পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে। রাস্তা ছেড়ে ডানে বায়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। নিরাপত্তার কথাতো আগেই বলেছি।

সাজেকে সবকিছুই এমন রঙিণ

সাজেক যাওয়া আসার সময়টাতে স্থানীয় শিশুরা রাস্তার পাশে এসে পর্যটকদের শুভেচ্ছা জানিয়ে হাত নাড়তে থাকে। সারা পথজুড়েই আপনি এ রকম দেখতে পাবেন। ওদের এই সৌজন্যতাবোধ দেখে যাওয়ার সময় আমাদের খুবই ভালো লেগেছিল। কিন্তু সাজেক গিয়ে অন্য গল্প শুনলাম। প্রথম দিকে যখন এ এলাকায় সমতলের মানুষরা আসতো, বিশেষ করে সেনাসদস্যরা, তখন স্থানীয় আদীবাসীদের বিরুপ মনোভাব থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে তাঁরা ক্যান্ডি, শুকনা খাবার ইত্যাদি আনতো, যেগুলো গাড়ি দেখতে আসা শিশুদের দিকে ছুড়ে দিত এবং যাবার সময় এই শিশুদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তো। এই হাত নাড়া দেখে দেখে আদিবাসী শিশুদের মনে ধারণা জন্মেছে যে হাত নাড়লেই কিছু একটা পাওয়া যায়! তাই এখন রাস্তায় গাড়িবহর আসলেই ওরা রাস্তার ধারে চলে আসে এবং হাত নাড়তে থাকে।

আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিভাবে কিভাবে আমরা সমতলের মানুষরা নিজেদের অজান্তেই ওদেরকে ভিক্ষায় নামিয়ে দিলাম। অথচ পাহাড়ীরা সাধারণত খুবই আত্মমর্যাদাবান এবং পরিশ্রমী হয়ে থাকে। বছর দশেক আগে বান্দরবান ট্যুরে চিম্বুক থেকে ফিরছি, হঠাৎ দেখি বৃদ্ধা এক মহিলা এক কাঁদি কলা নিয়ে রাস্তার ধারে বসে আছে। বিষণœ ওই ছবিটা আমাকে এতটাই আঘাত করেছিল যে আমার চোখে এখনও জীবন্তই রয়ে গেছে। পড়তি বিকেলের কমে আসা আলোয় দুর্গম, জনশুন্য পাহাড়ী এই রাস্তায় কে ওনার কলা কিনবে ভেবে পেলাম না। ওই বৃদ্ধার শরীরী ভাষা ছিল পরাজিত মানুষের কিন্তু আত্মসন্মানের কোন খামতি ছিল না। কিন্তু সাজেকের এই শিশুরা বড়ই হচ্ছে আমাদের মেকি ঠাঁটবাটের কাছে হার মেনে হাত পাততে শিখে। আমাদের চাকচিক্যময় জীবন দেখে স্বকীয়তা ভুলে আমাদের মতই মেকি হয়ে উঠছে এরা।

ছুড়ে দেওয়া বস্তু নিতে রাস্তার মধ্যিখানে চলে এসে শিুশু আহত হওয়ার মত ঘটনা ঘটার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সেনা প্রশাসন গাড়ি থেকে কিছু ছুড়ে না দিতে ট্যুরিস্টদের প্রতি নির্দেশনা জারি করেছে। আপনারাও এ রকম কিছু ছুড়ে দেবেন না।

এরকম আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু পথ বেয়েই যেতে হবে সাজেকে

আগের পর্বে মন্তব্যের ঘরে পাগলা জগাই বলেই ফেলেছেন যে ক’বছর আগে সাজেককে যেমন দেখে এসেছিলেন, তার সাথে মেলে না এখনকার সাজেক। মেলার কথাও না। যে কোন সুন্দরকে খুব দ্রæত ধ্বংস করতে আমাদের আগ্রহ ও ক্ষমতা অসীম। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে যে কোন দর্শনীয় স্থানের কথাই ভাবুন না কেন, তার সাথে বিশ বছর আগের ওই একই যায়গার তুলনা করলেই দেখবেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করতে আমরা কতবড় ওস্তাদ মানুষ। মাত্র দেড় থেকে দুই কিলোমিটার এলাকার সাজেকে যেভাবে দ্রæত স্থাপনা গড়ে উঠছে, আর যে হারে ট্যুরিস্ট এসে এলাকাকে নোংড়া করছে, ট্যুরিস্ট নিয়ন্ত্রণ বা পরিবেশ রক্ষায় উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে সাজেকও গুলিস্তান হতে সময় নেবে না।

প্রসঙ্গ থেকে সরে গেছি। আবার ভ্রমণে ফিরে আসি। সাজেক থেকে ফিরতি পথে আপনাকে আবার খাগড়াছড়ি হয়েই ফিরতে হবে। খাগড়াছড়িতে কিছু সময় কাটাতে চাইলে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রে যেতে পারেন, ওখানে এক্কেবারে প্রাকৃতিক একটা গুহা আছে। জেলা পরিষদ পার্কে গিয়ে ঝুলন্ত ব্রিজে দোল খেতে পারেন, জলপাহাড় পার্ক যেতে পারেন এবং অতি অবশ্যই রিছাং ঝরণায় মন ভেজাতে পারেন। এই ঝর্ণাতেই মনে হয় সবচেয়ে প্রশস্ত পাটাতন রয়েছে। তবে আপনি চাইলে রাঙামাটি হয়েও সাজেক যেতে পারেন, সেক্ষেত্রে ঢাকা থেকে রাঙামাটি, তারপর কপ্তাই লেক-শুভলং-মারিশ্যা-দীঘিনালা রুটে বোট জার্নি। আরো এক্সাইটিং আর ওয়াইল্ড রুট এটা। তবে আমি যেহেতু ওই রুটে আসিনি, বেশি কিছু বলতে পারবো না।

আমার গল্প এখানেই শেষ। সবাই সাজেক ঘুরে আসুন। শুভ ঘুরান্টিপুরোনো এক ব্লগার নুশেরাএই শব্দটা আবিষ্কার করেছিল। (এইসব চমৎকার ব্লগাররা কেন যে হারিয়ে যায় কে জানে, পরে এটা নিয়ে লেখার ইচ্ছে আছে)


সংযোজন:
//সাজেক ভ্যালিতে শুধু রবি আর এয়ারটেল এর নেটওয়ার্ক আছে
//সঙ্গে অডোমস এবং ফাস্ট এইড রাখা ভালো
// স্থানীয় লোকদের সাথে বিতর্কিত কোন বিষয়ে কথা না বলাই ভালো

ক্যামেরার পেছনে: হান্নান ও মার্গুবুল্লাহ
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১০:৫৪
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×