somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চেতনার বড়ি গিলিয়ে বাজার দখলের প্রবণতা শিল্পখাতের উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে...

০৯ ই আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিষণ্ন সুন্দরী টুম্পা খান খুবই আবেদনময়ী গলায় গেয়েছেন- ‘আমার অনুভূতির সাথে খেলার অধিকার দিলো কে?’... বাঙালির এই অনুভূতি বস্তুটা বেশ প্রবল। স্পর্শকাতরও। কোনোভাবেই অনুভূতির সঙ্গে ছিনিমিনি খেলতে দিতে রাজি নই আমরা। কিন্তু সেই অনুভূতিতেই যখন চেতনার ঘি ঢালা হয়, আমরা তখন পুরাই ফিদা! এই বিষয়ে উদাহরণ দেয়াটাই বাহুল্য।

স্বাধীনতার পর থেকেই চেতনার নামে চলে আসা আমাদের রাজনীতি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হওয়া ব্যতিরেকে সত্যিকারার্থে কতটুকু দেশের কল্যাণে এসেছে সেটা পুনর্বিবেচনার অবকাশ রাখে বলে আমি মনে করি। আমরা যেহেতু রাজনীতি সচেতন জনতা (এক মার্কিন কুটনীতিবিদ বলেছিলেন, তোমাদের সমস্যা হলো- তোমাদের রিকশাওয়ালা পর্যন্ত একেকজন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ!!), রাজনীতিতে বিভিন্নমূখী চেতনার ব্যবহার এর পক্ষে বা বিপক্ষে আমরা সোচ্চার। কিন্তু জীবনাচারণের আরো আরো দিকে যে এই চেতনার ঘি খাওয়ানোটা বেশ গভীরে পৌঁছে গেছে, তার খবর রাখছি কই?

আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে চেতনার রস ব্যবহার করাটা জাতীর জন্যে একটা পিছুটান। কারণ, চেতনা ব্যবহার করলেই যখন যেকোনো ধরণের পণ্য পাব্লিককে খাওয়ানো যায়, তখন পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নে খামোখা খরচ বাড়ানোর কি মানে হয়। দুঃখজনকভাবে আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে এভাবে বাজার দখলের একটা স্থুল প্রবণতা রয়ে গেছে। অব্যর্থ টোঁটকা হিসেবে উনারা এর প্রয়োগ করে থাকেন।

বিপণনে বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব নতুন করে কিছু বলার কোনো মানে নেই। জনমনে বিজ্ঞাপনের প্রভাব আর গুরুত্ব সম্পর্কে ব্লগাররা নিশ্চয় ভালো জানেন। সেই উনিশশ তিপ্পান্ন সাল থেকে... বললেই অনেকে বুঝে ফেলবেন ‘রক্সি পেইন্ট’র কথা বলা হচ্ছে। তেমনি ‘ম দিয়ে মা ছাড়া কি হয় আর’ বললেই অনেকের মনে পড়বে এক সময়কার ম্যানোলা বেবি পাওডার এর কথা। এই বিজ্ঞাপনগুলো দেখতাম আজ থেকে প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে। এখন হয়তো পণ্যগুলো মার্কেটে এক্সিস্টই করে না। তবুও বিজ্ঞাপনের গুণে মনের মধ্যে গেঁথে আছে। এ রকম আরো উদাহরণ দেওয়া যায়।

আবার বিপরীত পতিক্রিয়াও হয় বিজ্ঞাপনে। কিছু বছর আগে আড়ংয়ের এক দুধের বিজ্ঞাপনে নারী শরীরকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উপস্থাপনের বিপক্ষে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে আড়ংয়ের ওই বিজ্ঞাপন সব যায়গা থেকে উইথড্র করা হয়েছিলো। এ ধরণের উদাহরণও ভুরি ভুরি।

বলা হয়ে থাকে, বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে সবচেয়ে ট্রিকি এবং শক্তিশালি ‘পে অব লাইন’ ছিলো, ‘নো স্মোকিং; নট ইভন্ আবদুল্লাহ’। ঘটনা হলো, গত শতকের প্রথম দিকে ‘আবদুল্লাহ’ নামে টার্কিশ একটা অভিজাত সিগারেট ছিলো, খুব দামীও। ওই এখনকার ডানহিলের মত আর কি। এই আবদুল্লাহ একটা বিমানবন্দরে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করবে, কিন্ত বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা আছে যে এমন কিছুই করা যাবে না যাতে করে ধুমপানকে উৎসাহিত করা হয়। তো আবদুল্লাহ নিজেই একটা ধুমপান বিষয়ক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। কিভাবে তারা ধুমপানকে অনুৎসাহিত করে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করবে, তার কোন কূল কিনারা করতে পারছিলো না। তখন এই অমর পে অব লাইন’র আবির্ভাব হয়।

এ রকম অনেকভাবেই পণ্যের প্রসারে বিজ্ঞাপন করা যায়। যেগুলো সুদুরপ্রসারি প্রভাব সৃষ্টি করে। কিন্তু বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনমনে প্রভাব ফেলতে পারলেও যদি পণ্যের গুণগতমানে ক্রমোন্নতি না থাকে, তবে সে পণ্য ক্রমেই বাজার থেকে আউট হয়ে যায়।

আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্রুত এবং বেশি মাত্রায় লভ্যাংশ করার যে আত্মধ্বংসী প্রবণতা রয়েছে, সেই যায়গা থেকে পণ্যের উন্নয়নের বিষয়টা আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো অগ্রাহ্য করে এবং তা চেতনা দিয়ে পূরণ করতে চায়। সম্প্রতি একটা রেফ্রিজারেটরের বিজ্ঞাপন দেখলাম (ব্র্যান্ড নেম মুছে উপরে স্ক্রিনশট দিয়ে দিয়েছি)। রেফ্রিজারেটরটা চেতনার রঙে রাঙিয়ে ভালোই চটকদার ভাষায় প্রচারিত হচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন নিঃসন্দেহে। কিন্তু পণ্যের গুণগতমানের দিকে কতটা নজর দিয়েছে সেটা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে।

একটা টেলিভিশন স্টেশন আছে যার শ্লোগান হলো- ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়’। খুবই ভালো কথা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের যে মুল চেতনা সুশাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বৈষম্যহীনতা, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে এই টিভি স্টেশন কতটা তৎপর, সেটা ওরাই ভালো বলতে পারবে।

যেকোনো ব্যবসায় “ইসলামী” শব্দের ব্যবহারও একই ধারা বহন করে। আমাদের দেশীয় ব্যবসা-শিল্পের ক্ষেত্রে এ ধরণের উদাহরণ ভুরিভুরি দেওয়া যাবে।

আমাদের এই চেতনায় হাবুডুবু খাওয়ার মজা নিয়ে এখন প্রতিবেশি দেশের কোম্পানিগুলোও খেলাচ্ছে আমাদেরকে। আপনারা মনে করতে পারবেন যে গত বছর বা তার আগের বছর বাজাজ একটা বাইক মার্কেটে ছেড়েছে, যার ব্র্যান্ড নেম “ভি”, ভি ফর ভিক্টরি, ভি ফর ভিক্রান্ত (বিক্রান্ত)। বিক্রান্ত হলো সেই যুদ্ধজাহাজ, যেটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইন্ডিয়ান নেভি আমেরিকার সপ্তম নৌবহর ঠেকাতে ব্যবহার করেছিলো। এই জাহাজকে স্ক্র্যাপ করার পর সেই স্ক্র্যাপ দিয়ে এই “ভি” বাইকগুলো তৈরী হয়েছে.. .. .. আহা হা, কি চেতনা, কি চেতনা.. .. ..

আমার ধারণা, বাজাজ এই বাইকটা তৈরীই করেছে বাংলাদেশের মার্কেটের কথা মাথায় রেখে। কারণ এই বাইকের প্রমোশনে ওরা মুক্তিযুদ্ধ-বিক্রান্ত-বিজয় বিষয়টি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। ফলস্বরুপ, ভারতে কি অবস্থা জানি না, কিন্তু ঢাকার রাস্তায় অহরহই “ভি” ব্র্যান্ডের বাইক চলছে। মাঝখান দিয়ে কিছুটা আমাদের নিজস্ব প্রোডাক্ট ওয়ালটনের লিও, স্ট্যাইলেক্স, ফিউশন, ক্রুজ, এক্সপ্লোর ইত্যাদি বাইকগুলো রাস্তা থেকে উধাও হয়ে গেছে। যেগুলো বছর খানেক আগেও বেশ চোখে পড়তো।

এটা নেবুচাদনেজার এর যুগ না। পৃথিবী এখন আক্ষরিক অর্থেই মানুষের হাতের মুঠোয়। এখনকার মানুষ শুধু দেশের পার্সপেকটিভে চিন্তা করে না। সারা পৃথিবীর সাথে তুলনা করেই সে কিছু একটা কিনতে যায় যখন প্রয়োজন হয়। তাই এই চেতনা গিলিয়ে বাজার ধরার সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া দরকার। বরং সত্যিকার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজারে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জনে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনোযোগ দেওয়াটাই শ্রেয় হবে। তাহলেই টিকে থাকা যাবে; অন্যথায় নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১২:০৯
১৯টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×