somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তোমার বাচ্চা নেই কেনো...

৩০ শে জুন, ২০২০ সকাল ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাচ্চাবেলায় সবচে বড় স্বপ্ন থাকে বড় হওয়ার। সব বাচ্চাই বড় হতে চায়, বড় হয়ে সে একদিন মা-বাবার যায়গায় যাবে, পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব নেবে। সে চিন্তা থেকেই কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছেন- ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। তাই যদি হয়, তাহলে জন্মের আগে সব সন্তানও ঘুমিয়ে থাকে বাবা-মায়ের অন্তরে। একবার এ বিষয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম যার শিরোনামটা অত্যন্ত চমৎকার ‘ইচ্ছে হয়ে ঘুমিয়ে ছিলি হৃদমাঝারে।’ এই ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছেটাই একসময় ফুটফুটে এক শিশু হয়ে পৃথিবীতে আসে।

জগতের সাধারণ নিয়মেই মানুষ তার শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পন করে। একসময় যুগলবন্দীও হয়। তারপর একই নিয়মে হৃদমাঝারে থাকা ইচ্ছেটা ফুল ফুটিয়ে তাদের সংসারে আসে খুশির বার্তা নিয়ে। কিন্তু সবার জীবনতো আর একই নিয়ম মেনে চলেনা, অহরহই ছন্দপতন ঘটে। অনেকের ইচ্ছে হয়ে ঘুমিয়ে থাকা সে সত্তা আর জাগে না। কষ্টের এক কাব্য শুরু হয় তখন থেকে।

উন্নত বিশ্বের মত আমাদের দেশে যদিও এখন হরহামেশাই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি দেখা যাচ্ছে, তবুও পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন এখনও এখানে যথেষ্ঠই দৃঢ়। একের প্রয়োজনে, সুখে-দুঃখে অন্যের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। আত্মীয়, অনাত্মীয় পড়শীরা বিপুল উৎসাহ নিয়ে যেকোনো প্রয়োজনে এগেয়ে আসে এখানে। তবে এই আত্মীয় এবং অনাত্মীয়দের অতি উৎসুক্য আর অযাচিত প্রশ্নবান সময় বিশেষে কারও কারও জন্য যে মানসিক যন্ত্রণার হতে পারে, সে বিষয়টা বেমালুম ভুলে যান একদা নিজেও একই পদের যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে আসা মানুষটিও।

যেকোনো বিষয়ে বাঙালির উৎসুক্য অপরিসীম! যে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র লাভ-ক্ষতি নেই, সে বিষয়েও অবলীলায় বাঙালি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়। শুধু প্রশ্ন নয়, উপযাজক হয়ে উপদেশ আর পরামর্শের পসরা সাজিয়ে দিয়াশলায় কাটি দিয়ে দাত খোঁচাতে খোঁচাতে চলে যায় অন্য বিষয়ে। তার বলা কথাগুলো গ্রহণযোগ্য হলো কিনা, এ রকম মতামত দেয়ার জন্য সে যোগ্য কিনা, সেসব নিয়ে আদৌও চিন্তিত থাকে না সে।

বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু হয় কাছের মানুষদের মধ্যে ফিসফাস, বাচ্চা কই? তারপর একসময় সে ফিসফাস শব্দে রুপান্তরিত হয়ে লক্ষবস্তুতে হানা দেয়। প্রথম প্রথম এই প্রশ্ন ছেলেটি বা মেয়েটির কাছে কিছুটা কাংখিতই থাকে, মধুর লাগে। লাজভাঙা মুখে অষ্পষ্ট সুরে তখন সে বলে- আরও দুয়েক বছর যাক...। কিন্তু যখন আরও কয়েকটা বছর পার হয়েই যায়, আকাঙ্খার স্তর পেরিয়ে তখন সে প্রশ্নটা কর্কশ সুরে বাঁজতে থাকে। দু’বছর আগের সুরেলা প্রশ্নটা তখন হয়ে যায় জগতের সবচেয়ে কুৎসিত প্রশ্ন। বলাবাহুল্য, এই প্রশ্নের বিভিন্ন ফর্ম থাকে।


আমার বিয়ের কিছু বছর পরও যখন আমার বেবি ছিলো না, সে রকম একদিন আমার এক সহকর্মী ইন্টারকমে আমার সাথে কথা বলছিলেন, সে তো অফিসে অহরহই কথা হয়। হঠাৎ তিনি বললেন- ভাই আমি দুঃখিত, আমি জানতাম না বলেই ওইদিন প্রশ্নটা করেছিলাম...। আমি বুঝতে পারলাম না তিনি কিসের কথা বলছেন, তাই আমি বললাম কিসের কথা বলছেন? তিনি তখন বললেন- ওই যে আপনার বেবি নেই...। এরপর তিনি বেশ কিছু সাজেশানও দিলেন.. এদিকে আমি বাকরুদ্ধ!

ঘটনা হলো- এই ফোনালাপের সপ্তাহখানেক আগে এই সহকর্মীর সাথে অফিসের সামনের চায়ের দোকানে দেখা। তখন তিনি জানতে চাইলেন- আপনার বেবি কয়জন? আমি বললাম আমার বেবি নেই। তিনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। সে আলোচনার রেফারেন্স টেনে তিনি এখন এই দুঃখপ্রকাশ করছেন। ইনি কিন্তু একজন বিশ^বিদ্যালয় গ্রাজুয়েট, উচ্চশিক্ষিত!

দুরের মানুষ, কাছের মানুষতো আছেই, আত্মীয় স্বজন, বিশেষ করে খালা-চাচি-ফুফু-মামি শ্রেণির নারীরা এই প্রশ্নগুলো বেশি করেন। দেখা হলে এই প্রশ্নটা করা একটা ফরজ কর্তব্য হিসেবেই গণ্য করেন তারা। সমাজে এটা নিত্যদিনের ঘটনা। ভদ্রতার সকল সীমানা পার করে এই প্রশ্নগুলো চলতেই থাকে। আর ছেলেদের বেলায় সে প্রশ্নের সাথে অন্যান্য ইঙ্গিতগুলো হয় খুবই কদর্য, অশালীন।

কোনও এক অদ্ভুত কারণে কিছু মানুষ কেবল খোঁচা দেয়ার জন্যেই এ বিষয়ে কথা বলেন। এখানে সন্তান নিয়ে উৎকণ্ঠার চাইতে আঘাত করার চেষ্টাটাই মুখ্য। হয়তো আরেকজনের যৌনজীবন নিয়ে কথা বলে মনে মনে কোন অসুস্থ তৃপ্তি পান। যেহেতু ‘তোমার যৌনজীবন কেমন যাচ্ছে’- এটা জিজ্ঞেস করার ভদ্রোচিত উপায় হচ্ছে বাচ্চা বিষয়ক কথা বলা!

কোন দম্পতি সন্তান নেবে কি নেবে না, সেটা একান্তই তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কারো সন্তান নেই মানে তাঁদের সন্তান হচ্ছে না অথবা সন্তান নেই বলেই পৃথিবীর সবাই হাহাকার করছে, এই চিন্তাটা এখন অবান্তর চিন্তা। সন্তান হওয়ার বিষয়টি মানসিক, শারীরিক, বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাগত অনেক ইকোয়েশন মেলানোর উপর নির্ভর করে। এককভাবে কারও উপর বা কোনোকিছুর উপর নির্ভর করে না।

ছেলেরাও এই প্রশ্নে কষ্ট পায়, তবে বিবিধ কারণে তা সামলে নিতে পারে অথবা নিজের দায় কম বা নেই ভেবে কিছুটা রিলিফ পেতে পারে। কিন্তু একজন মেয়ের বেলায় যখন বাচ্চা থাকে না, তখন দিনরাতের প্রতিটা মুহূর্তে সে অভাববোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে, ভেতর থেকে ক্ষয় করে ফেলে যেহেতু মেয়েদের সত্তাতেই জড়িয়ে থাকে মাতৃত্ব। এ রকম সময়ে আমরা যখন বাচ্চা না থাকার কথাটা তাকে মনে করিয়ে দেয়াটা মহান দায়িত্ব হিসেবে নিয়ে ফেলি, তখন এর চেয়ে কষ্টকর কিছু হতে পারে না।

এমন না যে এ বিষয়গুলো আমরা জানি না, তবুও এই প্রশ্ন করে বাঙালি যে সুখ পায়, তার কাছে বাকি সব নস্যি মনে হয়। তাই ঘুরে ঘুরে কদর্য প্রশ্নটা করতেই থাকি- তোমার বাচ্চা নেই কেনো?

প্রথম ছবি
দ্বিতীয় ছবি
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৩
২২টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:১৩

ফেসবুকে বাঙালিদের মধ্যে ইদানিং নতুন এক ফতোয়া চালু হয়েছে, এবং তা হচ্ছে "দাওয়াতের নিয়্যত ছাড়া কাফের কুফফারদের দেশে বাস করা হারাম।"
সমস্যা হচ্ছে বাঙালি ফতোয়া শুনেই লাফাতে শুরু করে, এবং কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×