সময়ের হাওয়া গায়ে মেখে ভাসতে ভাসতে যখন এই অব্দি এসে পড়েছি, তখন কখনও কখনও পেছনে ফিরতে ইচ্ছে হয় বৈকি। কদাচিৎ ফিরে তাকালে স্মৃতির পাতাগুলো বেশ উঞ্চ এক ওম ছড়িয়ে দেয় শরীরময়। শীতের সকালের প্রথম রোদ্দুরে কুয়াশাভেজা দোয়েল যেভাবে গা ঝাঁড়া দিয়ে নতুন দিন শুরু করে, ইচ্ছে হয় ওরকম একটা গা ঝাঁড়া দিয়ে আবার শুরু করি আমিও।
সেই যে এক মায়াবী শহর ছিলো, যেখানে ঝাঁকড়া সব গাছের সারি পিচের রাস্তায় শরৎ-বোশেখে নিবিড় ছায়ার ছবি আঁকতো; ঝিরিঝিরি বাতাসে মাদল বাজাতো; সে নিরিবিলি নাটোরই কি আমার শুরু?
না। মা বলতেন, শুরুটা মুলঘর। এটা খুলনার দিকে একটা শহর। আমার অবশ্যি মনে পড়ে না কিছুই। বাবা-মা দুজনেই চাকুরিজীবনে ছিলেন পরিযায়ী; আমিও ঘুরেছি তাঁদের সাথে সাথে।
তারপর কত শহর-বন্দর পেরিয়ে, কত যান-শকটে চড়ে, কত মানব সন্তানের ভালোবাসা নিয়ে তবেই না এই আমি আজকের আমি হলাম! পেছনে ফিরলে সে ভালোবাসা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে চায়...।
একদিন শহরের উঞ্চতম দিনে পিচগলা রোদ্দুর ভেঙে পথে হাটছিলাম, হাতিরঝিলের দ্বিতীয় ওভারপাসের ওখানে আসতেই এক শিমুলরাঙা হাওয়া আমাকে ডাক দিলো। সে এক স্মৃতির হাওয়া। রাজধানীর সিসা গলানো শুন্যতা পেরিয়ে যেখানে নীল আকাশ পর্যন্ত চোখ যায় না, সেখানে সে বাতাসে আমি ভেসে গেলাম তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে অন্য এক শুন্যতায়। এক এক করে পাতা উল্টিয়ে আমাকে ইতিহাস ভ্রমণে নিয়ে গেলো যেনো!
সেখানেই এক গলিমুখে হঠাৎ দেখি আবু সাঈদ দাঁড়িয়ে। আরে! এখানে তুই? মনে আছে, ঝিকরগাছার নবারুণ লাইব্রেরির মিহির ভাইকে পটিয়ে পাটিয়ে হুমায়ূনের বই ধারে আনতাম পড়ার জন্য.... অথবা আসাদ স্যারের বায়োলজি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিএম স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ার হওয়ার কথা... অথবা পোস্ট অফিস থেকে নতুন বিদেশি ডাকটিকেট দেখার সেই উত্তেজনা...?
আমার কিন্তু বেশ মনে পড়ে।
ইদানিং নটা-পাঁচটা উদয়াস্ত ব্যস্ততার মধ্যে এরকম ঘটেনা সহসা। নিজের অকার্যকর সময়গুলোতে তাই কল্পনার রঙে পাখা মেলে খুঁজতে হয় বন্ধুদের। তখন নিজের সাথেই কথা বলি দ্বৈতসত্তা হয়ে। এর মধ্যেই হয়তো কোনো এক সুনসান তপ্ত দুপুরে গুলশান অ্যাভিনিউয়ের গল্পগুলো ভাঙতে ভাঙতে মুকুল এসে উপস্থিত হয় আমার আপিসে; ডেস্কে বসে সে আনন্দ উপভোগ করা যায় না পুরোপুরি। অগত্যা নিচে নামি। আমি খানিকটা আকুল হয়ে মুকুলকে দেখি, এই সেই মুকুল, ক্যাম্পাসের যাবতীয় অস্থিরতার দিনগুলোতে যে মুকুল আমাকে সঙ্গ দিয়েছিলো...। মোহসীন হলে মুকুল আমার বন্ধু কাম গার্জিয়ান ছিলো খানিকটা। পনেরো বছর আগের ক্যাম্পাসকে খোঁজার চেষ্টাটা ব্যর্থ হয় না সহসা...।
তারপর কিছু এলোমেলো কথা উড়ে যায় মুকুলের চিকন সাদা অপরিচিত সিগ্রেট শলাকা থেকে বের হওয়া ধোঁয়ার সাথে। মুকুল ইদানিং ব্র্যান্ড বদলেছে। সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে আমি একবার এক প্যাকেট সিগারেট কিনে মুকুলকে দিয়েছিলাম। আর সেটার গায়ে সুন্দর করে লেখা ছিলো- ‘আমার বিশ্বাস এটাই মুকুলের জীবনের শেষ প্যাকেট!’
পরে অবাক হয়ে দেখলাম- মুকুল ওই প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট খায় সারাদিন, আর দোকান থেকে কিনে খায় আরও দশটা, জীবনের শেষ প্যাকেট আর শেষ হয় না!!
সে সব জারুল ফোটা দিন কবেই সেপিয়া কালারে কনভার্ট হয়ে গেছে, মুকুল এখন বড় প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক। কিন্তু এই আগুনঢালা আলসে দুপুরে মুকুলের সিগ্রেটের ধোঁয়ায় সে দৃশ্যগুলোতে কিছুটা রং লাগতে থাকে... শুধু এখানে রিন্টুটা থাকলেই জমে যেতো।
আহা, রিন্টু! দুই বাচ্চার বাবা আর ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্তা রিন্টু এখনও আগের মতই আসর মাতানো, সেই ঢ্যাঙা চ্যাসিসে আগের মতই ঘুরান্টি, চঞ্চল, উচ্ছল। রিন্টুটা আর বড় হলো না! আগে আমরা দল বেঁধে ঘুরতাম, এখন আমাদের বাদ দিয়ে যুঁথি আর বাচ্চাদের নিয়ে দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে...। রিন্টু, তুই কি ভুলে গেলি- ছেঁড়াদ্বীপের ওয়াচ টাওয়ারে উঠে আমরা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের বর্ধিত সীমানা নির্ধারণ করে এসেছিলাম...?
সে সীমানা পর্যন্ত বেড়েছে কি প্রবালদ্বীপ? জানিনা। তবে আমার বন্ধুদের সীমানা সংকুচিত হয়েছে নিশ্চিতভাবেই। ইদানিং হাওয়ায় ভাসিয়ে মুঠোফোনে ডাক পাঠালেই কথা বলা যায় সবার সাথে। কিন্তু সে কথা কখনওই মেলে না ‘পাশাপাশি বসিবার’ কিছু গ্রে-স্কেল মোডের ছবির সাথে।
অগত্যা হঠাৎ রাস্তায়, অফিস অঞ্চলে যখন ইসহাক, আরিফ, আসাদ, বিপ্লব বা রোমেলের সাথে দেখা হয়ে যায়, তখন তরল গলায় গেয়ে উঠি- বন্ধু, কি খবর বল, কতদিন দেখা হয়নি....
ছবিসূত্র: নিজস্ব
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০২০ দুপুর ১:১০