ডাকসুর দেড়তলা সিড়ির ল্যান্ডিংয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছি আমি আর রিপন। চুপচাপ। মনোজাগতিক কিছু অস্থিরতার দায় ক্যাম্পাসের উপর চাপাতে রিপনকে ডাকলাম- চল, আজ বিকেলে ক্যাম্পাসে যাই। অতিতে এ রকম বহু কষ্টকল্পনা, ভীষণ অসম্ভব অভিমান-হাসি-রাগ-ক্লান্তির ভার নিজের কাঁধে নিয়ে এই ক্যাম্পাস আমাদের মানসিক প্রশান্তি দিয়েছে সকালের শৈশবের মতই।
তাই সব অসময়গুলোকে সময় করতে ফিরে ফিরে আসি এখানে, এই তরুবীথি, নীপবনে।
করোনা আমাদের ফাঁকিবাজিকে আরও একটু চাগিয়ে দিতে পেরেছে বলেই বোধ হচ্ছে, চারটা বাজতেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে নচিকেতার গান ভাজতে ভাজতে আপিস থেকে বের হয়ে পড়ি। বিবিধ কারণে ঢাকার রাস্তায় এখনও জন-বাহন কম। মরে আসা রোদ আর নতুন গজিয়ে ওঠা তীব্র সবুজের মধ্য দিয়ে কিছুটা ফাঁকা সড়কে চলতে বেশ আরাম আরাম লাগে। অনেকটা নব্বুই দশকের মত।
সে নব্বুইয়ের শাহবাগের গল্পগুলো দেখতে দেখতেই যেনো আমি আর রিপন চারুকলা, ছবির হাট আর নজরুলের সমাধি পাশ কাটিয়ে একসময় ডাকসুতে এসে গেলাম। চুপচাপ ক্যাম্পাসে যতদুর দৃষ্টি যাচ্ছে, জনমনিষ্যির কোনো চিহ্ন নেই, তার বদলে এখানে ওখানে জংলা গাছের বাড়বাড়ন্ত। ক্যাম্পাস এখন যেন এক নির্বাক চলচ্চিত্র। কোথাও কেউ নেই। এই 'না থাকা'র কারণেই হয়তো আশপাশ থেকে বিচিত্র সব শব্দ কানে আসছে। হয়তো পাশের রাবার গাছের একটা হলুদ হয়ে আসা পাতা বাতাসে ভাসতে ভাসতে মাটিতে পড়লো, ‘টুশ’ করে হওয়া তার একটা শব্দ, ডাকসুর কার্নিস থেকে একটা ছোট পাখি ফুরুৎ করে উড়াল দিলো- তার শব্দ, তালগাছটার নিচে অলস বসে থাকা কুকুরটার নখ দিয়ে রাস্তা আঁচড়ানোর ‘খসখস’ শব্দ। দুরে কোথাও কেউ একজন বাইসাইকেলের বেল বাজালো, তার রেশ থেকে যাওয়া ‘টুংংঙ’ শব্দ ইত্যাদি, ইত্যাদি।
অদ্ভুত ব্যাপার! মানবসৃষ্ট শব্দমুখর এই ক্যাম্পাসে প্রকৃতির এত এত শব্দ হয়, করোনা না হলে জানাই হতো না। রিপন শব্দগুলো শুনছে কিনা বুঝতে পারছি না, মেঝেতে সারিবদ্ধভাবে চলতে থাকা কালো পিপড়ের একটা দলকে পর্যবেক্ষণ করাতেই ওর সব মনোযোগ বলে মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে একটা কাটি দিয়ে সারিটাকে ভেঙে দিচ্ছে। এই পিপড়েগুলো চলারও শিশশশ একটা শব্দ হচ্ছে।
অপার্থিব এই শব্দজগতে আমার নিজেকে ফলিম্যানের মত লাগছে। আচ্ছা ভালো কথা, আপনারা ফলিম্যান সম্পর্কে জানেন তো?
একটা সিনেমা বা নাটকে অভিনেতা, অভিনেত্রীর কন্ঠ, মিউজিক ছাড়াও হাজার রকমের শব্দ থাকে। ধরুন ঝড় হচ্ছে, তার শো-শো শব্দ, বা একটা লোক রাত দুপুরে মাতাল হয়ে নিশ্চুপ গলিতে টলতে টলতে যাচ্ছে- তার টেনে টেনে হাটার শব্দ, অন্ধকারে একটা ঘরের দরজা খুললো- তার ক্যা-আ-চ শব্দ, অথবা একটা মানুষ শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে, ফ্যানের বাতাসে সে বইয়ের পাতা বারে বারে উল্টে যাচ্ছে, সে পাতা উল্টানোর ফস ফস শব্দ বা ওই ফ্যানটারই দুলে যাওয়ার শব্দ...। এ রকম অসংখ্য শব্দ থাকে যেগুলো লাইভ রেকর্ডিং করা যায় না। একজন ফলিম্যান স্টুডিওতে বসে বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই শব্দগুলো তৈরী করে। সামনে বড় একটা স্ক্রিনে রেকর্ডেড মুভি/নাটকটা প্লে হয় আর সেটা দেখে দেখে তৎক্ষণিকভাবে সে প্রয়োজনীয় শব্দগুলো তৈরী করতে থাকে এবং রেকর্ডিং হয়।
আপাতদৃষ্টিতে এটা কোন কাজ মনে না হলেও বিষয়টা অত্যন্ত কঠিন। বিশেষত একই শব্দের ভেরিয়েশন যদি ঠিক না হয় তাহলে পুরো ছবিটাই কেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন ধরুন একটা লোক দৌঁড়ে যাচ্ছে, সে যখন আপনার দিকে আসছে, তখনকার পায়ের শব্দ এক রকম, যখন আপনার খুব কাছে, তখনকার শব্দ একরকম আবার যখন আপনাকে পার করে গেল, তখনকার শব্দ আরেক রকম। আবার মনে করুন একজন একটা চিনামাটির কাপে চা খাচ্ছে, ওই কাপ যখন কাচের টেবিলে রাখছে তখন একটা শব্দ হচ্ছে, কাপের চায়ের পরিমাণ কমার সাথে সাথে সে শব্দের স্কেলও বদলে যাচ্ছে।
কি খুব সহজ মনে হচ্ছে?
নেপথ্যের শিল্পী হিসেবে ফলিম্যানকে নতুন নতুন শব্দের খোঁজে চব্বিশটা ঘন্টাই নিজের চারপাশে তীক্ষè নজর রাখতে হয়। পাড়ার টং দোকানে চা খেতে গিয়ে চায়ে বুঁদ হওয়ার চেয়ে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে হঠে কেতলি থেকে কাপে গরম পানি পড়ার কলকল শব্দ, হয়তো ওই সময়েই পাশের রাস্তায় কোনো একটা মোটরবাইক ক্যাঁ শব্দে তীব্র ব্রেক কষে দাঁড়ালো, এবং তারপরেই ঝনঝন করে কিছু বাসনকোসন পড়ার শব্দ, সাথে গাড়ির হর্ন, মানুষের গালাগাল, হট্টোগোল .... এত এত শব্দের মধ্যে ফলিম্যানের হাতের চা কখন ঠাণ্ডা পানসে হয়ে যায়, খেয়ালই থাকে না!
এ রকম একজন ফলিম্যানের জীবন নিয়ে একটা মুভি দেখেছিলাম। নিজের কাজের প্রতি এতটায় নিবেদিত যে একসময় সে শুধু অ্যবস্ট্রাক্ট শব্দই শুনতে থাকে, তার সামনে বসা মানুষের কথা শুনতে পায় না। মানে সবসময় প্রকৃতির শব্দুগলোতেই তার মনোযোগ চলে যায় ফলে বাবা-মা, স্ত্রী বা অন্যদের কথা তার মস্তিস্কে পৌঁছায় না...। সে হয়ে চলা শব্দগুলোর একটা ঘ্রাণ পায়।
এই নিরব ক্যাম্পাসে আজ বিচিত্র শব্দ শুনতে শুনতে হঠাৎ কবেকার কোন অনুরোধের আসরে ফেলে আসা কিছু শব্দ মনে পড়ে গেলো; একদা যে শব্দগুলোর ঘ্রাণ আমার কাছেও ছিলো।
ছবিসূত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:৫২