আমার নিক 'পংবাড়ী', মুক্তিযু্দ্ধ চলাকালীন 'জেড-ফোর্সের' সাময়িক হেডকোয়ার্টারের স্হানটির নামের সন্মানে; পংবাড়ী পশ্চিম ত্রিপুরার পাহাড়ের মাঝে অবস্হিত একটি গ্রাম; এখানে স্হানীয় উপজাতি রাজার বাড়ী অবস্হিত। রাজাদের পরিত্যাক্ত একটি পাহাড়ের উপর এই হাইড-আউট ছিল।
পংবাড়ী আগরতলা থেকে আনুমানিক ৪০ মাইল দক্ষিণে, বাংলাদেশ সীমান্ত হতে হয়তো ২০ মাইল ভিতরে; তখন মোটামুটি দুর্গম ছিল; কোন পাকা রাস্তা ছিল না; রাজবাড়ী ছিল ১ মাইলের মাঝে।
যথাসম্ভব, জুলাইয়ের কোন এক শেষদিনে আমি প্রথমবার পংবাড়ী গিয়েছিলাম: নোয়াখালীর চানগাজীর যুদ্ধের পর; দিনটি ছিল খুবই খারাপ: সরাদিন বৃস্টি হচ্ছিল, আমাদের মনোবল ছিল খুবই ভংগুর; অস্ত্রসহ আনুমানিক বিশ মাইল হেঁটে আমাদের প্লাটুন পংবাড়ী পৌঁছে। ওখানে ২ টি চালাঘর ছিলো: একটি রান্নাঘর, অন্যটি অস্ত্র গুদাম। ইপিআর ও বেংগল ইতিপুর্বে নিজেদের জন্য তাঁবু বানিয়েছিল; আমরা পৌঁচার পর, আমাদের তাঁবু টানানোর জন্য আদেশ দেন ক্যাপটেন মাহফুজ। সারাদিন না খেয়ে, অস্ত্র নিয়ে ২০ মাইল হাঁটার পর, সঠিকভাবে তাঁবু টানানোর অবস্হা ছিল না; গাছের সাথে তাঁবুকে কোনভাবে টাংগায়ে, সবাইকে জিরিয়ে নিতে বললাম; কয়েক মিনিটের মাঝে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো; আমাদের এই অবস্হা দেখে ইপিআর আর বেংগলরা অনেক হাসাহাসি করেছিল দীর্ঘ সময়। পংবাড়ী হাইড-আউট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল; মাঝে মাঝে প্রায শ'এর মতো সৈনিক ওখানে একত্রিত হতো।
পংবাড়ী থেকে আনুমানিক ২০ মাইল দক্ষিণ পুর্বে ছিল 'হরিণা': ১ং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার; এটা ছিল বিরাট ব্যাপার; তখন মেজর রফিক ছিলেন কমান্ডার; যুদ্ধের শেষ অবধি হরিণা প্রা্য ২২০০০ মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে দেশের ভেতরে পাঠায়; এরা ছিল গেরিলা যোদ্ধা। পংবাড়ী থেকে ১০ মাইল দক্ষিণে ছিল 'ওবায়েদ বলীর" ক্যাম্প; এটাও ১ নং সেক্টরের অধীনে ছিল: এখানে মওলানা ভাসানী পন্হী রাজনীতিবিদ "ওবায়েদ বলী" কৃষক ও ছাত্রদের গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে ১ নং সেক্টরে গেরিলা হিসেবে পাঠাতেন। পং বাড়ী থেকে ১০ মাইলের ভেতরে ছিল "বিএলএফ" এর ট্রেনিং ক্যাম্প: এখানে ছাত্রলীগের ছেলেদের ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল; এটাকে চালু করেছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র আব্দুর রব ও নিজামপুর কলেজের রাখাল দাস।
পংবাড়ী ছিল বড় সন্মানী যায়গা; আমরা প্রাণ দিয়ে যায়গাটাকে ভালোবাসতাম; পাকিরা ২ বার আক্রমণ করেছিল পংবাড়ী: একবার সীমান্ত থেকে আর্টিলারী দ্বারা; আমাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি; ২য়বার কমান্ডো আক্রমণ; আমাদের একজন ইপিআর সৈনিক গুরুতরভাবে আহত হয়; সেই সৈনিকের সঠিক দায়িত্ব পালনের কারণে, আমরা কম ক্ষতিতে বেঁচে গেছি।
ত্রিপুরার সেই দুর্গম পাহাড়ের গ্রামটি এখন আমিসহ বেশ কিছু মানুষের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে মুল্যবান যায়গা। আমার 'নিকটি' সেই গ্রামের ও রাজবাড়ীর সন্মানে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৪ দুপুর ২:৩১