somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামী ব্যাংকের কর্মনীতি : বিশেষত্বটা কোথায় ?

০৭ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাধারন বানিজ্যিক ব্যাংকের কার্যনীতির সাথে ইসলামী ব্যাংকের কোনো মৌলিক পার্থক্য আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করাই এই লেখার লক্ষ্য । ইসলামী ব্যাংকের প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতারা সাধারন বানিজ্যিক ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে ধর্মীয় যুক্তি ছাড়াও কিছু অর্থনৈতিক যুক্তিও দিয়ে থাকেন । তারা বলেন -

সাধারন ব্যাংক আমানতকারীকে গচ্ছিত টাকার জন্য পুর্বনির্ধারিত হারে সুদ প্রদান করে, কিন্তু ইসলামী ব্যাংক আমানতকারীকে ব্যাংকের ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে অংশীদার করে নেয় । যেমন লাভ হয়,সেই অনুযায়ী এবং মোট পূঁজিতে আমানতকারীর অংশ অনুপাতে লভ্যাংশ প্রদান করে । আবার সাধারন ব্যাংক থেকে কেউ ঋণ নিলে তাকে আসলের সাথে সুদ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয় । কিন্তু ইসলামী ব্যাংকে ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়িক কর্মকান্ডের অংশীদার হয় এবং ঐ ব্যবসায় অর্জিত মুনাফা থকে ব্যাংকের প্রাপ্য অংশ একটি পূর্বনির্ধারিত চুক্তির ভিত্তিতে ঠিক করা হয়,যার মধ্যে দিয়ে ঋণ উসুল করা হয় । মানুষকে বোঝানো হয়, "ঐ দেখো সুদ ছাড়াই ব্যাংকের কাজকর্ম কেমন চলছে, আসল কথা হলো ঈমানদার হওয়া এবং নিন্দুকদের কথায় কর্ণপাত না করা । "

সত্যি কি ঘটনা এমন ? খতিয়ে দেখা যেতে পারে । সাধারন ব্যাংক তার আমানতকারীকে সুদ দেয় কোথা থেকে ? প্রতিটি ব্যাংক তার নিজের পূঁজি ও আমানতকারীদের গচ্ছিত মোট অর্থ নিয়ে কোন না কোন উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে হয় সরাসরি বিনিয়োগ করে অথবা ঋণ প্রদানের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে । এইভাবে ব্যাংকের যে লাভ হয় তার একটি অংশ ব্যাংক তার আমানতকারীদের সুদ হিসেবে প্রদান করে; কোনো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ না নিলে ব্যাংকের লাভ হয় না । সে তার আমানতকারীদের সুদও দিতে পারে না । তাই নামে সুদ হলেও এ হলো মুনাফারই অংশ । বাস্তব ঘটনাটি এরকম বলেই ইসলামী ব্যাংকের পক্ষেও 'সুদ' কথাটি 'লভ্যাংশ' দ্বারা প্রতিস্থাপন করার সুযোগ ঘটে । দুটি ব্যাংকের মধ্যে এ ব্যাপারে বাচনিক পার্থ্ক্য থাকা ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই ।

দ্বিতীয়ত : ব্যাংকের আমানতকারীকে খাতাকলমে আমানতকারী বলা হলো নাকি অংশীদার বলা হলো এতে দুই পক্ষের কারোরই কিছু যায় আসে না ।

তৃতীয়ত : ব্যাংকের সুদের হারও প্রকৃতপক্ষে স্থির বা পুর্বনির্ধারিত থাকে না । আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, জাতীয় অর্থনীতি, বাজার, শিল্প ও কৃষিতে উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ইত্যাদি অনেক কিছু বিবেচনার ভিত্তিতে পূঁজিবাদের নিয়মে এক একটি দেশে ব্যাংকের লেনদেনের ক্ষেত্রে সুদের হার নির্ধারিত ও পরিবর্তিত হয় । তবে জাতীয় ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এই হার সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা একটি অর্থ বছরের শুরুতেই ঘোষিত হয় । কিন্তু ব্যক্তিমানিকানাধীন বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সুদের হার যদিও পূর্বাহ্নে ঘোষিত হয়, বাজার সাপেক্ষে তা পরিবর্তন করার অধিকার ব্যাংক মালিক সংরক্ষণ করেন । সুতরাং এই দিক থেকেও মৌলিক কোনো পার্থক্য চোখে পড়ছে কি ?

অন্যদিকে সাধারণ ব্যাংক যখন কোনো উৎপাদনমূলক ব্যবসায় ঋণ প্রদান করে সেখানেও ব্যাংকের অংশগ্রহণ অনেকটা নিজস্ব উদ্যোগে পূঁগি বিনিয়োগের মতোই বিষয় । তফাৎ শুধু এইটুকুই হয় যে, নিজের শিল্পে বিনিয়োগ করলে ব্যাংকের আয় হয় প্রত্যক্ষ মুনাফার আকারে, কিন্তু অন্য মালিকের শিল্পে ঋণ দিলে আয় হয় মুনাফা থেকে প্রদত্ত সুদের আকারে । এখানে আবার ব্যাংক আসলের সাথে যেটা সুদ হিসেবে আদায় করে, নাম যাই হোক তাও মুনাফা ছাড়া আর কিছুই নয় ।এই কারনেই যিনি ঋণ গ্রহীতা তাকে তার ব্যবসাটি ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের কাছেই বন্ধক (মর্টগেজড) রাখতে হয় । একইভাবে ইসলামী ব্যাংকও ঋণ গ্রহীতার প্রকল্পকে ব্যাংকের মালিকানাধীন রেখে দেয়, যদিও তাকে বলা হয় ব্যাংকের অংশীদার । "...ঋণের অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের সম্পদে ব্যাংকের মালিকানা ভাল থাকা উচিৎ ।" [ আল-নাজ্জার প্রমুখ, ইসলামী ব্যাংক কি ও কেন ?]

ঋণ গ্রহীতা যদি অংশীদারই হয় তবে আর আলাদাভাবে ব্যাংকের ঐ ব্যক্তির সম্পত্তিতে মালিক হবার প্রয়োজন কী ?? এরকম কোনো অংশীদারি কারবারের কথা কেউ কি শুনেছে যেখানে একদিকে দুইজনই অংশীদার আবার অপরদিকে একজন অপরজনের সম্পত্তির মালিক ???

যখনই ব্যাংকের বিনিয়োগ সুরক্ষার প্রশ্ন চলে আসবে, এরা বলবেন ব্যাংকের কাছে পুরো প্রকল্পটি ঋণ শোধ সাপেক্ষে বন্ধক থাকবে। আবার যখন ধর্মের নামে লোক ঠকানোর প্রয়োজন দেখা দেবে তখন এরা মানুষকে বোঝাবেন , আমাদের তো অংশীদারি ব্যবসা !!!

আসল কথা হলো ইসলামী ব্যাংককেও ঋণ আদায় করার সময় প্রদত্ত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশী তুলে নিতে হয় । তা না হলে ব্যাংক হিসেবে তার কারবার চলবে কী করে !
কিন্তি এই ব্যাংক তার ঋণগ্রহীতার সাথে ঋণ শোধের ব্যাপারে অংশীদারি কারবারের আড়ালে যে চুক্তিনামা সই করে তাতেই প্রদত্ত ঋণ সাপেক্ষে আদায়যোগ্য অধিকতর অর্ঠের পরিমাণ নির্ণীত হয় ।এমনকি ঋণ গ্রহীতার নেয়া প্রকল্পের আয়- ব্যয় ও যাবতীয় লেনদেন " ইসলামী ব্যাংকের দক্ষ অডিটর দ্বারা পরীক্ষিত হতে হবে এবং প্রকল্পের লাভ-লোকসানের হিসেবও তাদের দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে " [নাজ্জার, পৃ-৪৬] তার মানে হলো ইসলামী ব্যাংকও এমনভাবে ঋণ আদায়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে যে তা সাধারণ ব্যাংকের আসল ও সুদের যোগফলের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ হয় ।


ইসলামী ব্যাংকের প্রবক্তারা আরো একটি যুক্তির কথা বলছেন । বলছেন - "সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে সুদের তেমন ভূমিকা নেই । বাংলাদেশের বর্তমান ব্যাংকব্যবস্থা সুদনির্ভর, অথচ আমাদের ব্যাংকের মোট জামানতের ৩০% সুদমুক্ত রাখা হয়েছে ।এটা মুসলিম সমাজের স্বাভাবিক ঈমানী চেতনার বহিপ্রকাশ ছাড়া আর কী হতে পারে ? ড. মান্নান আবার এই তত্ত্বের সমর্থনে কেইনস এর কথাও উল্লেখ করেছেন ।

প্রথমেই বিভ্রান্তি সৃষ্টির এই অপচেষ্টাকে চিনে নেয়া দরকার । যে কোন দেশের যে কোন ব্যাংকেই একটি চলতি হিসাব আমানত থাকে ।তাতে সাধারন মানুষ খুব একটা টাকা জমা করেনা । এটা হলো মূলত ব্যবসায়ীদের দ্রুত লেনদেন সেরে ফেলার জন্য যখন খুশি টাকা জমা দেওয়ার ও তুলে ফেলার অধিকারযুক্ত আমানত । বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতেও তা আছে । আমাণতকারীদের লক্ষ্য এখানে সঞ্চয়ও নয়, উপার্জন বৃদ্ধিও নয় ।ফলে ৩০% এর উদাহরনটি দিয়ে সুদের সাথে সঞ্চয়ের সম্পর্ক প্রমাণ হয়না, আবার অপ্রমানও হয়না । তাছাড়া এই আমানতের সাথে ঈমানের কোনো সম্পর্ক নেই । ভারতের হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ব্যবসায়ী বা ব্রিটেনের খ্রিষ্ট বিশ্বাসী ব্যবসায়ীরাও এরকম কিছু অর্থ ব্যাংকে জমা রাখে - তাদের ধর্মীয় কেতাবে সুদ হারাম না করা হলেও - এটি মুসলিম দেশের কোনো একক বৈশিষ্ট্য নয়। তাই সাধারন মানুষকে তাদের অশিক্ষা-অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কীভাবে ধর্মব্যবসায়ীরা ঠকায় এই যুক্তিটি তার একটি উদাহরণ ।

সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে সুদের কোনো ভূমিকা নেই -এই কথাটাও মাত্র অর্ধসত্য । তাও নেতিবাচক অর্থে । যাদের সঞ্চয়ের সামর্থ্যই নেই, ব্যাংকের সুদ বাড়লো কি কমলো তাতে তাদের কিবা যায় আসে ? কিন্তু ইতিবাচক অর্থে যাদের সঞ্চয় করার মত উদ্বৃত্ত আছে, তারা সঞ্চয় করবে কিনা, করলে কতটা করবে, কোথায় করবে - তার পুরোটাই নির্ভর করে সুদের হারের উপর । মুশকিল হলো , ধর্ম ব্যবসায়ীদের এই সত্য্ স্বীকার করানো যায় না । কারন তাদের জন্য সত্য সম্ভবত দুনিয়ার সবচে হারাম জিনিস

আগের পোস্টটি এখানে :
ইসলামী ব্যাংকিং : গড়ে ওঠার ইতিহাস ও কিছু কথা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০০৯ বিকাল ৫:৩০
৩২টি মন্তব্য ২৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×