somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চার কোটিপতি চাষির গল্প

০৮ ই মার্চ, ২০১২ রাত ৯:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গাছে ফল, মাঠে সবজিন্ধ এই নিয়ে ঈশ্বরদী। মাঠের পর মাঠ শুধু সবজি আর সবজি। গ্রামের পর গ্রাম চোখে পড়বে বিভিন্ন রকম ফলবাগান। এখানকার এমন কোনো বাড়ি নেই, যার চার পাশের পতিত জায়গায় কোনো সবজি কিংবা ফলের চাষ করা হয়নি। শুধু পাবনা জেলা নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় এখানকার সবজির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। বহু শিক্ষিত যুবক সবজি চাষে নেমে স্বনির্ভর হয়েছেন। এমন সবজি ও ফল বিপ্লবের পেছনে ঈশ্বরদীর চার দিকে চারজন পরিশ্রমী ও অগ্রণী চাষির অবদান রয়েছে। তারা নিজেরা হয়েছেন সফল ও কোটিপতি, অন্য দিকে তৈরি করেছেন আরো অনেক সফল চাষি।

কলেজ পালানো ছেলে কোটিপতি লিচুচাষি
১৯৮৩ সাল। ঈশ্বরদীর মিরকামারি গ্রামের অবস্খাপন্ন চাষি তোরাব মণ্ডল ছেলে আবদুল জলিল কিতাবকে পড়াশোনার জন্য রাজশাহী কলেজে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কলেজ ছেড়ে পালালেন। বাড়ি এসে শুরু করলেন লিচুচাষ। ছেলের এমন পাগলামি দেখে বাবা খুব ক্ষুব্ধ হলেন। ছেলে লেখাপড়া করে চাকরি করবে, তা না করে শুরু করল লিচু বাগান। বাবা ধরে নিলেন এ ছেলে দিয়ে আর কিছু হবে না। কিন্তু কী অবাক ব্যাপার, বাবার সব আশঙ্কা ভুল প্রমাণ করে ছেলে এখন দেশখ্যাত লিচুচাষি।
শুরু করেছিলেন এক বিঘা জমিতে ১০টি চারা লাগিয়ে। কিন্তু ১৯৯০ সালের মধ্যে ৫০ বিঘা জমিতে লিচু বাগান করে সবাইকে অবাক করে দেন। কিতাব মণ্ডল এ বছর পর্যন্ত ৬৫ বিঘা জমিতে লিচু বাগান করেছেন। তিনি জানালেন, ঈশ্বরদীতে তার বাগানেই সবচেয়ে বেশি জাতের লিচু রয়েছে। খরচ বাদ দিয়ে প্রায় এক কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে আশা করছেন।
বাগান পরিচর্যায় ২২ জন শ্রমিক কাজ করে। পরিচর্যা খরচের বেশ কিছুটা উঠে আসে বাগানে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা হলুদের মাধ্যমে। ১৫ বিঘায় চাষ হয়েছে আপেল কুল ও বাউকুল।
লিচু নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। লিচুর পরিচর্যার জন্য কোনো আলাদা ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় না। কিতাব বললেন, যে পরিমাণ লিচু নষ্ট হয় তা থেকে অনায়াসে অ্যালকোহল উৎপাদন সম্ভব। বাইরে থেকে স্পিরিট আমদানির প্রয়োজনও পড়বে না। এ জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। এ ছাড়া লিচু গাছ থেকে উত্তোলনের সাথে সাথে বাজারজাত করা হয়। উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্খা থাকলে দু-তিন মাস ধরে লিচু বাজারজাত করা যেত। এতে চাষি-ভোক্তা উভয়েই লাভবান হতেন।

ধনিয়া চাষে ধনী ময়েজ
অপ্রধান মসলা ধনিয়া পাতার চাষ করেও দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব। তবে ধনিয়া পাতার জাতটি হতে হবে হাইব্রিড আর চাষ করতে হবে আগাম। তাহলেই বাজিমাত! যেমন করেছেন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার বড়ই চড়া গ্রামের চাষি সিদ্দিকুর রহমান ময়েজ। তিনি আগাম হাইব্রিড জাতের ধনিয়া পাতা চাষ করেই ভূমিহীন থেকে কোটিপতি। হাইব্রিড ধনিয়ার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য মসলা ও সবজি চাষ করেন। মাত্র মাধ্যমিক পাস এ চাষি ঈশ্বরদীর এক সফল ও মডেল চাষি। ধনিয়া চাষ কেমন লাভজনকন্ধ এমন প্রশ্নে তিনি জানান, প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ২৫ মণ ফলন পাওয়া যায়। প্রতি মণ পাতা গড়ে চার-পাঁচ হাজার টাকা বিক্রি হয়। ধনিয়া আবাদের জন্য সাধারণ চাষিরা যখন ক্ষেতে চাষ শুরু করে তার অন্তত পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে একজন সবজি চাষি হিসেবে তিনি ধনিয়া পাতার জন্য চাষ শুরু করেন। একই জমিতে দুই-তিন দফা ধনিয়ার আবাদ হয়। গাছের বয়স দুই মাস হলেই বিক্রি করে দেয়া হয়। খরচ যায় জমির লিজমানিসহ প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা।
ধনিয়া পাতার আবাদে অভাবনীয় সাফল্যের পর চাষি ময়েজ অন্যান্য সবজি ও ফল চাষেও এগিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে কুল, গাঁজর, পেঁপে, চিচিংগা, বারোমাসী পিঁয়াজ উল্লেখযোগ্য। ২০০৪ সালে ৪১ বিঘাতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ করে তিন লাখ টাকা লাভ করেন। ২০০৬ সালে ৮০ বিঘা জমিতে এক বিরাট কুল বাগান গড়ে তোলেন। ২০০৭ সালে কুল বিক্রি করে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা আয় করেন। এ বছর তার গাজর চাষে ১০ লাখ টাকা লাভ হয়। ২০০৮ সালে কুল চাষে তার ৯৫ লাখ টাকা আয় হয়েছিল। ২০০৯ সালে ১০০ বিঘাতে কুল চাষ করেন। দাম পড়ে যাওয়ায় লোকসান হয়েছে। পেয়ারা বাগান করেছেন ২০ বিঘাতে। সবে পেয়ারা উঠতে শুরু হয়েছে।

গরুর ব্যাপারী এখন গাজর বাদশা
সাত থেকে আট বছর আগে লোকে তাকে চিনত গরুর দালাল হিসেবে। বিত্ত-বৈভব ছিল না, ছিল না সামাজিক মর্যাদা। থাকার মধ্যে ‘শুধু বিঘে দুই ভুঁই ছিল’ তার। সেই দুই বিঘা জমি আজ জায়দুলকে গরুর ব্যাপারীর পরিচিতি মুছে করেছে গাজর বাদশা। ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারী গ্রামের ছাত্তারের ছেলে জায়দুল ইসলাম এখন দেশের অন্যতম প্রধান গাজর চাষি। জায়দুল জানান, লেখাপড়া না জানায় চাকরি বা অন্য ব্যবসায় যেতে না পারায় গরুর ব্যবসা ধরি। লোকে এ ব্যবসাকে বাঁকা চোখে দেখত। তারও খুব ভালো লাগেনি সে ব্যবসা। এরকম সময়ে এলাকার কৃষি কর্মী আব্দুল খালেক তাকে সবজি চাষের পরামর্শ দেন। জায়দুল ছেড়ে দেন গরুর ব্যবসা। কোমর বেঁধে নামেন সবজি চাষে। দুই বিঘা জমিতে গাজর চাষ করে প্রথম ৫০ হাজার টাকা মুনাফা পান। পাঁচ বছরের মাথায় ৩০ বিঘা জমিতে গাজর চাষ করেন। এখন তিনি চল্লিশ বিঘা জমিতে গাজর চাষ করেন। এই আট বছরের মাথায় তার নিজস্ব সম্পত্তির পরিমাণ ২৫ বিঘা। গাজর চাষাবাদ ও বিপণন সম্বধে জায়দুল আমাদের জানান, একই ক্ষেতে দুই দফায় গাজর আবাদ করা হয়। প্রথম ধাপে ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্ষেতে বীজ বোনা হয়। এই গাজর আগাম সবজি হিসেবে চড়া দামে (প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে) বিক্রি করা হয়। প্রথম দফায় গাজর তোলার পর দ্বিতীয় দফায় গাজর বোনা হয়। এই শেষের বার যখন গাজর তোলা হয় তত দিনে গাজরের বাজার নেমে যায়। এ জন্য গাজর কোল্ড স্টোরেজে রেখে দেন। জায়দুল জানান, প্রতি বিঘায় ৫০ থেকে ১২০ মণ ফলন পাওয়া যায়। বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা মুনাফা থাকে।

পেঁপের রাজা বাদশা মিয়া
ছাত্রজীবন থেকেই শাকসবজি আলু, টমেটো, গাজর, বেগুন ইত্যাদির চাষ করতেন। আজ শাহজাহান আলী ওরফে বাদশা মিয়ার নিজস্ব ৪০ বিঘা জমির ওপর শুধুই পেঁপের বাগান।
বাদশা মিয়া জানালেন, ৭৭ সালে বেগুন চাষে সাফল্য অর্জন করি। এক বিঘা জমিতে ৩৩ হাজার টাকা মুনাফা অর্জন করেছিলাম। মূলত তখন থেকেই সবজি চাষ পেশা হিসেবে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ৮৮-৮৯ সালে ধনিয়ার জমি লিজ নিয়ে ৮০ বিঘা জমিতে শাকসবজি উৎপাদন করি। এতে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করি। ১৯৯৭-৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক লাভ করি। এখন ৮২ একর জমির ওপর গড়ে তুলেছেন মা-মনি কৃষি খামার। যেখানে প্রায় ৩৫ প্রকার সবজি ও ছয় থেকে সাত জাতের ফল চাষ হচ্ছে। গড়ে তুলেছেন একটি ডেয়ারি ফার্ম। দেশের মধ্যে তিনিই প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে শরিফা বাগান করছেন। তার খামারে সব মিলিয়ে ৫০ থেকে ৬০ জন লোকের কর্মসংস্খান হয়েছে। বাদশা মিয়া আমাদের জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বারি, বিনা, বিএডিসি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তিনি খামার পরিচালনায় সাফল্য লাভ করেছেন।
লেখক:আমিনুল ইসলাম জুয়েল
এগ্রোবাংলা ডটকম



চার কোটিপতি চাষির গল্প

সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১২ রাত ৯:০৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×