somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উত্তর জানা নেই

২৪ শে এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৩:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাবেদ মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তবে সে শুনেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। বইয়ে পড়েছে এর ইতিহাস। কয়েকটি চলচিত্রে, প্রামাণ্য চিত্রে, আলোকচিত্রে যেটুকু ধরা পড়েছে তার প্রায় সবটাই দেখার চেষ্টা করেছে অতি আগ্রহে। এতেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা, যাঁরা যুদ্ধ করতে পারেনি কিন্তু যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, সম্ভ্রম হারিয়েছে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা, যারা সংগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তাদের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্ম নিয়েছে তার মনে। কিন্তু তার শিক্ষা-দীক্ষা আরোপিত শিক্ষার মতো নয়। প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে যাচাই বাছাই করে তবে সে সবকিছু গ্রহণ করে। তাই সে মাঝে মাঝে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নিজের ভূমিকা নিয়ে তার স্বকল্পিত স্বকীয় কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায়। এসব চিন্তা তার মানসপটে এক ঝড়ের সৃষ্টি করে। এঁকে দেয় এক বিপর্যস্ত ছবি। এই সময় ও সেই সময়ের একটা সমীকরণ মেলাতে চেষ্টা করে সে। ভাবে যুদ্ধের সময় যদি তার বয়স ষাট কিংবা সত্তর হতো। তাহলে তো সে যুদ্ধ করতে পারতো না। ট্রেনিং নিয়ে এসে কোন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যকে গুলি করে ধরাশায়ী করতে পারতো না। বরং একদিন জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এসে গ্রামে ঢুকতো। আর কয়েকজন মিলেটারি গাড়ি থেকে নেমে ঘর থেকে বের করে এনে তাকে বুড়া বুড়া বলে গুলি করে ফেলে রেখে চলে যেতো। তাহলে যুদ্ধে কী ভূমিকা থাকতো তার। যদি সে হতো গুলিবিদ্ধ নিহত সে বৃদ্ধ পিতার যুবক সন্তান। তাহলে হয়তো পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতো। ট্রেনিং নিয়ে সম্মুখ সমরে গুলি করে একজন মিলেটারিকে পরাস্ত করে চিৎকার করে বলে উঠতো-পিতা! আমি তোমার হত্যার বদলা নিয়েছি। সেটা কি দেশের জন্য যুদ্ধ হতো। নাকি হত্যার বদলে হত্যার উদ্দেশ্যে একের পর এক মিলেটারি ক্যাম্প বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকতো তার চেতনা। যদি সে প্রাণ হারাতো তাকে কি কোন উপাধি দেওয়া হতো এই যুদ্ধের জন্য। অথবা বেঁচে থাকলে সে কি কোন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার মাধ্যমে প্রজন্মের মনে সৃষ্টি করতে পারতো কোন চেতনা। নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় পাওয়া বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকতো। অথবা যদি সে হতো এক উæছল কিশোর। চাওয়া নাই, পাওয়া নাই, পিছুটান নাই। একদিন দেখল দলে দলে লোক শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসছে। রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে চলে যাচেছ অসংখ্য মানুষ শরণার্থী শিবিরে। দাউ দাউ করে জ্বলছে ঘর বাড়ি। মরছে মানুষ অকাতরে। মরছে ছাত্র, জনতা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি। রেডিওতে শোনা যাচ্ছে- দেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে। শোনা যাচ্ছে জাগরণের গান। প্রাণটা বড়ই উথাল পাতাল। কিছু একটা করতে হবে দেশের জন্য। এভাবে চুপ করে বসে থাকা যায় না। সবার অলক্ষ্যে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে রাইফেল কাঁধে ঝাপিয়ে পড়তো হায়েনার হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য। শুধুই সময়ের প্রয়োজনে। এক চরম উপলব্ধি থেকে, দেশাত্মবোধ আর দেশপ্রেম থেকে। হয়তো বুকপকেটে থাকতো একটা চিঠি-মাগো! ওরা বলে, তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না। বল মা তাই কি হয়! তাইতো আমার দেরি হচ্ছে। মাত্রতো আর কটা দিন। তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে তবেই না বাড়ি ফিরবো। অথবা প্রাণে বাজতো একটা গান- মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি। আর যুদ্ধ শেষে পা হারিয়ে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রজন্মের চোখে অবহেলিত, সরকারের তালিকার বহির্ভূত, সব রকম সুবিধা বঞ্চিত, শুধু স্বাধীনতা আসবে এই চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে চুপচাপ মুখ লুকিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন চুরি হতে দেখে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতো। আর স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী দেখার আগেই শেষ নিশ্বাসটুকুও শেষ হয়ে যেতো।

জাবেদের বাবা যুদ্ধ করেনি। সরকারী চাকরীজীবি ছিল। শহরে থাকতো। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে অফিসের কার্ড গলায় ঝুলিয়ে মাথায় টুপি দিয়ে আয়াতুল কুরসি পড়তে পড়তে অফিসে যেত। জাবেদ অবশ্য দেখেনি। মায়ের কাছে শুনেছে। সারাদিন ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো অন্যরা। এই বুঝি মিলেটারি ঘরের দরজার কড়া নাড়ল এমন একটা অবস্থা। রাতে বাতি জ্বালাতে পারতো না। পাশের রাস্তায় গাড়ি যাওয়ার শব্দ। সারি সারি বুটের আওয়াজ। থেকে থেকে মেশিনগানের গুলির আর্তনাদ শোনা যেত। দাদু নাকি কাথা মুড়ি দিয়ে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতো। আর মাকে বলতো। বউমা! দেখো সোনার বাংলা একদিন স্বাধীন হবেই। এত অত্যাচার আল­াহ সহ্য করবে না। বাংলার মেহনতী মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, মুঠে, মজুর সবাই স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। জীবন পণ করে যোগ দিচ্ছে মুক্তিবাহিনীতে। গেরিলা আক্রমণে অনেক জায়গায় মিলেটারিদের বেকাদায় ফেলেছে। ওদের এখন তাড়া খাওয়া শিয়ালের মতো পালায় পালায় অবস্থা। তাহলে দাদুর মধ্যে কি একটা সুপ্ত দেশপ্রেম ছিল। শুনেছি ভাষা আন্দোলনের সময় দাদুর সক্রিয় অংশগ্রহন ছিল। যদিও রফিক, সালাম, বরকত এর মতো প্রাণ দিতে হয়নি। আসাদের রক্তমাখা শার্ট এর মতো রক্ত ঝড়াতে হয়নি। তবুও দেশের জন্য একটা অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁর হৃদয়ে স্থান পেয়েছিল। অবশ্য বাবার সামনে এসব কথা একদম আলোচনা করা যেত না। তাঁর ধারণা কয়েকজন ক্ষমতালোভী মানুষের জন্য এই অস্থিতিশীল অবস্থা। ওদের শায়েস্তা করতে পারলে সব আন্দোলন চুকে যাবে। এগারো পরিবার ভেঙে বাইশ পরিবার হওয়ার মতো। উনাদের মতো ছাপোষা মানুষদের এসবে না জড়ানোই ভালো। রাষ্ট্রভাষা বাংলা হোক আর উর্দুই হোক, অফিস আদালতে সবতো ইংরেজীতেই করতে হচ্ছে। পড়াশোনাও সব ইংরেজীতে। আর ইংরেজীতে ভালো বলেই অনেক পরীক্ষা দিয়ে কোনরকমে একটা সরকারী চাকরি জোগাড় করেছে। রজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পাছে তাঁর চাকরিটাই না হারাতে হয়। তিনি বলেন দেশপ্রেম সবার মধ্যেই আছে। আমরা যে দিনরাত পরিশ্রম করছি সে শুধু নিজের জন্য নয়। দেশের উন্নয়নের জন্যও। দেশের উন্নয়নখাতে আমাদের আয়ের একটা অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। আন্দোলনের কারণে দেশের যে বিশাল ক্ষতি হচ্ছে সেটা কি ঐ রাজনীতিবিদেরা পূরণ করতে পারবে। প্রতিটি আন্দোলনে যারা মৃত্যুবরণ করছে তারাতো কোন না কোন পরিবারের সন্তান। কেউ কি চায় তার সন্তান এভাবে মারা যাক। শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমেওতো অধিকার আদায় করা যায়। দেশবিভাগের সময় মহাত্মা গান্ধী কি সেটা করেননি। আমি দেশের জানমালের ক্ষতি চাই না। এটাই আমার দেশপ্রেম। পরে পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে ওরা চলে আসে গ্রামে। পাশে বৌদ্ধ পাড়া থাকায় এদিকে তেমন কিছুই হয়নি। বৌদ্ধরা অনেক উঁচুতে একটা চীনের পতাকা লাগিয়ে রেখেছিল। যুদ্ধে চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র যোগান দিয়েছিল বলে বৌদ্ধ পাড়া হানাদারের আক্রমন থেকে রেহাই পেল। তবুও বড় রাস্তা দিয়ে যখন মিলেটারির গাড়ি যেত তখন সবাই বৌদ্ধ পাড়ায় গিয়ে আশ্রয় নিত। বিপদের সময় সবাই ভুলে যেত কে কোন জাতি। একসাথে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ একথালায় মুড়ি বিস্কিট খেত। চায়ের পেয়ালাও বার বার ধুয়ে নিয়ে জনে জনে চুমুক দিয়ে যেত। বৌদ্ধরাই সব আয়োজন করতো। অবশ্য যুদ্ধশেষে এসব কেউ খুব একটা মনে রাখেনি। এখন ওরা সংখ্যালঘু। যদিও বৌদ্ধ পাড়ার অনেক উন্নতি হয়েছে। সহপাঠী স্নেহাশীষ এর সাথে জাবেদ অনেকবার ঐ পাড়ায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়েছে। বৌদ্ধ মন্দিরও দেখেছে। ওদের প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেছে। কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়েনি। মনে হয়েছে সবইতো মানুষের মঙ্গলের জন্যই।

জাবেদের নানার বাড়িতে যুদ্ধে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। ওদের অধিকাংশই শরাণার্থী হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। শুধু বড়মামা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন মামা। মিছিল, মিটিং, আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। দেশের মাটিকে শত্রুমুক্ত করতে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। উনি বলতেন- সে সময় কোত্থেকে এত সাহস এসেছিল জানি না। শুধু মনে হতো পাকিস্তানী পতাকা নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের একটা পতাকা উড়বে এদেশের বুকে। সবুজ ঘাসের বুকে লাল সূর্য আর একটা বাংলাদেশের মানচিত্র। অনেক আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল কেমন হবে স্বাধীন দেশ। বাহান্নের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ও স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন তখন বাস্তবে রূপ লাভ করতে যাচ্ছে। বড়মামা যখন বলেন তখন মস্তিষ্কের কোষগুলোতে কী যেন এক আন্দোলন ঘটে জাবেদের। মনে হয় বড়মামা নয় জাবেদই বুঝি মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এক একটা অপারেশন যেন এক একটা লোমহর্ষক গল্প। একবারতো নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন মামা। মুখোমুখি যুদ্ধে প্রবল আক্রমণ ঠেকাতে কমাণ্ডারের নির্দেশে পেছনে আসতে গিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন খড়ের গাদায়। পাশ দিয়ে চলে গেল শত্রুদল। একটুও বুঝতে পারলে মর্মান্তিক মৃত্যু অবধারিত ছিল। রাখে আল­াহ্ মারে কে। ওই দিনই ওদের দলের পাঁচজনকে ধরে ফেলল বিপক্ষদল। পরে ওদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। হয়তো কোন গণকবরে চিরতরে ঘুমিয়ে আছে সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা। রণাঙ্গনে অকুতোভয় মুক্তিসেনার এমন অনেক আত্মাহুতির ফল আমাদের এই স্বাধীনতা। মামা অবশ্য আশাবাদী একদিন বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নত দেশের একটি হবে। থাকবে না মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য হাহাকার। তিনি বলেন- এ জাতি কখনো নত হয় না। শহীদের রক্ত বৃথা যায় না। আমাদের শ্রম, আমাদের শক্তি, জয় করে নিতে পারে সব অধিকার। স্বাধীনতা আমার অহঙ্কার। স্বাধীনতা আমার অলঙ্কার। আহা! কী দেশপ্রেম। শুনতে শুনতে জাবেদের চোখে জল এসে যায়।

যুদ্ধে বেশ লাভ হয়েছিল জাবেদের ফুফা কলিম উদ্দীনের। একেবারে আঙুল ফুলে কলাগাছ। দাদু একদম সহ্য করতে পারে না এই কলিম উদ্দীনকে। তিনিও খুব একটা এদিকে আসেন না। তবে তার ঢাকা শহরে বাড়ী গাড়ি সবই আছে। অনেক ব্যবসা। কয়েকটা গার্মেন্টস এর মালিক। বিহারীদের গুদামে চাকরি করতেন। ওদের ছিল এক্সপোর্ট ইমপোর্ট এর ব্যবসা। যুদ্ধের সময় ওরা বিহারে চলে যায়। কাগজপত্র রেখে যায় ফুফার কাছে। বিশ্বস্ত কর্মচারী বিশ্বাস ভঙ্গ করবে এমনটা ভাবেনি। যুদ্ধের পরে একবার এসেছিল কাগজ পত্র বুঝে নিতে। ততদিনে চালাক ফুফা সব নিজের নামে করে নিয়েছে। তারপর সব রমরমা অবস্থা। ওদের বাড়িটাও বিনাপুঁজিতে হাতিয়ে নিল। চুনকাম করিয়ে একেবারে প্লাস্টিক পেইন্ট দিয়ে সাজিয়ে নিল নিজের পছন্দ মতো। যুুদ্ধে প্রথম দিকে বিহারীরা যাওয়ার পর ফুফা গ্রামে গিয়ে দেখল গ্রামে মিলেটারি ক্যাম্প বসেছে। জুম্মাবারে নামাজ শেষ করে মাওলানা সাহেবের সাথে আলাপ করে তাঁর সাথে চলে গেল ক্যাম্পে। উর্দু ভাষায় পারদর্শী মাওলানা সাহেব মিলেটারিদের সাথে অনেক বিষয়ে আলাপ করলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন ফুফার সাথে। ফুফাও তাদেরকে শহরের অবস্থা সম্পর্কে বললেন। যে কোন পরিস্থিতিতে তাদেরকে সহযোগিতা করার কথা দিলেন। কিছুদিনের মধ্যে গ্রামের অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে যোগ দিলেন পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে। রাষ্ট্রদ্রোহী মুক্তিবাহিনী ডাকাতগুলোকে জব্দ করতে মধ্যস্থতার দায়িত্ব নিলেন। বিনিময়ে পেলেন নিরাপত্তা। সহযোগিতা করলেন ডাকাতদেরকে রাষ্ট্রের রক্ষকদের হাতে তুলে দিতে। পাকিস্তানী সৈন্য সারাবিশ্বে অগ্রগণ্য। তাদের সাথে লড়তে চায় মূর্খরা। স্পর্ধা দেখ। দেশদ্রোহী ধর্মদ্রোহী নেংটি ইঁদুরগুলোর বড় বাড় বেড়েছিল। তাই দুএকটাকে ঘাড় ধরে দিয়ে এল ক্যাম্পে। আর মিলেটারিরা বন্ধুকের নিশানা ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করল তাদেরকে ফায়ার করতে করতে। যারা দেশের খেয়ে দেশের পড়ে দেশের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায় তাদের এমনই শাস্তি হওয়া উচিৎ। জীবন থাকতে দেশের কোন ক্ষতি হতে দিবেন না তিনি। সরকার মা বাপ। সরকারের মানুষ এই মিলেটারিদের একটু সেবা করা মানে পক্ষান্তরে সরকারেরই সেবা করা। দেশের সেবা করা। তাই দরিদ্র রহিম মিয়ার ছাগলটা জবাই করে খুব ভালোভাবে রান্না করে নিমন্ত্রণ করেছিল মিলেটারিদের। গ্রামের হিন্দুরা সব অনেক আগে পালিয়েছিল। তাদের অলঙ্কারগুলো রেখে গিয়েছিল ফুফুর কাছে। ফুফা বলে দিয়েছেন এগুলো যেন কোনভাবেই ওদেরকে আর ফেরত দেওয়া না হয়। অবশ্য ওরাও ফেরত নিতে আসেনি। ওদের ঘরের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্রও ফুফার কাছেই রয়ে গেছে। ডাকাতদলের সদস্য রহমতকে ধরিয়ে দেয়ার পর মিলেটারিরা তাকে মেরে ফেলে। সেই থেকে ওর যুবতী বউটা একা অসহায় হয়ে পড়েছিল। পুরো জীবনটা এখনো পড়ে আছে তার সামনে। তাই তাকে মিলেটারিদের সেবায় নিয়োজিত করতে রাতের বেলা মুখ বেঁধে কোলে করে দিয়ে এসেছিল ক্যাম্পে। শুনেছিল সেই রাতেই কয়েকজন মিলেটারির উপর্যুপুরি অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মরে গিয়েছিল মেয়েটা। এমন মহান মানুষদের পরশে মৃত্যু হয়েছে বলে মেয়েটার জীবন ধন্য এমনটাই বলেছিলেন তিনি ফুফুকে। ফুফা বলেন- ভালোই ছিল স্বাধীনতার আগে, মূর্খরা সব লাফিয়েছিল নিতান্ত আবেগে। কী দেশপ্রেম! দেশের শান্তির জন্য শান্তি কমিটি, দেশ রক্ষার জন্য সংগ্রাম কমিটি কী করেননি তিনি দেশের জন্য। তবু ভারত আর রাশিয়ার হস্তক্ষেপে সবটাই পণ্ড হলো। অবশ্য ভালোই হয়েছে। বাংলাদেশ না হলে হয়তো উনাকে ঐ বিহারীদের গুদাম পাহারাই দিতে হতো। গাড়ি বাড়ী কিছুই হতো না। তাছাড়া তেমন কোন দোষতো করেনি। যা করেছে সে ঐ দেশপ্রেম থেকেই। শুধু একবার হেমন্ত বাবুর অষ্টাদশ বর্ষীয়া মেয়েটাকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। তাই ওরা যখন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন মিলেটারি ক্যাম্পে খবর দিয়েছিল। মিলেটারিরা তাড়া করলে পালাতে গিয়ে মেয়েটা ধানের ক্ষেতে পড়ে গিয়েছিল। আর ফুফা তাকে আড়াল করে একটা পড়ো বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার সুষমা উপভোগ করেছিল। এটা তো অপরাধ না। সেও তো আনন্দ পেয়েছে। পরে তাকে অন্য দলের সাথে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। শুনেছে সে স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই আছে। আর ঐ পলাশ মাস্টার বেশি বাড়াবাড়ি করতো। একেতো বিধর্মী মালাওন, তার উপর মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে লুকিয়ে রসদ জোগাতো। ফুফাকে ভয় দেখাতো ওদেরকে সব বলে দেবে বলে। তাই ওর মুখ বন্ধ রাখতে ওকে খুন করেছিল ফুফা। তবে তার কোন সাক্ষী রাখে নাই। তাছাড়া নিজের ও দেশের নিরাপত্তার জন্য এটা তাঁকে করতে হয়েছিল। তার উপর সে ইসলাম ধর্ম নিয়েও অনেক খারাপ কথা বলেছিল। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে ইসলাম রক্ষার একটা দায়িত্ববোধ থেকে এটা ফুফা করেছে। এটা জেহাদের পর্যায়ে পড়ে। অতএব এতে দোষের কিছু নাই। তাছাড়া ফুফা এখন অনেক দান খয়রাত করে। প্রতি ঈদে তাঁর বাড়ির সামনে জাকাতের কাপড়ের জন্য লাইন ধরে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে। কত গরীব দুঃখী কাপড় নিয়ে আল্লহর কাছে তাঁর জন্য দোয়া করে তার ইয়ত্তা নাই। তাঁর বাড়ীতে মিলাদ মাহ্ফিল হয়, কোরআন খতম দেয়া হয়, হজ্বও করেছেন কয়েকবার। সৌদি আরব থেকে হুজুররা আসলে তাঁর বাড়িতে তসরিফ রাখেন। সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তিরা তাঁর সাথে কোলাকুলি করতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন। এলাকার মসজিদে সবচেয়ে বেশি অনুদান তাঁর পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়। এলাকার ক্লাবে, সভা-সমাবেশে অতিথির আসন অলংকৃত করতে হয় তাঁকে। ফুফু বলেছেন এসবই অবশ্য যুদ্ধে পাওয়া আশি ভরি স্বর্ণালঙ্কারের বিক্রীত টাকার সুদে হয়ে যায়। আসলে এখনও হাত দিতে হয়নি।

জাবেদের ঘুম ভাঙল তার বোনের মেয়ে মুক্তির ডাকে। গতকাল সে এখানে বেড়াতে এসেছে। শুক্রবার ঘুম থেকে উঠতে মামা এত দেরি করছে দেখে সে ডাকতে শুরু করেছে। মামা তোমার কি শরীর খারাপ। এতক্ষণ শুয়ে আছো যে। ঘড়িতে প্রায় দশটা বাজতে চললো। মুক্তি একটানা বলে গেলো সব কথা। জাবেদের তখনও ঘোর কাটেনি। কী সব উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখে আজকাল। রাজ্যের সব চিন্তা মাথায় একটা জট পাকিয়ে ফেলেছে। মুক্তির প্রশ্নগুলো উত্তর দিল সে। বললো- না শরীর খারাপ নয়। একটা উদ্ভট চিন্তা একটা গল্প হয়ে স্বপ্নে ধরা দিয়েছিল। তাই দশটা বেজে গেছে বুঝতে পারি নি। মুক্তি জানতে চাইলো- কি গল্প। সবটা তাকে বলল জাবেদ। শুনে সে প্রশ্ন করলো- আচ্ছা মামা কখনো পরীক্ষা করে দেখেছো তোমার মধ্যে দেশপ্রেম আছে কি না। আর আমার মধ্যেও সেটা কতটা আছে তা কী করে বুঝতে পারবো মামা। তুমি যাঁদের কথা বললে তাঁদের সবারইতো দেশপ্রেম আছে। তবে একেক জনের একেক রকমের। এখন যারা হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর করে, যারা জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন করে, যারা এত কিছুর পরও ক্ষমতা আগলে ধরে রাখে, যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে, মানুষের বাড়িতে আগুন দেয়, যারা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদের মদদ দেয় তারাওতো দেশপ্রেম থেকেই তা করে। অথচ এক দেশপ্রেমীর কাছে অন্যজন দেশদ্রোহী হয়ে যায়। ইতিহাস কখনো নবাব সিরাজ-উ-দৌল্লাকে বিলাসী বানায়, কখনো বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের সম্মান দেয়। স্বাধীনতার জন্মকথায়ও এরকম অনেক এলোমেলো বিষয়, অনেক বিকৃতি স্থান পাচ্ছে। তাহলে কিসের মাপকাঠিতে দেশপ্রেম মাপবে মামা। মুক্তির কথা শুনে জাবেদ হতবাক। ওর এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর তার জানা নেই। কেউ জানে কিনা তাও জানেনা। শুধু একটা অনন্ত ভাবনার বেড়াজালে আবার জড়িয়ে যায় সে।
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×