somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রথম নানার বাড়ি ভ্রমণ

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

উনিশ শ’ আটষট্টি সাল। তখন এদেশটার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বড় মামা আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। প্রায় একমাস থাকার পর মামা মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব তাড়া দিতেছিলেন। কিন্তু অগ্রাহায়ণ মাস, ধান কাটা এবং মাড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত মা ইচ্ছে করলেও যেতে পারছেন না। মামাও নাছোর বান্দা, তার বড় বোনকে (আমার মাকে) সাথে না নিয়ে যাবেন না। যে কারণে মামা ধান কাটা-মাড়াই শেষ হওয়া পর্যন্ত একমাস থেকে মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হলেন। তখন দুরের পথে যাতায়াতের একমাত্র বাহন হলো রেল গাড়ি আর কাছের বাহন হলো গরুর গাড়ি। রেল স্টেশন আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় চার মাইল। এতোপথ মা’র পক্ষে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই পাশের গ্রামে গিয়ে বাবা গরুর গাড়ি ভাড়া করে এলেন।

গরুর গাড়িওয়ালা সন্ধার সময় গড়ি নিয়ে এসে হাজির। রাতে গাড়িওয়ালা আমাদের বড়িতে ভাত খেয়ে শুয়ে থাকল। নানার বাড়ি যাওয়ার আনন্দে আমার আর রাতে ঘুম হলো না। মাও ঘুমালেন না। অধিক রাত পর্যন্ত নান-নানির জন্য পিঠা-চিড়া তৈরী করে সময় কাটালেন। মধ্য রাতে জামা কাপড়ের ব্যাগ আর পিঠা-চিড়ার পোটলা-পুটলিসহ গরুর গাড়িতে চড়ে রেল স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। আমি এবং মা গরুর গাড়িতে, বাবা, মামা এবং আমাদের বড়ির দুই চাকর গফুর ভাই ও এন্তাজ ভাই গরুর গাড়ির পিছনে পিছনে হেঁটে আসছেন। আমরা যখন স্টেশনে গিয়ে পৌঁছি তখনও অনেক রাত। স্টেশনে পৌঁছার আরও একঘন্টা পর ঢংঢং করে লোহার ডান্ডা পিটিয়ে গাড়ি আসার খবর জানানো হলো। বাবা টিকিট কেটে মামার হাতে দিলেন।

রাত ঠিক চারটার সময় রেল লাইন বরাবর দক্ষিণ দিকে দূরে ছোট একটি আলো চোখে পড়ল। আলোটি ক্রমেই বড় হচ্ছে। বড় হতে হতে একসময় পুরো স্টেশন আলোকিত করে ঝকাঝক্ ঝকাঝক্ বিকট শব্দ করতে করতে এক চোখা দৈত্যের মত কয়লার ইঞ্জিনওয়ালা রেল গাড়ি এসে স্টেশনে থেমে গেল। বাবা তাড়াতাড়ি আমাদেরকে একটা কামরায় উঠিয়ে জানালার পাশের সিটে বসিয়ে দিলেন। গড়িতে তেমন একটা ভির নেই। অনেক সিট ফাঁকা পড়ে আছে। ছোট একটি কামরায় পাঁচটি ইলেক্ট্রিক বাতি জ্বলছে। কামরার মেঝেতে সুই পরলেও স্পষ্ট দেখা যায়। একটু পরেই গাড়ি হুঁ --- উঁ --- হুইসেল দিলে বাবা তাড়াতাড়ি কমরা থেকে নেমে গেলেন। গাড়ি একটা ধাক্কা দিয়েই আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে চলতে লাগল।

হেমন্ত কাল, শীত শীত ভাব থাকায় গাড়ির সব জানালা আটকানো। গড়ি চলছে, বাইরে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ পর পর হুইসেল দিয়ে স্টেশনে গাড়ি থামছে। থামার সময় হালকা একটা ঝাকি দিচ্ছে, একটু পরেই হুইসেল দিয়ে আবার একটা ধাক্কা দিয়ে আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে চলছে। প্রত্যেক স্টেশনেই গাড়ি থামছে, আর থামলেই মাঝে মাঝে গরম ডিমওয়ালা, চানাচুর ওয়ালা, পান-বিড়ি-সিগারেটওয়ালা কামরায় উঠে তার পশার অনুযায়ী চেচামেচি করে কেউ কিছু বিক্রি করছে আবার কেউ কেউ বিক্রি না করেই নেমে যাচ্ছে। যাত্রীরা হকারদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে কিছু কিনছে আবার কেউ কিছুই কিনছে না। প্রথমেই মামা আমাকে গরম ডিম কিনে ছাল ছাড়িয়ে দিলেন। আমি মজা করে খেলাম। পরের স্টেশনে চানাচুরওয়ালা কামরায় উঠে এলে মামা চানাচুর চাইতেই এক খামছা চানাচুর কৌটার মধ্যে তুলে পিয়াজ, মরিচ, তেল, মশলা দিয়ে কৌটাটা ডান হাতে ধরে বাম হাতের তালুতে ঠকাঠক্ ঠকাঠক্ ঘন তালে কয়েক বার আছাড় দিয়ে ঝালিয়ে দিল। দাম খুব বেশি নয়, এক আনা। খেয়ে দেখি খুব মজা। খুশি হয়ে খেলাম। ইতিমধ্যেই বাইরে ফর্সা হয়েছে। মামা জানালা খুলে দিলে বাইরে তাকিয়ে দেখি পূর্বদিকে সূর্য লাল হয়ে উঠছে। কিন্তু গাছ-গাছালি ঘর-বাড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম। সব পিছন দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। আমি মামাকে বললাম, মামা, গাছগুলো পিছনে দৌড়ায় কেন?
মামা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, না মামা, গাছ দৌড়ায় না, আমাদের গাড়ি দৌড়ায়। কিন্তু মামার কথা বিশ্বাস হলো না। কারণ যতবারই আমি বাইরে তাকাই ততবারই দেখি বাইরের সবকিছু পিছনে দৌড়ায়।

এক পর্যায়ে বেলা উপরে উঠে গেলে রোদে বাইরের সব কিছু ঝলমল করে উঠল। এখন বাইরের সব কিছু পরিস্কার দেখা যায়। বাইরে তাকিয়ে দেখতে দেখতেই বড় একটি স্টেশনে এসে গাড়ি থেমে গেল। আমি মামাকে প্রায় প্রত্যেক স্টেশনের নাম জিজ্ঞেস করতাম। মামা কোনটার নাম বলতেন আবার কোনটার নাম বলতে পারতেন না। এই স্টেশনের নাম জিজ্ঞেস করতেই মামা বললেন, এটা কাউনিয়া জংশন। আমি মামাকে বললাম, মামা জংশন কি?

মামা বললেন, তিন দিক থেকে রেল লাইন এসে যে স্টেশনে লাগে সেটাকে জংশন বলে। আমি মামাকে আর কোন প্রশ্ন না করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। এই স্টেশনে অনেক রেল লাইন। এতো রেল লাইন অন্য কোন স্টেশনে দেখিনি। প্লাট ফরম দু’টি। আমাদের গাড়িটি পূর্ব পার্শ্বের প্লাট ফর্মে এসে থেমেছে। স্টেশন মাস্টারের অফিসসহ হোটেল-রেস্টুরেন্ট সব এই প্লাট ফরমে। তাকিয়ে দেখি একটি হোটেলের উপরে সাইনবোর্ডে লেখা আছে মুসলিম হোটেল, তার পাশেই অন্যটিতে লেখা আছে হিন্দু হোটেল। বুঝতে বাকি রইল না যে, হিন্দু মুসলমানের জন্য আলাদা আলাদা হোটেল। একটু পরেই দুইজন কালো কোট গায়ে টিকিট চেকার কামরায় উঠে এলো। তারা উর্দুতে কথা বলতেছিল। তারই একজন মামাকে জিজ্ঞেস করলো, টিকিট বি আছে? মামা পকেট থেকে তিনটি টিকিট বের করে দেখালেন। দু’টি বড়দের টিকিট একটি আমার জন্য হাফ টিকিট। টিকিট চেকার প্রত্যেকটি টিকিটের গায়ে পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়ে দিলেন। বিনা টিকিটে কোন যাত্রী ছিল না। সবার টিকেট চেক করার পর দুইজনই নেমে গেলেন।

এই প্লাট ফরমে মানুষের সমাগমও অনেক বেশি হকারদের সমাগমও বেশি। হকারদের কণ্ঠে বিচিত্র সুর। খুব ভালো লাগছিল। এই চা গর- - -ম, এই চানাচুর- - - , এই ঝালমুড়ি- - -, এই পান-বিড়ি-সিগারে- - -ট ইত্যাদি বিচিত্র সুর শুনতে শুনতেই হঠাৎ আমাদের কামরার কাছে এসে এক জন হকার চেচিয়ে উঠল, লাগবে আরবের খুরমা খেজুর। আরবের খুরমা খেজুরের নাম শুনেই মামার দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। মামা অন্য দিকে তাকানো ছিল। আস্তে আস্তে বললাম, মামা আরবের খুরমা খেজুর! আমার কথা শুনে মামা আমার দিকে তাকালেন। আমার বলার ভাব ভঙ্গি আর আগ্রহ দেখে মামা খেজুরওয়ালাকে জানালা দিয়ে ডাক দিলেন, এই খেজুরওয়ালা এই দিকে আয়। খেজুরওয়ালা কাছে এলে মামা বললেন, খেজুরের দাম কত রে?
খেজুরওয়ালা বলল, দুই আনা ছটাক।
দুই আনা ছটাক দাম শুনেই মামা বললেন, আধা পোয়া দে অর্থাৎ দুই ছটাক।
খেজুরওয়ালা ছোট একটি দাড়ি পাল্লা দিয়ে আধা পোয়া খেজুর মেপে দিলে আমি খেজুর হাতে নিয়ে খুব মজা করে খেতে লাগলাম। মাকে বললাম, মা খাও, খুব মজা। মা মাথা নেড়ে জানালেন খাবে না। মাথা উপর নিচে ঝাকিয়ে মামাকে বললাম, মামা খাবেন? মামা দু’তিনটি খেজুর হাতে নিয়ে আর নিলেন না।

খেজুর খেতে খেতেই গাড়ি ছেড়ে দিল। হকারদের বিচিত্র সুরের ডাকাডাকি বন্ধ হলো। গড়ি আস্তে আস্তে গতি বাড়িয়ে চলছে। কিছুদুর যাওয়ার পরেই হঠাৎ কানে ঝমঝম শব্দ এলো। এরকম শব্দ আগে কখনও শুনি নাই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি লোহার বড় বড় পিলার একটার পর একটা পিছনে সরে যাচ্ছে। অনেক বড় ব্রিজ। নিচে বিশাল নদী। নদীতে কিছু নৌকা পাল তুলে, আবার কিছু নৌকা দাড় টেনে কেউ উজান দিকে কেউ ভাটির দিকে যাচ্ছে। মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা এটা কোন নদী? মামা বললেন, এটা তিস্তা নদী। জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে পিলে চমকে গেল। ট্রেন থেকে অনেক নিচে পানি। কোন কারণে ট্রেন থেকে নিচে পরে গেলে আর রক্ষা থাকবে না। খুব ভয় ভয় করতে লাগল, নিচে না তাকিয়ে দুরে নদীর দৃশ্য দেখতে দেখতেই গাড়ি তিস্তা ব্রিজ পার হয়ে এলো। এর পর তিস্তা স্টেশনে গাড়ি থেমে একটু পরেই ছেড়ে দিল। এরপর লালমনির হাট স্টেশনে এসে গাড়ি থামল। এটিও অনেক বড় স্টেশন। লালমনির হাটে অনেকক্ষণ গাড়ি দাঁড়িয়ে রইল। মামা আমাকে সাথে নিয়ে নিচে নামল। গাড়ির উপর দিকে তাকিয়ে দেখি একটি লোক লম্বা একটি কালো পাইপ নিয়ে গাড়ির উপর দিয়ে হাঁটছে। আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা লোকটি পাইপ দিয়ে কি করে?
মামা বলল, গাড়িতে পানি দেয়।

উপরে অনেক গুলো লোহার পাইপ একটু পরপরই লাগানো আছে। লোকটি লোহার পাইপগুলোর একটির মুখে রাবারের আঁকাবাঁকা নল লাগিয়ে গোল একটি চাবি ঘুরিয়ে দিল। চাবি ঘুরানোর সাথে সাথেই পানি চির চিরিয়ে পাইপের লিক হওয়া ছিদ্র দিয়ে চিকন ধারায় বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে চাবি বন্ধ করে দিলে পানি পড়া বন্ধ হলো। লোকটি পাইপ খুলে নিয়ে গাড়ির ছাদের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে এক বগি থেকে আরেক বগিতে চলে গেল। সেখানেও লোহার পাইপের সাথে নল লাগিয়ে সেই বগির টাঙ্কিতেও পানি দিল। এভাবে পুরো গাড়ির প্রত্যেকটি বগিতে পানি দিয়ে লোকটি পাইপসহ নিচে নেমে এলো। এর কিছুক্ষণ পরেই স্টেশনে ঝুলিয়ে রাখা লোহার ডান্ডায় ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজালে মামা তাড়াতাড়ি আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গার্ড বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সবুজ পতাকা হাতে নিয়ে ডাইনে বামে নাড়াতে থাকলে গাড়ি হুইসেল দিয়ে ছেড়ে দিল।

লালমনির হাট স্টেশন থেকে গাড়ি ছেড়ে তুষ ভান্ডার, কাকিনা, হাতি বান্ধা, বড়খাতা, পার হয়ে আমরা যখন আমাদের গন্তব্য বাবুরা স্টেশন এসে পৌঁছি তখন প্রায় দুপুর হয়েছে।

গাড়ি থেকে নেমে বাবুরা স্টেশনের পশ্চিম দিকে বাজারের ভিতর দিয়ে হাঁটছি। মামার দুই হাতে ব্যাগ। মামা আগে আগে হাঁটছে আমরা মামার পিছনে পিছনে হাঁটছি। বাজারের একটি মিস্টির দোকানে নিয়ে মামা আমাকে কিছু মিস্টি খাওয়ালো। মামাও কিছু খেলেন কিন্তু অনঅভ্যাসের কারণে মা হোটেলে বসে কিছুই খেলেন না। কারণ বাড়িতেও মা অপরিচিত লোকের সামনে কখনও ঘোমটা খোলেন না সেই কারণে হোটেলে অপরিচিত মানুষ জন থাকায় লম্বা ঘোমটা টেনে বসে রইলেন। মামা মা’র অবস্থা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি হোটেল থেকে আমাদের সাথে নিয়ে বের হয়ে এলেন।

বাজার থেকে অল্প কিছু পশ্চিমে গিয়েই একটা ছোট নদী চোখে পড়ল। এটার নাম বুড়ি তিস্তা। বুড়ি তিস্তা পার হতে কোন নৌকা লাগল না। অল্প পানি হেঁটেই পার হলাম। নদীর ওপারে ধুধু বালুচর। বালুচরের মাঝ দিয়ে মানুষ চলাচলের মেঠো পথ। সেই পথ দিয়ে বালুচর হাঁটতে লাগলাম। কিছুদুর গিয়ে আমি হাঁপিয়ে গেলাম। মা আমাকে কোলে তুলে নিল। কিন্তু কোলে নিয়ে বেশিদুর হাঁটতে পারলেন না। হাঁপিয়ে গেলেন। অবশেষে মা আমাকে নিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়লেন, আমাদের অবস্থা দেখে মামাও ব্যাগ নামিয়ে আমাদের সাথে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার আমরা হাঁটা শুরু করি। কিছুদুর যাওয়ার পর আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব হলো না। মামা তার হাতের ব্যাগ দু’টা এক ঘাড়ে নিয়ে অন্য ঘাড়ে আমাকে তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন। কিছুদুর যাওয়ার পর মামা হাঁটলেও মাকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। মা ঘাসের উপর বসে পরে মামাকে বকাবকি করতে লাগলেন। মা মামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এতো রাস্তা হাঁটতে হয় তুই আগে কইলি না ক্যা, তাইলে তো আমি আইসি না।

মামা মার কথায় ভ্যাবা চ্যাকা খেয়ে বললেন, আরে বুবু বেশি রাস্তা নাই তো, আর একটু সামনে গেলেই বাড়ি পাওয়া যাইবো।

আর একটু করতে করতে মামা আমাদের অনেক রাস্তা হাঁটিয়ে নিয়ে এলেন। মা বিরক্ত হয়ে মামাকে বললেন, আর একটু সামনে আর একটু সামনে করতে করতে তো বেলা আসর ওক্ত হইল, তারপরেও তর আর একটু রাস্তা শেষ হয় না। তোরা কোন জায়গায় বাড়ি করছারে। হাঁটতে হাঁটতে তো আমার জান থাকে না।

মামা মা’র কথায় অনুনয় বিনয় করে বলতে লাগলেন, বুবু আর সামান্য পথ। এই টুকু হাঁটলেই তিস্তা নদী। ওই যে দেখা যায় নদী। পশ্চিম দিকে চায়া দেখ। ্ওই যে নদী। ওই নদী পার হইলেই আমাগো বাড়ি।
মামার এ কথা বলার পরও আরো প্রায় এক মাইলের মত পথ হাঁটতে হলো। এই এক মাইল হাঁটতে গিয়ে মা মামাকে বকাবকি করতে করতে তার হাঁটার ঝাল মিটিয়ে নিলেন। আমার মা তার ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়, যে কারণে এতো বকাবকির পরও মামা মা’র কোন কথার উত্তর দিলেন না এবং বিরক্তও হলেন না।

এই অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে তিস্তা নদীর পাড়ে যখন এসে পৌছলাম তখন পশ্চিম দিকে বেলা ঢলে পড়েছে। খেয়া নৌকা ওপারে ছিল। আমাদের দেখে দু’জন যাত্রী নিয়ে তাড়াতাড়ি এপার চলে এলো। খেয়া নৌকায় যখন নদী পার হয়ে এলাম তখন সুর্য ডুবে ডুবে অবস্থা। আরো প্রায় দুই মাইলের মত রাস্তা হেঁটে নানার বাড়ি যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা পার হয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। মামা আমাদের বাইরে রেখেই আগে আগে বাড়ি ঢুকে হাঁক ছাড়লেন, সব বাইরে বাড়াও রে-- দেখো কেডা আইছে। মামার ডাক শুনে নানী দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরলেন। মা নানীর গলা ধরে কেঁদে দিলেন। নানীও কান্না শুরু করে দিলেন। কান্না অবস্থায় নানী মাকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। এরমধ্যে নানা বাইরে কোথায় ছিল খবর পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে মা’র কান্নার আগেই নানা কেঁদে দিলেন। কান্না করতে করতে মাকে বলতে লাগলেন, মা তুই আইছস। আমি প্রতি দিনই তর লাইগা পথের দিকে চায়া থাকি। বহুদিন পরে কাছে পাওয়ায় মেয়ের প্রতি বাবার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার সে কি দৃশ্য, সে কথা বলে বুঝানো যাবে না!

এবার নানা মাকে ছেড়ে দিয়ে নানীকে লক্ষ্য করে বললেন, আমার নাতিডা কই গো?
নানি আমাকে ধরে নিয়ে নানার কাছে দিলে নানা আমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে নানিকে ধমক দিয়ে বললেন, এই ব্যাক্কল, কলাগাছের মত খারায়া রইছো ক্যা? হাঁটতে হাঁটতে নাতির পাও দুইডা ফুইলা গ্যাছে। দুইডা বড় বড় চোখ থাকতেও কেউ দেহ নাই, তাড়াতাড়ি পানি গরম করো। গরম পানি দিয়া ওগো দুই মাও বেটার পাও ধুইয়া দাও। বলেই নানা আমাকে নিয়ে উঠানে পাতা জলচৌকিতে বসে পড়লেন। একটু পরে নানী গরম পানি নিয়ে এসে নিজের হাতে আমার দুই ঠ্যাংগ পানি ঢেলে ঢেলে ধুয়ে দিলেন। নানা-নানীর এই আদর আমি জীবনেও ভুলতে পারবো না।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৬
৩৭টি মন্তব্য ৩৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×