somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রাইমারী স্কুলের বিবাহযোগ্য সহপাঠীগণ এবং কিছু ঘটনা

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(গ্রাম্য পরিবেশে গুণভরি হাই স্কুলের বর্তমান অবস্থা।)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পূর্বের ঘটনা। বাবা আমাকে দেড় কিলোমিটার দূরে গুণভরি ফ্রী প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস টুতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রথম দিন ক্লাসে অল্প কিছুক্ষণ থেকেই বাবার সাথে চলে এলাম। পরদিন থেকে ক্লাস করতে লাগলাম। প্রথম দিন বয়স্ক ক্লাসমেটদের দেখা না পেলেও পরের দিন কয়েক জনের চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। সতেরো আঠারো জন ছাত্রের মধ্যে সাত আট জনই বয়স্ক। বিশাল দেহের সাত আটজন ক্লাস টু'র ছাত্র। বাকীগুলোও একেবারে ছোট নয়। বয়সে আর লম্বায় বেশ বড়ই বলা চলে। মোট কথা-- ক্লাস টুতে যত ছাত্রছাত্রী ছিল তাদের মধ্যে আট নয় জন ছাড়া বাকী সবাই বিবাহের উপযুক্ত। অসম বয়সের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে আমিই সব চেয়ে ছোট।

আমার কাছাকাছি বয়সী যারা ছিল তারা হলো-- ছালাম, সবুর, খলিল, রশীদুন্নবী, জহির, নুরুজ্জামান ও হাবীবা। আর বাকীদের বয়সের কথা মনে হলে এখনও আমার হাসি পায়। অনেকেই মনে করতে পারেন কাহিনীকে রম্য করার জন্যই হয়তো এসব লিখছি। না ভাই, আমি কাহিনীকে রম্য করার জন্য এসব লিখছি না, দেশ স্বাধীনের পূর্বে বাংলাদেশের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের অজো পাড়া গাঁয়ের স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের বয়সের যে বাস্তব চিত্র দেখেছি সেই সত্য কাহিনীটাই তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

ক্লাস ওয়ান আমি আমার গ্রামের স্কুলেই পড়েছি। আমার গ্রামের স্কুলের সহপাঠিদের অনেকেই আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিল কিন্তু এত বড় ছিল না। ক্লাস টু’র ছাত্রদের অত বড় চেহারা দেখে প্রথমেই আমার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন-- ক্লাস টু’র ছাত্র বড় হলে আর কত বড় হবে? কিন্তু বাস্তবে তারা এত বড় ছিল যে বর্তমানে ঐ বয়সের ছেলেদের হাইস্কুলের ক্লাস টেনেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেইসব বয়স্ক ছাত্রদের কিছু বর্ণনা নিচে তুলে ধরলাম--

বয়স্ক আটজনের মধ্যে একজন হলো শ্রী তৈলক্ষ্য দাদা। তাকে আমি দাদা বলেই ডাকতাম। তার দৈহিক বর্ণনা কি আর বলব-- সে এত বড় দেহের অধিকারী ছিলেন যে বর্তমানে এরকম দেহের অধিকারী কাউকে কলেজে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। লম্বায় কমপক্ষে ছয় ফুট, বুকের মাপ চল্লিশ ইঞ্চির কম নয়। হাতের কব্জি দু’টি যেমন মোটা পায়ের পাতাগুলিও তেমনি চ্যাপ্টা। এই বিশাল দেহের ছাত্র ধুতি-সার্ট পড়ে ক্লাসে আসতেন। গায় গতরে ভারী হওয়ায় হাঁটার সময় থপর থপর শব্দ হতো। ক্লাসের অনেকেই তাকে গজ হস্তী বললেও বিশাল দেহের কারণে ভয়ে কেউ সামনা সামনি এই নামে ডাকতো না। তবে এই ছাত্র বিশাল দেহের অধিকারী হলেও খুব ঠান্ডা মেজাজের ছিলেন। কখনই কারো সাথে ঝগড়া বা রাগ করতেন না। শিক্ষকদের খুবই মার্যাদা করতেন। পড়া না পারায় শিক্ষকের বেতের বাড়ি খেলেও কখনই মাথা তুলে স্যারদের দিকে তাকাতেন না। শিক্ষকের সামনে সবসময় মাথা নিচু করে থাকতেন। বিধাতা যদি দেহ অনুযায়ী এই ছাত্রের মেজাজ দিত তাহলে আমাদের মত পুচকে ছাত্ররা তো দূরের কথা শিক্ষদেরও শিক্ষকতা করতে হিমসিম খেতে হতো। এই বিশাল বপুর ক্লাসমেটের সাথে খুব বেশি দিন ক্লাস করার সৌভাগ্য হয় নাই। ক্লাস থ্রীতে উঠার পরই তৈলক্ষ্য দা স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলেন। পরে জেনেছি ঐবছরেই তিনি বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন।

কয়েক বছর আগে গ্রামের বাজারে হঠাৎ করেই দেখা। আমি তো মনে করেছিলাম এতদিনে বুড়ো হয়ে শরীরের চামড়া ঝুলে গেছে। কিন্তু তার ভোটভোটা মোটা চেহারায় এতটুকুও চামড়া ঝোলে নাই। ক্লাস টুতে যেমন দেখেছি সেদিনও মনে হলো ঐরকমই আছে। তবে তার চাল চলনে আগের চেয়ে অনেক ভারত্ব এসেছে। স্কুল জীবনে যেমন ধুতি পরতো সেদিনও তেমনি তাকে ধুতি পরা অবস্থায় পেয়েছিলাম। লুঙ্গী, পায়জামা জীবনে কখনও পরেছেন কিনা সেটা আমি যেমন চোখে দেখিনি তেমনি আমার বন্ধুবান্ধবরাও নাকি দেখেনি। তার কাহিনী যখন লিখছি তখন তিনি এই ধরাধামে আর নেই কিছুদিন আগে স্বর্গবাসী হয়েছেন।

এর পরের বয়স্ক ছাত্রটির নাম আইজার ভাই। লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি, তবে তৈলক্ষ্য দাদার মত বুকের মাপ অত না হলেও ত্রিশ বত্রিশের কম নয়। ক্লাস টু'তে পড়লেও তিনি ১০০% বিবাহযোগ্য ছিলেন। বড় ভাই প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার ছিলেন। তারই উৎসাহের কারণে ক্লাসটুতে ভর্তি হয়েছিলেন। বিবাহযোগ্য হলেও পড়া শোনায় ভীষণ মনোযোগী ছিলেন। ক্লাস টুতে তিনি ফার্স্ট বয় ছিলেন। ক্লাস ফাইভে উঠার পরে তার পক্ষে আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয় নাই। বাবার মৃত্যুর পরপরই তাকে লেখাপড়া বন্ধ করে সংসারী হতে হয়েছিল।

এর পরের বয়স্ক ছাত্রের নাম জিন্নত আলী। জিন্নত আলী পড়ায় যেমন অমনোযোগী ছিলেন তেমনি স্কুলেও অনিয়মিত ছিলেন। ক্লাস ফোরে পড়া অবস্থায় শিক্ষকের সাথে অঘটন ঘটিয়ে আর স্কুলে আসেন নাই।

জিন্নত আলীর সেই দিনের ঘটনা আজো আমার মনে দাগ কেটে আছে। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। স্কুলের পুরো মাঠ বন্যার পানিতে তল (উপরের ছবিতে দেয়া সেই মাঠ)। কোথাও আধ হাঁটু কোথাও এক হাঁটু পরিমাণ পানি। স্কুল ঘরটি মাঠ থেকে উঁচু হওয়ায় মেঝে শুকনা ছিল। স্কুল মাঠের হাঁটু পানি পার হয়েই স্কুলে ঢুকতে হতো।

তৃতীয় পিরিয়ডে মোসলেম স্যার ক্লাস নিতে ছিলেন। জিন্নত আলী আমাদের পিছনের বেঞ্চেই বসা ছিল। পড়া না পাড়ায় মোসলেম স্যার বাঁশের এক ইঞ্চি চওড়া বেত দিয়ে শক্ত তিনটি পেটন দিতেই ভ্যা করে কেঁদে দিল। অত বড় ছাত্র পেটন খেয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়ায় হাসি আটকাতে পারলাম না। আমরা কয়েকজন হো হো করে হেসে উঠলাম। মোসলেম স্যার আমাদেরকে ‘চুপ’ বলে জোরে একটা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। আমাদের হো হো হাসির কারণে স্যার আর একটি বেতও মারলেন না। তিনিও হয়তো জিন্নতের কান্নায় অনুতপ্ত হয়েছিলেন। স্যার বেত টেবিলে রেখে ব্লাক বোর্ডে ইংরেজির শব্দার্থ লিখতে ছিলেন। এমতোবস্থায় হঠাৎ জিন্নত লাফ দিয়ে আমাদের বসে থাকা বেঞ্চের উপর দিয়ে পার হয়েই মোসলেম স্যারকে গালি দিতে দিতে খোলা দরজা দিয়ে ভো দৌড়।

শুধু দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলে মোসলেম স্যার হয়তো কিছু বলতেন না। স্যারের বাপ মা তুলে গালি দেওয়ায় স্যার ক্ষেপে গেলেন। শিক্ষক হিসাবে নিজে না দৌড়িয়ে আমাদেরকে “ধর ধর” করে ধরতে বললেন। আমরা তো এমনিতেই শিয়াল দাবড়িয়ে বেড়ানো ছাত্র। ধর ধর বললে পাতের ভাত ফেলে শিয়ালের পিছনে দৌড়াই, তারোপর স্যারের মুখ থেকে ধর ধর শুনলে কি আর বসে থাকা যায়? স্যার ধর বলার সাথে সাথেই সাত আটজন ক্লাস থেকে লাফিয়ে বের হলাম। মাঠের পানির ভিতর দিয়ে থাপুরথুপুর থাপুরথুপুর করে দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু জিন্নত লম্বা হওয়ায় টপাটপ পা ফেলে মাঠের পানি পার হয়ে রাস্তায় উঠে সোজা বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগল। আমরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে সাত আটজন পানির ভিতর দৌড়াতে গিয়ে পরস্পরের পানির ছিটায় কেউ আধা ভেজা হলাম, কেউ পিছলে পড়ে পানিতে গড়াগড়ি করে পুরোই ভিজে গেলাম। জিন্নতকে ধরার চেয়ে পানির ভিতর দৌড়ানোর আনন্দটাই আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল। আমরা যতনা দৌড়াই তার চেয়ে বেশি পানির ভিতর উপর হয়ে পড়ে হুড়োহুড়ি করি। কাদা পানিতে হুড়োহুড়ি গড়াগড়ি করে নাস্তানাবুদ হলেও জিন্নতকে ধরা সম্ভব হলো না। জিন্নত প্রাণপণে দৌড়িয়ে আমাদের থেকে কয়েক শ’ গজ দূরে চলে গেল।

এদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ করে সাত আট জন মাঠের পানির ভিতর দৌড়াদৌড়ি করার কারণে, পুরো স্কুল জুড়েই হৈচৈ পড়ে গেল। হাইস্কুল এবং প্রাইমারী স্কুল পাশাপাশি হওয়ায়, শিক্ষকসহ সব ছাত্রছাত্রী ক্লাস ছেড়ে বাইরে চলে এলো। পুরো স্কুল জুড়ে হৈ হৈ কান্ড শুরু হওয়ায় মোসলেম স্যার খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি ট্রান্সফার নিয়ে অন্য স্কুলে চলে গেলেন।

এই ঘটনায় জিন্নতের নামটি পুরো স্কুলেই ছড়িয়ে গেল। স্কুল জুড়ে হৈ হৈ করায় জিন্নতও ভয় পেয়ে ঐ যে স্কুল ছেড়ে দিল আর কখনই স্কুলে এলো না। এর কিছুদিন পরেই নাকি জিন্নত বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। আমি যখন তার কাহিনী লিখছি তখন সে আর এই জগতে নেই। কয়েক বছর আগে পরোপারে চলে গেছেন।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৭
৩২টি মন্তব্য ৩২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×