শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর। ভাইবোনদের মধ্যে আমি একটু বেশি বাবার নেওটা ছিলাম। বাবা যেখানেই যেত আমি তার পিছু ছাড়তাম না। বাধ্য হয়েই বাবা আমাকে অনেক অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। এই বিয়েতেও বাবার পিছু না ছাড়ায় সাথে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
কনে দেখার দিন তারিখ আজ মনে করতে পারছি না, তবে সঠিক তারিখ মনে না থাকলেও মাসের নামসহ ঘটনাগুলো মনে আছে। মাসটি ছিল পৌষ মাস। মেয়ের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে সোজাসুজি এক কিলোমিটার দূরে। রাস্তা দিয়ে ঘুরে গেলে প্রায় দুই কিলোমিটার। গ্রামের নাম ডাকুমারী। দুপুরের দিকে আমি এবং বাবাসহ প্রায় সাত আটজন বরপক্ষ হয়ে মেয়ের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। বাড়ির সামনে বিশাল উঠান। উঠানের পশ্চিম পার্শ্বেই এক সারিতে বড় বড় চারটি টিনের ঘর। ভিতর বাড়ির উত্তর এবং পশ্চিম পার্শ্বে আরো তিনটি টিনের ঘর, টিনের ঘরের পাশেই রান্না ঘর। দক্ষিণ পার্শ্বে গোয়াল ঘর ও খানকা ঘর। বাহির বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে বিশাল বিশাল তিনটি খড়ের গাদা।
কনের বাবারা দুই ভাই। একজনের নাম জনাব দেওয়ানী আরেক জনের নাম বকস দেওয়ানী। দুই ভাইয়ের চারটি স্ত্রী। ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনীসহ ২৫/২৬ জনের সংসার। কনে হলো বকস দেওয়ানীর সাত সন্তানের মধ্যে সব চেয়ে ছোট সন্তান। বাড়ির পরিবেশ কিছুটা হাট বাজারের মত। ছোটদের চিল্লাচিল্লি কান্নাকাটি আর বড়দের হাউকাউয়ের চোটে বাড়িটি সবসময় গমগম করে। খড়ের গাদা, বাড়ির সাইজ আর লোক সংখ্যা অনুযায়ী বড়সর গৃহস্থ বাড়ি বললে ভুল হবে না।
বাহির বাড়ির উঠানে পৌছার সাথে সাথেই দুইজন বৃদ্ধ এগিয়ে এসে ছালাম দিয়ে সবার হাতে হাত মিলালেন। বাহির বাড়ির উঠানের পূর্ব পাশে কলসি ভরা পানি ও সাথে দুই তিনটি কাসার বদনা ও কাঠের খরম রাখা ছিল। সেই ভরা কলসি থেকে পানি ঢেলে বদনায় ভরে ওজু করতে দিলে মুরুব্বিরা ওজু করে নিলেন। একে একে সবাই ওজু করার পর সামনের সারির মাঝখানের টিনের ঘরে বসতে দেওয়া হলো। টিনের ঘরটি অনেক লম্বা, ২৫ হাতের কম নয়। পুরো ঘরে কোন পার্টিশন নেই। ঘরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত মাটির মেঝেতে ধানের খড় বিছিয়ে তার উপরে নক্সি কাঁথা বিছানো। আমরা ছেলে পক্ষের আটজন ঘরের মাঝামাঝি বসলাম। মেয়ে পক্ষের কয়েক জন লোক আগে থেকেই বসা ছিল। বর পক্ষের লোকজনের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ছোট, বাকি সবাই বয়স্ক। দুপুরের খাওয়া যখন খেতে দিল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। দুপুরের খাবার বিকালে দিলেও স্মৃতিময় সেই খাবারের স্মৃতি আজো ভুলতে পারি নাই।
ঘরটি ছিল পশ্চিম দুয়ারী। খাবারের জন্য আমরা পশ্চিম মুখ করে বসলাম। আমরা ছাড়াও মেয়ে পক্ষের লোকজন বসেছে। সম্ভাবত তারা ঝি জামাই, বেয়াই টেয়াই হবে। ঘরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত কমপক্ষে ২৫/২৬ জন লোক। প্রত্যেকের সামনে একটি করে থালা দেয়া হয়েছে। তবে সেই সময় গ্রামাঞ্চলে বর্তমানের মতো প্লেটের প্রচলন ছিল না। গ্রামের কৃষকদের খাবারের থালাগুলো অনেকটা বড় ছিল, সকাল বেলা উঠেই যারা এক থালা পান্তা ভাত খেতো তাদের ছোট ছোট প্লেটে ভাত খেয়ে পোষাতো না। তখনকার এক থালা ভাত বর্তমানের তিন প্লেটের চেয়েও বেশি। গ্রামের পরিশ্রমী মানুষদের দুই তিন থালা ভাতের নিচে পেট ভরতো না। তবে তখনকার থালাগুলো দুই ধরনের ছিল, বেশি দামের কাসার থালা আর কম দামের টিনের থালা। বৃদ্ধদের সামনে বড় বড় কাসার থালা দেয়া হয়েছে আর বাকিদের সামনে টিনের থালা।
থালা সামনে নিয়ে বসে আছি এমন সময় একজন কাসার বদনা দিয়ে থালার ভিতর পানি ঢেলে হাত ধুয়ে দিলেন। আরেকজন থালার হাত ধোয়া পানিগুলো একটি বালতিতে ঢেলে নিয়ে পরিষ্কার করে দিলেন। হাত ধোয়ার পর থালা সামনে নিয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষ করছি, এমন সময় একজন মুখ ছড়ানো একটি মাটির নতুন হাঁড়ি নিয়ে হাজির। এর আগে কখনও এরকম কনে দেখা অনুষ্ঠানে খাওয়ার সৌভাগ্য হয় নাই। হাঁড়ির ভিতর কি আছে বুঝতে পারছি না। যখন হাঁড়ি থেকে প্রত্যেকের পাতে পাতে দু’টি করে গোল গোল দিয়ে গেল তখন বুঝতে পারলাম এগুলো মুড়ির মোয়া। মুড়ির মোয়া কড়মড় করে খেতে না খেতেই আরেকজন চিড়ার মোয়া দিয়ে গেল, আরেকজনে কাউনের মোয়া, তিলের মোয়া, খইয়ের মোয়া, চাউল ভাজার মোয়া এমনি করে এক এক করে প্রায় সাত আট প্রকারের মোয়া দিয়ে যাওয়ার পরে নিয়ে এলো নারকেলের কুলি পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, চিতই পিঠা, সব শেষে দিল দুধে ভিজানো রসের পিঠা।
মোয়া আর পিঠা খেয়েই আমার পেট ভরে গেল কিন্তু তখনও নাকি অর্ধেক আইটেম বাকি আছে। আরো কি আইটেম বাকি আছে একটু পরেই বুঝতে পেলাম, পিঠা খেতে না খেতেই নিয়ে এলো চাউলের পায়েস, কাউনের পায়েস। আখের গুড় আর গাভীর খাঁটি দুধে তৈরী পায়েস, আহা! কি যে মজা হয়েছিল তা বলে বুঝানো যাবে না। এখনও অনেক পায়েস খাই কিন্তু সেই দিনের মত অত স্বাদের পায়েস আর পাই না। যাই হোক, সেই স্বাদের পায়েস আমার পক্ষে এক থালার বেশি খাওয়া সম্ভব হলো না কিন্তু আমি খেতে না পরলে কি হবে অনেকেই দুই তিন থালা করে খেয়ে নিল। বিশাল এক গামলা ভরে পায়েস নিয়ে এসেছে। দুই তিন থালা করে পায়েস খাওয়ার পরও গামলার পায়েস শেষ হলো না। তখনও আধা গামলা পায়েস অবশিষ্ট ছিল। পায়েসওয়ালা বলল, আপনারা কেউ কি পায়েস আরো নিবেন না ফেরৎ নিয়া যামু?
যাদের পেট ভরেছে তাদের অনেকেই বলল, অনেক খাইছি, আর লাগবো না ফেরৎ নিয়ে যান।
ঘরের দক্ষিণ পাশ থেকে মেয়ে পক্ষের এক বৃদ্ধ কিছুটা তিরস্কার করেই বলে উঠলেন, কি খাইলেন আপনারা? এক গামলা পায়েসের আধা গামলাই বেশি হইল? আপনাদের মধ্যে মনে হয় পায়েস খাওয়াইয়া লোক নাই?
বৃদ্ধের এমন খোঁচা মারা কথায় ছেলে পক্ষের এক বৃদ্ধের মনে হয় আঁতে ঘা লাগল। তিনি বলে উঠলেন, আধা গামলা পায়েস ফেরৎ নিতে যহন আপনাদের আপত্তি তহন আর ফেরৎ নেওনের দরকার কি? কষ্ট কইরা নিয়া আইছেন চেষ্টা কইরা দেখি খাওয়া যায় কিনা।
আমার যতটুকু মনে পড়ে সেই আধা গামলা মানে বর্তমানের সাত আট প্লেটের কম নয়। যে বৃদ্ধটি পায়েস ফেরৎ আনতে বলল তার পাশে আরো দুইজন বৃদ্ধ বসা ছিল, একজনে পায়েস ফেরৎ আনতে বললেও তারা তিন জনে মিলেই খেতে লাগল এবং মুহুর্তেই আধা গামলা সাবার করে দিলেন। তাদের খাওয়ার কথা মনে হলে আজও আমার চোখ কপালে উঠে যায়। বৃদ্ধদের গামলা ভরা পায়েস খাওয়া দেখে আমি আশ্চার্য হয়ে হা করে তাকিয়ে ছিলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি আমার মত অনেকেই তাদের পায়েস খাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। পরে শুনেছিলাম ঐ বৃদ্ধকে পাল্লাপাল্লি করে পায়েস খাওয়ার জন্যই ছেলে পক্ষ দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছে। সেই আমলে বিয়ের খাওয়া নিয়ে এরকম পাল্লাপাল্লির প্রচলন ছিল। যারা বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে তাদের খোঁচা মারা কথা অনুযায়ী খেতে না পারলে পরাজিত হওয়ার গ্লানি বরণ করতে হতো। কাজেই কোন পক্ষই পরাজিত হতে চাইতো না, যে কারণে অতিরিক্ত খাওয়া খেতে পারে এরকম লোকজনকে খুঁজে খুঁজে দাওয়াত দিয়ে আনা হতো। তবে যারা এইরকম খাওয়া খেত তারা এলাকার মাতব্বর শ্রেনীর লোক ছিল। বৃদ্ধদের পায়েস খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা সবাই হাত গুটিয়েই বসে রইলাম।
তিন খাদোকের পায়েস খাওয়া শেষ হতে না হতেই বাঁশের তৈরী ঝাকা ভরে ভাত নিয়ে এলো। আমার সামনে টিনের থালা আর বুড়োদের সামনে কাসার থালা। কাসার থালাগুলি সাইজে এত বড় ছিল যে সেই সময়ের মাপ অনুযায়ী কমপক্ষে আধা সের চাউলের ভাত লাগত।
ভাত দেয়ার পূর্বমুহুর্তে একজন পাতের কিনারে একটু করে লবন দিয়ে গেল, লবন দেয়ার পরপরই আরেকজন থালা ভরে ভরে ভাত দিয়ে গেল। ভাত দেয়া শেষ হতে না হতেই আরেকজন কাসার চামুচ দিয়ে আলু ভাজি দিয়ে গেল। যতটুকু মনে পড়ে নতুন দেশি আলূ চিকন চিকন সুতার মত করে কাটা। মুখের মধ্যে দিলে চিবুতে হয় না এমনিতেই মিলিয়ে যায়। সেই আলু ভাজির স্বাদের কথা কি আর বলবো, আজো সেই স্বাদ মুখে লেগে আছে।
এরপর দিয়ে গেল গোল গোল করে ভাজা বেগুন ভাজি, লাউ ভাজি, মিস্টি কুমড়ার ফুল ভাজি, কয়েক প্রকারের শাক একত্র করে সাত মিশালী শাক ভাজি। শাক ভাজির কথা কি আর বলবো, ছোট ছোট মুলা শাক, ডাটা শাক, হেলাঞ্চা শাক, বতুয়া শাক, পুন্যনাপা শাক, খুদিয়ামন শাক এইরকম সাত প্রকারের শাক একত্র করে নাকি এই শাক ভাজা হয়েছে। ঐ বয়সে আমি বাড়িতে খুব একটা শাক খেতাম না। কিন্তু কনের বাড়ির ঐ শাক আমার কাছে এত মজা লেগেছিল যে পুরো শাক খাওয়ার পরে বাবার পাত থেকে আরো একটু শাক নিয়ে খেয়েছিলাম।
বিভিন্ন ধরনের শাকসব্জির খাওয়া শেষ করতে না করতেই নিয়ে এলো কই মাছের ভাজি, রুই মাছের ভাজি, বড় বড় পুটি মাছের ভাজি, বোয়াল মাছের ভুনা, চিতল মাছের ভুনা। এইরকম প্রায় চার পাঁচ প্রকারের মাছের ভাজি এবং ভুনা দেয়ার পরে এলো মুরগীর মাংসের ভুনা। মুরগীর ভুনা মাংস খাওয়া শেষ হতে না হতেই আলু দিয়ে খাসির মাংসের তরকারী, এরপর মাসকালাইয়ের ডাল। আমি ভুনা মাংস খেয়েই খাওয়া শেষ করে হাত গুটিয়ে বসে রইলাম কিন্তু ঐ তিন বুড়োর খাওয়ার চাহিদা তখনও কমে নাই, তারা তরকারিসহ ডাল ভাত খেয়েই যাচ্ছে। খাওয়া শেষে গামলায় কিছু ডাল বেশি হয়েছিল, সেই ডাল আর ডালওয়ালাকে ফেরৎ নিতে দিলেন না। সেই বৃদ্ধ ডালওয়ালাকে বললেন, আরে বাপু, ডাল আনছোই যহন ফেরৎ নেওনের দরকার কি, আমাগো পাতে ঢাইলা দাও চুমুক দিয়া খাই। তিন বৃদ্ধ মিলে গামলার সেই ডালগুলোও চুমুক দিয়ে খেয়ে নিলেন। অনেকেই হয়তো মনে করতেছেন এসব গাল গল্প করছি, না ভাই, গাল গল্প নয় বাস্তবে যা দেখেছিলাম তাই এখানে বলার চেষ্টা করছি।
ভাত খাওয়ার পর মনে করেছিলাম হয়তো খাওয়া এখানেই শেষ, অনেকেই থালা চেটে খেয়ে হাত ধোয়ার জন্য বসে আছে, এমন সময় কনে পক্ষের এক বৃদ্ধ হাত ধুতে নিষেধ করে বললেন, দয়া করে আগেই আপনারা কেউ হাত ধুইবেন না, দুধ ভাত আছে। দুধ ভাতের কথা শুনে সবাই আবার নড়েচড়ে বসলেন। চেটে খাওয়া থালায় আরো এক খামছা করে ভাত দিয়ে গেল, ভাত দেয়ার পরপরই গরম গরম দুধ ঢেলে দিল। দুধের পরিমান একেবারে কম নয়। আমার থালায় যে পরিমাণ দুধ দিয়েছে তাতে এক পোয়ার কম হবে না। ভরা পেটে খুব কষ্টে দুধ ভাত খাওয়া শেষ করলাম। মনে করেছিলাম এতো খাওয়ার পরে হয়তো বুড়োগুলো আর ক্ষেতে পারবে না কিন্তু তাদের দুধভাত খাওয়া দেখে মনে হলো এখনো তাদের খাওয়ার কিছুই হয় নাই আরো এক গামলা ভাত দিলেও খেয়ে নিবে। এতো খাওয়ার পরও তারা দুধ ভাত কম খেলেন না, বড় বড় কাসার থালা ভর্তি করে কম করে হলেও এক দেড় সের দুধ খেয়ে নিলেন। আহারে খাওয়ারে! তারা একজনে যে খাবার খেলেন বর্তমানে দশজনেও এ খাবার খেতে পারবে কিনা সন্দেহ। সেকালের বিয়ের অনুষ্ঠানের সেই খাওয়ার দৃশ্য আজো স্মৃতি হয়ে আছে, আজো সেই দৃশ্যগুলো চোখে চোখে ভাসে।
(চলবে)