ছোটগল্পঃ দেয়ালচিত্র, গিগাকু মুখোশ এবং সেই পলাতক মাতাল
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১.
দরজায় নক করতে গিয়ে থমকে গেলাম,
কলিং বেলটা নষ্ট সেইটা জানা ছিল, অকারণেই সুইচে আঙুল বুলিয়ে খানিক পিছিয়ে এলাম। 'দুম!' করে লাথি কষালাম দরজায়। শতাব্দীকাল ধরে নির্মাণাধীন এগারো নম্বর রাস্তার বারোমাসি কাদা, আমার আট নম্বর জুতোর তলার ছাপে নতুন অস্তিত্ব খুঁজে নিল। সিড়ির রেলিং এ হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে একটা প্রশ্ন উদয় হলো মনে, লাথিটা মারলাম কেন?
বছরখানেক আগে,
"এইরকম ভারী সোলের জুতা পরিস ক্যানো?" এই প্রশ্নটা এক বাল্যবন্ধুকে করেছিলাম। উত্তরে সে বলেছিলো, "শ্যু পরলে কেমন জানি একটা কনফিডেন্স আসে..., রাস্তাঘাটে হাঁটার সময়, অফিসে বসে, যেকোনকিছুতে লাত্থি মারার জন্য কনফিডেন্স..." এরপর থেকে জুতা পরা অবস্থায় আমি ওকে বিশেষ ঘাঁটাই না আর। আত্মবিশ্বাসী পাগলদের বেশি ঘাঁটানোটা একপ্রকার নির্বুদ্ধিতা বটে।
প্রায় নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল খানিকটা, খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি একটা মুখ বেরিয়ে এলো ফাঁক দিয়ে,
"কি চাস?"
আমি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তার অনুপস্থিত জননীর কাছে অসম্ভব কিছু চেয়ে বসলাম, বহুল প্রচলিত একটি কুবচন। কাজে দিল এই গালি,
"ভেতরে আয়...", বলে দরজা আরেকটু মেলে ধরে সরে দাঁড়ালো সে। আরো কিছু খিস্তি করবার ইচ্ছা ছিলো, তবে এইসব আওয়াজে পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে যাবার মতো পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছে দেখে আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এবং সাথে সাথে টের পেলাম,
এখানে আসাটা উচিৎ হয় নি মোটেও।
চারপাশে এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ময়লা কাপড়োচোপড়, বেসিনের ট্যাপটা থেকে পানি ঝরছে অনবরত, কেন জানি মনে হল ওটা বন্ধ করা হয় নাই অনেকক্ষণ ধরে, পায়ের কাছে একটা তুবড়ে যাওয়া প্লাস্টিকের বোতল, মোজাইকের মেঝেতে আরেক মোজাইক- অগুনতি পোড়া সিগারেটের ফিল্টারের, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে আঁশটে কোন দুঃসংবাদ, এইসব বোঁটকা গন্ধের মধ্যে একটা অল্পপরিচিত গন্ধে চোখ ফেরাই চারপাশের মনযোগ ফেরাই দেয়ালে...
দেয়ালের গোড়ায় কালো গুঁড়ো ছড়িয়ে আছে, কয়লার গুঁড়ো...
"একটাই আঁকা হইছে, খালি এই ঘরের বাকি দেয়াল আর রান্নাঘর বাকি আছে।" আমি এগিয়ে যাই দেয়ালচিত্রের দিকে...
উন্মুক্তবক্ষা এক রমণী ওপাশে ঘুরে বসে আছে, কোমরের কাছে গুটিয়ে আছে শাড়ি। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, শিল্পকলা বস্তুটির উপর আগ্রহ বরাবরই ছিলো কম, তবুও দেখি, বেকায়দায় বেয়াদব আঙুলগুলো সামলে নিয়ে পকেটে পুরি। বন্ধুর দিকে না চেয়ে বলি,
"পেছনে ফিরে ক্যানো? সামনে থেকে আঁকতে পারস নাই?" বিশ্বাসঘাতক ঠোঁটে বিদ্রুপ ফুটে উঠেছে, টের পাইনি। আমাকে পাত্তা না দিয়ে সে বলে, "বেডরুমে আছে..."
নাহ! এইসব পাবলিক ঠাট্টা সহজে হজম করতে পারে না মোটেও। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বেডরুমের দিকে এগিয়ে যাই, এই দরজায় অবশ্য নক করে অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন নেই।
"Blink twice if you are here against your will."
চেঁচালাম আমি।
উত্তরে নাক ডাকার শব্দ ভেসে এলো, এলোমেলো বিছানায় ঘুমায় রাজকন্যে, পায়ে এখনও আঁটা সেই ভারী সোলের শ্যু। অপরচিত সব হরফ, ভুতুড়ে চোখেরা সবগুলো দেয়াল থেকে চেয়ে আছে, সিলিং থেকে কালচে পায়রাদের ছবি ঝুলছে, এতসব কর্কশ দেয়ালচিত্রগুলোর মাঝে নিদ্রামগ্ন নেশাগ্রস্ত তরুণ। ঘুমের মধ্যেও দু'হাতে একটা অদ্ভুত মুখোশ ধরে আছে, আমি বিজাতীয় বস্তুটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি; তবে গন্ধটা তীব্রতর এখানে, পোড়া তামাক, এলকোহল, ঘাম, ঘুণে ধরা কাঠ... এবং কয়লার।
"আধুনিক গুহাচিত্র, হাহ!"
এগিয়ে গিয়ে হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চড় কষাই ঘুমন্ত বন্ধুর গালে, ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো। ঘোলাটে নিষ্পলক চোখে আমার দিকে তাকায়ে বলে, "সমস্যা কি তোর?"
"ওটা কি জিনিশ?" ওর হাতে ধরা আছে সেই মুখোশ তখনও।
"গিগাকু মাস্ক..." আমার চেহারা দেখে আবারো বলে ওঠে, "...জাপানীজ..." আমি হাত নেড়ে থামিয়ে দেই। এখান থেকে বের হওয়া দরকার। "বের হ, তোরে তোর বাসায় লোকজন খোঁজে, আমারে অনেকবার কল দিছে..."
"আজকে না, তোরে আবারও কল দিলে বলিস যে আমারে খুঁজে পাস নাই।" বার কয়েক মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুম তাড়ানো চেষ্টা করল সে। আমি আরো অধৈর্য্য হয়ে উঠি, বিনা অভিযোগে অন্য কারো পারিবারিক আপদ সামলে বেড়ানোর বয়স শেষ এখন।
"ভদ্রমহিলাকে আর কোন মিছা কথা কইতে পারবো না আমি।"
"বলিস কি, তোর তো পেশাই মিথ্যা কওয়া!" বলে আঁকিয়ে।
"হা হা হা, নাইস..." এড়িয়ে যাই বিষয়টা, সদ্য জেগে ওঠা বন্ধুকে আবারো বলি,
"একরকম কান্নাকাটি শুরু করছে সে, আমি কি করতে পারি?"
"তার গলা সবসময় ঐরকম শোনায়..." সাদাসিধে উত্তর।
"বউরে কি এতোটাই সুখে রাখছিস?"
এরপরে আর কিছু বলবার থাকে না কারো। কষ্টেসৃষ্টে বিছানা ছেড়ে ওঠে সে। গলা খাকারি দিলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আঁকিয়ে, আমি ধমকে উঠতে গিয়েও থেমে গেলাম। ক্ষেপে উঠতে পারি না তার উপর, জীবনযুদ্ধ থেকে পলাতককে আশ্রয় দেবার অপরাধে। আমি বাসাটাকে প্রতিকূল সময়ের আশ্রয়স্থল হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করি ক্ষণিকের জন্য।
"বহুদিন পর আসলি এইখানে তুই, সেটা কি জানিস?" খানিকটা অনুযোগের সুরে বলে আঁকিয়ে। হ্যাঁ, আমি জানি। বেশ কয় প্রস্থ সামাজিক সংস্কার শেষে যেটুকু টিকে আছি তাতে বোধকরি খানিক পানসে হয়ে গেছি, এইখানে ফিরে আসবার মতো কারণ খুঁজে পাওয়াটা বেশ মুশকিল হয়ে পড়েছে গত দুই বছরে।
২.
আমরা তিনজনে একসাথে বেরিয়ে আসি লিভিং রুমে। দেয়ালে আঁকা ছবিটার সামনে এসে দাঁড়াই। আরো ক'বার দেখলে এই ছবিটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি, কেন জানি মনে হল। হুট করে সেই অদ্ভুতুড়ে মুখোশের কথা খেয়াল হল,
"মাস্কটা কি কাজে আসে? নাকি হুদাই রাখছিস?"
"সে এইটা মুখে লাগায়ে এইসব আঁকে..." আঁকিয়ে কোনরকম বাধা দেবার আগেই বলে বসে মাতাল।
"...this is just an act...a very necessary act." গম্ভীর মুখে বলে অন্যজন।
"ডাক্তার দেখাও, বন্ধু... খুব শিগগিরই দেখাও..." অদ্ভুত বিষয়, খুব বেশি আহত হলো না সে এই কথায়। হুমম...মানে দাঁড়াচ্ছে যে এর আগে বেশ ক'বার শুনেছে সে এই কথাটা।
"আচ্ছা আঁকার সময় ভুলটুল করলে কি করিস? পেন্সিলে আঁকলে একটা ইরেজার পাওয়া যেতো অন্ততঃ..." পাত্তা দেয় না আমার কথায় ভদ্রলোক, এইসব মূঢ়তায় অভ্যস্ত এতোদিনে সে। আমি আরেকটু চেষ্টা করি,
"যা তোরে হোয়াইটওয়াশ কিনে দিমুনে না হয়।" কথাটা বলে নিজে নিজেই হেসে উঠি।
ভাবলেশহীন মুখে ভারী জুতোর মালিক ডান হাতের আঙুল পরখ করতে থাকে একটা একটা করে। এখনও কিছু বলে নি বেডরুম থেকে বের হবার পরে, শোকার্ত? আমি নির্দয় আমোদে লক্ষ্য করি ওকে...। অবশেষে কোন একটা অভিব্যক্তির আভাস পাই তার চোখে, দু'পলক ফেলে শিল্পী বন্ধুটির দিকে ফিরে বলে ও,
"দোস্ত, ছবিটা ভয়াবহরকমের কুৎসিত।"
এশট্রে থেকে আধপোড়া সিগারেটটা তুলে নিয়ে ঠোঁটে চেপে,
আমার আগেই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে দিলো আঁকিয়ে।
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=
০১।
চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন
হালহকিকত
ছবি নেট ।
মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।
প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন
মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।
প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন
কুড়ি শব্দের গল্প
জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!
সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্ম ও বিজ্ঞান
করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন
তালগোল
তুমি যাও চলে
আমি যাই গলে
চলে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফুরালেই দিনের আলোয় ফর্সা
ঘুরেঘুরে ফিরেতো আসে, আসেতো ফিরে
তুমি চলে যাও, তুমি চলে যাও, আমাকে ঘিরে
জড়ায়ে মোহ বাতাসে মদির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন