তোমার বাবা বললেন, তুমি এবার অনার্স ২য় বর্ষে। আরো ৬ বছর আগে আমি তোমার এই ক্লাশে পড়েছি বলে তোমাকে তুমি করে লিখলাম। আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় জানানো দরকার বলে তোমার বাবাকে না জানিয়েই তোমাকে লিখছি। শোন, ভালোবাসা যা করেছি হিসেব করে দেখলাম আমার প্রেমিকার বিয়ের পরেই । বিয়ের আগের ভালোবাসার সাথে আবেগের মিশাল ছিল, পরেরটা বাস্তব। আমার পুরনো প্রেমিকার নাম আসমানী। বাংলা সিনেমার নায়কের মতো আমার একটা মুত্রগ্রন্থী আসমানীকে দিয়ে দিয়েছি। বিবাহিত একটা মেয়ের জন্য এমন প্রেম দেখানোটা গোপন রাখতে চেস্টা করেও পারিনি। মা’তো এ ঘটনার শোনার পর থেকে কান্নাকাটি শুরু। আব্বা আর কোনদিন ঘরে ঢুকতে দিবেনা বলে দিয়েছে শুনেছি। আমার ভয় শুধু বড় ভাইয়াকে নিয়ে। উনি সামনে পেলেই নিশ্চিত একবারে কয়েকশ থাপ্পর কশিয়ে দিবেন, একবারও ভাববেন না, এ¤িœতেই একটা কিডনি নেই, এত চড় কি সহ্য করতে পারবে?
আসমানী তখন স্কয়ার হসপিটালে ভর্তি ছিল। আমার নয়া চাকুরীতে ছুটি দিবেনা বলে অফিসে না বলেই কিডনি দেয়া-দেয়ির ৮ দিন পর অফিসে গিয়ে দেখি আমার থেকে অল্প ছোট বয়সী দুনিয়ার এক সুন্দরী মেয়ে আমার চেয়ারে বসা। চাকুরী চলে যাওয়ার কস্ট মুহূর্তে মুড়ির মতো উড়ে গেল। ৫ মিনিট মেয়েটাকে দেখে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে আসলাম। আমার মতো বেকারের চাকুরী চলে যাওয়া আর পুরনো বয় ফ্রেন্ডের সাথে নিজের বউ চলে যাওয়ার কস্ট একই রকম দূর্যোগের বিষয় হলেও আমার তেমন লাগেনি। কারন ৩২তম রিটেনে কিভাবে যেন টিকে গিয়েছিলাম। তাই একটা গোপন সাহস ছিল ভিতরে ভিতরে। সত্য বলতে কি সম্পা, তোমার বাবা রিটেনের রেজাল্ট শুনেই তোমাকে আমাকে দিতে রাজি হয়েছেন। তিনি চাচ্ছেন বিয়েটা যেন ২ সপ্তাহের মধ্যে সেরে ফেলি। এত জলদি জলদি করার কারন কি জানো? ভাইবা’তে টিকে গেলে যদি মোড়ামুড়ি শুরু করি! আমিও একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। তোমার বাবা যেদিন নৌকার উপর বসা তোমার ছবিটা দেখালো আমারতো ভিরমী খাওয়ার দশা। এমন টেলিসামাদ মার্কা ছেলের সাথে নিজের এমন সুন্দরী মেয়ের বিয়ে দেয়ার গোপন রহস্য কি? প্রথম চাঞ্চেই মনে হল, মেয়েরও বোধহয় ভাল্ব টাল্ব নেই- একজনের নাই কিডনি, আর একজনের ভাল্ব। পরে ভাবলাম, মেয়ে বোধহয় নিজের না। ভাইয়ের মেয়ে টেয়ে হবে। ভাইয়ের মৃত্যুর সময় হাত ছুয়ে বেদিকে কথা দিয়ে এখন ফাইসা গেছেন। এখন যারে পায় তারেই মেয়ে দেখায়। পরে শুনলাম তোমার দাদির উপর বেদম অপবাদ যন্ত্রনা দেয়ার পর দাদার ৪৯ তম বছরে তোমার বাবা পয়দা হন। এ সময়েই তোমার দাদি মারা যায়। তোমার বাবা এ ঘটনা বলার সময় বেশ কান্নাকাটি করেছেন যেটা সাময়িকভাবে আমাকেও বেদনা দিয়েছে।
যাক কিডনি দেয়ার কাহিনী শোন, এর আগে স্কয়ার হসপিটালে যাইনি কখনো। টিটু ভাইর রুমে যাওয়ার সময় হসপিটালের সামনে থেকে যেতে হতো বলে দেখেছি মাত্র। তবে জানতাম যে এখানে চিকিৎসা খরচ খুব বেশি। সাজ্জাদ ওর বড় আপার ছেলে হওয়ার সময় এখানে ছিল কয়েকদিন। ও সব ইউনিটই চিনে। তবে সাহস করে ওকেও জানাতে পারিনি। রাত ১১ টায় মানুষিক প্রস্তুতি ট্রস্তুতি নিয়ে আসমানীর ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে ওর ইউনিট ও বেড নম্বর জেনে নেই। দূর্বল হয়ে পড়তে পারি ভেবে আড়াইশ গ্রাম আঙ্গুর কিনে খেতে খেতে ওর ইউনিটে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি একদম পশ্চিম পার্শ্বের শেষ বেডে ওর পাশে ওর মা বসে আছে। ওর আম্মাকে আমি একদিন শুধু দেখছিলাম। মূলত সেজন্যই চিনতে পারানা, পাশেই পাতলা সাদা কাঁথা বুক সমান টেনে আসমানী ঘুমে ছিল, মুলত ওর মুখ দেখেই কনফার্ম হওয়া। আমি সরাসরি গিয়ে বললাম, খালা জলদি জলদি ডাক্তার ডাকেন। পেট চিরে একটা কিডনি সরায়ে আমাকে বাঁচান। খালা ভাবলেন আমি মজা করছি। উনি বসে বসেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। বুঝলাম তিনি কান্নাকাটি করছেন। আসমানীর পাশের বেডটাতে রোগি ছিলনা। পাতলা কাঁথার ফাক থেকে আসমানীর ডান হাত বেড়িয়ে আছে, হাতের বুড়ো আঙ্গুল যেন ফিসফিস করে বলছে, ধরেন, আড়ালে এসে হাতটা শক্ত করে ধরেন, দুদিন থেকে আপনার জন্য হাত বের করে আছি, অথচ আপনার কোন খোজ নাই। এরকম বেআক্কেল হলে হয়! মুহুর্তে আমার মেজাজ বিগরে গেল, ’’ বললাম, আমি বেয়াক্কেল না তুই? বাপরে মুখের উপর ‘‘না’’ বলে দিলে আজ এ দশা হতো? বাইরের একটা লোক বিয়ে করে কিডনি খুইয়ে ঘর সংসার ভুলে আরামে আরামে এ হসপিটাল ও হসপিটাল ঘুরছে! কিডনি নস্ট হইছে না তোর স্বামী চুরি করে নিয়ে কাউরে দিছে দ্যাখ! ফাজিল মেয়ে যেন কোনকার!
আসমানী ঘুমে জেনেও পলিথিনের অবশিষ্ট আঙ্গুর দুটি ওর হাতে গুজে দিয়ে খালার হাত ধরে বললাম, ‘‘ আমি মজা করছিনা খালা। জন্মগতভাবেই আমার ৩টা কিডনি। অতিরিক্ত একটার কারনে মাঝেমাঝে আমার পাগলামি বেড়ে যায়। আপনার টাক মাথাওয়ালার স্বামীর যে থাপ্পরটা খেলাম তাওতো এই বাড়তি কিডনিটার জন্যই। এই তিনটা কিডনির যন্ত্রনায়ই আসমানীর বিয়ের দুদিন আগে কাকার রিক্সা থামিয়ে বললাম, আপনারা যে ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করছেন সে ছেলের থেকে আমি কোন অংশে খারাপ না। জলদি জলদি ঐ বিয়ে বাদ দিয়ে আমার বাবাকে খবর দেন। উনি বাবাকে খবর না দিয়ে জলদি জলদি একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলেন। খালা, কিডনি একটা না সরালে এরকম থাপ্পর পথেঘাটে আরো খেতে হবে। জলদি ডাক্তার ডাকেন। আসমানীর পাশে রাখা পলিথিন গুলো চেক করতে করতে বললাম, খালা, ভিটামিনওয়ালা কোন খাবার টাবার থাকলে দেনতো, শক্তি সঞ্চার করা দরকার।
সম্পা, এই অল্প বুড়ো মহিলা আমার কথা শোনার পর আরো জোরে কান্না শুরু করলেন। প্রথম ভাবলাম, তার স্বামীকে টাক মাথাওয়ালা বললাম বলে হয়তো, আবার ভাবি, কিডনি ম্যানেজ হয়ে গেলো ভেবে হয়তো আনন্দ সামলাতে পারছেন না। সবার শেষে ভাবি, হয়তো উনি আফসোস করছেন, ইস এমন তিন কিডনিওয়ালা মহৎ প্রাণ ছেলেটাকে উনি জামাই বানাতে পারলেন না এ কস্ট তিনি কোথায় রাখবেন!
যাক, শোন এবার, ১ কিডনি নিয়ে আমি মোটামুটি ভালোই আছি। ডাক্তার বলেছেন, পানিটা একটু বেশি খেতে তাই সাথে সাথে সবসময় মামের বোতল রাখি। তোমার বাবার কাছে শুনলাম, তুমি আমার প্রথম চিঠি পেয়েছো তবে তার উত্তর তুমি করতে যাচ্ছোনা। আমাকে দেখা করার জন্য বলেছো। এ প্রস্তাব যে কোন ছেলের জন্য পরম আনন্দের হলেও আমি খানিকটা বিব্রত। কারন ঝিনাইদহ যাওয়ার মতো টাকা আমার হাতে নেই। চাকুরীটা চলে যাওয়ার হাত খরচ চালানোরও আর উপায় নেই। বাকী বক্করও কেউ দেয়না আজকাল। সাজ্জাতরে বললাম, ৫০০০ টাকা দে, স্বর্ণাকাররা যে সুদ দেয় বিসিএসটা হলে তার সমান সুদ দিয়ে দেবো। ও মুখের উপর বলল, আসমানীর স্বামীর কাছে চা। সুস্থ বউ নিয়া লঞ্চ ভাড়া করে কেবিন সাজাইয়া সুন্দরবন টু মঙ্গলা ঘুরবে আর কিডনির দাম দিবেনা এইটা কেমন কথা!
আমি ভালোমন্দ আর কিছুই বলি নাই। তাই নির্লজ্জের মতো তোমার বাবার কাছ থেকেই ধার নিলাম। শোন সম্পা, তোমাদের বাড়ি যেতে লাগবে ১২ ঘন্টা আর এই চিঠি তোমার হাতে যেতে লাগবে মিনিমাম ৩ দিন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঝিনাইদহর উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠার সময় চিঠিটা পোস্ট করবো। তুমি কোনো ধরনের ঝামেলা না করলে আমি তোমাদের বাড়িতে একদিন থাকবো বলে প্লান নিয়েছি। তোমাদের পিছনের পুকুর দিয়ে চ্যালা মাছ ধরে বেগুন আর টমেটো দিয়ে মাখা মাখা ভাজি করে খাওয়াবে (তোমার বাবা তোমার রান্নার গুন বর্ণনা করতে গিয়ে এই আইটেমের কথা বলেছেন)। এই ২৪ ঘন্টার মধ্যে চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে কোন কথাই বলবোনা। সারাদিন আমাকে নিয়ে ঘুরবে অথচ জানবেনা এই ছেলেটার মুত্রগ্রন্থীতে ঘাটতি আছে। দেখবে কেমন সুন্দর, ইনোসেন্ট হাতের আঙ্গুল অথচ বুঝতেই পারবেনা এ হাতেও আর একটা মেয়ের ভালোবাসার আবছা আবছা ছাঁপ আছে।
ইতি
হেলাল।