রং জিনিসটাই আমার ভীষণ প্রিয়! লাল-নীল, হলুদ-সবুজ, সাদা-কালো, কমলা-গোলাপি...কি সুন্দর!
ছোট থাকতে রং নিয়ে আমার মহান সব শিল্প কর্মের সুপ্ত প্রতিভাগুলো বিকশিত হত বাসার প্রতি ঘরের দেয়ালে দেয়ালে। গুহা মানবীর মতো প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে অঙ্কিত হত আমার জীবন কাহিনী। সবচেয়ে বেশি কাহিনী রচিত ছিল আমার বিছানার পাশের দেয়ালে যতটুকু হাতের নাগাল যেত ততটুকু জুড়ে, সাইনপেন গুলোর সদ্বব্যবহার করে একটা অভিনব টাওয়ারের নীল নকশা অঙ্কন করেছিলাম আমি। যার চূড়ায় ছিল একটা আলু! তবে খুব দুঃখ লাগে ভাবতে যে সেই টাওয়ারের মর্মদ্ধার সে আমলে কেউই করতে পারেনাই।
কোন ক্লাস মনে নাই তবে খুব ছোট থাকতে মামা আমেরিকা থেকে বেশ বড় এক সেট সাইন পেন এর ব্ক্স নিয়ে গিয়েছিলেন আমার জন্য। ব্ক্সটাতে দুই রকমের সাইনপেন ছিল। মোটা আর সরু। তাছাড়াও দুইটা বোনাস পেন ছিল যেটা দিয়ে একটা টান দিলে তিনটা করে আর দুইটা করে দাগ হয়ে যেত! যেটা দিয়ে দাগাতে আমার অনেক ভালো লাগতো!
স্কুলে যাওয়া শুরু করার পর মনে আছে মা অনেকগুলো মোম পেনসিল কিনে দিয়েছিলেন। যেগুলি সার্পনার দিয়ে সার্প করতে খুব মজা। সার্প করার পর সেই নানান রঙের গুঁড়োগুলো একসাথে মিশিয়ে একটা কৌটার মধ্যে জমিয়ে রাখা ছিল আরো মজা। কিছুদিনেই সেই মোম রংগুলো তাই ভ্যানিশ হয়ে যেত আর আমার কৌটাটা ভরে যেতে থাকতো। :>
(আসল মজাটা হয়েছিল যেদিন হাঁড়ি-পাতিল খেলার সময় গুঁড়াগুলি দিয়ে একটা নতুন ধরনের স্যুপ বানিয়ে মাকে যখন খেতে সেধেছিলাম!)
যাই হোক আমার খুব প্রিয় রং ছিল সে সময় স্ট্যানডার্ড কাঠপেনসিল। ছবি এঁকে তার উপর তুলি ভিজিয়ে টান দিলে মনে হতো জলরং এ আঁকা। স্কুলের ড্রইং ক্লাসে এই কাঠপেনসিলটাই ব্যবহার করতে বলত। কিন্তু পরীক্ষা আসতে আসতে সব পেনসিল হালুয়া হয়ে যেত। কারনটা অবশ্য তেমন কিছুনা-এত কষ্ট করে রং করে আবার তুলির আঁচড় কে মারে। তাই বুদ্ধি করে ডাইরেক্ট পানির মধ্যে পেনসিলটা চুবিয়ে চুবিয়ে আঁঙ্কন শিল্প সম্পাদন করতাম আরকি! :#>
এরপর ঠিক মনে পরছে না সম্ভবত জন্মদিনে একজন একটা ইয়া বিশাল প্যাস্টেল কালারের বক্স দিয়েছিল। আসলেই অনেক বড়। আমার জীবনে প্রথম দেখা প্যাস্টেল কালার। কিই সুন্দর! কাউকে ধরতে দিতাম না। নিজেও ব্যবহার করতাম না(ছবি আঁকতে পারলে তো!)। স্কুলে ঐ বক্সটা নিয়ে ভাবই থাকতো আলাদা! প্যাস্টেল কালারের সেড আর কাগজের উপর তাদের মিশ্রন দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো।
ড্রইং খাতায় ছবি আঁকা শেষে পাতায় পাতায় গাদা খানেক পাউডার ছিটিয়ে তারপর রেখে দিতাম।
বাবা একবার সিঙ্গাপুর থেকে একসেট ডার্ক প্যাস্টেল কালার নিয়ে আসছিলেন। সেই পুরা সেটটায় আমার ভালোমতো ছোঁয়া লাগার আগেই কোথায় জানি হারিয়ে গেছে! মনে পড়ে আমি প্যাকেট থেকে খুলতাম, রংগুলি নাড়াচাড়া করতাম, আবার বক্সে রেখে ট্রান্সপারেন্ট প্যাকেটা দিয়ে মুড়িয়ে ব্ক্স বন্ধ করে ড্রয়ারে রেখে দিতাম। রংগুলো ডার্ক আর খুব সুন্দর ছিল!
ইন্ডিয়ার ফুটপাথ থেকে কিনেছিলাম ওয়াটার কালারের টিউব। ওদেরও আমার ছোঁয়া পাওয়ার সৌভাগ্য খুব বেশি একটা হয়নি, তার আগেই শুকিয়ে খটখটে মরুভূমি।
একটু বড় হওয়ার পর মায়ের শখের ফেবরিক্স কালারের দিকে চোখ পরলো। চোখ আগেই পরেছিল তবে ধরার অনুমতি ছিল না। আবার কোথায় জানি লুকানোও থাকতো!
দুপুরগুলোতে ডিজনির বইগুলো থেকে ছাপ হয়ে হয়ে বাবার যতগুলো রুমাল আর গেন্জি ছিল সবগুলাতে পিনোকিও, টুইটি, ডামবো, বামবি সহ আরো কত সব যে মুভি রিলিজ হত বলে শেষ হবেনা !
সে সময় কাজের কাজ একটাই হয়েছিল, ক্লাসে এক ফ্রেন্ড তখন সুপার ম্যানের দারুন ফ্যান। তাকে একটা রুমালে সুপারম্যানের 'S' লিখে দিয়েছিলাম। কি যে খুশি হয়েছিল সে!
এ্যাম্বুস ইউজ করে কার্ড বানানোও শিখেছিলাম মায়ের ফেবরিক কালার দিয়ে। কার্ডে এঁকে হালকা গরম ইস্ত্রি দিয়ে ডলা দিলেই রংগুলো ফুলে উঠত। কি যে দারুন ছিল সে সব অবসর সময়গুলো!
বাবার যত রকমের পেন ছিল সব অলিখিত নিয়ামানুযায়ী আমার পেন ছিল। অফিসে কেউ কোন দামি পেন গিফট করলে বাসায় আনার সাথে সাথে সেটা আমার ড্রয়ারের প্রবেশ করত। যার মুখ আর কেউ কোনদিন দেখতে পেতনা। এমনকি নিজেরও হয়ত কালি শুকানোর আগে দেখা হতনা!
বাবা অফিসের কোন মিটিং এ যেতে গেলে আর কোন পেন খুঁজে পেতেন না। সংগ্রহের প্রায় সব পেনই বাবার দেয়া ছিল। তার মাঝে একটার মাজেজা অবিষ্কার করেছিলাম অনেকদিন পর। একবার বাসার ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল দেখি পুরা পেনটা থেকে হালকা সবুজ এক আলো বের হচ্ছে। ফ্লুরোসেন্ট পেনটা নিয়ে বহুত জায়গায় ভাব মেরেছিলাম!
একবার একটা ছোট্ট ঘড়ি ওয়ালা সোনালি পেন আমাকে দেখতে দিয়েছিল বাবা। আমি দেখে টেখে খুব সুন্দর বলে ফেরত দিয়ে দিয়েছিলাম। পরে শুনি মায়ের কাছে গিয়ে বলে আমাকে দেখালো তবুও কেন আমি নিয়ে নিলাম না!
ঢাকায় যখন প্রথম জেল পেন বের হল, এক কাজিনের কাছে সোনালি-রূপালি পেন দেখে আমার তো মাথা খারাপ হওয়ার দশা! প্রায় ৩৫ না কত টাকা জানি ছিল তখন এক একটা পেনের । অনেক দিন ধরে একটু একটু করে পেনগুলো আমার কালেকশনে এসেছিল!
আরেকটা পেনসিল ছিল(এখনও নিউমার্কেটে হয়তো পাওয়া যায়) সার্প করা লাগেনা চারপাশে মোড়ানো কাগজটা একটু একটু করে খুললেই হয়। সেটাও খুব মজার ছিল!
জার্মানিতে থাকতে প্রতি উইকের সেল পেপার দিলেই চোখ থাকতো সব সময় স্টেশোনারির দিকে। কত পেন যে কিনে ড্রায়ারে রেখে কালি শুকিয়েছি জানা নাই। যেই যেই রঙের জেলপেন কেনা বাকি ছিল আমার সেই সময় মোটামুটি প্রায় তার সবগুলোই আমি পেয়ে যাই।
আমার এখন পর্যন্ত ব্যবহার করা সবচেয়ে দারুন লাগা সাইনপেন হল Stabilo. 0.4 mm এই পেনটা দিয়ে লিখতে খুব্বি ভালো লাগে। সরু নিবের এই সাইনপেন গুলো দিয়ে এখনও সময় পেলে দাগাই!
লন্ডনে পাউন্ড শপে গিয়ে কিনব না কিনব না করেও এক সেট পোস্টার কালার কিনে ফেলেছিলাম। এমন খসখসে রংগুলো ...একটুও ভাল্লাগেনাই
আমি জানি যে আমার রংগুলোর কখোনই সদ্বব্যবহার করা হবে না তবুও কেন জানি কিনে ফেলি! তবে এটা একটা ভালো দিক যে আমি কখোন তেমন দামি রং কিনে নস্ট করিনাই। অধিকাংশই কম দামি, তবুও...
(সেদিনও একটা দোকান থেকে এক ডলার দিয়ে ২৪ টা ক্রেয়ন কিনে ফেলেছি! )
স্কুলে প্র্যকটিকাল খাতায় সেলো বলপেন দিয়ে লিখেছিলাম, ফাইনালের দিন জমা দিতে গিয়ে দেখি পুরা খাতার লেখাগুলি কেমন জানি হলদে টাইপ হয়ে গেছে! আমার রেড লিফ দিয়ে লিখতে ভালো লাগতো না, অনেকেই দেখি লিখতো।
জীবনে সব্বচেয়ে আরাম পেয়েছি যে বলপেনটা দিয়ে লিখে তা হল "ম্যাটাডোর" বলপেন! ওহ কি যে আরাম লিখতে!
এখানে একদিন ক্লাসে এক মেয়ে আমার কাছ থেকে পেনটা দিয়ে লিখে টিখে বলে সে এটা আর ফেরত দিতে পারবেনা... দেয়ার সাথে সাথে আমিও চামে এটা আমার দেশের পেন হ্যানত্যান ডায়ালগ মেরে দিসি ।এখানে আসার আগে ডজন খানেক কিনে এনেছিলাম এখন যা প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে! সেদিন ক্লাসটেস্টে একজন পেন আনতে ভুলে গেছিল আমিও ভদ্রতা করে আমারটা দিলাম যে লেখ....ওটাও আর ফেরত দিলনা... (তবে আমি এখানে পেনসিল দিয়েই ক্লাসে লিখি, মোছার একটা চান্স থাকে! )
এই স্মৃতিচারণ লিখতে গিয়ে অনেক সময়ে হাতে থাকা আরো অনেক পেন-পেনসিলের কথা লিখতে ভুলে গেসি...যেমন একটা ইয়া লম্বা পেনসিল ছিল যার বডি জুড়ে বিভিন্ন রঙের শিষ ছিল। বদলে বদলে রং করতে হত! মেলা থেকে ইয়া লম্বা লম্বা পেন আর কাঠ পেনসিল কেনা হয়েছিল। আর একটা পেনসিল ছিল অরিজিনালি গাছের ছোট্ট একটা ডাল! ছোটখাট সুটকেস সাইজের একটা রং পেনসিলের বক্স ছিল- কাঠ পেনসিল, দুইরকমের সাইনপেন আর জলরং ছিল বক্সটাতে...মনে পড়ছে না কে দিয়েছিল!
কত দুপুর...কত তুলি...কত জলরং...কত কাগজ...
ছবি আঁকা-আঁকি বা ডায়েরি লেখালিখি আমি কখোনই তেমন একটা পারিনা...করিওনা...তবুও কেন জানি রং আর সাদা কাগজ দেখলে খুব খুশি হয়ে যাই! মার্কারের গন্ধ শুঁকি...গ্লিটারের টিউবগুলো আলো পরে ঝলমল করে দেখি...ধবধবে সাদা সাদা এফোর পেপারগুলো ফাইলে রেখে দেই, এমনিই!
আজব লাগে নিজেরই! হায়রে শখ! তবে আমার শুকিয়ে যাওয়া রং গুলির মতো শখগুলোও প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে...আগের মতো আর সেই পাগলামিও নাই! দুনিয়ায় স্রষ্টার সৃষ্টি এত আলো আর এত রং যে আমি চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি তা ভাবলেই মনটা প্রফুল্ল হয়ে যায়!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১:০৩