somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে

২৯ শে মে, ২০১৪ বিকাল ৩:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ব্যাগে সামান্য কিছু জামাকাপড় এবং পকেটে নামেমাত্র টাকা-পয়সা নিয়ে যখন সে বাইরে পা ফেলল, তখন দুনিয়াটা সিগ্রেট খাচ্ছিল। কমদামি জিনিস, নিকোটিন নেই বললেই চলে। কিন্তু ধোঁয়া, সে কি ধোঁয়া, বাপস রে! চারিদিকে সাদাটে আঁধার জাঁকিয়ে বসেছে যেন। সে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বুক ফুলিয়ে ফেলল, তারপর মুক্ত চোখে দেখে নিল আশপাশ। আজ তার ভ্রমণ শুরু। কিন্তু গাছগুলো সব হাতমোজা পরা বেড়ালের মত গুটিয়ে স্থবির হয়ে আছে, বিভ্রান্ত ঘাসেরা কোনদিকে বেড়ে উঠবে বুঝতে না পেয়ে নুইয়ে পড়েছে, আর সবকিছু থমকে গেছে। সব স্থির কেন? তার মত এরাও কি অপেক্ষা করছে একটা কিছু ঘটবার?

এইটুকু ভাবতে না ভাবতেই বাতাসের ক্ষুদে সেনারা পাতায় পাতায় ড্রামের শব্দ তোলে, পাখিরা আর একটা হাঙরদেঁতো বাদুর সমস্বরে কোরাস গাইতে গাইতে বিয়েবাড়ির আমেজ এনে ফ্যালে। এই সব বিতিকিচ্ছিরি স্বাগতম-ধ্বনির মধ্য দিয়ে সূর্যটা স্টেজে উঠে পড়ে। স্বাগতম! স্বাগতম হে সূর্য্যিদেব! সে হাতে হাতে তালি দিয়ে ওঠে। এবার আমার পাহাড়টা দেখাও দেখি? সূর্য তার মনোবাঞ্ছা শুনে প্রাচীন প্রতীকের উন্মোচন ঘটায়, ধোঁয়া সরে যায়, মেঘেরা সসম্মানে দুদিকে সরে পথ করে দেয়। দূর দূর দূউউউর দিগন্তে একটা ঝাপসা ত্রিভুজ ভেসে উঠে। সে হাসে। আহা, আহা সেই প্রিয় ত্রিকোণ সৃষ্টি! জন্মের পর থেকেই যাকে দেখে আসছি আলোয় ভেসে আবির্ভূত হতে, যার চূড়ায় উঠে দাঁড়াবার স্বপ্ন আমার আজন্ম, সেই অপূর্ব ক্ষয়াটে পাথর! এতদিনে আমি যোগ্য হয়েছি, এই আমার হাত-পা-রক্ত-হৃদয়-মন দেখো উন্মুখ, উন্মত্ত; আজ আমি আসব তোমার কাছে। দেখব তোমার প্রতিটি প্রিয় অংশ পরখ করে। সে পা বাড়ায়।

এই কৃষ্ণচূড়ার শ্বাস, এই ভোরের উল্কি প্রজাপতি, এই জীর্ণ অতীত আবাস- সবটা সে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। জানা নেই কত দূরে সেই পাহাড়। জানা নেই কিভাবে যাওয়া যায় সেখানে। কিন্তু এই কি ভাল নয়? জীবনের সাবলীল স্রোতে এমন করেই গা ছেড়ে দিয়ে খুঁজে নেওয়া নিজের রাজ্য। পথ নেই, বানিয়ে নাও। পিঠের ব্যাগে সত্ত্বা তোমার, ভয় কি আর হারাবার। খুঁজে না পাও, চলতে থাকো পৃথিবীর গোলকত্বে বিশ্বাস করে। একদিন সামনে আরাধ্য বস্তু পড়বেই। সে চলতে থাকে। বিশ্বাসে বিশুদ্ধ নিজেকে তার মুক্ত মনে হয়। সামনে এগোও, সামনে এগোও। কোন পিছুটান নেই। সংশয় নেই। সামনে এগোও, সামনে এগোও...

হঠাৎ তলপেটের চাপে তার পর্যটকীয় উদ্দীপনা থমকে যায়। ইস, সে জিবে কামড় দিয়ে ভাবে, সকালে অতি উৎসাহের চোটে সে প্রাতঃকৃত্যের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই ভুলে গেছে। কি বিচ্ছিরি টাইমিং! এতক্ষণে অনেকটা দূরে এসে পড়া গেছে, এখন তো ঘুরে আবার বাসায় যাওয়াও সম্ভব না। সামনেই বড় রাস্তা, একটা পাবলিক টয়লেট দেখা যাচ্ছে, তার সামনে হুড়মুড় করে গিয়ে সে ঠকঠকায়। অন্তঃপুরবাসি গম্ভীর কণ্ঠে হুঙ্কার দেয়, 'কেবল বইছি। কেরা রে ডিস্টাব করে?'

তার মাঝে এবার ত্যাগীয় তাড়াহুড়োর সাথে সাথে ভীতি-ও দেখা দেয়। ওফ খোদা, এ কি জ্বালা হল! এক মিনিট আগেও তো সব ঠিকঠাক চলছিল, মুহূর্তেই সব পালটে গেল কিভাবে? অবশেষে পরিস্থিতি (এবং তলপেটের) চাপে পড়ে সে ভ্রমণের প্রথম সূত্রটি শিখে ফ্যালে- যখন যেমন, তখন তেমন। এরপর দেবদারু গাছের পাতা আর টিউবওয়েলের পানি সহকারে বাকি বস্তুর পাশাপাশি মধ্যবিত্ত লাজশরমও বিসর্জিত হয়।

এবারে কাপড়চোপড় ঠিকঠাক করে সে বড় রাস্তার একপাশে উঠে আসে। আশেপাশে কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না। খালি রাস্তা, ধুলো উড়ছে, রোদ বাড়ছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তার একটু বিরক্ত লাগতে থাকে। কি ব্যাপার, এমন কেন? কেউ কোথাও নেই, এ কেমন কথা হল? সোজা একদিকে হাঁটা ধরবে নাকি? এরকম চিন্তা-ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতে না খেতে হঠাৎ তার পাশে একটা ট্রাক এসে থামল। তারপর নিজেই উঠল, নাকি ট্রাকটাই তাকে তুলে নেয়- আসলে কি ঘটল সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সে ট্রাকের ভেতরে আবিষ্কার করে।

ভেতরে একটা কেমন যেন লুঙিপড়া-পানখোর-নোনা পরিবেশ, ট্রাকঅলা তার সস্তা মোবাইলে মিলিটারি বাদ্য শুনছে আর বাতাসে ভুঁড়ি গোঁতাচ্ছে। পাছার নিচে চামড়ার সিটটায় জান্তব গন্ধ, যেন এইমাত্র কোন নধর বাছুরের চামড়া ছিলে তুলো ভরে সেলাই করে দেওয়া হয়েছে। তার অস্বস্তি লাগতে থাকে। সে উসখুস করে, আশেপাশে চোখ বুলোয়। স্টিয়ারিংটা চকরা-বকরা রঙের গামছা দিয়ে পেঁচানো, ড্রাইভারের পায়ের কাছে ব্রেকপেডালের বদলে বাংলা মদের পরিত্যক্ত বোতল, ড্রাইভারের স্যাণ্ডো গেঞ্জি লেপটে আছে দেহের সাথে। বিভ্রান্ত ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে, গাড়ি সামনে এগোচ্ছে এখন। ড্যাশবোর্ডে পিক ফেলে লোকটা তাকে জিজ্ঞেস করে, 'কৈ যাবেন ভাইডি?' সে একটু ভড়কানো কণ্ঠে জানায় যে দূরের পাহাড়টা তার উদ্দেশ্য।
'দূরের পাহাড়?' লোকটা অবিশ্বাসে মকমকিয়ে হাসে, 'ধুর মিয়া, এইসব কি কন! অইখানে কেউ জাইতে পারে নাকি?'
-কেন, ওঠে না কেউ চূড়ায়?
'নাহ। যে উঁচা, অত কষ্ট করব কে? কেউ যায় না।'
-কিন্তু, কিন্তু আমি যে বেরিয়েছি ওর ওপরে উঠবো বলে? আমি কি করব তবে?
'কি আর করবেন, বেরাইছেন যখন, চলেন শুঁড়িখানায় যাই। বেশি দূরে না, কাছেই; অদের কালেকশন ভাল, মাইয়া মানুষেরও কমতি নাই। হেহে', লোকটা আবার মকমকায়।

যাত্রাপথে সে বারবার প্রতিবাদ করে, বারবার বলতে চায়- না, শুঁড়িখানায় মাতাল হয়ে মেয়েমানুষ নিয়ে পড়ে থাকা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি নিচে পড়ে থাকতে চাই না। আমি চূড়ায় উঠবো। ওখান থেকে বিশ্বজগত দেখব। কিন্তু লোকটা তার কথায় কর্ণপাত করে না। বরঞ্চ সে তাকে গাড়ি চালানোর সবক দেয়। 'গারি চালান লাগে খোলা মনে, আরাম কৈরা। বেরেক করলে গারির ক্ষতি। এই খরগোশ-হরিণ-মানুষ দুই-চারডা সামনে পড়তেই পারে, কিন্তু তাই বইলা গারি থামান যাব না। টান দিয়া আগায়া যাবেন। তাইলে গারি ভাল থাকব। জীবনের ফরমুলাও এইডা, কুন থামাথামি নাই। সামনে আগাও, সামনে আগাও-বুজছেন?' সে বিরক্ত হয়, একটু ভয়ও পেয়ে যায়। লোকটা কি পাগল, নাকি? কি বলছে এগুলো? কিন্তু সিনেমার নায়কদের মত চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে যেতেও তার সাহস হয় না। নিরূপায় হয়ে তাই সে অপেক্ষা করতে থাকে- রাস্তা ফুরোবে কখন। কিন্তু, আয় খোদা! নচ্ছার রাস্তাটাও তেমন সুবিধার নয়, এখানে ওখানে গর্ত, ছোটখাটো পুকুর হয়ে আছে। ট্রাকঅলার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তাতে, সে এসবের তোয়াক্কা না করে চলছে নিজের ইচ্ছেমতন। মাঝখান থেকে বিপদ হচ্ছে তার। এই চাঁদি ঠুকে গেল ছাদের সাথে, এই দুম করে কাঠের জানালার এক কোণা এসে চোয়ালে আপারকাট বসিয়ে দিল; মাঝখান থেকে ঝাঁকিতে ঝাঁকিতে তার ভীষণ বমি বমি লাগতে শুরু করে। পেটের ভেতরে একেবারে যেন প্রতিবাদের স্রোত বয়ে যাচ্ছে একের পর এক।

এরকম বহু বহু প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে যেন কত ঘণ্টা পর, ট্রাকটা থামে। সে টলোমলো পায়ে নেমে আসে। তার সারা শরীর মনে হচ্ছে জখম হয়ে গেছে, মাথা ঘুরছে, চোখে ঘোলা ঘোলা লাগছে সবকিছু। ট্রাকঅলা কিছু বলতে পারার আগেই সে দ্রুত শুঁড়িখানার বিপরীতে যে পায়ে হাটা রাস্তাটা চলে গেছে, সেটাতে সরে আসে। তারপর মাটিতে বসে নিঃশ্বাস নেয় কিছুক্ষণ। ওফ, ভ্রমণে যে এতো কষ্ট করতে হয় কে জানত? আর না বাবা, ট্রাকের ঝামেলায় আর জীবনেও না। চিরদিনের সঙ্গী পা-দুটোর মর্ম অনুধাবন করতে পেরেই হয়তো, সে ঠিক করে- এখন থেকে হেঁটেই পথ চলবে। ভ্রমণের দ্বিতীয় সূত্রই হয়তো এটা- পা দুটোই তোমার সবচে বড় বন্ধু।

ট্রাকঅলা হাতে কঠিন পানীয় নিয়ে তাকে ডাকে, বারের দগদগে ঘায়ের মত বারবণিতারা আদিম প্রবৃত্তি নিবৃত্তির ইশারা করে, কিন্তু তাদের মিটমিটে আলোমুখর ঘাঁটি থেকে ক্লান্তিহীন পথিক মুখ ফিরিয়ে নেয়। যাত্রা শুরু করে মেঠো অনিশ্চিতে।

রাত কেটে যায়। সে হাঁটে। বিষাক্ত সরীসৃপের নাগাল এড়িয়ে, ক্ষুধার্ত দানবের এলাকা পেরিয়ে, সে এগোয়। ধীরে কিন্তু নিশ্চিন্তে চলতে চলতে প্রথমবারের মত সে ভ্রমণের আরেকটা দিক খুঁজে পেতে থাকে। এতক্ষণ পর্যন্ত সে স্রেফ দেখেছে, মাড়িয়ে এসেছে পথ; কিন্তু অনুধাবন করে নি কিছুই, বুঝতে পারেনি প্রতিটা জায়গার নিজস্ব সৌন্দর্য থাকে। শহর, গ্রাম, অরণ্য - সবাই নিজস্ব উপায়ে সুন্দর। শহরের একেকটা গগনচুম্বী দালানে কি মানুষের চিরন্তন আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে ফুটে ওঠে না? মানুষের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য তার শহরগুলো, যেখানে জীবন আশ্চর্য অভিযোজনে ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি একক কৃত্রিমতায়। অরণ্যে এই জীবনের সৌন্দর্য আরও বহুগুণে বিবর্ধিত হয়ে ওঠে যেন। এখানে জীবন প্রাচীন, আদিম, খাঁটি। চারিদিক অন্ধকার নেমে এলেও, নিস্তব্ধ নয়। অজানা, অসাধারণ, অবর্ণনীয় শব্দে মেতে আছে বনভূমি। নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এই অদ্ভুত সৌন্দর্যে তার মনে হয়, যেন প্রকৃতিপ্রদত্ত তৃতীয় নয়ন সে হারিয়ে ফেলেছিল, আজ এই স্থিরজ জীবনের সংস্পর্শে এসে তার সেই চোখটি খুলে গেছে, আজ সে সত্যিই 'দেখছে'।

তন্ময় হয়ে হাঁটতে হাঁটতেই চাঁদ অদৃশ্য হয়ে সূর্য আবার ওঠে, সে পাহাড় দেখে নিজের পথ ঠিক করে নেয়। আশেপাশের জঙ্গল এখন অনেকটাই ফরসা হয়ে আসছে, এখানে ওখানে মানুষের বসবাসের চিহ্ন ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। অরণ্যদেবের সাম্রাজ্য এখন শেষ, সামনে তিনি মানবজাতির সাথে সহাবস্থানে আছেন। একটা টিনের ঘর দেখা গেল। খড়ের ভেজা গাদা। আর্দ্র মাটিতে খুর দাবিয়ে গরু ঘাস চিবোচ্ছে। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে তার মানে। সে বুঝতে পারে নি কেন? এতোটাই কি মগ্ন হয়ে গেছিল যে প্রকৃতির স্নান তার চোখে পড়ে নি? কিছুটা ভেবে সে চিন্তাটাকে নাকচ করে দেয়। বর্ষাকালের বৃষ্টি নিয়ে একটা কথা আছে না- 'নৌকার আগা ভিজে তো পাছা ভিজে না'; হয়তো সেরকম বৃষ্টি হয়েছে। সে বাসাটাকে পাশ কাটিয়ে এগোতে থাকে।
এরপর পরের গ্রামটাকে পার হয়ে আসে।
তারপর পরেরটা।
পরেরটা।
পরেরটা।
হাঁটতে হাঁটতে তার খিদে লাগে একসময়। একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তার বড় বড় চুল-দাড়ি দেখে তারা কি ভাবে কে জানে, কিন্তু অন্ততঃ ডাল-ভাত জুটে যায়। মেলামাইনের প্লেটে নোংরা নখের আঁচড় কেটে সে খায়। একটু ঘুমিয়ে নেয় কাঁঠালগাছটার নিচে। হয়তো বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে গল্প করে কিছুক্ষণ। তারপর আবার, চলো, সামনে চলো। লোকালয় থেকে লোকালয় সে পার হয়ে এগিয়ে যেতে থাকে পাহাড়ের দিকে, একটু একটু করে। সে দেখে --
কৃষকেরা হাসিমুখে গান গাইতে গাইতে কাজ করছে জমিতে।
প্রাইমারি স্কুলের সামনে দলবেঁধে খেলছে শিশুর দল।
নারীরা ঘরের সামনে উঠোনে বসে সুঁই-সুতোয় গাঁথছেন স্বপ্ন।
যুবকেরা গল্প করছে মুদির দোকানের সামনে বসে।
তার ক্লান্তি লাগে না। একেকটি চেহারা যেন একেকটি সম্ভাবনা হয়ে তাকে উদ্দীপ্ত করতে থাকে। প্রকৃতির এত কাছে মানুষগুলো, এরা কখন যে প্রকৃতির একটি অংশ হয়ে গেছে- তা তারা নিজেরাও হয়তো জানে না। তারা কি জানে, তাদের এতো কাছে একটি মহান, শিলাদৃঢ় সৃষ্টির বসবাস? তার কৌতূহল হল। বুড়ো বটগাছটার নিচে একজন স্থবির মানুষকে পেয়ে সে ধরে বসল, আচ্ছা, পাহাড়টায় এপর্যন্ত এ গ্রামের কেউ উঠেছে?
-'কিসের পাহাড়?', লোকটা বিরক্তই হয় যেন।
ওই যে, সে আঙুল তুলে দেখায়, ওই বিশাল পাহাড়টায়। কেউ উঠেছে?
-'না বাবা, কে যাবে অতসব ঝক্কি-ঝামেলায়! আমাদের তো সংসার চালাতে হয়, অকাজে ঘুরঘুট্টি কাটলে চলবে নাকি!'
এদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব তাকে হতাশ করে, কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারে না। সত্যিই তো, তার কোন বাঁধন নেই, নোঙরছাড়া সে ঘুরতে পারছে ইচ্ছেমতন; কিন্তু এরা তো আটকে গেছে বিশ্বচরাচরের পান্থশালায়। পথে নামার সুযোগ তাদের দেওয়া হয়নি। পথিক ভাবে, সত্যি সে সৌভাগ্যবান!

পথে বেশিক্ষণ চলতে থাকলে ছোট ছোট বিষয়গুলো একসময় গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। ক'দিন পর দেখা যায়, এখন কয়টা বাজে, আজ কত তারিখ, কি বার- কিচ্ছু মনে নেই। সূর্য ওঠে, ডোবে, রাত আসে, যায়- একটা চক্র। এতে দেখার আনন্দ আছে, গোণার যৌক্তিকতা নেই। মানুষ যে অদ্ভুত উপায়ে সময়কে মাপতে চায়, পথ তার ঘটায় বিলুপ্তি। দাড়ি কাটা হয়নি কতদিন, কুটকুট করত প্রথম প্রথম, এখন কিছুই মনে হয় না। আছে, থাক না। কাটার কি দরকার। চোখের সামনে প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট, নতুন কিছু দেখছে সে প্রতিদিন। বেশভূষো নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়? এখন জীবনের অসীমপদী সমীকরণ থেকে নিজেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নেবার পালা। রাস্তার পাশে পুকুরে মুখ ধুতে গিয়ে সে নিজেকে দেখে। শুকিয়ে যাওয়া নোংরা একটা মুখ। কিন্তু চোখদুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। অভিজ্ঞতার ফল কি এটা?

আচ্ছা, শেষ কবে ভালমত সাবান-টাবান মেখে সে গোসল করেছিল? ভাবতে গিয়ে তার হাসি পায়। কম হলেও বিশ-পঁচিশ দিন হবে। এসব নগণ্য বিষয়কে আসলে গুরুত্ব দেবার মানে হয় না। মহান উদ্দেশ্য নিয়ে তার যাত্রা, দুএকটা নোংরা জামা আর অন্তর্বাসের জন্য তাতে কি ছেদ পড়তে পারে? খুব বেশি অস্বস্তি লাগলে থামো, ব্যাগের ভেতরে হাতাও। যে কাপড় থেকে সবচে কম গন্ধ আসছে, সেটা বের করে পরে ফ্যালো। ব্যাস, সমস্যার সমাধান। সে গায়ের জামাটা টেনে ধরে একটু শুকে দেখে। এই যে অদ্ভুত ঘাম-ধুলো-ভ্রমণজীর্ণ গন্ধটা আসছে- এ হল স্বাধীনতার ঘ্রাণ। স্বয়ং স্বাধীনতা তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। সে হৃদপিণ্ডে হাত রাখে। ঢিবঢিব, ঢিবঢিব। পরম মূল্যবোধ, পরম সৌন্দর্য, পরম মুক্তি পূর্ণতা পাচ্ছে এইখানটায়। এসব ভাবতে ভাবতে সে সামনে এগোয়, এবং হঠাৎ আবিষ্কার করে- সে পৌঁছে গেছে পাহাড়ের পাদমূলে।

অবাক হয়ে সে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে এই মহান প্রাচীন সৃষ্টিকে। অভিজ্ঞতা তাকে বাস্তবমুখী করেছে, তাই ফাঁপা নান্দীপাঠ না করে সে বিস্ময়মাখা চোখে এই বৃহৎ শিলাস্তম্ভকে দেখে, মনে মনে শ্রদ্ধা জানায়। পাহাড়ের একেকটি অগভীর ফাটলে পা রেখে, একেকটি চিড়ে আঙুল ঢুকিয়ে সে একটু একটু করে উপরে উঠতে শুরু করে। হাতের আঙুলগুলো ছড়ে যাচ্ছে, হড়কে যাচ্ছে পা, থরথরিয়ে কাঁপছে দেহের প্রতিটি পেশি, কিন্তু সে থামে না। অমানবিক কোন যন্ত্রের মত নিখুঁত বিশ্বাসে, যান্ত্রিক দক্ষতায় তার আঙুলগুলো খুঁজে নেয় সাময়িক আশ্রয়। বাতাস তার শত্রু, সে চায় না পাহাড়ের চূড়োয় অন্য কারো প্রবেশাধিকার থাকুক, এমনকি তার নিজের ঘাম নিজের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে চায়। কিন্তু সে থামে না, কালো পাথরের ওপরে চামড়ার চর জাগিয়ে পাহাড়ের অন্তরাত্মার সাথে মিশে যায়। ঠিক প্রকৃতির মতো করে। কত রাস্তা তাকে পাড়ি দিতে হল, কত ব্যথা সয়ে, কত ভুল শুধরে সে এসেছে এতদূর- এই যাত্রাপথে তাকে সবচে বেশি অবাক করেছে, ভালবেসেছে এই প্রকৃতি। নতুন কিছু শিখিয়েছে। পাখিদের গান, ফুলের ঘ্রাণ, পাহাড়ের গা বেয়ে ছলকে পড়া জলস্রোতের ফেনা- এরা যেন তার কতকালের বন্ধু, আপন, প্রিয়জন। এদের স্নিগ্ধতাকে পুঁজি করে সে শেষ খাড়া ঢাল-টাকেও পেরিয়ে আসে, তারপর পেশির ওপর শেষবারের মত শক্তি খাটিয়ে উঠে পড়ে চূড়োয়।

পথিক এবারে একটা সমতল পাথর বেছে নিয়ে বসে পড়ল তার ওপর। ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি কাপড় ভেদ করে চামড়া স্পর্শ করে, কিন্তু সে আমলে নেয় না এসব। তার চোখ তখন নিচের সমতলে। সূর্য উঠছে এখন, গাছের পাতায় পাতায় তার রশ্মির মোলায়েম ঝলকানি। বাতাস এখন সন্ধি করতে চাইছে, মৃদুমন্দ পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে সারা গায়। দূরের একটা নদী হিরেখচিত রূপালি ফিতের মত ঝকঝক করে উঠছে। সূর্যের একটা একাকী রশ্মি এসে তার গালে মিশে যায়। পথিক বিভ্রান্ত হল। এই জিনিস, এই দৃশ্য দেখার জন্য সে জন্মের পর থেকেই অপেক্ষা করছে, কত শত পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। কিন্তু নিজেকে তার অর্থহীন মনে হচ্ছে কেন? কেন এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য সে উপভোগ করতে পারছে না?

বিষাক্ত সাপের মত সংশয় তার হৃদয়ে ফণা তুলতে থাকে। প্রশ্নেরা মাথাচাড়া দেয়। সৌন্দর্য কি? কেন এই পরিবেশকে আমি সুন্দর বলব? আসলেই প্রকৃতি কি সুন্দর, স্নিগ্ধ?

তার মনে হতে থাকে, প্রকৃতি আসলে গলা-কাটা নীতিতে বিশ্বাসী। সে শক্তের ভক্ত, নরমের যম। হিংস্র বাঘেরা ছিঁড়ে নিচ্ছে সুন্দর হরিণীর গলা, ছদ্মবেশি আগ্নেয়গিরি হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে রক্তে-ছাইয়ে-লাভায় ভাসিয়ে দিচ্ছে জনপদ, জলোচ্ছ্বাস-সুনামি-বন্যা কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার প্রাণ। কিন্তু প্রকৃতি বললেই আমাদের মাথায় আসে ডালে ডালে গান গাইছে পাখি, ফুটছে ফুল। এমনকি ওই পাখিরাও আনন্দে নয়, বরঞ্চ দেহজ চাহিদা-কামনা-বাসনা পূরণ করতেই ডাকছে সঙ্গীকে। এতো সহিংসতার মাঝে, কামের মাঝে কিভাবে প্রকৃতি তার শান্তিময়ী রূপটাই তুলে ধরে? পাহাড়ের ঝর্ণা দেখে আমাদের মুখ হা হয়ে যায়, কিন্তু লোকালয়ে এই ঝর্ণারই অবহেলিত, দূষিত সন্তান নদী কেন আমাদের চোখে পড়ে না? কে বলেছে এই পাহাড়-সমুদ্র-নদীরাই মাপকাঠি, একে কেন সৌন্দর্য বলবে সে? সৌন্দর্যের মূল্য কি? মঙ্গাপীড়িত একজন মানুষ কোনটা বেছে নেবে- সৌন্দর্য না স্থুল খাদ্য? রোগী কোনটা বেছে নেবে- পিকাসো না পেনিসিলিন? বস্তুর ওপরে তত্ত্বকে, ভাবকে বেছে নেবার পেছনে কোন যুক্তি নেই। সৌন্দর্য স্রেফ মানুষের একটা জিনিসকে বাড়িয়ে-চাড়িয়ে দেখার অপক্ষমতার প্রকাশ। প্রেমিকার চোখে কে কবে দেখেছে প্রেম, বিশ্বাস, ভালবাসা? ওসব ফাঁকি। আবর্জনা। মিথ্যে স্তুতি। আমরা নিজেদের কোন না কোন প্রয়োজন মেটাতে খাই-হাগি-বাচ্চা পয়দা করি-মরে যাই, এটাই সত্য। এর পেছনে আর কোন গভীর মহান তত্ত্ব নেই। আর এ ব্যাপারটা যারা মেনে নিতে পারে নি, তারাই পালিয়ে বেড়ায় সাহিত্য নিয়ে, সৌন্দর্য খোঁজে তারাই।

তার আগের কথা মনে পড়ে। সে এখন বুঝতে পারে সব। মাঠে সে যেসব কৃষকদের দেখেছিল, তারা গান নয়- আসলে বিলাপ করছিল। সময়মত সার পায়নি, ফলন হবে না, ঋণ শোধ করতে পারবে না, হয়তো বাপের ভিটেটা হারাতে হবে; এই ভয়ে তারা কাঁপছিল। রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে দলবেঁধে এসেছিল বুভুক্ষু খরাপীড়িতের দল, নামেমাত্র দরে জমি বেঁচে প্রাণ বাঁচাবে বলে। যে শিশুর দল খেলছিল, তারাই ক'দিন পর পেটের দায়ে নামবে জীবনযুদ্ধে। গ্রামের মেয়েগুলো সবাই মিলে তখন একত্র হয়ে যুক্তি করছিল গার্মেন্টসে কাজ করতে ঢুকবে কি না। বেকার যুবকের দল আসলে টাকার ভাগ বাটোয়ারা করছিল, সদ্য সন্ত্রাসের হাতছানিতে সাড়া দিয়েছিল কিনা! দেখার চোখ ছিল না তার, বুঝতে পারেনি এতদিন।

সৌন্দর্যের কুৎসিত স্বরূপ উন্মোচন করতে পেরে এবারে পথিক কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করল। তারপর সে চারিদিকে তাকায় আবার। নতুন চোখে, নতুন বিশ্বাসে। এতদিন যেসব জিনিস দেখে সে কুঁকড়ে গেছে, যাদের সম্মুখীন না হয়ে পালিয়ে বেরিয়েছে, তাদের ভেতরের পবিত্রতা দেখতে পায়। হঠাৎ তার অস্থির লাগে। সত্য উন্মোচন করতে আর কতটা ভেতরে যেতে হবে তার? আর কত মিথ্যে ভাবনা, যুক্তি ছড়িয়ে আছে জীবনে, কতগুলোর মুখোশ খুলে দেখবে সে? তার হাতে অস্ত্র নেই, নাকি না, আছে তো! যুক্তির ধারালো তলোয়ার আছে তার কাছে! চারিদিকের ঘনিয়ে আসা ঘন কালো আঁধার আর দর্শনের ভুল-ভ্রান্তির সাথে সে এই তলোয়ার বাগিয়ে লড়তে শুরু করে।

সে ভাবল, যুক্তিবাদি মানুষ মাত্রই জানে, আসলে জীবনের কোন সার্থকতা নেই। কোন মানে নেই। আমাদের কেউ বাঁচে অনেকদিন। কেউ বাঁচে কম। কারো ক্ষেত্রে সুখের পাল্লাটা একটু ভারি, কারো ক্ষেত্রে দুঃখের। কিন্তু দুঃখের পাল্লা কখনো খালি হয় না। তুমি বাঁচতে চাও, তোমাকে আগুনে পুড়তে হবে। মানিয়ে নিতে হবে নিজেকে। কেন? এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই। ধর কোন খেয়ালি বালক নতুন একটা খেলনা পেল, একটা আতসি কাঁচ। কাছেপিঠে পিঁপড়ে দেখে সে একটাকে বিনা কারণে পুড়িয়ে ফেলল সূর্যের আগুনে। আমরা সবাই সেই পিঁপড়েটা। জীবন একটা দুঃস্বপ্ন, একে পাড়ি দিতে গেলে ভুগতে হবেই, চাও বা না চাও। আর এত ভোগান্তির পরও, মরতে হবেই। এ থেকে মুক্তি নেই কোন। সৃষ্টির পর থেকে কত কোটি কোটি মানুষ এসেছে এই গ্রহে, তাদের কয়জনকে আমরা মনে রেখেছি? ভাস্করাচার্য, সক্রেটিস, নিউটন, আইনস্টাইন, মোজার্ট- আর কয়জন? বাকি যারা মনে রাখার মত কিছু করতে পারেনি, তারা মরে গেছে। হারিয়ে গেছে মহাকালের মৌনতায়। আমরাও এমন করেই হারিয়ে যাব, যত ভুয়ো অর্জন, সম্পর্ক, ভালবাসা হারিয়ে যাব তার সাথে সাথে। জীবন একটা অসুস্থ লড়াই, একটা পাতানো খেলা, যার ফলাফল একটাই- পরাজয়।

তাহলে লড়ে কি লাভ? কি লাভ অযথা বেঁচে থেকে? এই বিকট রসিকতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান, শেষ হাসি হাসার জন্যে একমাত্র করণীয়- মৃত্যু। নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলা। এই উপসংহারে পৌঁছে পথিক বাকহারা, নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। সে নিজের আত্মার ভেতরে উঁকি মেরে দেখল, প্রতিটি আবেগ, প্রতিটি বিশ্বাসের ভিতে টোকা মেরে পরীক্ষা করল। তার মাঝে এই কাজটা করার ক্ষমতা আছে?
সে কি পারবে?

এই দ্বিধা, এই ভয় তাকে ক্লান্ত করে ফেলল। ক্লান্তি রূপ নিল বিভ্রান্তির। সে কি এখন বেঁচে আছে, না মরে গেছে? কে তাকে চালাচ্ছে, প্রবৃত্তি না প্রকৃতি? বিভ্রান্তি থেকে এলো ভয়। যেন তার চারিপাশে কালো কুচকুচে এক দেয়াল তুলে দেওয়া হল। সূর্য উধাও হয়ে গেল। গলিত লাভার মত গরম আর ধূসর-কালো ছাই তার নাকে মুখে শরীরে ঢুকে আঁকড়ে ধরল আষ্টেপৃষ্ঠে। পোড়াতে লাগল তাকে। হাজার চেষ্টা করেও সে নড়তে পারল না, যেন সহস্র শেকলে বেঁধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে তাকে। কালঘড়ির তীক্ষ্ণ কাঁটা ঘুরে এলো এক পাক, একটা লাভার ফোঁটা পড়ল তার গায়ে। তারপর ঘুরল আরেক পাক। আরেকটা ফোঁটা। আরেক পাক। আরেক ফোঁটা। এভাবে কেটে গেল কত সহস্র কোটি বছর। দিনগুলো তার জখম হওয়া শিরার ভেতর দিয়ে, পায়ের ওপর দিয়ে শিরশিরিয়ে পার হয়ে যেতে লাগল। নিস্তব্ধ মহাবিশ্বে একটি মাত্র একক নিঃসঙ্গ শব্দ শোনা যেতে লাগল- 'টপ' 'টপ' 'টপ', লাভা গড়িয়ে পড়ছে নিশ্চিন্ত নৃশংসতায়। ফোঁটাগুলো ধীরে ধীরে একটা ছোট্ট পুকুর হয়ে গেল। পুকুর থেকে স্রোত। স্রোত থেকে ঝর্ণা। এরা ঢুকে যাচ্ছে তার আত্মায়, ছাই করে দিচ্ছে তার বিশ্বাস, স্মৃতি; শুষে ক্ষয় করে নিচ্ছে তাকে। চিৎকার করতে করতে একটা সময় তার চোয়ালের হাড় ভেঙে গেল। হঠাৎ এক মুহূর্তে অন্ধকারের এই গহ্বর থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে সমস্ত ইচ্ছেশক্তি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর বিনা দ্বিধায় লাফিয়ে পড়ল পাহাড়ের সেই সুউচ্চ পবিত্র চূড়া থেকে। সে আর দুঃস্বপ্নে বাঁচতে চায় না।

পড়তে পড়তে তীব্র বাতাস থেকে চোখ বাঁচিয়ে সে কল্পনা করতে থাকে, এই এখনি শেষ হয়ে যাবে সব। থ্যাচ করে মাটিতে তার মাথাটা পড়বে আগে, কিছু অনুভব করার আগেই, মুক্তি। বিজয়ীর হাসি হেসে সে চোখ বোজে। হাতটা বুকের কাছে গুটিয়ে আনতেই হঠাৎ তার মনে হয়, জামাটা এত মসৃণ, মোলায়েম লাগছে কেন?!

সে অবাক হয়ে চোখ মেলে এবং, হা ঈশ্বর! তার গায়ে ধবধবে সাদা কটনের শার্ট! আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে সে শুধু ধূসর, শূন্য দেয়াল দেখতে পায়। এসব কি? এসব কি?? কালো আকাশটা কই, পাহাড়টা কই? সূর্যটাও নেই, তার বদলে সিলিঙয়ের সাথে লাগান একটা টিউব লাইট থেকে সাদা আলো আসছে। হা খোদা, তবে কি মুক্তি মেলে নি? সে এখানে কেন? কোথায় সে???

এতসব প্রশ্নের মাঝে অতর্কিতে তার মনে পড়ে যায় সবকিছু। এই অপ্রত্যাশিত স্মৃতির স্রোত এসে তাকে, তার সম্পূর্ণ সত্ত্বাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ডুবিয়ে দেয়। তার দমবন্ধ হয়ে আসে।
ভয়ে, হতাশায় সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে।
শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করে, লড়ে।
ভেঙেচুরে ফেলতে চায় সবকিছু।
মিনতি করে, মেরে ফেলো আমাকে, মেরে ফেলো!
এবং হাতপায়ের সকল শক্তি হারিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।

***
'স্বর্ণা, ওর নাম আসিফ', বৃদ্ধা নার্স তার নতুন সহকর্মীকে পরিচয় করিয়ে দেয়, 'আসিফ খুব ভাল ছেলে, তাই না, আসিফ?' ভাল ছেলে 'আসিফ' মাথা নাড়ে, হাসে। তারপর আবার খুব মনোযোগের সাথে নিজের তলপেটের লোম টানতে থাকে। মধ্যবয়েসি একজন লোক থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে এই কাজ করছে, জিনিসটা দেখতে স্বর্ণার খুব অস্বস্তি লাগে। সে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়, 'আপা, সামনের সেলে কোন পেশেন্ট থাকে?'
-'ফরটি থ্রি। নাম জানি না।'
স্বর্ণা একটু এগিয়ে গিয়ে উঁকি দেয়, 'আরাম করে ঘুম দিচ্ছে। দেখে তো শান্তই মনে হয় বেচারাকে।'
-'ঘুমোচ্ছে না, ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।'
ও অবাক হয়, 'কেন?'
-'আধঘন্টা আগে বিকট এক চিৎকার শোনো নি? গলার রগ ফুলিয়ে ফুলিয়ে চিল্লাচ্ছিল। তারপর কিছুতেই ইঞ্জেকশন নেবে না, জোর করে দিতে হয়েছে। বয়স হলেও গায়ে শক্তি আছে বটে লোকটার।'
স্বর্ণা মনে মনে ভাবল, অদ্ভুত তো! কে কেমন মানুষ দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে। অন্য একটা জগত! 'আচ্ছা, এর সমস্যাটা কি?'
'কেউ জানে না। লোকটা অনেকদিন ধরে আছে এখানে, আমি আসার আগে থেকে, তাও প্রায়', নার্স আঙুল গোণে, 'হুম, প্রায় তেতাল্লিশ বছর হবে। প্রথমদিন থেকে একই রুটিনে চলছে। সকালে একেবারে সুস্থ মানুষের মত আচরণ করে, দেখলে বুঝতেই পারবে না এ মেন্টাল পেশেন্ট। দুপুর থেকে তার বিড়বিড়ানি-ফিসফিসানি শুরু হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরের একোণ থেকে ওকোণ সমানতালে পায়চারি করতে থাকে। ওই যে, হেড নার্স আছে না, তখন উনি ছাড়া আর কারো কথা শুনতে চায় না।'
'বেশ ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার দেখছি', স্বর্ণা মন্তব্য করে।
-'আসলে অনেকদিন ধরে আছে তো, সবার একটু মায়া পড়ে গেছে। কত চিকিৎসা করা হল, লোকটার তবুও কোন উন্নতি ঘটল না। খারাপ লাগে দেখলে। এরকম কেস দেখলেই মনে হয়, আসলে মানুষের মস্তিষ্ক সম্পর্কে নিয়ে আমরা কত কম জানি!'
'তা ঠিক', সে সম্মতি জানায়। হঠাৎ তার একটু খটকা লাগে, 'আচ্ছা আপা, রুটিনের কথাটা কি বললেন?'
-'মানে, লোকটা প্রতি দুপুরে একই শব্দ বিড়বিড় করে, কি ভ্রমণ নিয়ে কি সব হাবিজাবি যেন বলে। প্রতিটা বিকেলে মেঝে থেকে খাট বেয়ে ওঠার চেষ্টা করে, আর রাতে এই সময়টায় পুরো পাগল হয়ে যায়, হেভিলি সিডেট করে রাখতে হয়। পরের দিন আবার এই রুটিনের পুনরাবৃত্তি। এরকমই চলছে বছরের পর বছর।'

'আল্লা, কি কষ্টে আছে লোকটা', স্বর্ণা শিউরে ওঠে, 'শুনে মনে হচ্ছে যেন একটা বাজে দুঃস্বপ্নের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে, আর বেরোতে পারছে না। ইস!'

***
ব্যাগে সামান্য কিছু জামাকাপড় এবং পকেটে নামেমাত্র টাকা-পয়সা নিয়ে যখন সে বাইরে পা ফেলল, তখন দুনিয়াটা সিগ্রেট খাচ্ছিল। কমদামি জিনিস, নিকোটিন নেই বললেই চলে। কিন্তু ধোঁয়া, সে কি ধোঁয়া, বাপস রে! চারিদিকে সাদাটে আঁধার জাঁকিয়ে বসেছে যেন। সে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বুক ফুলিয়ে ফেলল, তারপর মুক্ত চোখে দেখে নিল আশপাশ। আজ তার ভ্রমণ শুরু...

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৪ বিকাল ৪:০২
৪১টি মন্তব্য ৪১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠিক কোন বিষয়টা মৌলবাদী পুরুষরা শান্তি মত মানতে পারে???"

লিখেছেন লেখার খাতা, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৭


ছবি - গুগল।


ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম এখন আর শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়, রোজগার এর একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্মও। একটু স্মার্ট এবং ব্রেন থাকলে ফেসবুক/ইনস্টাগ্রাম থেকে রোজগার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

×