somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ ব্যাধিবৃত্ত

১৩ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
মোশতাক আহমেদ স্বপ্ন দেখছেন।

স্বপ্নে তিনি ফিরে গেছেন সেই ছোটবেলায়। রান্নাঘর থেকে কী সুন্দর ঘ্রাণ আসছে! লোভ সামলানো যায় না, পেট চনচন করে ওঠে ছ’বছরের মোশতাকের। চুপিচুপি ঢুকে মুঠিপিঠায় হাত দিতেই আম্মা দেখে ফেলেছেন, পিছু ডাকছেন, 'মুশু, এই পাজি, থাম থাম!' আর ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে পুরো ঘরবাড়ি মাথায় তুলে দৌড়ুচ্ছে। হাঁড়িপাতিল উল্টে পড়ছে ঝনঝন, কাঁচের গেলাস-বাটি ভাঙছে তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে, আম্মা বকছেন – মুশুর মনে হচ্ছে সে আজীবন এরকম দৌড়ে যেতে পারবে, পায়ের নিচে বিদ্যুৎচমকের মত পার হয়ে যাবে শহর, প্রান্তর, নদী, পাহাড়।

হঠাৎ পা পিছলে যায় মুশুর। প্রচণ্ড গতির ঝোঁক সামলাতে না পেরে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাটিতে, দু'বার ডিগবাজি খাওয়ার পর সবুজ প্রান্তরের ঘাসে ঘেঁষটাতে ঘেঁষটাতে এসে অবশেষে গতি রহিত হয়। মুশু ঘাসে মুখ ডুবিয়ে পড়ে থাকে, ঘাস তার কানে ফিসফিস করে বলে - 'ওঠেন, ওষুধ খাওয়ার সময় হৈছে।' মুশু কথা বুঝতে না পেরে বলে, 'উঁ?'

ঘাসের তাতে মেজাজ আরও গরম হয়, চীৎকার করে বলে, 'উঠেন! ওষুধ খাওয়ার সময় হৈছে, বুঝেন না বাংলা কথা?”


মোশতাক আহমেদ চোখ মেলেন। নার্সিং হোমের মেয়েটা চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মোশতাক আহমেদের অসহায় লাগে। মেয়েটা জানে তার শরীরের একপাশ সম্পূর্ণ প্যারালাইজড, তিনি গত পাঁচ বছরে একবারও নিজের শক্তিতে বিছানা থেকে পিঠ তুলতে পারেন নি। তাকে ধরে ওঠাতে হবে, বালিশ গুঁজে হেলান দেওয়াতে হবে, তারপর বাকি কাজ। সবই মেয়েটা জানে। তবুও কেন এমন খারাপ আচরণ করে?

সে মোশতাক আহমেদকে ওষুধ খাওয়ায়, অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে বিরক্ত মুখে স্টীলের গ্লাসে পানি এগিয়ে দেয়। গ্লাসের কিনারা গিয়ে উনার ঠোঁটে-মাড়িতে ঘা মারে, তিনি নিঃশব্দে সহ্য করে নেন। তারপর শুইয়ে দিতে শুরু করলে শোয়ানোর সময় বেডের ধাতব মাথার সাথে তার মাথা ঠুকে যায়, তিনি এবারে থাকতে না পেরে অজান্তেই ‘উহ!’ করে ওঠেন, মেয়েটা কোন অনুভূতি প্রদর্শন করে না। কাজ সেরে নির্বিকার মুখে ট্রলি নিয়ে পাশের বেডে চলে যায়।

মাথার ওপরে ঢিমেতালে পাখা ঘুরছে। তিনি সেদিকে অনেকক্ষণ চুপ করে চেয়ে থাকতে থাকতে আত্মহত্যার কথা ভাবেন।

মানুষ কেন বেঁচে থাকে?

কারণ জীবন মূল্যবান। একবার হারিয়ে ফেললে আর পাওয়া যায় না। তাই? নাকি জন্ম নেওয়া মানেই দুনিয়ার সাথে, খোদার সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া; মেমোরেণ্ডাম অফ আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং উইথ গড। এই এই দায়িত্ব, এই এই কর্তব্য এখন তোমার ঘাড়ে – যাও, মৃত্যুর আগ অবধি পালন করতে থাকো। আর যতই জীবন তোমার নরক-সম হোক, যতই ঝড়-ঝঞ্ঝা-দুঃখ-কষ্ট আসুক না কেন, নির্ধারিত সময়ের আগে যদি নিজেকে মেরে ফেলো, তাহলে কিন্তু চুক্তি ভেঙে ফেলা হলো।

আর চুক্তিভঙ্গকারীর শাস্তি হবে ভয়ানক। সুতরাং খুব সাবধান! বেঁচে থাকো মাটি কামড়ে!

মোশতাক সাহেব জীবনে বারংবার নিজের সাথে এই কথোপকথনের সম্মুখীন হয়েছেন। বারবার ভেবেছেন আত্মহত্যার কথা। সাহসে কুলায় নি।


আট বছর বয়সে আব্বা-আম্মা দুজনেই মারা গেলেন। চাচার বাড়িতে আশ্রয় মিললো। চাচাতো দু’জন বড়োভাই ছিলো, মোশতাকের চেয়ে পনেরো আর সতেরো বছরের বড়ো। এরা ওকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন খেলা খেলতো। ক্রিকেট, ফুটবল, বরফ-পানি; মাঝেমধ্যে বাড়িতে কেউ না থাকলে ঘরের মধ্যে কুস্তি। কাপড়চোপড় খুলে এমন কুস্তি খেলাটা ভালো লাগতো না মোশতাকের। সে ছোট মানুষ, শক্তিতে পারতো না। আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কুস্তি খেলায় সবসময় হারতো। হারলে হারু পার্টির কাজ ছিল হাঁটু গেড়ে বসে চোখ বন্ধ করে জিভ বের করে থাকা, আর তাতে জিতা পার্টি তখন বাম হাতের বুড়ো আঙুল ঘষে দেবে। ওর ভাইয়েরা আদেশ করেছিল এই খেলার কথা কাউকে না বলতে। কুস্তি খেলায় অনেকে ব্যথা পায়। চাচা শুনলে নাকি মোশতাক-কেই বকবেন।

রাতে তিন ভাই একসাথে ঘুমাতো ওরা। মোশতাক একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়তো, মাঝেমধ্যে গভীর রাতে দেখতো তার শরীর পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরেছে ভাইদের কেউ, ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে তারা নিচুস্বরে প্রশংসা করতো - মোশতাকের শরীর কতো নরোম, দেখলেই হাতে চটকে দিতে ইচ্ছে করে। মোশতাকের ঠোঁট নাকি ঠিক মেয়েদের মতন। মোশতাক কি জানে একটা ছেলে একটা মেয়েকে বিয়ে করলে তারা কিভাবে চুমু খায়? তারপর কি করে?

মোশতাকের অনেকগুলো সকাল শুরু হতো ফুলে যাওয়া ঠোঁট আর শরীরের এখানে ওখানে কামড় নিয়ে। এমন দিনগুলোতে অসুখের ভান করে চাচা-চাচির কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতো ও। ভাইয়েরা মিষ্টি এনে দিতো, মোশতাক-কে মেলায় নিয়ে যেত। তখন আর কান্না পেতো না ওর।

ইস্কুল জীবনে ভালো কোন বন্ধু হয় নি ওর। ভাইয়েরাই বেস্ট ফ্রেণ্ড ছিলো। তাদের বাইকের পেছনে বসে এলাকা ঘুরেছে, তারা প্রেম করলে ডাক-হরকরার দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি টানা শিখেছে। ইস্কুলের গণ্ডি পার করে ভিন্ন শহরের কলেজে উঠে যখন মোশতাক অন্য মানুষের সাথে মিশলো, আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলো তার সাথে কি ঘটতো, তখন ছেলেটা কাউকে কিছু বলতে না পেরে বাথরুমের দরজা আটকে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলো, মরে যেতে চেয়েছিলো। আত্মঘৃণার, আত্মহত্যার এহেন বিষাক্ত ঘোর থেকে বেরুতে অনেকদিন সময় লেগেছিল ওর; কিন্তু ততোদিনে ক্ষতি যা হবার, হয়ে গেছে। ভেতরে একটা কিছু ভেঙে গেছে মোশতাকের, চোখে সেই দ্যুতিটা নেই, হাসিতে সেই প্রাণ নেই।

চাচা-চাচী বারবার আফসোস করতেন, ভাস্তে দূরে সরে যাচ্ছে; বাড়িতে আসে না, কথা বলে না। মোশতাক যখন টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ নিজেই চালাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো, চাচীকে জানালো, চাচী অভিমান করেছিলেন ভীষণ। ওকে অকৃতজ্ঞও ভেবেছিলেন হয়তো মনে মনে। ও কিছু ব্যাখ্যা করে বলতে পারে নি। কি বলবে?

এরপরে ঈদে ও মাঝেমধ্যে যেতো চাচার বাসায়। ততদিনে ভাইদের বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘোরে। মোশতাক তাদের দিকে তাকালে তারা চোখে চোখে রাখতে পারে না, থতমত খেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়, অন্যদিকে চলে যায়।”



মোশতাক সাহেবের ঘোর ভাঙে। ব্লাডারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই বহুদিন, এখন পেটের অবস্থাও ভালো যাচ্ছে না। ঘন ঘন কাপড় নষ্ট হয়ে যায়, তাই নার্সেরা এডাল্ট ডায়াপার পরিয়ে রাখে। সেটা পাল্টাতেও দেরি করে আবার। এমন অপরিষ্কার রাখার কারণে তলপেটের নিচে হলুদ পুঁজভরা ফোঁড়ায় ভরে গেছে তার, আর... এখন একটা মাংসপচা বাজে গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে কেমন যেন, তাই না?

মোশতাক সাহেব ভাবেন কাউকে ডাকবেন, ডায়াপারটা পালটে দিক, সুগন্ধী স্প্রে ছড়িয়ে যাক অন্ততঃ। তিনি ক্ষীণস্বরে একটু ডাকেন, ‘নার্স, এই নার্স!’

কেউ আসে না।

তিনি ভাবেন, তিশাম এলে বলতে হবে নার্সিং হোমটা ভালো না। অন্য কোথাও যেন উনাকে রেখে আসে। অবশ্য ছেলেটা দেশেই আসতে চায় না, কবে যে আসবে! ছেলের অপেক্ষা করতে করতে মোশতাক সাহেব আরেকবার নিজের ভেতরে ডুবে যান।

ভার্সিটিতে ওঠার পরেও মোশতাকের তেমন পরিবর্তন ঘটলো না। ক্লোজ বন্ধু বানানোর ক্ষমতা নেই তার, যতটা পারে সবার সাথে মিল দিয়ে চলতো। অনার্স, মাস্টার্স আস্তে আস্তে পার হয়ে গেল, একটা বিদেশি কম্পানিতে জয়েনও করে ফেলল ও কিভাবে কিভাবে যেন – সেখানেই বীথির সাথে ওর প্রথম কথা।

বীথি চঞ্চল, হাসিখুশি একটা মানুষ। মন যা চায় সেটাই করে ফ্যালে। মোশতাক রাশভারি, গম্ভীর, একটা কিছু করার আগে দশবার ভেবে নেয়। বিপরীত বিপরীতকে টানে – কথাটা হয়তো সত্যি। ওদের কাজের আলাপ গড়িয়ে গড়িয়ে হয়ে যেতো সাঁঝের আলাপ, তারপর একসাথে কোথাও চা খেতে যাওয়া। একত্র সময় কাটাতে অজুহাত খোঁজা, কাজের ফাঁকে লাঞ্চ। বাড়ি ফিরে অফিসের ফাইলের কারণ দর্শিয়ে ফোনকল [যদিও তারা ভিন্ন ডিপার্টমেণ্টের], সেটা ফুরোতে ফুরোতে মধ্যরাত। নিয়মিত কাজ শেষে একসাথে আড্ডা, ডিনার। সিদ্ধান্তে আসতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না দু’জনের। ছোট্ট করেই বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে ফেলে ওরা।

একদিন ভালোবাসাবাসির পর দূর্বল মুহূর্তে মোশতাক বীথির চুলে আঙুল চালাতে চালাতে নরম গলায় বলে, ‘তোমাকে একটা কথা কখনো বলা হয়নি। সাহস পাই নি আসলে। শুনবে?’

বীথি কি যেন বলতে যাচ্ছিল, স্বামীর কথায় থেমে গিয়ে তার চোখে কৌতূহল চিকচিক করে ওঠে, ‘তাই?’ সে আগ্রহ নিয়ে উঠে বসে, ‘কী এমন কথা এতোদিন লুকিয়ে রেখেছো? বলো না শুনি?’

মোশতাক বলে। কাহিনীর এক পর্যায়ে পুরনো ক্ষত খুঁড়ে দুঃস্বপ্নগুলো জাগাতে জাগাতে ওর চোখ বেয়ে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, মোশতাক অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে। অপেক্ষা করতে থাকে, বীথির হাত কখন এসে ওকে জড়িয়ে ধরবে, ওর চোখের পানি মুছে দেবে।

কিন্তু অপেক্ষা শেষ হয় না। মোশতাক চোখ খুলে দেখে বীথি ওর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে, সেই চোখে একপ্রকার করুণা, একপ্রকার... ঘৃণা? মোশতাকের মনে হতে থাকে কোথাও বড় ভুল হয়ে গেছে একটা। ও অসহায় হয়ে বীথিকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু তো বলো!’
বীথি বলে, ‘এই কথা এর আগে কাউকে বলেছো?’
মোশতাক বিহ্বল হয়ে মাথা নাড়ে, ‘উহুঁ।’
বীথির কণ্ঠ তীব্র হয়ে ওঠে, ‘তাহলে আমাকে বলার কি দরকার ছিলো?’ ও থতমত খেয়ে মাফ চাইতে গেলে বীথি ওকে প্রায় চিৎকার করে থামিয়ে দেয়, ‘আমি প্রেগনেণ্ট, মোশতাক! প্রেগনেণ্ট! ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো, কিন্তু তার মধ্যে এইটা তুমি কি বললে?’

মোশতাক মরিয়া হয়ে আত্মসমর্থন করতে গেলে বীথির গলায় যেন হিস্টিরিয়া চলে আসে, ‘দাঁড়া, কথা বলবি না! আমাকে বলতে দে! আমি একটা আনন্দের খবর দিতে যাচ্ছিলাম, সেইটার মাঝখানে সে বলে তার চাচতো ভাইয়েরা নাকি তার গোয়া মারতো! ছিঃ! তুই প্রতিবাদ করেছিস কখনো?’

মোশতাক মাথা নিচু করে থাকে।

‘কোনদিন মানা করিস নাই। বুঝ আসার পরেও কিছু বলিস নাই। আজকে কেন বললি? আজকে, আমার পেটে যখন তোর বাচ্চা, তখন কেন এই কথা বললি? এই মাদারচোদ, উত্তর দে। তুই কি গে? আরেকটা নাগর আছে তোর, সেইটার কাছে মারা খাইতে যাস, এইটাই এখন বলতে চাইছিলি তো?’

বলতে বলতে কেঁদে ফেলে বীথি। মুখের থুতু নাকের শ্লেষ্মা এক হয়ে বুদবুদ ফুটে ওঠে নাকের কাছে, বীথি সেগুলো হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ডলতে ডলতে মোশতাক-কে সর্বশক্তি দিয়ে লাত্থি মারতে থাকে, ‘বেরো তুই, বের হ! আমার সাথে এক ঘরে থাকবি না খবরদার!’ মোশতাক বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে অবশ শরীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পেছনে দড়াম করে দরজা আটকে দেয় বীথি, তারপর বিছানায় মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করে।

মোশতাক সেদিন ছাদে এসে সিগারেট টানতে টানতে ভাবছিলো লাফ দেবে কি দেবে না। নিজের সাথে আত্মহত্যা নিয়ে সেই পরিচিত কথোপকথন। সিগারেট শেষ করে লাফ দিতে যাওয়া সময় মনে হল, বীথি প্রেগনেণ্ট। ওহ খোদা! বীথি প্রেগনেণ্ট! আমাদের একটা বাচ্চা হবে! আমি না থাকলে কি হবে বাচ্চাটার?

মোশতাক আর লাফ দিলো না। পিছু হটে এসে আকাশের দিকে একটা নিস্ফল চীৎকার ছুঁড়ে দিলো ভীষণ, যেন তাতে অসহায় একটা আত্মার জমে থাকা সব আক্রোশ মিটে যাবে, ক্রুর বিধাতার প্রতি বঞ্চিতের সব ক্রোধ পানি হয়ে যাবে। চীৎকারের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার পর, নিঃশব্দে যে লোকটা ঘরে ফিরে গেলো, সে একটা আকণ্ঠ পরাজিত মানুষ।

তারপর কেটে যেতে থাকে সময়। ওদের ফুটফুটে একটা ছেলে হয়, নাম রাখা হয় তিশাম। বীথি ওই সময়টায় মোশতাক বা তিশাম কাউকেই কেন যেন সহ্য করতে পারতো না। তার দৃঢ় বিশ্বাস – মোশতাক সমকামি, এখনো কেউ প্রস্তাব দিলে সে কাপড় খুলে পশ্চাৎদেশ এগিয়ে দেবে। মোশতাক সমাজ-স্বীকৃত জীবনের লোভে বিয়ের নাম করে বীথিকে ধোঁকা দিয়েছে, যাতে তলে তলে বিকৃত কামনা ঠিকই চরিতার্থ করতে পারে। বীথির জীবনটা ইচ্ছে করে নষ্ট করে দিয়েছে সে। এইসব অভিযোগ-অনুযোগ বহুদিন ধরে সকল আত্মীয়-স্বজনের মাঝে ঢালাও করে প্রচারের পর বীথি যেদিন আসলেই ডিভোর্স-পেপার পাঠালো, মোশতাক সত্যি বলতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল মনে মনে। তবু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তিশামের কথা ভাবো। তুমি ওকেও একা ফেলে যাবে?’

বীথি মুখ শক্ত করে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি দেশে থাকবো না। বাইরে যাচ্ছি, সেখানে সব ঠিকঠাক করে তিশামকে নিয়ে যাবো। ততদিন যদি তিশামের কিছু হয়, খবরদার। চাইলেই জেলের ভাত খাওয়াতে পারি তোমাকে, মনে রেখো।”



মোশতাক সাহেব আর মনে করতে চান না। তিনি বাস্তবে ফিরে আসতে চান, কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় তার চারিপাশে মৃত্যুর দুর্গন্ধ আর অচল শরীর – অতীতে ফেরা ছাড়া আর কি করার আছে?


তিশামকে মোশতাক ভালোবাসতো বলা ভুল হবে। মানুষ কি অক্সিজেনকে ভালোবাসে? তিশামের জীবনকে পরিপূর্ণ করার জন্য যত যা করা সম্ভব মোশতাক করতো, ছেলেও এদিকে বাপের ভক্ত। কিন্তু আস্তে আস্তে ছেলে বড়ো হতে লাগল, মোশতাক অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ছেলে বাপকে গণ্য করছে কাজের লোকের মতন। কেমন যেন একটা চাপা তাচ্ছিল্য। এই লোকটা আমাকে প্রতিপালন করে, করবেই তো, বাপেদের এটাই তো কাজ। এই কাজে কোন গ্ল্যামার নেই।

কিন্তু গ্ল্যামার আছে মায়ের জীবনে। মায়ের প্রতি ছেলের ফ্যাসিনেশন বাড়তে থাকে। মা তো শাসন করে না, না চাইতেই দামি ব্র্যাণ্ডের গিফট পাঠায়, ছেলের মন বোঝে। মোশতাক অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে – ছেলে অনলাইনে কথা বলছে মায়ের সাথে, নাক কুঁচকে বলছে – এই দেশের অবস্থা তো জঘন্য, বুঝলে মা? তোমাদের ওখানকার সিস্টেম সুন্দর! তারা একমত হয়ে এমন বিবিধ গল্প করতে করতে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে, দু’জন কি উচ্ছ্বল! ছেলে বাপকে ছবি দেখায় – দেখো ওই দেশ কত সুন্দর, মা কত স্মার্ট, দেখেছো? মোশতাক কথা খুঁজে পায় না। চোখের সামনে সে অসহায় হয়ে দেখে নিজের ছেলে অন্যের হয়ে যাচ্ছে।

ক’দিন পর কলেজ পাস করার পর ছেলে আবদার করে, ‘বাবা আমি বাইরে গ্র্যাজুয়েশন করি?’
মোশতাক এতোদিন এটার ভয়-ই পাচ্ছিল, ‘কোথায় যেতে চাও?’
ছেলে উৎসাহে ডগমগিয়ে বলে, ’মা-র কাছে! মা বলেছে এপ্লাই করলেই হবে, আর সব ব্যবস্থা ওখান থেকে হয়ে যাবে। আমার বিদেশ খুব ভালো লাগে বাবা, আর বাইরের ডিগ্রি থাকলে ক্যারিয়ারে অনেক সুবিধা, বলো? যাই প্লিজ?’

মোশতাক বুকে পাথর বেঁধে ছেলের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি খুঁটিনাটি সব গুছিয়ে দেয়। কিন্তু বিমানবন্দরে গিয়ে বিদায়ের ঠিক আগ মুহূর্তে নিজেকে সামলাতে পারে না, ছেলের হাত ধরে আকুল হয়ে বলে, ‘বাবা, ফিরে আসবি তো? আমি যে একা হয়ে গেলাম!’

ছেলে হাসিমুখে আশ্বাস দেয়, তারপর উড়োজাহাজ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় মোশতাকের বুক থেকে দূরে, অনেক দূরে।

এরপরে মোশতাক খুব দ্রুত বুড়ো হতে শুরু করে।
ছেলে তার ফেরে না। বিভিন্ন অজুহাত। কাজ। পড়ালেখা। মাস্টার্সের পর পিএইচডি। ডিগ্রির পর ডিগ্রি নিতে হবে, দেশে ফেরার সময় কোথায়? মোশতাক এইভাবে ধীরে ধীরে মোশতাক আহমেদ হয়ে যান। অবসর নিয়ে নেন। বীথির মৃত্যুখবর পান ছেলের কাছে। ছেলে কাঁদে, তিনি সাতসমুদ্র তেরো নদী দূর থেকে সান্ত্বনা দেন। ছেলে বিয়ে করে, নাতিনাতনি হয়, তাদের কথা আর ছবি অনলাইনে দেখে দেখে তিনি সাধ মেটান। ছেলে একদিন প্রস্তাব করে, বাপকে নিজের কাছে নিয়ে আসার। শুনে মোশতাক আহমেদের বুকে যেন পদ্মার ঢেউ জাগে। তিনি ভেতরের রোমাঞ্চ চেপে রেখে লজ্জা লজ্জা মুখে জিজ্ঞেস করেন, ‘সত্যি? তোদের কষ্ট হবে না?’ ছেলে বলে, ‘কি যে বলো বাবা! তুমি কাগজ রেডি করো।’ তিনি দুরুদুরু বুকে সবকিছুর তৈয়ারি করতে শুরু করেন। ওই দেশে গিয়ে কি কি করবেন, নাতিনাতনিদের সাথে কিভাবে আনন্দ করবেন – এসব ভেবে উত্তেজনায় রাতে তার ঘুম আসে না।

এবং বিধাতার পরিহাস - তার দু’দিন পরেই, মোশতাক আহমেদ স্ট্রোক করলেন।

খবর পেয়ে অবশেষে, অবশেষে তিশাম বাপকে দেখতে আসে। স্ট্রোকের কারণে মোশতাক আহমেদের একপাশ সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেছে, তিনি তবুও একটা হাতে ছেলেকে আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। ছেলে বিষণ্ণ মুখে জানায়, ‘এমন অবস্থায় কিভাবে তোমায় নেবো বাবা? তুমি সুস্থ হলে, তারপর...’

মোশতাক আহমেদ জিজ্ঞেস করেন, ‘এই রোগ কী ভালো হয় রে?’
ছেলে চুপ করে থাকে।
ক’দিন সঙ্গ দেয়।

তারপর হাসপাতাল থেকে বাপকে সরিয়ে এই নার্সিং হোমে রেখে আবার উড়াল দেয় বিদেশে।

মোশতাক তারপর বারবার আত্মহত্যার কথা ভাবতেন। নরক আর কতই খারাপ হবে? এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোন মানে নেই আর। তার কোন দায়িত্ব নেই, কোন কর্তব্য নেই, কারুর সাথে কোন চুক্তি নেই।

কিন্তু একটা ক্ষুদ্র আশাবাদ তাকে বাঁচিয়ে রাখে।
মোশতাক আহমেদ নিজেও এর ব্যাখ্যা জানেন না।
তবুও তো পেঁচা জাগে,
গলিত স্থবির ব্যাং আরও দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় ---”



তীব্র দুর্গন্ধে মোশতাক আহমেদের স্বপ্নঘোর টুটে যায়। তিনি তার সচল হাতটা বহুকষ্টে নাড়িয়ে দেখেন, ডায়াপার ফেটে গেছে, দুই দিনের জমা মলমূত্র আর পুঁজের মাঝে তিনি চলৎশক্তিহীন পড়ে আছেন। মোশতাক আহমেদ শ্বাস নিতে চেষ্টা করেন, কাউকে ডাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। জিভ উলটে গলার ভেতরে চলে গেছে। দম আটকে আসে তার, তড়পাতে তড়পাতে অসহায় মানুষটার মুখ নীলচে রঙ ধারণ করে।

তারপর একেবারে নিথর হয়ে যায়।




২.
ম্যাজিস্ট্রেট বসে বসে টেকনিশিয়ানের সাথে আলাপ করছেন, ‘এইটা কয় নম্বর গেলো যেন?’
-‘চার নম্বর, সার।’
‘কেবল? তারমানে আরও একুশটা আছে!?’
-‘জি সার।’
‘আসামী কি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো এবারো?’
-‘না সার। অটো-সাজেশন দেওয়া আছে। এখন চাইলেও আত্মহত্যা করতে পারবে না, মনের ভেতর থেকে সায় পাবে না।’
‘প্রতিবার কি ট্রমার পরিমাণ বাড়াচ্ছো? নাকি একেক জীবনে একেক রকম ট্রমা ফেস করবে?’
-‘চেষ্টা করছি সার ভ্যারাইটি রাখার। নিয়ম হচ্ছে ওর একজন ভিকটিম যা অনুভব করেছিলো, সেটায় ফোকাস করা। ট্রমাগুলা ক্রমান্বয়ে একটা জীবন কিভাবে ধ্বংস করে দেয় সেইটা ক্রমশঃ জ্যামিতিক হারে বিবর্ধিত করে করে অনুভব করাতে হয়। যদিও মাঝে মাঝে দুই একটা সুখস্মৃতি মিশিয়ে দিতে হয়, নইলে মস্তিষ্ক বাস্তব বলে মেনে নিতে চায় না। সার, দেখেন, মনে হয় জ্ঞান ফিরেছে আসামীর...’

মোশতাক তীব্র আলোর নিচে ঘোলাটে চোখে মিট মিট করে তাকায়। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে একজন একঘেয়ে গলায় বলে যায়, ‘আসামী - মোশতাক আহমেদ, বয়স - একচল্লিশ বছর। অপরাধ – আট ও দশ বছরের দুইটি শিশুকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করতে করতে খুন করা। আদালত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি – ২৫ বার জীবনদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই মুহূর্তে চার নম্বর জীবন সমাপ্ত হলো। পরবর্তী জীবন শুরু করার জন্যে উপস্থিত কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রার্থনা করা যাচ্ছে।’

ম্যাজিস্ট্রেট আসামীর দিকে একবার তাকিয়ে দেখেন। পুরো মুখ ঢাকা, কিন্তু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে, দরদর করে চোখের পানি ঝরছে। মোশতাক তার দিকে তাকিয়ে চীৎকার করে কি যেন বলতে থাকে, ক্রোধ নাকি জিঘাংসা নাকি ক্ষমাভিক্ষা - মুখোশের আড়ালের কারণে কিছু বোঝা যায় না। ম্যাজিস্ট্রেটের শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, ‘অনুমতি প্রদান করা হলো।’ তারপর নিচু গলায় যোগ করেন, ‘ট্রমা-টা বাড়ায়া দিও হারামজাদার।’

শুনে মোশতাকের চোখ বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে আতঙ্কে।

টেকনিশিয়ান মাথা নেড়ে একটা বাটন টিপে দেয়।

বিপ!



সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০২০ সকাল ১০:৩৮
৩০টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×