somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ রঙ্গমঞ্চ

০৯ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
মিটিংয়ে সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হলো, আমরা - মানে আশকোণা দক্ষিণ নাট্যসমাজ – এবারের বর্ষায় তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসটা মঞ্চে তুলছি। নাট্যরূপের দায়িত্ব বরাবরের মতই আমাদের রেসিডেণ্ট সাহিত্যিক আশরাফের হাতে। সে আশ্বাস দিয়েছে দু’দিনের মধ্যে স্ক্রিপ্ট রেডি হয়ে যাবে। সাধারণতঃ নাটকে নির্দেশনা দেয় সবার অভিভাবক, সুতাব্বু, (আপার নাম কোন এক কালে ছিল সুতপা, ‘সুতপা আপা’ ডাকটা প্রায়শঃই সুতোপা’পা হয়ে যেত, তারপর আশরাফ একদিন বললো ইংরিজিতে এইসব পাপা-টাপা ধরছিস কেন, সুতো-আব্বু বলে ডাকলেই হয়! আপার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও সেটাই কিভাবে যেন টিকে গেছে, শুনি মিতুল’দা-ও নাকি ভুল করে মাঝেমধ্যে বউকে সুতাব্বু ডেকে ফ্যালেন এখন!) কিন্তু আপার মা অসুস্থ, ও থাকছে না এবার। বরঞ্চ সুযোগ পেয়ে মিটিংয়ে তার সেই পুরাতন ডায়লগ শুনিয়ে গেল– ‘আমি কি সারাজীবন থাকবো নাকি রে হতচ্ছাড়ার দল? পাঁচপঞ্চাশ পার করে ফেলেছি, মরে যাবো ক’দিন পর। এবার তো নিজেরা কিছু করতে শেখ!’

তাই নাটক তোলার দায়িত্ব এসে পড়েছে আমার ঘাড়ে।

জীবনে অনেক কিছু তুলেছি – ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছি, ইস্কুলের পিচ্চি বদমাশের দল দুই বিষয়ে ফেল করে বসে থাকলে টেনেটুনে ওদের উপরের ক্লাশে তুলেছি; নাটক-টাই তোলা হয় নি কখনো। এমনিতে আমি টীচার মানুষ, ইস্কুলে পড়াই তাও দেড় যুগের বেশি হয়ে গেলো। নাটক দেখার ঝোঁক ছিল ছেলেবেলায়, পিরেন্দেল্লো-ব্রেখট-ইবসেনের ভক্ত ছিলাম। সেই ভক্তি বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে, তার সাথে বেড়েছে সাহস, তাই এখন অবসরে শখের নাটক করি একটু-আধটু।

অভিনয়ে খুব যে প্রতিভা আছে তা না, মোল্লার দৌড় অই শুয়ে থাকা মরা লাশ, টহলদার কিংবা দুই লাইনের দারোয়ান পর্যন্তই। কিন্তু অর্গানাইজেশন আমার শক্তির জায়গা। আগ্রহ নিয়ে খাটতে পারি, মানুষকে খাটাতে পারি, অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের দলে বুড়োর তালিকায় সুতাব্বুর পরেই আমার নাম। নাটক তুলতে আর কী লাগে?

এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার আগে একটাই শর্ত ছিল আমার। দায়িত্ব নেবো - যদি এবং কেবল যদি – মূল চরিত্র ‘নিতাই’ এর পার্টটা মনিরকে দেওয়া হয়।

মনির আমাদের একমাত্র ‘খাঁটি’ অভিনেতা। প্রতিটা থিয়েটার দলেই এরকম দু-একজন থাকে, যারা বাকিদের চে অনেক বেশি ট্যালেণ্টেড, কাঁচের মাঝে হীরের মতন জ্বলজ্বল করে ওঠে; চোখে পড়বেই। তাদের তুমি যে চরিত্রই দাও, যত কাঁচা লেখাই হোক, যত ম্লান ডায়লগ-ই হোক না কেন – ফাটিয়ে দেবে।

মনির সেরকম একজন। জীবনে বহু নাটকের কলাকার দেখেছি, বহু সন্ধ্যে বেইলি রোড আর শিল্পকলার আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে রাত বানিয়ে ফেলেছি – কিন্তু মনিরের মতো এমন করে চরিত্রে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে কাউকে দেখিনি। তার অভিনয়ের রেঞ্জ কতটা বিশাল, কতটা বিস্তৃত সেটা বোঝাতে গেলে গত একটা বছরের কথাই যথেষ্ট। গত বছর আমরা তিনটে নাটক করেছিলাম; ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ –এ সে ছিলো বিদ্রোহী নেতা নূরলদীন, ‘কবর’ -এ ছিলো করিৎকর্মা তেলবাজ ইন্সপেক্টর হাফিজ, আর ‘মেঘনাদবধ’ -এ শোকগ্রস্ত, ক্রোধান্বিত পিতা রাবণ। পুত্রের মৃত্যুতে ব্যথিত হৃদয়ে সে যখন বিলাপ করছিলো -

‘হা পুত্র, হা বীরবাহু, বীর-চূড়মণি!
কি পাপে হারাইনু আমি তোমা হেন ধনে?
কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি,
হরিলি এ ধন তুই? হায় রে, কেমনে
সহি এ যাতনা আমি?’


ওফ! এক সিনেই দর্শক কাত! আমাদের বাজেট কম থাকে, স্ক্রিপ্ট দূর্বল, পোশাক-আশাক যাত্রাপালার চেয়ে খুব একটা উন্নত হয় না, মেকআপ নামেমাত্র; তারমধ্যে সাধু ভাষায় নাটক - তবুও ওই মুহূর্তে প্রতিটা মানুষ কোন এক মন্ত্রবলে যেন চলে গিয়েছিল লঙ্কার সুবিশাল রাজদরবারে, চোখের সামনে দেখছিলো লঙ্কারাজের হাহাকার। প্রতিটা শব্দ যেন একেকটা শক্তিবাণ হয়ে বিঁধছিল বুকে, এমন তার আর্তনাদ! ব্যাটা মেঘনাদ স্বয়ং পুরো নাটকে এতোটা হাততালি পায়নি যতটা তার বাপ রাবণ অই এক দৃশ্যে সেদিন আদায় করে নিয়েছিলো।

তাই আসর জমাতে গেলে মনিরকে আমার লিড রোলে লাগবেই।

যদিও মিটিঙয়ে হ্যাঁ-না কিছু বলার জন্যে মনির ছিল না। কোনদিনই থাকে না। সে মুখচোরা চুপচাপ মানুষ; মধ্যবয়সে পড়ে গেছে তবু বিয়ে-থা কিছু করেনি, যদ্দুর জানি - ছেলে বা মেয়ে – কোন বন্ধুই নেই তার। যদি নাটকের প্রাকটিস ছাড়া অন্য কিছুতে তাকে ডাকা হয়, ‘মনির, অমুক দিন মিটিংয়ে এসো, বা সবাই মিলে আড্ডা দেবো, এসো’ - সে মাথা নিচু করে বসে থাকবে, বেশি জোরাজুরি করলে ফোন বন্ধ করে ঘটনার দিন উধাও হয়ে যাবে। তার নাকি স্ক্রিপ্ট ছাড়া কথা বলতে গেলে অসহায় লাগে, কথা খুঁজে পায় না।

তাকে খুঁজতে হলে যেতে হবে জামাল ভাইয়ের দোকানে। সেখানে দশ বছর বয়েস থেকে মনির এসিস্টেণ্ট হিসেবে কাজ করে আসছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে পার্ট-টা সে নেবে কি না।

ওসব পরে। আগে হাতের কাজ সারতে হবে একটা। কারেণ্ট বিল দ্বিগুণ এসেছে এই মাসে; আজ ঘর থেকে বের হবার সময় ঘরওয়ালি পইপই করে বলে দিয়েছে, ‘এই ধরো বিল, ফেরার আগে বিদ্যুৎ অফিসে যাবে, গিয়ে ভালমত বুঝে আসবে কোন যুক্তিতে এতো টাকা বিল আসে। আমরা কি নতুন এসি কিনেছি না একশোটা বাতি জ্বালিয়ে বিয়ের মজলিস সাজিয়েছি, যে ডাবল খরচ হবে?’

সুতরাং, গন্তব্য বিদ্যুৎ অফিস।

অফিসে ঢুকে ভেতরে গেলাম, দেখি নতুন একটা মেয়ে বসে আছে কাউণ্টারের পেছনে। বিল দেখালাম। মেয়েটা কিছুক্ষণ কম্পিউটার ঘাঁটলো, তারপর বিরক্ত মুখে বললো, ‘ভুল করেছে মনে হয়। আপনার একাউণ্ট নাম্বারটা দিন, ঠিক করে প্রিণ্ট দিচ্ছি।’ তারপর কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতা। নীরবতা কাটাতে খোশগল্প করার চেষ্টা করলাম, জিজ্ঞেস করলাম মেয়েটা নতুন জয়েন করেছে কি না, ক’দিন হলো। মেয়েটা ভাবলেশবিহীন মুখে জানালো বিদ্যুৎকর্মীদের একটা প্রশিক্ষণ প্রকল্প চলছে; সে এসেছে প্রশিক্ষক হিসেবে। আজ লোকবল কম বলে কাউণ্টার সামাল দিতে হচ্ছে।

‘খুব খাটিয়ে নিচ্ছে তাহলে আপনাকে, হ্যাঁ? বাড়তি পয়সা পাবেন এর জন্যে?’ ঠাট্টা করলাম আমি।
-‘কী পাবো?’ মেয়েটা অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞেস করলো।
ধুস, শোনেইনি কী বলেছি! ‘মানে এই যে, বাড়তি কাজ করাচ্ছে আপনাকে দিয়ে, সেটা বললাম।’

উত্তর দেওয়ার তেমন উৎসাহ দেখা গেল না মেয়েটার কণ্ঠে, ‘ও, হ্যাঁ। করতে হয় মাঝেমধ্যে’, বলে খটখট করে কি যেন টাইপ করতে শুরু করলো আবার। মেয়েটা আসলেই এমন নিরামিষ, নাকি আমি বেশি গায়ে পড়ে গল্প জমাচ্ছি, তাই বিরক্ত হচ্ছে, ইগনোর করছে? চুপ করে যাবো?

এত কথা নরমালি আমি বলি না। আসলে খারাপ লাগছিল একটু একটু। কেমন একটা শীতল শাঁসহীন ভাব মেয়েটার অস্তিত্বে। যেন জীবনশক্তি শুষে নিয়ে কেউ পরিত্যক্ত ছোবড়াটা ফেলে গেছে।

আমি কথা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, ‘তাহলে ক’দিন আছেন এখানে?’
‘জি, প্রতিটা শাখায় আট সপ্তা করে থাকতে হয় আমাদের’, মেয়েটা এবারে একটু সরব হয়, হয়তো ভদ্রতা বজায় রাখতেই। কণ্ঠ আবেগহীন হলেও চোখ দুটো চঞ্চল; বলছিলো- দুই বছর আগে জয়েন করেছে, তারপর থেকেই এমন করে পুরো বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে; থিতু হয় নি কোথাও। কচুরিপানার মতন ভাসমান জীবন, শেকড় মাটি ছোঁয় নি।

আমার মাথায় তখন ঘুরছিলো অন্য কথা। এই মেয়েকে আমাদের সেকেণ্ড ফিমেল লিড হিসেবে খুব মানাতো, যা হাইট, কথা বলার একটা ধাঁচ- ঠাকুরঝি হিসেবে পারফেক্ট হতো একেবারে। জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবে কি? খারাপ কিছু ভাববে?

আমি আর ধরে রাখতে না পেরে বলেই ফেলি, ‘আপনি কি নাটক করেছেন কখনো?’ মেয়েটা কথা থামিয়ে অবাক হয়ে বলে, ‘না তো! কলেজে ভার্সিটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছি দু’একবার, একক নাচ-টাচ দিয়েছি, কিন্তু নাটক করি নি কখনো। কেন?’
-‘না মানে, আমাদের লোকাল একটা নাট্যদল আছে’, আমি আমতা আমতা করে বলি, ‘সামনে নাটক উঠবে একটা, সেটার বিভিন্ন পার্টের জন্য অডিশন হবে। আপনি কিন্তু আসতে পারেন চাইলে।’

ভাবছিলাম সোজা মানা করে দেবে, নইলে বিরক্ত হবে, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার - মেয়েটা এই প্রথম হাসলো আমার কথা শুনে, ‘তাই নাকি? আমাকে দেখলে কি নাটকের লোক মনে হয়? মানাবে আমাকে?’
-‘কেন মানাবে না? আমরা সবাই এমেচার, কেউই প্রফেশনাল না; এলে বুঝবেন। এসে ঘুরে যান একবার। আর কিছু না হোক, এইটুকু অন্ততঃ বলতে পারবেন যে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলো।’
‘কোথায় আপনাদের অডিশন? কখন?’
-‘ইস্কুলের অডিটোরিয়ামে, শুক্রবার বিকেল চারটার মধ্যে। আসছেন তো তাহলে?’

মেয়েটা শুনলো, তারপর সরাসরি জবাবে না গিয়ে কেমন একটা ভাসা ভাসা হাসি দিয়ে বললো, ‘জানেন, এতো জায়গায় থেকেছি, এই প্রথম লোকাল কেউ আমাকে কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলো?’

আমরা কিছুক্ষণ কথা বললাম আরও। মেয়েটার নাম নীরা। নীরা জানালো আমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হয়েছে সে, ধন্যবাদ দিলো। অডিশনে আসবে কি না জানে না, কিরকম একটা হুটহাট ব্যাপার। কনফিডেন্স পাচ্ছে না। তবে, কথা দিলো অবশ্যই ভেবে দেখবে।






২.
এতোদিন ধরে মনির বারংবার লিড রোলে আসায় দর্শকের একটু হলেও বিরক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সত্যি বলতে, মনির যদি একই নাটকে, একই রোলে সারাজীবন অভিনয় করে যেত, করেই যেত; আশকোণা দক্ষিণ দর্শকসমাজের তাতে বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকতো না।

কারণ প্রতিবার স্টেজে যে মানুষটা উঠতো, সে তো আর আমাদের চেনাজানা মনির থাকতো না। প্রতিবার মঞ্চের গাঢ় বাদামী রঙের পর্দা সরে গেলেই মনির উবে যেত তার সাথে; সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো অন্য কেউ, স্ক্রিপ্ট আর নাট্যপরিচালকের কল্পনার একটা মিলিত ফসল।

বাকি মানুষেরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকে, আর মনির বাঁচে মঞ্চে।

মিতুলদা একবার বলেছিল মনিরের বোধহয় কোন মানসিক সমস্যা আছে। একটা মানুষ জড়বস্তুর মতন ব্যক্তিত্বহীন হয় কি করে? হয়তো মাইল্ড অটিস্টিক হতে পারে, চেক করলে জানা যেতো। ছেলেটাকে কেউ একবার বোঝাক যে তার জীবনে কিছু করা উচিত, কিছু হওয়া উচিত। এরকম শাদা ক্যানভাসের মতন শূন্য জীবন নিয়ে কেউ বাঁচে? একটা বিয়ে করুক। অন্ততঃ জামাল ভাইয়ের দোকান ছেড়ে অন্য কোথাও ভাল একটা চাকরি নিক। কিন্তু এসব বলে কী লাভ? যে ছেলেটাকে বাপ-মা ফেলে রেখে গিয়েছিল ভৈরবের কোন এক এতিমখানার দরোজায়, যে ছেলেটা সেখান থেকে দশ বছর বয়সে ভেগে এসেছিল এই আশকোণায়; জামাল ভাইয়ের দোকানে খাবার চুরি করতে এসে ধরা খেলো – জামাল ভাই মেরেধরে কই পুলিশে দেবেন, তা না দিয়ে হুট করে দোকানে পিচ্চি হিসেবে রেখে দিলেন। আমরা বলেছিলাম, দেখবেন দুইদিন পর ক্যাশ ফাঁকা করে ভেগে যাবে আবার, এদের অভ্যাস-ই এমন; কিন্তু জামাল ভাই মুখ শক্ত করে বলেছিলেন – ‘ভাগলে ভাগবো, হেই রিক্স আমি নিমু, তোমাগো এতো কথা ক্যান মিয়া?’ - সেই একাকী, নিস্তব্ধ ছেলেটাকে চোখের সামনে বড়ো হতে দেখেও আমরা আপন করে নিতে পারিনি, এরকম শক্ত কথা বলার অধিকার অর্জন করতে পারি নি। মনির সবার মাঝে থেকেও বৈরাগ্যব্রত পালন করে গেছে। জামাল ভাই বকবক করতেন মাঝেমধ্যে, তিনিও নিজের ছেলের হাতে দোকানের মালিকানা সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে মরে গেছেন পাঁচ বছর হলো। সুতরাং কে কী বলবে?

যাকগে। মনিরকে দোকানে গিয়ে বললাম নাটক তোলার দায়িত্ব এবার আমার, আমি চাইছি ও-ই লিড রোলটা করুক। ফাইনাল স্ক্রিপ্ট হাতে পাই নি, ফুলস্কেপ কাগজে খসড়া করে পিন মেরে নিয়েছি। ওটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম। মনির খুলেও দেখলো না, পায়ের আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে বরাবরের মতই একই প্রশ্ন করলো ও আমাকে –

‘এবারে কী হচ্ছি আমি?’

প্রশ্নটা শুনলে প্রতিবার কেমন করুণা জাগে আমার এই ছেলেটার ওপর। শাদা ক্যানভাসও কি রঙের ছোঁয়া পেতে এমন উতলা হয়?




৩.
দেখতে দেখতে শুক্রবার বিকেল ঘনিয়ে এলো। ইস্কুলের চাবি বাড়তি একগোছা আমার কাছে থাকে, এরকম অডিশনের সময়গুলোয় খুব কাজে লাগে। দুইতলায় একটা রুম দখল করে আমি, লিটু ভাই আর সুতাব্বু সামনের বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। সামনে উন্মুক্ত ডায়াস। নিচে ইচ্ছুক প্রার্থীরা স্ক্রিপ্টের পাতা হাতে অপেক্ষা করছে, ডাক পেলে তারা একে একে রুমে আসবে আর লাইন রিড করবে। বেশ গাম্ভীর্যমাখা পরিবেশ।

প্রথমেই মনির। ওর পজিশন পাক্কা, অডিশনে আসার দরকার নেই – এটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু মনির কোনদিন অডিশন মিস দেয় না। অইটুকু প্রাকটিসের সুযোগও ছাড়তে চায় না বোধহয়। আমরা মানা করি না, কারণ ওর অভিনয় স্বচক্ষে দেখতে পারাও একটা তৃপ্তির বিষয়। একটা প্রিভিলেজ। ওকে বললাম, ‘নিতাইয়ের প্রথম কবিগানের সীনটা করো মনির।’

মনির একটু সময় নিলো প্রস্তুত হতে। কাগজে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে তারপর সেটা আলতো করে নামিয়ে রাখলো সামনে। ডায়াসে আমাদের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে একটা চাপা হাসি দিলো। মেরুদণ্ড টানটান করে সোজা দাঁড়িয়েছে, পাঁচ ফিট সাত ইঞ্চির মনিরকে কোন প্রকার প্রপ ছাড়াই মনে হচ্ছে ছ’ফিট লম্বা। চোখ চকচক করছে আত্মবিশ্বাসে। ওর দিকে তাকিয়ে মনে হল - হঠাৎ করে যেন কিছু একটা পালটে গেছে, আর আমাদের সামনে মন্ত্রবলে এসে দাঁড়িয়েছে নিতাই, সাক্ষাৎ ডাকাত-বংশের ছেলে নিতাই। কবিয়াল নিতাই। সে নরম গলায় বললো – ‘কি গো, শুরু করো!’

ওর তাগিদে ঘোর টুটে গেল, সবাই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। তাই তো, শুরু করা যাক। আমি মহাদেবের লাইন পড়লাম, লিটু ভাই কখনো মহাদেবের দোয়ার, কখনো রাজন, কখনো শহুরে বাবু; আর সুতাব্বু ঠাকুরঝি। এদিকে ডায়াসে একাই আসর জমিয়ে বসেছে মনির। আমি জানতাম ওর গলা ভরাট, সংলাপে সাবলীল। নাটক করতে গেলে টুকিটাকি সঙ্গীতের সাধনাও লাগে। কিন্তু এরকম সুরেলা গলায় যে সে ধুয়ো ধরতে পারে, গান করতে পারে – এটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিলাম? ঢুলির চরিত্র লেখা নেই এই সীনে, কিন্তু কাহিনির প্রয়োজনে নিতাই নিজেই ঢুলি হয়ে যাচ্ছে কখনো কখনো; গান বাঁধছে আর মুখে মুখে ঢোলে কাঠি দিচ্ছে – ডুডুম! মহাদেবের ব্যঙ্গে, রঙ্গে, অপমানে কখনো তার কালো মুখ আরও কালো হয়ে যাচ্ছে, মাথা নিচু করে বসে পড়ছে, তারপর বিপর্যস্ত মুখে জোর করে হাসি টেনে জবাব দিচ্ছে আবার! রাজন চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে – ‘বাহ ওস্তাদ, বাহ!’ শহুরে বাবু অবাক হয়ে বলছেন, ‘হি’য আ পোয়েট! হ্যাঁ, আ পোয়েট!’ এদিকে ঠাকুরঝি বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে দেখছে পুরো ব্যাপারটা- ‘নিতাই, আমাদের নিতাই – সত্যি এত বড় কবিয়াল হয়ে গেছে!’ তার অবগুণ্ঠন খসে পড়েছে নিজের অজান্তে।

এভাবে আমি, লিটু ভাই আর সুতাব্বু যখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নাটকের গভীরে ডুবে গেছি, ঠিক তখনি সীন শেষ, নিতাই হুট করেই আবার মুখচোরা, চুপচাপ মনির হয়ে গেলো। আমাদের দিকে নার্ভাস হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাই, কেমন হয়েছে? চলবে?’

আমার স্বাভাবিকে ফিরতে একটু সময় লাগে, ‘হুঁ।’

মনিরকে আরও নার্ভাস দেখায়, নাকের ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, ‘ভাই, পার্টটা পাবো? কী বলেন?’

ছেলেটা সত্যিই জানে না ওর অভিনয় কেমন হয়? ওর এমন কমিকাল টেনশন দেখে কেমন হাসি পেয়ে যায় আমার। আমি গম্ভীর মুখে বলি, ‘প্রাকটিস করতে থাকো, দেখা যাক। ভালো সম্ভাবনা আছে।’

মনির তাতেই খুশি, আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘থ্যাংকিউ ভাই! থ্যাংকিউ!’

সুতাব্বু ওকে জিজ্ঞেস করলো, ‘নিচে একটা নতুন মেয়েকে দেখেছ মনির?’ মানে নীরা এসেছে কি না সেটা জানার জন্য। মনির কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিলো, ‘কিজানি! লক্ষ্য করিনি।’

আর কয়েকটা পার্টের জন্য অডিশন নেবার পরে লিটু ভাই নিচে গেলো, বিড়ি টানতে। উপরে যখন এলো তখন তার সাথে দেখি নীরা। আমি লাফ দিয়ে উঠলাম, ‘কখন এসেছেন আপনি?’ নীরা লাজুক হেসে বললো, ‘ঠিক সময়েই। কিন্তু উপরে ওঠার সাহস করতে পারিনি। আমাকে দিয়ে কি নাটক হবে?’

সুতাব্বু আমার চেয়ে বেশি এক্সাইটেড, ও বেঞ্চে কিল মেরে বললো, ‘হবে না মানে! অ্যাই লিটু, ওরে স্ক্রিপ্ট দে। ঠাকুরঝির পার্ট। মা, তুমি বসো। স্ক্রিপ্টটা পড়ো। লিটু তুই বুঝা!’ তারপর আমাকে পাঁজরে কনুই মেরে ফিসফিস করে বললো, ‘এরে পেলি কোথায়?’
আমি বলি, ‘বিদ্যুৎ অফিস।’
সুতাব্বু এক মুহূর্ত থম মেরে তারপর বলে, ‘যেখান থেকেই আসুক, ব্যাপার না। অবশেষে জোয়ান ছেড়ি একটা পাওয়া গেল, এটাই কথা! সাবাস!’

‘জোয়ান ছেড়ি’ নিয়ে আমাদের আফসোস বহুদিনের। নায়িকার অভিনয় করার জন্য উপযুক্ত বয়সের কাউকে পাওয়া খুব কঠিন। প্রতিভাবান মেয়েরা হয় প্রফেশনাল থিয়েটারে ঢুকে যায়, সেখান থেকে ইন্ডাস্ট্রিতে; কিংবা দুই একদিন রিহার্সালে আসে, তারপর বিয়ে/পড়ালেখা/পরিবারের মানা ইত্যাদি অজুহাতে আর খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। দিনশেষে পনেরো থেকে পঁচিশ বছর বয়সের নায়িকার রোল দিতে হয় চল্লিশোর্ধ আণ্টিদের – যাদের একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে তারা নারী, এবং নাটকে আগ্রহী। মেয়ে না পেয়ে ষোল বছর বয়সের ছোকরাকে পরচুলা আর শাড়ি পরিয়ে স্টেজে নামাতে হয়েছে – এমন দৃষ্টান্তও আছে আমাদের! সুতরাং সেখানে নীরার মতন কাউকে দেখলে খুশি হবারই কথা।

যদিও আমাদের খুশি বেশিক্ষণ টিকলো না। নীরার সাথে শুষ্ক কাষ্ঠখণ্ডের খুব একটা তফাৎ নেই। বেচারিকে যে পার্ট-ই দেই, যে লাইন-ই পড়তে বলি, একইভাবে পড়ে। দুঃখে চোখ দিয়ে পানি পড়লেও একই গলা, রোমাণ্টিক ডায়লগেও তাই, রসিকতা করতে গেলেও তাই। কি বিপদ!

সুতাব্বু একটু ডিরেকশন দেওয়ার চেষ্টা করলো। আমিও বললাম, ‘ঠাকুরঝি একটা চঞ্চল মেয়ে, নিতাইয়ের গুণমুগ্ধ, নিজে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও নিতাইয়ের প্রতি সে টান অনুভব করে। আপনার এক্সপ্রেশনে এই টান ফুটিয়ে তুলতে হবে। ঠিক আছে?’
কিসের কি। নীরা সেই একঘেয়ে গলাতেই সংলাপ আউড়ে যাচ্ছে।

সুতাব্বু অন্য পথ ধরে। আপনি থেকে তুমি-তে নেমে আসে, ‘মা, কিছু মনে করো না। একটা পারসোনাল প্রশ্ন করি?’
নীরা মাথা তুললো, ‘বলুন?’

‘তুমি কি কখনো প্রেমে পড়ছো? অন্যভাবে নিও না। জিজ্ঞাসা করার কারণ হচ্ছে – তুমি আসল জীবনে প্রেমের যে উষ্ণতা, যে তীব্রতা – সেটারে নাটকে নিয়ে আসার চেষ্টা করো। বুঝলে?’

নীরা ভুরূ কুঁচকালো, ‘আসলে আমি তো কোথাও স্থির হতে পারি নি, এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে – দৌড়ে বেড়াতে হয়। তাই সেই ভাবে সুযোগ হয় নি-’ সুতাব্বু কথা শেষ করতে দিলো না, ‘উহু, চাকরিজীবন বাদ দাও। স্কুলে হয়নি? কলেজে? ভার্সিটিতে? মানুষ কম বয়সে প্রেমে পড়ে না? সেটার কথা বলছি।’

নীরা এবার চিন্তা করলো কিছুক্ষণ, ‘স্কুলে থাকতেও তেমন সুযোগ হয়নি। আব্বা সরকারি চাকরি করতেন, ঘন ঘন বদলি হতেন। আমি স্কুলে যেতাম আর আসতাম। বন্ধু ছিল না।’ শুনে সুতাব্বু হতাশ হয়ে আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে, এদিকে নীরা বলে যাচ্ছে, ‘অবশ্য প্রেমে পড়েছি- সিনেমার নায়কদের প্রেমে। মানে যেখানেই যাই, বন্ধু পালটায়, কিন্তু টিভি খুললে তো সেই একই নায়কদের দেখা যায়, তাই না? তখন মনে হতো যেন আমরা একসাথে আছি সবসময়, জীবনসঙ্গীর মতন। তাদের সিনেমা দেখতাম, তারপর রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, আমরা একসাথে ঘুরছি, ডেট করছি, তারপর সংসার করছি – এরকম। বিশেষ করে উত্তমকুমার আছেন না? অনেক আগে মুভি করতেন? উনি আমার ফেভারিট। এটাকে প্রেম হিসেবে ধরা যাবে?’

সুতাব্বু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘হ্যাঁ মা, কেন যাবে না। অবশ্যই যাবে।’
আমি বেগতিক দেখে সমাপ্তি টেনে দিলাম আলোচনার, ‘নীরা, আপনি এসেছেন, খুব খুশি হয়েছি আমরা। নিচে অপেক্ষা করুন গিয়ে, ঠিক আছে? বাকিদের সাথে পরিচিত হোন। আমরা অন্যান্যদের অডিশন সেরে আপনাকে ডাকছি।’

কি আর করা, অন্য পার্টের জন্য দেখতে লাগলাম। লিড ফিমেল ক্যারেকটার ‘বসন্ত’ হিসেবে নিতু নামের একজনকে পছন্দ করলো লিটু ভাই, কাজ চালানো যাবে আর কি। বসন্তের দলের প্রধান, ‘মাসীমা’ হিসেবে পেলাম এক আণ্টিকে। কিন্তু ঠাকুরঝি আর মেলে না, খালি মাসীমা পাই। মাসীমা আর ঠাকুরঝির পার্ট-প্রার্থীর রেশিও বিশ ইসটু এক। লিটু ভাই ঘণ্টাখানেক পর ক্ষেপে গেল, ‘ধুর, অই মেয়েকেই পার্ট-টা দে তো বাল। সেকেণ্ডারি রোল, মনিরের সাথে দাঁড়ালে কে আর দেখতে যাচ্ছে অভিনয় পারে কি না পারে। মনিরকে ডেকে দুইজনকে একসাথে রিহার্সাল করিয়ে দেখ।’

মনির বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়ে একা একা দরজা আটকে রিহার্স করছে। ওকে ডাকতে লোক পাঠালাম। এদিকে লিটু ভাই নীরাকে ডেকে নিয়ে এলো। অবাক হয়ে দেখি, কাঁদছে মেয়েটা! বারবার চোখ মুছছে। ‘কি হয়েছে, মা?’ সুতাব্বু ওকে কাছে নিয়ে বসালো।

‘আমার অভিনয় জঘন্য, তাই না?’ নীরা মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো। শখের থিয়েটার করা লোকজন এই টাইপের কথার সাথে, আত্মসংশয়ের সাথে খুব পরিচিত। এসময় আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠিয়ে দেওয়ার জন্যে যেকোন মিথ্যে বলা জায়েজ। সুতাব্বু তাই প্রতিবাদে গর্জন করে উঠলো, ‘অসম্ভব! কে বলেছে এই কথা?’
-‘বলতে হবে না আন্টি। আমি জানি। আপনি উষ্ণতা চাচ্ছিলেন, সেটা নেই আমার মধ্যে। নিজেকে চলতা-ফিরতা বরফখণ্ড মনে হয় মাঝেমধ্যে, জানেন?’
‘কি সব বলছো, মা!’
-‘সত্যি! আমি ইচ্ছা করে এমনটা হই নি, বিশ্বাস করুন! ছোটবেলা থেকে মানুষের সাথে মিশতে পারতাম না, বন্ধু বানাতে পারতাম না, মানুষ ভাবতো আমি অহংকারী। আমার কি ইচ্ছা করে না সবার সাথে মিশতে? আড্ডা দিতে? সারাদিন ঘরে বসে সিনেমার নায়কদের নিয়ে ফ্যাণ্টাসিতে আর কতো ডুবে থাকা যায়? বাস্তব জীবনে কাউকে ভালো লাগলে আমি কেন যেন আর এগুতে পারি না’, নীরাকে অসহায় দেখায়, ‘কথা ভুল বলে ফেলি। ভুল কাজটা করি। কিংবা হার্টবীট বেড়ে যায়, টেনশনে যোগাযোগ-ই বন্ধ করে দেই। যেন আমাকে কাঁচের বোতলে বন্দী করে রেখেছে কেউ’, নীরা দুই হাত দিয়ে অদৃশ্য একটা দেয়ালে ব্যর্থ ধাক্কা মেরে দেখায়, ‘ভেতর থেকে দেখি সবই, কিন্তু ছুঁতে পারি না বাইরের কাউকে।’

আমরা কেউই সাইকায়াট্রিস্ট নই, সুতরাং সান্ত্বনা দেবো, নাকি জবাবে উপযুক্ত কী বলবো খুঁজে পাই না। বিব্রত হয়ে এদিকে ওদিকে তাকাই।

নীরা বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে সুতাব্বুকে বলে, ‘আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন কখনো প্রেমে পড়েছি কি না। পড়িনি। কিন্তু পড়তে চাই। আমি জানি এই নাটক কি নিয়ে। উপন্যাসটা পড়া আছে আমার। আমি জানি ঠাকুরঝির ক্যারেকটার কতটা চঞ্চল, কতটা উষ্ণ হওয়া উচিত; ঠাকুরঝি কি অনুভব করে, কেন অনুভব করে – আমি বুঝতে পারছি সবই। কি-কিন্তু...’

সুতাব্বু নরম গলায় বলে, ‘কিন্তু কি, মা?’

‘কিন্তু...’, নীরা আবারো অদৃশ্য দেয়ালে হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে দেখায়, ‘সেই বোতলবন্দীই মনে হচ্ছে নিজেকে। বেরিয়ে আসতে পারছি না।’

নীরার কথা শেষ হবার সাথে সাথে দরজা ক্যাঁ—চ করে খুলে যায়।

‘ফুলে ধুলে প্রেম হয় না ফুল ফুটিবার কালে!
ফুল ফোটে সই চাঁদের পানে নাচে হেলেদুলে!
বলো!!
ধুলা থাকে মাটির বুকে, চরণতলে অধোমুখে-
ফুল ঝরিলে দু’জন মেলে এই লেখা কপালে!’
বলো!!


এরকম গুনগুণ করতে করতে ঘরে ঢুকলো মনির, খানিক হাঁটছে খানিক নাচছে – দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিতাই এখনো পুরোদমে ভর করে আছে ওর ওপর। আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম, ‘মনির, ইনি নীরা, ঠাকুরঝির পার্টের জন্যে এসেছেন। আর নীরা – ওর নাম মনির; আমাদের লিড ক্যারেকটার।’ মনির আমার কথা শুনলো, কিন্তু হাই-হ্যালোর বালাইতে গেল না। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নীরার ভেজা চোখমুখের দিকে, দু’পা সামনে এগিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত মুখে বললো, ‘ও ঠাকুরঝি, কাঁদছো কেনে?’

এবার নীরার অবাক হবার পালা। মেয়েটা বললো, ‘সরি?’
-‘বলি, কাঁদছো কেনে? কষ্ট পেয়েছো মনে?’ মনির কোমলসুরে জিজ্ঞেস করে।
নীরা কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে যায়। অপ্রস্তুত হয়ে কান্নাও বন্ধ হয়ে গেছে তার। আমি এই সুযোগে টপিক আবার নাটকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি, ‘মনির, তুমি আর নীরা একসাথে একটা সীন করো। এই যে তোমাদের স্ক্রিপ্ট’, মনির হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয়, আর নীরাকে ল্যাগব্যাগে হাতে প্রায় জোর করে গুঁজে দিতে হয়, ‘আট নং পেজ থেকে পড়ো, রোমান্সের সীনটা; বেশীক্ষণ লাগবে না। দুই মিনিটের ব্যাপার।’

মনির কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর নীরাকে বলে, ‘ঘোমটা দেবে না? ঠাকুরঝির মাথায় ঘোমটা থাকে।’
নীরা বিনা প্রশ্নে ঘোমটা দেয়। দু’জনে তারপর স্ক্রিপ্ট দেখে দেখে সংলাপ শুরু করে।

আমরা অবাক হয়ে দেখি – মনিরের সাথে নীরার খাপে খাপে যেন মিলছে কোথাও, কিন্তু ঠিক ধরতে পারি না। নীরার আড়ষ্টতা একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে থাকে; এক্সপ্রেশনে, গলার স্বরে সহজাত একটা ছন্দ চলে আসে। দুই মিনিট পার হয়ে প্রথম ওর মুখে স্বতঃস্ফূর্ত হাসি ফোটে; দশ মিনিট, তারপর বিশ মিনিট হয়ে যায় – ওদের থামার নাম নেই। একে অপরের দিকে তাকিয়ে, হেসে, ওরা এমনভাবে সংলাপ বলে যাচ্ছিল যে সেসব আর সংলাপ মনে হচ্ছিল না।

এদিকে আরো অডিশন বাকি আছে, আমি বাধ্য হয়ে আধঘণ্টা পর থামতে বলি। মনির তো মনির-ই, একটা নার্ভাস হাসি দিয়ে ও আরেকবার জিজ্ঞেস করে – পার্টটা পাবে তো? তারপর আশ্বাস পেয়ে বাইরে চলে যায়। কিন্তু নীরা তখনো চুপ; ওর চোখে কেমন একটা ঘোর জমে আছে। যেন স্বপ্ন দেখছিল, এইমাত্র ঘুম ভাঙলো। কিংবা আজ থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু করলো নতুন করে।

সুতাব্বু নীরাকে পারলে জড়িয়ে ধরে, ‘দেখছো, মেয়ে নাকি অভিনয় পারে না! এটা কী ছিল তাহলে?’
নীরা ঢোঁক গিলে বলে, ‘অ-অভিনয়? ভালো হয়েছে?’
-‘খালি কি ভালো? মার্ভেলাস! ফাস কেলাস!’

নীরা একরকম হতভম্ব হয়ে বেঞ্চিতে বসে থাকে, যেন ওর সাথে এইমাত্র কি হলো বুঝে উঠতে পারেনি। আমি আস্তে করে বলি, ‘নীরা?’
-‘হু?’
‘আপনি সিলেক্টেড। কাল সন্ধ্যে থেকে রিহার্সাল। ঠিক আছে?’
-‘হু’। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ যদি কিছু না বলে, এরকম আজীবন সে থম মেরে বসে থাকতে পারবে। তাই মনে করিয়ে দিলাম, ‘অডিশন শেষ কিন্তু। ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারেন।’

সে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায়। লিটু ভাই খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে, ‘খালি নাকি বতল-বন্দী বতল-বন্দী। মনির এসে বতল ভেঙ্গে দিছে, এখন? পুরাই বলদ হয়ে গেছে মেয়েডা।’

আমি কথা না বাড়িয়ে পরের প্রার্থীকে ডাকলাম। বহু কাজ বাকি।




৪.
ইস্কুলের অডিটোরিয়ামে সপ্তাহে নিয়মিত পাঁচ রাত করে রিহার্সাল শুরু করে দিলাম আমরা। যেকোনো ভাল নাটকে একটা অন্তর্নিহিত ছন্দ থাকে, সেটা আস্তে আস্তে প্রাকটিস করতে করতে আয়ত্তে আসে। তার আগে ডিরেকটরের ঘাম ছুটে যায় - মানুষকে লাইন মুখস্ত করাও, কোথায় কোন এক্সপ্রেশনের ভুল সেটা দেখিয়ে দাও, কলাকুশলীদের মধ্যে কেমিস্ট্রি জন্মাচ্ছে কি না, টাইমিং ঠিক থাকছে কি না তা দেখো – ঝামেলার অন্ত নেই।

আনন্দের ব্যাপার, নীরা আর মনিরকে কিছু বলতে হচ্ছিল না আমার। ঠাকুরঝি ক্যারেকটারে নীরা নিজেকে এতোটা ঢেলে দিচ্ছিল, আমি হাঁ করে দেখছিলাম শুধু। এটাই কি সেই শুষ্কং কাষ্ঠং মেয়েটা? যে কারুর সাথে মিশতে পারে না বলে কাঁদছিলো সেদিন?

ওর সাথে সম্পর্ক তুমিতে সহজ হয়ে এসেছে তখন।

তবে লিটু ভাই ভুল কিছু বলে নি। ‘বোতল ভাঙা’র ফল টের পেলাম দ্বিতীয় সপ্তায় এসে। নীরা ব্যাকরুমে আমাকে আর আশরাফকে প্রায় কোণঠাসা করে ধরলো, ‘ভাই, আমি কি খারাপ অভিনয় করি?’ ওর অকস্মাৎ প্রশ্নে অবাক হলেও এবার আমি মন থেকে অনেস্ট উত্তর দিলাম, ‘মোটেই না। ঠাকুরঝির রোল তোমার চে ভালো কেউ করতে পারবে না।’ নীরা যেন আরও সাহস পেল এই কথায়, হুট করে বলে ফেললো, ‘তাহলে আমি যদি লিড ফিমেল ক্যারেকটার করতে চাই, দেবেন?’

আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়, ‘বসন্তের ক্যারেকটার তুমি করতে চাও?’
-‘হ্যাঁ!’
‘তাহলে ঠাকুরঝি কে হবে?’
-‘আচ্ছা, আমি বলি – শুনুন। ডাবল রোল করবো। ঠাকুরঝি আর বসন্তের একসাথে কোন সীন নেই কোথাও, চেক করে দেখেছি, ঠিক আছে? মেকআপ আর পোশাক ওদের পুরো আলাদা, দর্শক ধরতেই পারবে না। তাছাড়া বসন্তের সব লাইন আমার মুখস্ত, ভাই, মনিরের সাথে আমার বোঝাপড়াও ভালো’, নীরার কণ্ঠে কাকুতি ঝরে পড়ে, ‘দেবেন?’

বলে কি মেয়ে! আমি কিছু বলার আগেই আশরাফ আপত্তি তোলে, ‘দেখো নীরা, বসন্তের রোলে নিতু অলরেডি রিহার্স করছে, দুই সপ্তা হয়ে গেছে। ওকে এখন সরানো সম্ভব?’

নীরার চোখ সরু হয়ে ওঠে, ‘নিতুর রিহার্সাল আমি দেখেছি। ওর কি মনিরের সাথে বিন্দুমাত্র কেমিস্ট্রি আছে, আপনারাই বলুন? এই নাটকের হার্ট হচ্ছে বসন্ত; ও নিতাইকে কাছে টানবে, ভালোবাসবে, প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করবে – সেটা বিশ্বাসযোগ্য না হলে মানুষ নাটক দেখবে কেন? নিতুকে বরং বসন্তের সখীর রোলটা দিয়ে দেন, ভালো মানাবে।’

আহা, মেয়েটা যদি বুঝত, এভাবে যেকোন রোল হাইজ্যাক করা আর একটরের গালে টাটিয়ে থাপ্পড় মারা সমান কথা। আর তারমধ্যে কথা হচ্ছে লিড রোল নিয়ে। এভাবে হুট করে বললেই হলো? নতুন মেয়ে নিয়ে কাজ করতে গেলে এই এক সমস্যা। পরিস্থিতি বুঝতে চায় না।

আমি মেজাজ সামলে বোঝানোর চেষ্টা করি, ‘কনফিডেন্স থাকা ভালো, তবে একটু ধীরে ধীরে এগোও। এরকম লাফিয়ে উঠে আরেকজনের অডিশন-করা-রোল দখল করতে চাওয়া ভালো দেখায় না। তাছাড়া দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্যারেকটারকে একাই প্লে করার কথা বলছো। কেমন ক্ষমতা লাগে ডাবল রোল করতে গেলে, বোঝো?’

নীরার গলায় দ্বিধার চিহ্নমাত্র নেই, ‘আমি জানি আমি কি বলছি। মনিরের সাথে বসন্তের একটা সীন আমাকে করতে দিয়ে দেখুন, তারপর যা করার করবেন। ঠিক আছে? একটা সীন জাস্ট!’

করুক একটা সীন! করার পরে মানা করে দেবো, তখন যদি ঠাণ্ডা হয়। নিমরাজি হয়ে সায় দিলাম। নীরা মনিরকে ব্যাকস্টেজ থেকে ধরে নিয়ে এলো মঞ্চের মাঝখানে, তারপর...

তারাশঙ্কর বসন্তের বর্ণনায় বলেছিলেন, ‘মেয়েটি শুধু মুখ ভরিয়া হাসে না, সর্বাঙ্গ ভরিয়া হাসে’। বসন্ত সমাজব্যবস্থার বাইরের মেয়েমানুষ- উদ্দাম, উত্তাল একটা ক্যারেকটার। নাচতে জানে। গাইতে জানে। খোঁচা মেরে কথা বলতে জানে। খোঁচা সইতে না পেরে কাঁদতে জানে। বসন্ত – এক কথায় – প্রচণ্ডভাবে ভালবাসতে জানে।

মঞ্চে যা হচ্ছিল সেটা- ব্রিলিয়ান্ট একটিং? নাকি অন্য কিছু? - আমি জানি না কি বলবো। কিন্তু এক কথায়, চোখের সামনে বসন্তকে দেখতে পাচ্ছিলাম। সীন শেষ হবার আগেই নিতু উঠে বের হয়ে গেলো। কোন কথাই শুনলো না। যাওয়ার আগে অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে একবার শুধু বলেছিলো, ‘ভাই, আমি অভিনয় করতে এসেছিলাম, ছোটলোকের মত রোল নিয়ে রাজনীতি করতে নয়। ওকেই দেন পার্টটা। পাগলের সাথে পাগলই যায়। আই কুইট।’

নীরা মনিরের সাথে দৃশ্যটা শেষ করে আমার দিকে বিজয়ীর ভঙ্গিতে তাকায়। নিতুকে বের হয়ে যেতে দেখেছে ও, বুঝতে পেরেছে ঘটনা। আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছিল এভাবে একটা শিল্পী হারিয়ে। ওকে একচোট ঝাড়লাম, কড়াগলায় থ্রেট দিয়ে বললাম, এরকম কাজ আমি কিন্তু দ্বিতীয়বার সহ্য করবো না। নীরা মাথা পেতে সব শুনলো, মেনে নিলো।

তবে অস্বীকার করবো না, হাসিমুখে যখন ও মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসছিল – আমি মনে মনে মিলিয়ে দেখেছিলাম। সত্যি, কোন ভুল নেই। পারফেক্ট কাস্টিং। মেয়েটি শুধু মুখ ভরিয়া হাসে না, সর্বাঙ্গ ভরিয়া হাসে।

এই অবিসংবাদিত বিজয়ের পর নীরার নাটক-সংক্রান্ত প্রচেষ্টা আরও বেড়ে গেলো। নাটকের আশিভাগ এখন ওদের দু’জনের কাঁধে, সুতরাং কারুর সামান্য খামতি থাকলেই মাঝখানটায় ঝুলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। নীরা জান লড়িয়ে দিতে লাগলো। সন্ধ্যেয় এসে নাচের ট্রেনিং নেয়; তারপর দেড়ঘণ্টা রিহার্সাল, তারপর আবার নাচের ট্রেনিং। আমাদের বারংবার মানা সত্ত্বেও ঠাকুরঝি আর বসন্তের জন্যে আলাদা আলাদা পোশাক পরে সে প্রাকটিস করবে- যাতে মনিরের সুবিধা হয়। ঘামে সারা শরীর ভিজে যায় বেচারির, প্রাকটিস শেষে কোনমতে চেয়ারে উল্টেপাল্টে নির্জীব পড়ে থাকে। ওকে আর মনিরকে দেখে বাকিদের ওপরেও প্রভাব পড়তে শুরু করলো। কেউ প্রাকটিস মিস দেয় না। সবার রিহার্সাল এতো ইমোশনাল রূপ নিতে শুরু করলো যে আমিই মাঝেমধ্যে হাসতে হাসতে তুইতোকারি করতাম, ‘সব রিহার্সালেই শেষ করে দিবি তোরা? নাটকের জন্য কিছু তো বাদ রাখ!’

সুতাব্বু এরমাঝে সময় করে একদিন আমাদের অবস্থা দেখতে এসেছে। নিবিষ্টমনে নীরা-মনিরকে দেখতে দেখতে আমাকে প্রশ্ন করলো, ‘কাহিনি বুঝতে পারছিস?’
-‘কার কাহিনি?’
সুতাব্বু হাত দিয়ে ইশারা করে দেখায়, ‘নীরার। মেয়ে তো গেছে।’
-‘নীরা? মনিরের সাথে?’
‘তাহলে? ও কি জানে, নাটক যেদিন শেষ, নিতাই-ও সেদিন খতম? মনির নামের অধঃক্ষেপ পড়ে থাকবে কেবল। যখন বুঝবে, গলায় কলস বেঁধে যমুনায় নামবে রে, দেখিস! মেয়েটারে তুই সাবধান করে দিস।’

আমি কিছু বলিনি। এসব পারসোনাল ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাই না। সুতাব্বু অবশ্য নীরার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেছে এ নিয়ে। এক রাতে রিহার্সাল শেষে আমরা ক্লান্ত হয়ে বসে আছি সবাই। বিড়ি-চা-বিস্কুট চলছে। সুতাব্বু নীরার সাথে গল্প করছে, ‘জানো মেয়ে, বছর তিনেক আগে আমরা ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ তুলেছিলাম মঞ্চে। আর নায়িকা খুঁজে পাই না। কি বিপদ! লাস্টে মিতুল বলে – যাও, তুমিই করো রোলটা। পরে আমি – এই থুত্থুড়ে বুড়ি – হলাম জোহরা, আর আমার বিপরীতে মনির সাজলো ইব্রাহিম কার্দি!’

নীরা হেসে ফেলে, ‘কি কপাল আপনার আণ্টি!’

সুতাব্বুও হাসে, ‘কপাল-ই তো! মাঝেমধ্যে অভিনয়ের গভীরে ঢুকে যেতাম, এত টানটান উত্তেজনা চলে আসতো; মনিরকে সত্যি সত্যি কার্দি মনে হতো, মনে হতো সত্যি সত্যি ওকে ভালোবেসে ফেলছি। নিজেকে তখন জোর করে বাস্তবে কান ধরে ফিরিয়ে আনতাম – উহু, আমার সামনের মানুষটা পেশবার জেনারেল নয়, নয় কোন শৌর্যে-বীর্যে অদ্বিতীয় সামরিক সুপুরুষ – এইটা মনির। বয়সে হাঁটুসমান একটা ছেলে যে মুদির দোকানদারি করে।’

‘আণ্টি, এত ছোট করে কেন বলছেন?’ নীরা যেন একটু আহত হয়।

সুতাব্বু বলে, ‘না না, ছোট কেন করবো, জাস্ট বাস্তবতাটা বলছিলাম। ও তো ওর মতন করে স্পেশাল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে ধাক্কাটা লাগে নাটকের শেষ দিনে।’
নীরা বলে, ‘কি হয় শেষ দিনে?’
-‘নাটক শেষ, মনিরের ক্যারেকটার-ও শেষ। আমি আর কার্দির ছিটেফোঁটা পাইনি ওর মধ্যে। তুমি দেখো, এই নাটক শেষে ওর মধ্যে নিতাইয়েরও চিহ্ন থাকবে না কোন। এটাই শক লাগে। একটা মানুষ এতটা মেথড অ্যাকটিং করে কীভাবে!’
নীরা মাথা নাড়ে, ‘বিশ্বাস হলো না আণ্টি। ক্যারেকটারের সাথে একটু-আধটু মিল না থাকলে কেউ এত ভালো অভিনয় করতে পারে না। ভালো করে দেখলে অনেকখানি মনিরের মাঝে কোন জায়গায় একটুখানি নিতাই ঠিকই খুঁজে পাবেন।’
সুতাব্বু মলিন হেসে বলে, ‘জানি মা। আমারো বিশ্বাস হতে চায়নি প্রথমে।’

নীরা এবার একটু রেগে যায়, ‘তা হোক। এসব আমাকে বলছেন কেন? আমার কি তাতে?’
সুতাব্বু বলে, ‘ভাবলাম একসাথে কাজ করছো; জেনে রাখা ভালো। তাই-’
নীরা আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উঠে চলে যায়। এরপরে আর আমরা কেউ ওকে কিছু বলিনি। হয়তো বলা উচিত ছিল। ক’দিন পর শুনলাম নীরা বিদ্যুৎ অফিসে বলে দিয়েছে – ও আর সারা বাংলাদেশ দৌড়াদৌড়ি করতে পারবে না। রীতিমতন হুমকি দিয়েছে- আশকোণা ব্রাঞ্চে যেন ওকে স্থির করা হয়। নইলে চাকরি ছেড়ে দেবে।

আমার তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। নাটকের চাপ কি জিনিস কেবল বুঝতে শিখছি। নীরার রোমাণ্টিক লাইফে নাক গলানোর সময় কোথায়? সুতরাং এসব খুব দ্রুত চাপা পড়ে গেলো। আর অতটা লক্ষ্য করতাম না।




৫.
আট সপ্তার রিহার্সাল শেষে সাহস করলাম, এবারে দর্শকের সামনে যাওয়া যায়। সবার দোয়া সম্বল করে, বুকে থুতু দিয়ে শো শুরু করে দিলাম। তিনদিন – বেস্পতি, শুক্র, শনি। আমার নির্দেশনায় প্রথম নাটক – তাও আবার কবিগান নিয়ে; আত্মা ধকধক করছিলো, না জানি কেমন রেসপন্স আসে! কিন্তু মনির আর নীরার অভিনয় সব সংশয় ঝেড়েপুঁছে সাফ করে দিলো। এই তিনটে দিন দর্শক হাঁ করে গিলছিলো প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা সংলাপ বিশ্বাস করছিলো; আর নাটকের শেষ অংশে বসন্তের মৃত্যুতে যেন বাজ পড়ছিলো একেকজনের মাথায়। শোকাহত নিতাই সব ছেড়েছুঁড়ে নিজের এলাকায় ফিরে যায়, শোনে তার ঠাকুরঝিও আর নেই; রাজনকে আঁকড়ে ধরে নিতাই যখন ফুঁপিয়ে উঠছিলো – ‘হায়, জীবন এত ছোট কেনে? এ ভূবনে?’ – সেই চিরন্তন আক্ষেপ ছুঁয়ে যাচ্ছিলো সব্বাইকে, দর্শকসারির কারুর চোখ আমি শুকনো দেখিনি। ঝপ করে প্রতিবার পর্দা নামতেই মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠছিলো অডিটোরিয়াম।

বেস্পতিবারে নীরার বস আর সহকর্মীরাও এসেছিলো নাটক দেখতে; নাটক শেষে যখন কলাকুশলিরা সবাই মঞ্চে চলে এসেছে দর্শকের হাততালি মাথা পেতে নিতে – নীরার বস বিশাল এক গোলাপ ফুলের তোড়া তুলে দিলো ওর হাতে। নীরা সামনে এগিয়ে তোড়া হাতে নিয়েছে, সেখান থেকে একটা ফুল বের করে মনিরকে দেওয়ার জন্যে কেবলই পিছু ঘুরলো- কিন্তু মনির ততোক্ষণে উধাও হয়ে গেছে।

দ্বিতীয়বার পর্দা নামলো এই বাড়তি দৃশ্যের লজ্জা ঢেকে দিতে- একটা মেয়ে ফুল বাড়িয়ে ধরে আছে, কিন্তু নেবার মানুষটা নেই।

ব্যাকস্টেজে গিয়ে দেখি বেচারি তখনো ফুল হাতে বসে আছে, চোখ ভেজা। আমাকে দেখে অসহায় হয়ে বলছে, ‘আমি কী করলাম? এভাবে কেন চলে গেলো ও? কোন কারণে মনে কষ্ট পেয়েছে?’

আমি সান্ত্বনা দিলাম, ‘মনির অমনই। তোমার কারণে চলে যায় নি। ও নাটক শেষে স্টেজে থাকতে অস্বস্তিবোধ করে।’
-‘কালকেও এমন করবে?’
‘হ্যাঁ।’
-‘আর লাস্ট দিন? শনিবারে শো শেষ করে একসাথে ডিনার করার কথা আমাদের সবার – ওখানে থাকবে না?’

আমি হেসে ফেলি, ‘বোকা মেয়ে, তোমার কি মনে হয় মনির এসবে কোনোদিন থাকে? মুখচোরা মানুষ সে। শনিবার নাটক শেষ করে বাড়ি চলে যাবে। দু’দিন স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী থাকবে, সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ। তারপর আবার মঙ্গলবার দোকানে গিয়ে বসবে। এমনটাই হয়ে আসছে আজীবন।’

নীরা মন খারাপ করে বলে, ‘ইস। মানুষটা কত একা! আপনারা কেউ ওকে সঙ্গ দেন না কেন?’
-‘সঙ্গ কি জোর করে দেওয়া যায়?’ আমি পালটা প্রশ্ন করি। নীরা উত্তর দিতে পারে না।

শুক্রবারে নীরার অভিনয় তেমন ভাল হল না। মেয়েটা কী যেন ভাবছে, মনোযোগ অন্যদিকে। নাটক শেষে মনির চলে গেলো, নীরা কিছু না বলে স্রেফ চেয়ে চেয়ে দেখলো।

পরের দিন শনিবার মেয়েটা তার শ্রেষ্ঠ অভিনয়টা করে দেখালো। এমনিতে মনির থাকে আমাদের মধ্যমণি, কিন্তু সেদিন সেও ম্লান নীরার কাছে; বসন্তের মৃত্যুদৃশ্য দেখে আমাদের গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল – কি বিশুদ্ধ, খাদবিহীন বিষাদ! এইভাবেও তাহলে অভিনয় করা যায়?

তারপর নাটক শেষে পর্দা নেমে এলো। মনির পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু পারছে না। নীরা ওর হাত ধরে আছে। ওদের চারপাশে ঘিরে রেখেছে বাকি কলাকুশলিরা। মনির হাত ছাড়াবার জন্য টানাটানি করে, ‘আচ্ছা, আমি তাহলে আসি?’
নীরা হাত ছাড়ে না, ‘কই যাবে?’
‘এইতো’, মনির ইতস্ততঃ করে, ‘বাড়ি।’
‘আজকে আমরা সবাই একসাথে ডিনার করবো। তুমি যাবে না?’
মনিরের মুখ লাল হয়ে যায়, ‘আমি আসলে, ওসবে অতটা...ভালো লাগে না আমার’, এইটুকু বলে আর কিছু বলতে পারে না সে। লজ্জায় তাকাতে পারছে না কারুর দিকে, মাথা নিচু করে আছে। ঠিক সুতাব্বু যেমন নীরাকে সেদিন বলেছিল - নিতাইয়ের ন-ও নেই তার মধ্যে আর।

‘ঠিক আছে’, নীরা বলে, ‘তোমাকে ছাড়তে পারি, এক শর্তে।’
মনির পারলে হাত ছাড়িয়ে দৌড় দেয় তখন, মানবসঙ্গ এড়ানোর জন্যে সে সব করতে রাজি, ‘কি শর্ত?’
‘একটা উপহার আছে তোমার জন্য। উপহার আমি নিয়ে আসবো, ততক্ষণ তুমি কোত্থাও যাবে না, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। এটাই শর্ত। রাজি?’
মনির রাজি হলো। নীরা গেল উপহার আনতে, এদিকে দর্শকেরা, এমনকি সহ-অভিনেতারাও এসে মনিরকে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, প্রশংসা করছে ওর অভিনয়ের, হাত মেলাচ্ছে। এসবের মধ্যে মনির কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল; প্রশংসায় ওকে আমি কখনো খুশি হতে দেখিনি। বেচারা প্রশংসা চায় না। বাড়ি যেতে চায়।

নীরা উপহার এনে মনিরের হাতে দিলো। একটা বই, রবিবাবুর ‘শেষের কবিতা’। মনির বিব্রত হয়ে বইটা নিলো, তারপর নিচুগলায় ‘থ্যাংকিউ’ বলে চলে যাবে, কিন্তু নীরা তাকে এত সহজে ছাড়ার পাত্রী না, ‘বইটা খুলে দেখবে না? আমার পছন্দের একটা সীন আছে, ঊনত্রিশ পৃষ্ঠায়। আমি পাতা ভাঁজ করে রেখেছি।’

মনির বলে, ‘ইয়ে, মানে...’

নীরা তাড়া দেয়, ‘দেখবে না আমার পছন্দের সীন কোনটা?’

মনির নিরুপায় হয়ে বই খুললো। নীরা ওর বুকের কাছে সরে এসে লাবণ্যের লাইনটা পড়লো, “আপন রুচির জন্যে আমি পরের রুচির সমর্থন ভিক্ষে করি নে।” তারপর থেমে বললো, ‘অমিত কি বলছে, পড়ো।’

মনির পড়তে চাচ্ছে না, কিন্তু ভদ্রতা বজায় রাখতে হবে তো! সে ছোট একটা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলো, তারপর নরমাল গলায় অমিতের লাইন পড়তে লাগলো, “এটা বেশ বলেছেন, তা হলে নির্ভয়ে শুরু করা যাক—

রে অচেনা, মোর মুষ্টি ছাড়াবি কী করে,
যতক্ষণ চিনি নাই তোরে?”


নীরা হাসিমুখে চেয়ে আছে মনিরের দিকে, চোখে জিজ্ঞাসা - তারপর? তারপর?

মনির পড়তে থাকে,
“কোন অন্ধক্ষণে
বিজড়িত তন্দ্রা জাগরণে
রাত্রি যবে সবে হয় ভোর,
মুখ দেখিলাম তোর।”


পড়তে পড়তে মনিরের কণ্ঠে উদাত্ত, দরাজ টান চলে আসে –
“তোর সাথে চেনা
সহজ হবে না--
কানে কানে মৃদুকন্ঠে নয়।
করে নেব জয়”


আমরা অবাক হয়ে দেখি মনিরের চোয়াল কি এক প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়ে যাচ্ছে, শরীরে চলে এসেছে টান টান ভাব। যেন দশ বছর কমে গেছে বয়স! নীরা ওর কাঁধ ধরে আস্তে আস্তে ব্যাকস্টেজের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। মনির আবৃত্তি করেই যাচ্ছে –
“হে অচেনা,
দিন যায়, সন্ধ্যা হয়, সময় রবে না,
তীব্র আকস্মিক
বাঁধা বন্ধ ছিন্ন করি দিক,
তোমারে চেনার অগ্নি দীপ্তশিখা উঠুক উজ্জ্বলি,
দিব তাহে জীবন অঞ্জলি।”


আবৃত্তি শেষ হতে-না-হতেই মনির নীরার হাত চেপে ধরলো। তারপর দুজন ব্যাকস্টেজ হয়ে, দরজা হয়ে – উধাও! ডিনারের সময় দুটোর একটাকেও খুঁজে পাওয়া গেল না। ওদের খবর অবশ্য পেলাম পুরো এক সপ্তা পর। বিয়ে করে ফেলেছে।

কাউকে দাওয়াত দেয় নি, তাতে আমরা রাগ করিনি (লিটু ভাই প্রস্তাব দিয়েছিলো শাস্তি হিসেবে মনিরের দোকান লুট করা হোক। সুতাব্বুর সাহায্য নিয়ে তারপর বহু কষ্টে আগ্রহী লুটেরাদের নিরস্ত করা হয়েছে)।

যতটুকু দেখি আর শুনি - মনির-নীরা বেশ সুখী দম্পতি। ওদের সম্পর্কের খুঁটিনাটি অবশ্য সপ্তায় সপ্তায় বদলায়। দুজন মিলে ওই মুহূর্তে কোন নাটক বা উপন্যাসটা পড়ছে – সেটার ওপর নির্ভর করে।

সেদিন কারেণ্টের বিলের ঝামেলা মেটাতে আবার গিয়েছিলাম বিদ্যুৎ অফিস। নীরার সাথে গল্প হলো। মেয়েটা কি হাসিখুশী! আগের নীরার সাথে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘জামাই-বউ ইদানিং কী পড়ছো? উপন্যাস, নাটক, কবিতা – কী?’

নীরা জবাব দেয়, ‘গত এক সপ্তা ধরে মজনুন আমার পিছু পিছু ঘুরছে, সম্রাট শাজাহান এসে পাণিপ্রার্থী হয়েছেন; আর প্যারিস এসে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে দুইবার!’ অপার্থিব শান্তিশান্তি চেহারায় বলতে থাকে ও, ‘বলুন তো ভাই, আমার মত সৌভাগ্যবতী আর কয়জন আছে দুনিয়ায়?’

আমি অভিনন্দন জানালাম। বললাম, এলাকার মানুষজন সবাই ওর সুখ দেখে খুশি। অনেকে আছে, বিশেষ করে মেয়েরা, একটুখানি হিংসা আর অনেকখানি আফসোসও করে বৈকি! শুনে নীরা মেকি-রাগে মুখ ঝামটা দিলো, ‘এতোটা বছর চোখের সামনে হেলায় পড়ে ছিলো, রত্ন চিনতে পারে নি – সে কী আমার দোষ? উচিত হয়েছে, এখন করুক আপসোস!’ বলেই হেসে ফেললো।

আমি কাজের কথা পাড়লাম। নাটক আরেকটা তুলছি সামনের মাসে। ডিরেকটর হিসেবে আমার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। নীরা আর মনির কী থাকছে?

‘তাই?’ নীরার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আমার প্রস্তাব শুনে। আগ্রহভরে প্রশ্ন করলো –

‘এবারে কী হচ্ছি আমরা?’


সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৮:০৭
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×