যতটুকু মনে পড়ে আশির দশকের শেষার্ধে আমাদের বাসায় সাদা-কালো টেলিভিশন ছিলো, ছিলো দু'ব্যান্ডের রেডিও। সে সময়টাতে রেডিও বিনোদনের একটা বেশ জনপ্রিয় মাধ্যম ছিলো। সকালবেলা রেডিওতে বাবা সংবাদ শুনতেন নিয়ম করে, ভুল না করে থাকলে সে সময় সম্ভবত বিবিসিও শোনা যেত রেডিওতে। তবে সে সময় সবচেেয়ে ভালো অনুষ্ঠানগুলো হতো, দুপুর বেলায়। অনুরোধের আসর গানের ডালি, বেবী লজেন্স সংগীতমালার মতো অনুষ্ঠানগুলো ছিলো বেশ হৃদয়গ্রাহী। সৈনিক ভাইদের নিয়েও খুব সম্ভবত একটা অনুষ্ঠান হতো, নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না এই মুহূর্তে। তবে অনেক জনপ্রিয় বাংলা গানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় এই অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমেই।
ছোটবেলা থেকে আমার বয়সী অনেকের মতো ঠিক এভাবেই আমারও পরিচয় হয়েছিলো সদ্য প্রয়াত শ্রদ্ধেয় এন্ড্রু কিশোর স্যারের গানের সাথে। তার সেই ভরাট গলা, সেই পুরোনো গান আজও আমাদের উদ্বেলিত করে। ভুল না বলে থাকলে, বাংলাদেশের কয়েকটা প্রজন্ম তার গান শুনে বড় হয়েছে, ভালোবেসেছে তার স্বকীয় গায়কীকে। সেদিক থেকে আমি বা আমাদের প্রজন্মটা বেশ ভাগ্যবান বলতে হবে। আমাদের এই একটা প্রজন্ম দেখেছে বা উপভোগ করেছে রেডিও থেকে অডিও ক্যাসেট, সিডি থেকে এমপিথ্রি, ইন্টারনেট এবং হালের এইচডি বা ফ্ল্যাক মিউজিক। সন্দেহ নেই আগামীতে আরো নতুন মাধ্যম হয়তো আসবে কিন্তু এ্যানালগ থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রবেশের এই সময়টা, বাংলা মিউজিক এর জন্য অনেক বড় একটা মাইলফলক। এর মাঝেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন আমাদের প্রিয় এন্ড্রু কিশোর। তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন হাজারো গান, সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সংগীতকে। তার অনেক জনপ্রিয় গান পরবর্তীতে ক্যাসেট এবং সিডি মাধ্যমে আসায় তা ব্যক্তিগত এবং জাতীয়ভাবে সংরক্ষণের সুযোগ তৈরী হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, জাতি হিসেবে আমাদের উচিত শুধু এন্ড্রু কিশোর নয়, আরো অন্যান্য যারা বিশিষ্ট গুণী শিল্পী আছেন বা ছিলেন, তাদের কর্মগুলোকে সংরক্ষেণের উদ্যোগ নেয়া। আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রনালয় এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান ডিজিটাল মাধ্যমে বা ইন্টারনেটে এগুলো সংরক্ষণ এখন আর কোন কঠিন বিষয় নয়। প্রয়োজন শুধু ইচ্ছের।
কিছুদিন আগেই আমরা হারিয়েছি, শ্রদ্ধেয় আইয়ুব বাচ্চুকে। যিনি বাংলা ব্যান্ড মিউজিকে নিয়ে গেছে ভিন্ন মাত্রায়, যায় অবদান এই জাতি মনে রাখবে দীর্ঘদিন। কিন্তু তারপরেও শুধু শিল্পীর গুনগান করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আমি বিশ্বাস করি একজন গুণী শিল্পী কোন না কোনভাবে একটা সমাজেরই প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন তার কাজের মাধ্যমে। তাদের অকাল প্রয়াণে কিছুটা উহ্ আহ্ করেই যেন আমরা ক্ষান্ত না হয়ে যাই। বরং তিনি বা তারা যা দিয়ে গেলেন আমাদের, তা সংরক্ষণ করে ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে তুলে দেয়ার একটা মানবিক এবং জাতিগত দায়িত্বও আমাদের রয়েছে। নয়তো এই লোক দেখানো মিথ্যে কান্না আর আস্ফালন আমাদের জাতিগত মানসিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ হয়েই থেকে যাবে অনন্তকাল ধরে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৩:৪৭