মানুষের জন্ম হওয়ার পর থেকে জ্ঞান হওয়ার (চেতনাবোধ জাগ্রত হওয়া) আগ পর্যন্ত অনেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়, কিছু সুখকর কিছু বেদনাদায়ক। ভালো বা মন্দের এই চেতনাবোধ স্বাভাবিকভাবেই মানুষের খুব একটা মনে থাকে না। অভিজ্ঞতা, যেমন ধরুন, জন্মের পর থেকে মা-বাবা, ভাই-বোন বা আত্মীয়-স্বজনদের অপার ভালোবাসা, আদর কিংবা স্নেহ পাওয়া কিংবা ছোট বেলায় কোন দুর্ঘটনায় পড়া বা আঘাত পাওয়া ইত্যাদি। যদি ধরা হয় ১৫/১৬ বছরের পর থেকে মানুষের মাঝে ধীরে ধীরে চেতনাবোধ গড়ে উঠতে শুরু করে, তবে মূলত একজন ব্যক্তির চেতনাবোধ ঐ সময়েরর পর থেকেই পরিপূর্ণভাবে সবকিছু অনুধাবন করতে শেখে। সময়ের সাথে সাথে তা সমৃদ্ধ বা এনরিচড হতে থাকে।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন আপনার বয়স ত্রিশের কোঠায়। আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বিগত ১৫ বছরে আপনার জীবনের কিছু বাজে অভিজ্ঞতার কথা বলুন এবং সমান সংখ্যক ভালো অভিজ্ঞতার কথা বলুন। দেখা যাবে, ভালোর তুলনায় খারাপ অভিজ্ঞতার বিষয়গুলো আপনার বেশী মনে আছে এবং তা আপনি তুলনামূলকভাবে ভালো অভিজ্ঞতার চেয়ে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছেন। খারাপের প্রতি মানুষের এই দুর্নিবার আকর্ষণ এবং সেটাকে নিজের ভেতর জিইয়ে রাখার এই প্রবণতাকে নেতিবাচক পক্ষপাতদুষ্টতা বা নেগেটিভ বায়াস বলা হয়।
পরিণত বয়সের যে কোন একটা সময়ে এসে যদি আপনি বিষয়গুলোতে সূক্ষ্মদৃষ্টিপাত করেন, তাহলে চারপাশের অনেককিছুতেই নেতিবাচকতা খুঁজে পাবেন, তার কারণ মানুষের ভেতর এই নেতিবাচকতা ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখার মতো অনেককিছুর সাথে অনেককিছুকে এক সুঁতোয় বেধে ফেলেছে। এটা একটা মানবিক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর এই নেতিবাচকতার ধারনাগুলো এক সময় মানুষের ভেতর এতটা বদ্ধমূল ধারনা হিসেবে প্রোথিত হয়ে যায় যে, মানুষ সেটাকেই স্বাভাবিকভাবে ভাবতে শুরু করে। ঠিক কি কারণে মানুষ তার চারপাশ সম্পর্কে এই নেতিবাচক ধারনাগুলো জিইয়ে রাখে তার সঠিক ব্যাখ্যা এখনো পুরোপুরিভাবে দেয়া সম্ভব নয় আরো গভীর আলোচনা ব্যতীত। আর আজকের লিখার কারণ সেটা নয়।
এক উদাহরণ দিচ্ছি, ধরুন একজন মানুষ ক্রমাগত মিথ্যে কথা বলে। আপনার মনে কি কখনো প্রশ্ন জেগেছে যে, কেন একজন মানুষ মিথ্যে কথা বলে। যে যখন ছোট ছিলো তখনতো সে মিথ্যে বলতো না। কারণ সে সময় সে বুঝতেই পারতো না যে মিথ্যে কথা বলতে কি বোঝায় বা সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া কেন ঠিক নয়। সে খুব অকপটেই সত্য বা স্বাভাবিকভাবে যেটা যে দেখেছে বা জেনেছে সেটাই বলেছে। যে কারনেই অনেক সময় আইনের চোখে ছোট বাচ্চাদের স্বীকারোক্তিমূলক কথা বা জবানবন্দীকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয় বা বিশ্বাসযোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়ে থাকে। বাহ্যিক বা নৈতিক বাস্তবতার জ্ঞান হওয়ার পরেই মূলত একজন মানুষ মিথ্যে কে রপ্ত করে নিজের প্রয়োজনে বা প্রভাবতি হয়ে।
প্রশ্ন হলো এ থেকে পরিত্রানের কোন উপায় আছে যাতে আমরা নেতিবাচকতার প্রভাব থেকে সরে আসতে পারি? উত্তরঃ আছে, সেটা হলো ন্যায়নিষ্ঠতা। আর আমার আলোচনার মূল বিষয় হলো এই ন্যায়নিষ্ঠতা ঘিরে। খুব সাধারণ ভাষায়, ন্যায়নিষ্ঠতা হলো এমন কিছু মানবিক গুনাবলী যা ভালো আর মন্দের মধ্যে থেকে ভালোর দিকে ধাবিত করে। এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন ন্যায়নিষ্ঠতা-র শতভাগ সঠিক ইংরেজী আমার জানা নেই। ইংরেজীতে সেটা "Righteousness" এর সমার্থক তবে সেটার আক্ষরিক মানে হলো "ধার্মিকতা"। মূল কথা হলো, পুরো সমাজ তথা আমাদের চারপাশের সবাই যদি সত্য বলে বা "সঠিক" (নীতিগতভাবে) কাজটি করে তাহলে অন্য একজন মানুষের মিথ্যে বা ভুল কাজ করার কোন শিক্ষা সে পাবে না তদুপরি সে সে ধরনের কাজও করবে না। কিন্তু ঐ যে মানুষ বরাবরই ভুলকে ভালোর আগে রপ্ত করে নেয়! সমস্যা সেখানেই।
দুই হাত বা পা নিয়ে জন্ম নিলেই আমরা তাকে মানুষ বলি কিন্তু কোন ব্যক্তি মানবিক ন্যায়নিষ্ঠতার গুনাবলী অর্জন না করেই কি প্রকৃত মানুষ হতে পারে? দুই হাত বা পা নিয়ে জন্ম নিলে সে আর দশটা প্রাণীর মতোই পৃথিবীতে বিচরণ করে কিন্তু "মানুষ" হওয়া কি আর হয়ে ওঠে? উত্তর হলো, ন্যায়নিষ্ঠতা ছাড়া মানুষ হওয়া বলতে আমরা যেটা সবাই বুঝি সেটা হওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সততা, সঠিক, আর ইতিবাচক নৈতিকতার মানদণ্ড কে নির্ধারণ করে দিচ্ছে? আপনি যদি মানুষের তৈরী নিয়মকেই নৈতিকতার মানদন্ড হিসেবে ধরতে চান তাহলে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে দ্বৈত নীতি (আপনার জন্য সঠিক অন্যের জন্য ভুল) দেখতে পাবেন। স্থান, কাল বা পাত্র ভেদে একই নিয়মের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র দেখতে পাবেন। অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমাজে মানব সৃষ্ট নিয়মের এই অসামঞ্জস্যতা আপনিও বুঝতে পারবেন। যেমন বড়লোক হলে অনেক ক্ষেত্রেই অন্যায় করেও পার পাওয়া যায়, গরীব হলে তার উপরই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অবিচার আর অন্যায়ের খড়গ নেমে আসে। তারা বরাবরই অবহেলিত। আমার জন্য ইতিবাচক ব্যাপারটি হয়তো আপনার জন্য নেতিবাচক বিষয়। তাহলে সবার জন্য ইতিবাচক বিষয়টি কেন আমরা রপ্ত করছি না। কারণ মানুষ বিভিন্ন কারনে পক্ষপাতদুষ্ট। যদিও মানব সৃষ্ট আইন বরাবরই ন্যায়-নীতির কথা বলে ঢাকঢোল পেটায়, তদুপরী সেটা বাস্তবে ততটা বাস্তবায়িত হতে দেখা যায় না। হাজার বছর ধরে মানুষ কেবল তাদের তৈরী ন্যায়নিষ্ঠার মানদণ্ডকে বিবর্তিত করেই যাচ্ছে কিন্তু সেটার পূর্ণতা আজও আসেনি।
ডিভাইন বা ঐশ্বিক কোন হস্তক্ষেপ ছাড়া সেটা কোনদিন সম্ভব বলেও আমি মনে করি না। আপনাদের কি ধারনা?
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২১ সকাল ১০:৪৯