খুব কম করে হলেও দিনে পাঁচ বার বাবাকে মনে পড়েই। এছাড়া কখনো শুয়ে থেকে, কখনো হাটতে গিয়ে কিংবা খেতে গিয়ে, বিভিন্ন সময়ে, কারনে-অকারনে। এক দিনে ঠিক কতবার বাবাকে মনে পড়ে তা হিসেব করা হয় নি। প্রবাসে আসার পর প্রায় বেশ কিছু বছর বাবা-মা'র সাথে নিয়মিত সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে কথা হতো। মা'র সাথে পারিবারিক কথা হতো বেশী। বাবা অফিসে থাকার কারণে রাতেই মূলত বাবার সাথে কথা হতো। এভাবে অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছিলো।
বড় ভাই জার্মানী থেকে পড়াশোনা করে দেশে ফেরার পরেই মূলত স্কাইপে ভিডিওতে কথা হতো। কিছুদিনের মধ্যেই বড় ভাই, মা'কে আইফোন দেয়া হলো, তখন থেকে নিয়মিত ভিডিওতে কথা হলেও বাবা বেশীরভাগ সময়ই শুয়ে থেকে কথা বলতেন। যাতে মা'র সাথে কথা বলার সময় বাবাকেও দেখা যায়।
২০১৮-এর শেষ দিকে, তখন আমার ছেলে রায়ান-এর জন্ম হলো। বাবা ভীষণ খুশি হলেন, ফোনে আমার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে নাতিকে দেখতেন, দোয়া করতেন। কথা শেষে মা'র সাথে নাতিকে নিয়ে চলতো আলোচনা, মা'কে বলতেন ওকে এটা কিনে দিয়ে আসো ওটা কিনে দিয়ে আসো। বাবা-র শরীর তখন ভালো ছিলোনা। একা একা কোথাও যেতে পারতেন না, কারো সাহায্য ছাড়া হাটা-চলা তার জন্য সমস্যার বিষয় হয়ে গেল। মাস খানেকের বাচ্চা নিয়ে আমার স্ত্রী আমাদের বাসায় এলো বাবাকে নাতি দেখাতে। বাবা কোলে নিতে পারলেন না, তার সে শক্তিও নেই। বাবার পাশে বিছানায় শুইয়ে রাখা হলো নাতিকে। তিনি দেখলেন, খুশিতে কাঁদলেন। যেদিন সে তার নাতিকে দেখলেন, সেদিন রাতে ফোন দিয়েও বাবা-মা'র সাথে কথা বললাম। সবকিছু ঠিক মনে হলেও মন যেন কেমন করছিলো। বাবা-মা'র সাথে কথা বলা শেষ করে ফোন রেখে দিলাম। কয়েক মিনিট পরেই আবার ফোন দিলাম। মা'কে বললাম বাবা'কে ফোনটা দিতে। ভিডিওতে কথা বলার সাহস হয়নি কেন যেন, তাই অডিও কলেই বাবা'র সাথে কথা হলো। অতীতের সব ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলাম, বললাম আমার জন্য দোয়া করতে। বললাম বড় ভাইকেও তিনি যেন তার ভুলের জন্য ক্ষমা করে দেন। বড় ভাই ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাননি। ফোনে বাবা কাঁদলেন, আমিও কাঁদলাম। ক্ষমা করলেন আর উপদেশ দিলেন যেন বড় ভাইয়ের সাথে কখনো বিবাদ না করি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো বাবার সাথে শেষ কথা হচ্ছে। হলোও তাই। সত্যি সত্যিই সেটাই ছিলো বাবার সাথে শেষ কথা।
এরপর মাত্র ক'দিন পরেই যেদিন বাসা থেকে ফোন এলে যে, বাবা হাসপাতালে, আমার তখনই মনে হয়েছে, খুব সম্ভবত এটাই বাবার বাড়ি থেকে শেষ যাত্রা। এরপর আর তার বাড়ি ফেরা হয়নি। হাসপাতাল থেকেই বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমাকে বলা হলো বাবা আইসিইউতে, আমার মন মানে নি। তখন আমার চাকুরি ছিলোনা, তবুও একদিনের মধ্যে টিকিট কেটে আমি বাড়ির পথে রওনা হলাম। ফ্র্যাঙ্কফুর্টে ট্রানজিট ছিলো, নিউ ইয়র্ক থেকে জার্মানীতে নেমেই বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম। বাবা'র কি অবস্থা? বড় ভাই বললেন "ভালো না" কিন্তু বললেন না বাবা আর নেই। বড় ভাইকে বললাম, বাবার যাইহোক আমি না আসার আগ পর্যন্ত যেন কোন বড় সিদ্ধান্ত না নেয়া হয়। তিনি আশ্বস্ত করলেন।
ঢাকায় নেমে দেখি বড় ভাই আসেন নি। ছোট চাচা এসেছেন আমাকে নিতে, গাড়িতে সরাসরি গ্রামের বাড়ি যেতে হবে বললেন। বাবা আর নেই সেটাও তিনি বললেন না। আমার বুঝতে আর বাকি রইলো না। গ্রামের বাড়ি পৌছে দেখি অনেক মানুষের ভিড়, আমার শ্বশুর, শাশুড়ী, ফুপু, চাচা, মামা আর একটা লাশবাহী গাড়ী। দু'চোখ বেয়ে কান্না নেমে এলো মনের অজান্তে। লাশবাহী গাড়ির দিকে গেলাম। দেখি, বাবা শুয়ে আছেন। ভাবলাম, বাবা এত ঠান্ডার মাঝে কিভাবে শুয়ে আছেন? তার কি ঠান্ডা লাগছে না?! হাওমাও করে কান্না চলে আসলো। আমি এত শব্দ করে খুব সম্ভবত এর আগে কখনো কাঁদিনি। বাবা চুপচাপ শুয়ে আছেন, কোন কথা জিজ্ঞেস করলেন না। আসার সময় কোন কষ্ট হলো কিনা, কেমন আছি কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। খুব অবাাক হলাম, বার বার মনে হচ্ছিলো এই হয়তো বাবা কথা বলে উঠবেন। তিনি কিছুই বললেন না।
আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমি আর বড় ভাই কবরে নামলাম। যতটা সম্ভব যত্ন করে বাবার পা ধরে নামালাম। বাবা তখনো শুয়ে ছিলেন, চুপচাপ, কোন কথা নেই। বাবার দিকে শেষ বারের মতো তাকালাম। মনে মনে বললাম, "বাবা, তোমার সাথে আবার দেখা হবে তুমি এই সৃষ্টির যেখানেই থাকোনা কেন, অনেক কথা বাকি রয়ে গেছে বাবা। এইতো আমি আসছি তোমার পিছু পিছু, আর মাত্র ক'টা দিন। সে পর্যন্ত তুমি অনেক অনেক ভালো থেকো, আমি আসছি।"
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২২