স্কুল জীবনের ভালো বন্ধুদের সাথে যে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা দীর্ঘদিন মনে থাকে সত্যি। তবে বড় হতে হতে ধীরে ধীরে জীবনের গন্তব্যও বদলাতে থাকে সবার। ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায় হলেও সে সব মানুষের উপস্থিতি ধীরে ধীরে জীবন থেকে আঁড়াল হতে থাকে। স্কুল পেরিয়ে কলেজ হয়ে বিশ্ববিদ্যলয় থেকে বের হতে হতে স্কুল জীবনের তেমন কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে ব্যতিক্রম যে একেবারেই নেই তাও নয়। আমি স্বাভাবিকক্ষেত্রের কথা বলছিলাম।
আমার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। কলেজে উঠেই আমার অনেক স্কুল জীবনের বন্ধু হারিয়ে গেছে। এরপর তো বাংলাদেশ ছেঁড়ে আমেরিকায় পাঁড়ি জমানোর পর তাদের ৯৯.৯৯% -এর সাথেই আমার সম্পর্ক এক প্রকার ছিন্ন হয়ে যায়। মানে তাদের সাথে বছরের পর বছর ধরে কোন যোগাযোগ নেই, দেখা নেই, কথা নেই। আমাদের প্রজন্মটা (মিলেনিয়াল) এমন একটা সময় বড় হয়েছে যেটা আমার কাছে বেশ ইউনিক মনে হয়। আমরা টাইপরাইটার থেকে কম্পিউটারের প্রচলন, ল্যান্ডফোন থেকে মোবাইল, ইন্টারনেট সবই আমাদের চোখের সামনে আর্বিভাব হয়েছে বা শুরু হয়েছে। তাই দুটো সময়ের পার্থক্য বেশ ভালোভাবে আমরা বুঝতে পারলেও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সেটা ঠিক পরিষ্কার বুঝতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
আমেরিকায় যখন পা রাখা হয় তখন বাংলাদেশের বাসায় বাসায় ইন্টারনেট ছিলো না, না ছিলো ফেইসটাইম না হোয়াটসএ্যাপ। কলিং কার্ড কিনে বাংলাদেশে ফোন দিতে হতো। কথা শোনা যেত কিছুক্ষণ পরপর। ঐরকম টাকা খরচ করে খুব বেশী বন্ধুদের সাথে কথা-বার্তা হতো না। ফলাফল হলো, ওদের জীবনের বিশাল একটা সময়ে আমার আর আমার জীবনে ওদের অনুপস্থিতি দেখা দেয়, কিছুটা দূরত্বও তৈরী হয়।
কয়েকদিন আগে আমার এক বাংলাদেশী বন্ধু আমাকে হোয়াটসএ্যাপের একটি গ্রুপে এ্যাড করে দেয়। ওখানেই অনেক পুরোনো বন্ধুদের দেখতে পাই। হঠাৎ করেই একদিন গ্রুপে খবর আসে, "ফারুক" আর নেই। ফারুক? নামটা চেনা-জানা কিন্তু কোন ফারুক? দেখতে কেমন? ছবি কোথায় পাই? ফেইসবুকে আছে নাকি? কিছুটা কষ্টবোধ থেকেই ওর রূহের মাগফেরাত কামনা করে গ্রুপে মেসেজ দিলাম, যদিও তখনও ওর অবয়ব মনে করতে পারি নি। আরেক বন্ধুকে নক করে ওর ছবি বের করে দেখে অনেকক্ষন "থ" হয়ে ছিলাম। আরে! এইতো সেই ফারুক! স্কুল জীবনের সদা হাসি-খুশিতে আমাদের মাতিয়ে রাখতো। ওর মনটা ছিলো কলুষমুক্ত, কখনো কারো সাথে ওর বাজে সম্পর্ক দেখিনি। তাহলে কি হলো? অবুঝের মতো অতি আবেগী আরেক বন্ধু ওর জানাজার ছবিটাও শেয়ার করে। আমি দেখতে থাকি ও অনন্ত ঘুমে বিভোর।
জানতে পারি, বন্ধু নিজেই নিজেকে সবার কাছ থেকে চিরজীবনের জন্য সরিয়ে নিয়েছে। ঠিক কোন অভিমান বা কষ্টে তা ঠিক জানা হয়ে ওঠে নি। ঐ যে, দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতি। সম্ভবত ও দীর্ঘদিন হাসে নি। কোন অজানা কষ্ট কিংবা অভিমান ওর ভেতরে ক্রমশ বড় হতে হতে একদিন ওকেই ছাঁপিয়ে গেছে। আঁড়াল হয়ে গেছে বন্ধুটিও।
বন্ধু, অনেক কথা বলার ছিলো, শোনার ছিলো। শেষ পর্যন্ত দেশে আসলাম কিন্তু তোর সাথে দেখা হওয়ার আগেই চলে গেলি। যেখানেই থাকিস, বন্ধু তুই ভালো থাকিস। ওপারে কোন একদিন, দিগন্তবিহীন কোন খোলা মাঠের এক কোনে বসে বাদাম চিবুতে চিবুতে তোর অজানা গল্পটাও শোনাস, আমিও হাসি না অনেকদিন।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২৫ বিকাল ৩:১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



