
বুঝতে পারি যে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান পাল্টা শুল্ক আরোপ নিয়ে বেশ বেকায়দায় আছে বর্তমান সরকার। এমন একটা সময়ে যে কোন সরকারই বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ার কথা। বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার উদ্দেশ্যে পাল্টা শুল্ক নিয়ে যে দর কষাকষি হচ্ছে তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ২৫ টি বোয়িং বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছি কিছুক্ষণ আগেই, তবে তাতে আমি মোটেও উচ্ছ্বসিত নই। আমার মনে হয় না এতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো কোন কারণ আছে।
বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এতগুলো বিমান কেনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা আমার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে এটা পরিষ্কার যে বিগত ২০২৩ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরকালে ১০টি এয়ারবাস এ৩৫০ কেনার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো হাসিনা প্রশাসন, সেটা খুব সম্ভবত আর এগুচ্ছে না। ঐ দশটি বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর একটা মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিমানের বহরকে ডাইভারসিফাই করা। বাংলাদেশের বিমান সংস্থা আগে থেকেই মূলত বোয়িং বিমান ব্যবহার করছে। সুতরাং নতুন করে বোয়িং ক্রয় করা হলে হয়তো ট্রেনিং-এর খরচ তুলনামূলকভাবে কম পড়বে। তদুপরি বোয়িং এর উপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা আরো অনেক বেড়ে যাবে। নেগোসিয়েশনের ক্ষমতা অনেকটাই কমে যাবে। এটাকে ঠিক ভালো সিদ্ধান্ত বলে আমার মনে হয় না। বিশ্বের সব বড় বড় এয়ারলাইন্স-ই তাদের বহরকে ডাইভারসিফাইড করার প্রয়াস করেন মূলত এসব কারনেই।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশ্বব্যাপাী বোয়িং এর আর্ন্তজাতিক বাজার যেখানে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে সেখানে এয়ারবাস দিন দিনই বোয়িংকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বিগত ২০২৪ সালেও বোয়িং এর সর্বমোট বিমানের ক্রয়াদেশ ছিলো ৩১৭ টি সেখানে এয়ারবাসের ছিলো ৮২৬ টি (সূত্র)। পূর্ববর্তী বেশ ক'বছর ধরেই এয়ারবাস বোয়িং কোম্পানীকে টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে। এর অগণিত কারন আছে যা হয়তো এই স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে উন্নত প্রযুক্তির প্রোডাক্ট, প্রোডাক্টের সার্ভিস ট্র্যাক রেকর্ড, ফুয়েল কনজামশন, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপত্তাসহ সবকিছুই এয়ারবাসের ফেভারে। যেখানে বিশ্বের বড় বড় বিমান সংস্থা ধীরে ধীরে এয়ারবাসের দিকে ঝুঁকছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চাপে পড়ে অনেকে দেশই বোয়িং থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তার কারন মূলত সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের চাপ। ইতোমধ্যে ভারত ও ভিয়েতনাম ১০০টি ও ইন্দোনেশিয়া ৫০টি বোয়িং বিমানের অর্ডার দিয়েছে। বাংলাদেশও এই ২৫টি বিমানের অর্ডার দিয়েছে অনেকটা বাধ্য হয়েই। তবে সেটা দেশের জন্য কতটা লাভজনক হবে তার সঠিক কোন হিসেব জনগণ পায় নি। কোন মডেলের বিমান কতগুলো করে কেনা হচ্ছে সেটাও জানা জরুরী।
বিমানকে লাভজনক করতে না পারলে, এগুলো কেবলই অর্থঅপচয় বলে গণ্য হবে। ভারতও তার জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাকে লাভজনক করতে পারেনি বিধায় টাটা কোম্পানী সেটাকে কিনে নিয়েছে (সূত্র)। আপাত দৃষ্টিতে বিমান বাংলাদেশ সে পথে না হাটলেও বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিমান ক্রয় করে কতটুকু মুনাফা অর্জন করা সম্ভব সেটাই দেখার বিষয়। তবে শেষ পর্যন্ত বিমান পর্যাপ্ত লাভের মুখ দেখাতে না পারলে বিমানকে কেনার মত কোন বাংলাদেশী কোম্পানী আছে কিনা, সেটা আমার জানা নেই। একটি রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠানকে প্রকৃত অর্থে লাভজনক না করে বছরের পর বছর জনগণের টাকা গচ্চা দিয়ে বিমানের মত ব্যয়বহুল কোম্পানীকে কতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে তা বোঝা জরুরী।
বিগত কয়েক বছরের বাংলাদেশ বিমানের লাভ-লোকসানের খতিয়ান:
২০১৮-১৯ = ২.০৯ বিলিয়ন (সূত্র)
২০১৯-২০ = ০.৮১ বিলিয়ন (সূত্র)
২০২০-২১ = ১.৫০ বিলিয়ন (সূত্র)
২০২১-২২ = ৪.৩৫ বিলিয়ন (সূত্র)
২০২২-২৩ = ০.২২ বিলিয়ন (সূত্র)
২০২৩-২৪ = ২.৮২ বিলিয়ন (সূত্র)
তথ্যসূত্র: বিমান বাংলাদেশ বার্ষিক প্রতিবেদন
উপরের খতিয়ান দেখে খুব বেশী আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই কারন পুরো সংখ্যাগুলোই টাকায় উল্লেখ করা হয়েছে। ডলারের হিসেবে পুরো সংখ্যাটিই বেশ নগণ্য বিশেষ করে ডলারের বিপরীতে টাকার মানকে যদি সঠিকভাবে ধরে হিসেব করা যায়। বাংলাদেশের অর্থ-ব্যবস্থায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখার জন্য অনেক প্রচেষ্টা চলে সেটাও আমাদের জানা থাকার কথা। যাইহোক, আমি নিশ্চিত সরকারে যারা আছেন এবং যারা এ সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন তারা আমার চেয়ে বিষয়গুলো নিয়ে অনেক বেশী জ্ঞান রাখেন এবং জানেন। তাদের উদ্দেশ্য দেশের জন্য ইতিবাচক হবে এমনটাই প্রত্যাশা করি। তারপরেও বলবো, চাপে পড়ে নেয়া সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের স্বার্থকে কতটুকু বড় করে দেখবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে আমার ধারনা এই মুহূর্তে বিমানের চেয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য সামরিক যুদ্ধ বিমান একটু বেশীই জরুরী। আমার বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে আমাদের বেশ ভালোই সমর্থন ও সহযোগিতা করতে পারবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ১:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


