~ ~
“ চার বছরের মেয়ে শিশু ধর্ষিত” ।
~ ~
“ স্বামীর পরকিয়ার বলি হতে হল রেহানাকে” ।
~ ~
“জরিপে উঠে এসেছে অবিশ্বাস্য কাহিনী । নিকটাত্মীয়ের দ্বারা মেয়েদের লাঞ্চনার হার বাড়ছে”।
~ ~
“শাশুড়ির হাতে অত্যাচারিত কয়েকজনের করুণ কাহিনী” ।
ইদানীং মাঝে মধ্যে পত্রিকার পাতায় পচা-গলা সমাজের এইসব সংবাদ পড়ে সুমন একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে, মাথায় হঠাত রক্ত চড়ে যায়, মুষ্ঠিবদ্ধ হাতদুটো কাকে যেন অদৃশ্যভাবে কিছুক্ষণ মারতে চায় ।
ইদানীং সুমনের মাঝে মধ্যে অদৃশ্য সুপারম্যান হতে মন চায় । তাতে করে প্রচলিত আইন কানুন, সমাজের ভণ্ড শাসন উপেক্ষা করে নারী নিপীড়নকারীদের আচ্ছাসে পেটানো যেত ।
ইদানীং সুমনের মনে হয় ছেলে সন্তান হবার হ্যাপা বোধহয় কম । মেয়ে সন্তান হলে দুশ্চিন্তা বেশি ।
দু চারদিন পর রেহানার ডাক্তার দেখাবার কথা । মা রেহানাকে নিয়ে যাবেন ।
অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরে সুমন । মা আর রেহানা বাসায় নেই । ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরোজা খুলে সে।
টূং টাং। কলিংবেলের আওয়াজ । পিপ হোলে দেখে স্বস্তি পায় সুমন । মা আর রেহানা ফিরেছে । রেহানার মুখটা ক্যামন অন্ধকার ।
হাতমুখ ধুয়ে রেহানা ফ্রেস হয়ে আসে । সুমন জিজ্ঞেস করে ঃ আজকে না রিপোর্ট পাবার কথা ছিল ?”
রেহানা হ্যাসূচক শরীরী ভঙ্গি করে ।
সুমন আগ্রহে গলা বাড়ায় ঃ কি ? ছেলে না মেয়ে ?
~~ তোমার মন খারাপ হবে ।
~ মানে কি ? ক্লিয়ার করে বল । ছেলে না মেয়ে ?
~~ মেয়ে ।
সুমন একটু নিভে যায় । পরক্ষণেই বলে ঃ
~ আরে মন খারাপ হবে কেন ? ছেলে প্রেফারড ছিল , মেয়ে হলেও অসুবিধা নাই । কদিন আগেও যখন তুমি এ প্রশ্নটা করেছিলে একই কথা বলেছিলাম ।“
~~ সেদিন তো কারণ জানতে চেয়েছিলাম তুমি বল নাই । আজকে বল ছেলে প্রথম চয়েস হবার কারণ কি ?
সুমন একটু ভাবে । এরপর যে কথাগুলো বলে তা সে মন থেকেই বলে ।
~ আসলে ছেলে মেয়ে যাই হোক আমার কাছে একই । ছেলে হলে সুবিধাটা আমার কাছে বেশি মনে হয় তাই ছেলে চাইছিলাম। যেমন ধর, মেয়ে হলে তার সুপাত্রে বিয়ে দেবার দুশ্চিন্তা বেশি । শশুড়বাড়িটা কেমন হবে এই চিন্তাও আছে । তারপর ধর আমাদের যে সমাজব্যবস্থা, তাতে একটা ছেলের নামে কিছু রটলেও তেমন কোন অসুবিধা নাই । কিন্তু আল্লাহ না করুক, কারো মেয়েকে নিয়ে যদি কোনকিছু রটে যায় তাহলে দেখ তার ভোগান্তি আর তিতাকথার অন্ত নাই। সেই মেয়েটার বিয়ে দিতেও অসুবিধা হয় । ঐ পাড়ার রহিম সাহেবের কথাই ধর না ।“
এছাড়াও, সুমন আরো যোগ করে ঃ
“যদি বিয়ের পর দেখা যায় স্বামী ভাল না, তাইলে মেয়ের কস্ট ভেবে কি করে থাকব বল?”
সুমনের অবচেতন মনের ব্যাকগ্রাউন্ডে আরও কিছু ভাবনা খেলে যায় । হিসেবের সংসারে বহু লোকে এখনো ছেলেকেই ভবিষ্যতের আর্নিং সোর্স মনে করে । অর্থনৈতিক টানাটানির জন্য যখন সন্তান বেশি নেবার সুযোগ সীমিত হয়ে এক্টাতে দাঁড়ায়, তখন লোকের চয়েস প্রধানত ছেলেতেই থাকে ।তাছাড়া যতই লোকে বলুক, এখন বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে যৌতুক প্রথা নাই, কিন্তু অঘোষিত উপহার প্রথা তো আছে । মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলের ঘর ভালভাবে সাজিয়ে না দিলে অনেক মেয়েকেই শ্বশুড়বাড়িতে চাপা ফিসফাসের অত্যাচার সইতে হয় । সুমন এসব ভাবনা অবশ্য স্ত্রীর কাছে প্রকাশ করে না।যেন নিজের মনে নিজের সাথে কথা বলে সে।
রেহানা বলে ওঠে ঃ ক্যান, একটা ছেলের কি খারাপ বউ হতে পারে না ?”
~ তা পারে, কিন্তু এরকম ব্যাপার এখনো এদেশে সংখ্যায় কম । তাছাড়া এরকম ক্ষেত্রে ছেলেরা যত সহজে জীবনসংগী বদলাতে পারে, এদেশের সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা এখনো এ ব্যাপারে সমাজের প্রত্যাশিত সহযোগিতা পায় না“।
যদিও সুমন মন থেকে বলে তবু রেহানার মনে একটা কিন্তু রয়ে যায় ।
এইসব কথাবার্তার ফাঁকে আড়ষ্টতার জন্য যে কথাটি স্ত্রীকে সুমনের বলা হয়ে ওঠে না তা হল সেই শৈশব থেকেই মেয়েটিকে তার রক্ষা করে যেতে হবে ওত পেতে থাকা কিছু কিছু মানুষ পদবাচ্যের চতুস্পেয়ে জন্তুর হাত থেকে । এই শত্রুর অবস্থান কোথায়, কখন তারা হামলা করতে পারে তা সুমনের জানা নেই । যৌনহামলা বা টিজিং এর ব্যাপারে ছেলেদের ক্ষেত্রে শৈশবটা তাদের জন্য বেশি ভালনারেবল, কিন্তু একটা মেয়েকে ভালনারেবল থাকতে হয় জীবনের বিভিন্ন স্তরে । একজন দায়িত্ববান বাবা হিসেবে সুমন যেন সচেতনভাবে তার দায়িত্বটা পালন করতে পারে সেজন্য সে মনে মনে প্রার্থনা করে ।
কয়েক বছর পর । মেয়ের সাথে ফ্রি হয়ে জগতের জটিলতাগুলো ঠারেঠোরে যাতে বোঝানোর জন্য সুমন রেহানাকে মাঝে মধ্যে তাগিদ দেয় । মেয়েকে একটা কারাতের স্কুলে মেয়েদের ব্যাচে ভর্তি করিয়ে দ্যায় সুমন । ছুটির দিনগুলোতে ক্লাস । ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুমন মেয়েকে নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করে । রেহানা একবার বলেছিল, এইসবের দরকার কি। আমরা যে কারাতে শিখি নাই তাতে কি হইছে ।
~ সবকিছুরই দরকার আছে । কখন কি কাজে লেগে যায় ? তুমি বুঝবানা । সুমনের জবাব ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৩:১৬