সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী কম্পিউটার গেম বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র বা সিরিয়াল অনুসরণে এসব গেইম অনেক সময় তৈরি হয়। আবার মৌলিক কাহিনী নিয়েও যে কম্পিউটার গেইম তৈরি হয় না-তানয়। কিন্তু ব্যতিক্রমও ঘটে অনেক সময়। মাইক নিওয়েলের চলচ্চিত্র ‘প্রিন্স অব পারসিয়া' ও দ্য স্যান্ডস অব টাইম'র কথা এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। এই চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনীর পর এটিকে নিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পের জগতে সমালোচনার ব্যাপক ঝড় ওঠে। এই চলচ্চিত্রটি একই নামের একটি কম্পিউটার গেইম অনুসরণে নির্মিত হয়েছে। এ নিয়ে আজ আমরা বিস্তারিত কথা বলার চেষ্টা করবো।
‘প্রিন্স অব পারসিয়া' একটি ত্রিমাত্রিক কম্পিউটার গেইম। ২০০২ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে এই গেইমগুলো নির্মিত হয়েছে। ২০০৭ সালে ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানী এই গেইমগুলোর ভিত্তিতে একটি ফিল্ম তৈরির কাজ শুরু করে। ‘প্রিন্স অব পারসিয়া,দ্য স্যান্ডস অব টাইম' চলচ্চিত্রটি চলতি বছরের জুন মাসের প্রথম দিকে প্রদর্শিত হয়। একযোগে বহু সিনেমা হলে এই চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু চলচ্চিত্রটির বিক্রি তেমন ভালো হয় নি। জনগণের মাঝেও চলচ্চিত্রটি তেমন একটা সাড়া জাগাতে পারে নি। চলচ্চিত্র সমালোচক কিংবা দর্শকদের মাঝেও খুব একটা জনপ্রিয়তা পায় নি। কিন্তু একটি গেইমকে ভিত্তি করে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি কেন বাণিজ্যিক সাফল্য পেতে ব্যর্থ হলো? এ প্রশ্নের জবাব পেতে আমরা ধীরে ধীরে ফিল্মটির গভীরে ঢোকার চেষ্টা করবো। প্রথমেই চলুন চলচ্চিত্রটির কাহিনী বা গল্পের প্রতি মনোযোগ দেওয়া যাক।
আলমুত নামে একটি শহর, সুন্দর এবং পবিত্র। তাহমিনা নামের এক রাজকন্যা এখানে শাসন করছেন। ইরানের প্রিন্স এই শহরটির ওপর আক্রমণ চালিয়ে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। আলমুতের পুরোহিতরা শত শত বছর ধরে একটি খঞ্জর লুকিয়ে রেখেছেন। তাদেঁর বিশ্বাস যে-ই এই খঞ্জর হাতে নিতে পারবে সে সময়কে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে এবং বিশ্বের ভাগ্য বদলে দিতে পারবে। এমনকি এই খঞ্জর পৃথিবীকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। অনেক ঘটনার পর ঐ খঞ্জর ইরান-সম্রাটের পালকপুত্র দাস্তানের হাতে এসে যায়। কোনো এক ষড়যন্ত্রের কারণে দাস্তান ফেরারি হয়ে যায় এবং তাহমিনা ঐ খঞ্জর ফিরে পাবার জন্যে দাস্তানের পিছু নেয়। ফিল্মের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে জানা যায় দাস্তানের চাচা চাচ্ছে ঐ খঞ্জরের সাহায্যে বিশ্ব সভ্যতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। সেজন্যে দাস্তান শেষ মুহূর্তে বিশ্বকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। খঞ্জর ব্যবহার করে সময়কে পেছনের দিকে নিয়ে যায় এবং ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
প্রিন্স অব পারসিয়া চলচ্চিত্র হলিউড নির্মিত সর্বসাম্প্রতিক ফিল্মগুলোর একটি। এই ছবিটির মাধ্যমে চেষ্টা করা হয়েছে কল্পিত কিছু দৃশ্য তৈরির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ট্যাজিক বাস্তবতাগুলোর সমাধান দেওয়ার। এক ব্যক্তির পদমর্যাদার প্রতি আকর্ষণকে সার্বজনীন সিস্টেমের ওপর আরোপ করা উচিত নয়-এ বিষয়টি খুব সহজভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র নির্মাতাগণের দৃষ্টিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশগুলোর ওপর বিশেষ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলোকে ধ্বংস করে ফেলার লক্ষ্যে বৃহৎ শক্তিগুলোর হামলা একটা সাধারণ ঘটনা। এ ধরনের ঘটনাকে শক্তিপ্রয়োগ বা বলদর্পিতা বলা ঠিক নয়। চিত্রনাট্যকারগণ যদি দাবিও করেন যে একান্ত বিনোদনের জন্যেই ফিল্মটি তৈরি করা হয়েছে,কিন্তু এর বিষয়বস্তুর প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দিলে বোঝা যাবে চলচ্চিত্রটির বিষয় বর্তমান সময় কেন্দ্রিক। কেননা ইরাক এবং মধ্যপ্রাচ্যে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে বলে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এখানকার কোনো কোনো দেশের ওপর হামলা চালিয়েছে।
টাইম প্রকাশনার বিশিষ্ট শিল্প সমালোচক রিচার্ড কোরলিস এই ফিল্মটি নির্মাণের সাথে বিশ্ব রাজনীতির ওপর কর্তৃত্বের অধিকারীদের সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি প্রবন্ধে লিখেছেনঃ ‘প্রিন্স অব পারসিয়া ছবিটি আসলে একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। যারা ইরাকে হামলার বিরোধী, মূলত এই ছবিটি তাদের জন্যেই। এই চলচ্চিত্রে এক সম্রাট তার ভাইয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি ছোট্ট শহরের ওপর হামলা চালায়। সম্রাটকে বলা হয়েছিল যে ছোট্ট ঐ শহরটিতে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে।'
‘প্রিন্স অব পারসিয়া' চলচ্চিত্রটির একটি সমস্যা হলো সবকিছুই একেবারে ভাসাভাসা এবং অগভীর। এমনকি ইরাক যুদ্ধের ব্যাপারে যে উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে তা-ও একেবারেই অস্থায়ী। বাহ্যত ফিল্মটির সংলাপ যেন ভ্রাতৃত্বের প্রসার বা নৈতিকতার বার্তাবাহী, কিন্তু চরিত্রগুলো নিজেদেরকে অমর করে তোলার ক্ষেত্রে অর্থাৎ টিকিয়ে রাখার জন্যে পরস্পরে হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। চরিত্রগুলোর মাঝে মন্দ থেকে ভালো হয়ে যাবার যে মানসিক পরিবর্তন ঘটে, তা-ও কোনোরকম ভূমিকা বা পটভূমি ছাড়াই খুব দ্রুত ঘটে যায়। আসলে চলচ্চিত্রটিতে নির্দিষ্ট কোনো তত্ত্ব বা চিন্তাশৈলীরই প্রয়োগ নেই। এইসব দিক বিবেচনায় মূল কম্পিউটার গেইমটির সাথে চলচ্চিত্রটিকে তুলনা করে বেশিরভাগ দর্শকই কম্পিউটার গেইমকে বেশি নম্বর দিচ্ছেন। আর চলচ্চিত্রটিকে মধ্যমানের একটি ছবি বলে মনে করেন যার গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় কোনো মূল্যমান নেই।
দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার লেখক ডেভিড কক্স ‘প্রিন্স অব পারসিয়া' সম্পর্কে লিখেছেনঃ এর বাহ্যিক দিকটি আকর্ষণীয় তবে সামগ্রিক বিচারে ফিল্মটির কোনো মূল্য নেই। চরিত্রগুলো ব্যক্তিত্বহীন আর সংলাপগুলো শিশুসুলভ। ঘটনা তো একেবারেই আনাড়ি ধরনের। চরিত্রগুলোর পরিনতি বা ভাগ্যের জন্যে দর্শকদের মাঝে কোনোরকম উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা কাজ করে না। ফিল্মের নায়ক দরোজা দেয়াল পাড়ি দিয়ে কোনোরকম কষ্ট ছাড়াই শত্রুদেরকে পরাস্ত করে, প্রেমে আসক্ত হয় এবং যাদুময় খঞ্জরটি লাভ করে। কিন্তু এগুলো একটা গেইমের জন্যে ইতিবাচক পয়েন্ট, চলচ্চিত্রের জন্যে নয়। একটা চলচ্চিত্র দর্শককে অবশ্যই মোহগ্রস্ত করে তুলবে। ‘প্রিন্স অব পারসিয়া' চলচ্চিত্রটি তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন চরিত্রের নামগুলো ইরানী। কিন্তু কাহিনী লেখা হয়েছে হাসান সাব্বাহের জীবনী এবং ইসমাইলিয়া ফের্কার ভিত্তিতে। তবে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে অনেক রদবদল করা হয়েছে। নামগুলো ইরানী ব্যবহার করা হলেও ইরানের ইতিহাস বা সাহিত্যের সাথে সেগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং আরবি এবং হিন্দি গল্পের সাথে মিল রয়েছে। মরক্কোতে ছবিটির শুটিং হয়েছে যার ফলে মিউজিকসহ চরিত্র নির্বাচনে যেমন আফ্রিকান ও আরবদের প্রাধান্য রয়েছে তেমনি তাদের পোশাক পরিচ্ছদ এবং জীবনাচারও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ইরানী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না নেওয়ার কারণে বোস্টন গ্লোব সাপ্তাহিকীর এক লেখক বেশ সমালোচনাও করেছেন।
'প্রিন্স অব পারসিয়া' চলচ্চিত্রের সমালোচনা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।
ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন
=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।
আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।