somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমাজ বদলের প্রত্যয় ও দুই কবির মানসিক দীনতা

২৫ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফকির ইলিয়াস
===================================
এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে ভাষণ দিতে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে সফরসঙ্গীদের বহরটি ছিল বেশ বড়। ছিলেন ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দও। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, তারা এসেছেন নিজ খরচে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরসঙ্গী দলে তিনজন কবিও এসেছিলেন। এরা হচ্ছেন, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা ও মুহাম্মদ সামাদ।
এই তিনজন কবি যুক্তরাষ্ট্র সফরে আসার আগে একটি সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। তারা সরকার কর্তৃক বরাদ্দ বিজনেস ক্লাস বিমান ভাড়া প্রত্যাখ্যান করে ইকোনোমি ক্লাস আসন নিয়েছিলেন। ফলে রাষ্ট্রের সাশ্রয় হয়েছিল প্রায় তেরো লাখ টাকা। বিষয়টি নন্দিত হয়েছিল দেশে-বিদেশে।

কোনো রাষ্ট্রীয় সফরে সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব থাকার রেওয়াজটা বিশ্বজোড়াই চলমান। যে কোনো সুসভ্য গণতান্ত্রিক দেশের। রাষ্ট্রপ্রধান অন্যদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে গেলে রাষ্ট্রের বিশিষ্টজনকে সফরসঙ্গী হিসেবে নিতেই পারেন। সেই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনাও তিনজন কবিকে সফরসঙ্গী করেছেন। তবে বিশ্বসমাজের নিরিখে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পার্থক্য হচ্ছে এই, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা দলীয় মতবাদী বুদ্ধিজীবী কিংবা কবি সাহিত্যিকদেরকে রাষ্ট্রীয় সফরে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন। এর আগে ক্ষমতাসীন থাকাকালে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশের ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত কবি ফরহাদ মজহারকে চীন সফরে সঙ্গী করেছিলেন।

তবে খুবই অবাক করা বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী তিনজন কবি এবারের নিউইয়র্ক সফরের সময় সরকারি তোষামোদির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তাদেরকে যখন বিভিন্ন সমাবেশে কবিতা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তখন তারা সরকারি বাণীবন্দনায় ব্যস্ত থেকেছেন বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, কবিতার বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে। অন্য ভাষাভাষি কবিরা এমন সরকারি তোষামোদে সাধারণত ব্যস্ত হন না। তিন কবিকে নিয়ে বাংলাদেশের জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনে আড্ডার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই আড্ডায় কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, তার সৌভাগ্য তিনি একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রধানের সফরসঙ্গী হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশন দেখতে এসেছেন। নির্মলেন্দু গুণ আরো বলেন, এর আগে শামসুর রাহমান এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গী হয়ে। গুণ নিজেকে সৌভাগ্যবান দাবি করে বললেন, তিনি কোনো স্বৈরশাসকের সফরসঙ্গী হয়ে আসেননি। তার কথায় শামসুর রাহমানের প্রতি এক ধরনের তাচ্ছিল্যই প্রমাণ পেলো। অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই শামসুর রাহমান তৎকালীন দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদে থাকাকালীন সাংবাদিক হিসেবে সরকারি আজ্ঞাবহ হয়েই জিয়াউর রহমানের সংবাদ কভার করতে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন।

তিন কবিকে নিয়ে আরেকটি আড্ডার আয়োজন করেছিল মুক্তধারা, নিউইয়র্ক। সেই আড্ডায় নির্মলেন্দু গুণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বর্তমান সময়ে বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি কি? এ সময়ে এই প্রজন্মের কারা ভালো লিখছেন? এর জবাবে গুণ বলেন, ‘আমার পড়াশোনা খুবই কম। আমি কারো লেখা পড়ি না। আমাকে উৎসর্গ করে অনেকে বই লিখে। সেগুলোও উল্টেপাল্টে দেখি না। খাটের নিচে ফেলে রাখি।’

একই প্রশ্নের জবাবে মহাদেব সাহা বলেন, ‘আমি যে কাগজে আমার লেখা ছাপা হয়, সেই পৃষ্ঠাগুলোতে চোখ বুলাই। অন্যের লেখা পড়ি না। আমাকে কেউ বই উপহার দিলে, উপহার পাতাটি ছিঁড়ে ফেলে সের দরে বইগুলো বিক্রি করে দেই। ঘুরে ফিরে বইটি লেখকের হাতে গেলে তিনি ব্যথিত হবেন ভেবে ঐ পাতাটি ছিড়ে ফেলে দেই।’

পাঠক, লক্ষ্য করুন, এই হচ্ছে সমকালের দুই কবির মানসিক দীনতা। আর এদের হাত ধরেই এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে এই প্রজন্ম, এই কবিতার মহাকাল। আমার সৌভাগ্য হয়েছে বিশ্ববরেণ্য বেশ কিছু ব্যক্তিত্বের সাহচর্য পাওয়ার যারা মনে প্রাণে বাংলা সাহিত্য, ভাষা ও ঐতিহ্যকে সম্মান এবং লালন করেন। এমন কিছু ব্যক্তির সঙ্গে দেখা-কথা হয়েছে যারা বাঙালি না হয়েও বাংলা ভাষা, কবিতা, সংস্কৃতিকে ধারণ করে চলেছেন মনেপ্রাণে। তাদেরই একজন ক্লিনটন বি. সিলি। মনে পড়ছে, ক্লিনটন বি. সিলিকে আমি যখন আমার লেখা বই উপহার হিসেবে দিতে চেয়েছি, তখন তিনি সানন্দে বলেছেন, ‘আপনার বই আমাকে আলোকিত করবে’। তার এই বিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রায় একই ভাষায় উষ্ণ আতিথেয়তা দেখিয়েছেন বাংলাভাষার আরেক বিদেশী প্রেমিক উইলিয়াম রাদিচে। ব্রিটেনে এই পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘নবীন লেখকদের লেখা আমি সম্মানের সঙ্গেই পড়ি। কারণ আমি মনে করি নবীনরাই কালে কালে নতুনের দরজা খুলে দেয়।’ বিশ্ব সাহিত্যের বড় বড় কবি সাহিত্যিকদের মাঝে এমন নাক সিটকানো ভাব সচরাচর দেখা যায় না। ব্যক্তি স্বাধীনতা কিংবা মত প্রকাশের স্বাধীনতা কি সৃজনশীল ভাবনা সাম্রাজ্যকে এমনভাবে অস্বীকার করে?

নির্মলেন্দু গুণ কিংবা মহাদেব সাহা অন্য কোনো গ্রন্থের মানুষ নন। তাদেরকে এই প্রতিবেশ, এই পরিবেশের সঙ্গেই বসবাস করতে হয়। যে গণমানুষের করের টাকায় সরকারি বড় বড় সফরগুলোর খরচ আসে সেই ট্যাক্সের টাকায়ই তারা বিদেশে এসেছিলেন। অথচ হরেদরে যেভাবে সমকালীন বাংলা কবিতা কিংবা সাহিত্যের মূল্যায়ন তারা করেছেন, এ দুই কবির কাছে কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিল না। পরিশুদ্ধ পঠন-পাঠন ছাড়া কোনো মহান জ্ঞানীর জ্ঞানভাণ্ডারও শাণিত থাকে না। আর উদার মানসিকতা সব সময়ই আগুয়ান প্রজন্মকে মহৎ পথ দেখায়। এ কথাটি সকলেরই মনে রাখা দরকার।
------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ/ ঢাকা / ৭ অক্টোবর ২০১০ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত
Click This Link




৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×