অমল সরকার, শহরের বড় ডাক্তার। মাঝ বয়সী, দুই সন্তানের জনক। তবে দেখে তত টা বয়সী মনে হয় না। চুল গুল কিছুটা লম্বা, ঘন কাল, দাড়ি নেই। অর্থের কোন অভাব নেই, সংসারে তেমন কন ঝগড়া নেই তবুও মনে সুখ নেই। যদিও চলায় তা দৃশ্যমান নয় কিন্তু চোখে তা স্পষ্ট। এত কিছু থাকা সত্যতেও চোখে জেন কিসের ক্লান্তি, কি যেন থেকেও নেই।
দুই সন্তান আর ইস্ত্রি চার জনের ছোট্ট সংসার। । আরেক সদস্য আছে তবে সে সংসারের বাইরে। ঘরের আসবাব যেমন পুড়ান হলে তার জাগায় নতুন এনে পুড়ান গুলে কে ঘরের বাইরে ফেলা হয় ঠিক তেমনেই সে আজ সংসারের বাইরে,এখন দুনিয়ারই বাইরে।
আজ তার সেই ফেলনার চির বিদায় উদ্দেশেই পাঁচ বছর পর গ্রামে যাচ্ছে অমল। সে একাই যাচ্ছে। রাত্রেই টেলিগ্রাফ এ খবর এসেছে, রাত্রেই রওনা হয়েছে। স্ত্রী গায়েত্রি বার-বার বাধা দিয়েছে বটে তবে আজ সে কন বাধা মানতে চাই না। দেরি হলে যে আর দেখতে পাবে না।
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভো-ভো আওয়াজ তুলে ছুটে চলছে ট্রেন। খুব জোরেই ছুটছে তবুও তার কাছে মনে হচ্ছে যেন পিপড়ার গতি তে চলছে ট্রেন। পাঁচ বছর আগে যাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেছিল, যে তার কাছে কেবল বোঝা, আজ সেই বোঝা দূর হওয়ায় সে খুশি না হয়ে বরং অনেকটা দুখী। কতবার তাকে চিঠি পাঠিয়েছে, একবার দেখতে চায় বলে, নানা অজুহাতে যায় নি। আজ তাকে দেখতেই ছুটে চলা।
প্রতি মাসে কেবল নামমাত্র কিছু টাকা পাঠাত। অথচ তার উপর ভড় করেই এত কিছু, তার পর শহরে এলো আর গ্রামের সেই মানুষ যেন তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল।
অতীতের নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ জোড়া ভিজে উঠেছে তা সে জানেই না। তার কাছে মনে হচ্ছে অতীতের পাপের সাঁজা স্বরূপ কে যেন তার হৃদয় কে টুকরো-টুকরো কড়ছে আর তা থেকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। সেই রক্তই যেন পানি হয়ে চোখ জোড়া দিয়ে দেহের বাইরে আসছে। অতীতের সব স্মৃতি ট্রেনের কামড়া জুড়ে বিরাজ করছে আর যেন তাকে কুড়ে কুড়ে খচ্ছে।
সকাল বেলা ট্রেন এসে থামল। একদিন আগেও যারা তাকে দেখে মনে করতেন ত্রিশ বছর বয়সী তারাই আজ দেখলে ভাববে তার বয়স বোধ হয় এক রাত্রেই বিশ বছর বেরে গেছে।ট্রেন থেকে নেমেই সে এক ছোকরা কে ডেকে তাকে নিয়ে চলল শ্মশান এর দিকে।
তাকে দেখেই গ্রামের এক বৃদ্ধা বলে উঠলেন, “বাপু তুই এয়েছিস। নে বাবা একটু সিঁদুর লাগিয়ে দে। বেঁচে থাকতে তোকে টা তোর জন্য কম করে নি। তোকে দেখার বড় ইচ্ছা ছিল কিন্তু বাপ তুই সেই গেলি আর তো এলি না।”
সিঁদুর নিয়ে পরিয়ে দিল তার প্রথমা স্ত্রী প্রতিমা দেবী কে। তার অশ্রু-যেন এবার গরজন করে বেরিয়ে এলো। চিৎকার করে বলে উঠল, “প্রতিমা আমায় ক্ষমা করো।”
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৭ রাত ৮:২৮