somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডুব

০৬ ই জুন, ২০১৭ রাত ৮:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দশ বছর পর আজ মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে শ্বাস নিচ্ছে শুবল । আজ সে মুক্ত, সত্যই মুক্ত। কোন পাপও নেই, কোন পিছুটানও নেই। অবশ্য পাপ তার কোন কালেই ছিল না।

বের তো হোল জেল থেকে, কিন্তু কোথায় যাবে। তার তো আপন বলে কেউ নেই। এই দুনিয়ার এত মানুষের মাঝে তার যেমন আপন কেউ নেই তেমনি এত জায়গার মাঝেও তার নিজের কিছুই নেই। একদিন সবই ছিল, অঢেল না হোক যথেষ্ট। ভালোবাসার মানুষ ও ছিল। কিন্তু এখন কিছুই নেই।

দশ বছর পর যখন জেল থেকে বের হয়েছে তখন তাকে দেখে ভিক্ষুক ছাড়া কিছু মনে হওয়ার কথা নয়। উষ্কখুষ্ক চুল, লম্বা আধা পাকা দাড়ি, ময়লা জামা। অবশ্য, সত্যি বলতে সে এখন এক রকম ভিক্ষুক ঐ বটে।

অতীতের হাজারো কথা ভাবতে ভাবতে সে কিছুদূরে একটা গাছের উপরে বসে পড়ল। এই জীবনের ভার সহার মত তার আর শক্তি নেই, সে বইতে চায়ও না। কিছু মানুষ তাকে ভিক্ষুক ভেবে সিকি-আধুলি দিয়ে গেল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিল আমি ভিক্ষুক নই কিন্তু পারলো না। ঠিক যেমনি একদিন তার মেয়ের মারা যাওয়া আটকাতে পারেনি, যেমনি পারেনি তার মেয়ের হত্যাকারীর বিচার করতে।

সযত্নে সে টাকা গুল তুলে নিলো। মধুর কণ্ঠে কে যেন বলে উঠল, “বাবা বাড়ি আসবে না।” “আসব, আসছি মা। আমি আছি,”-চিৎকার করে বলে উঠল শুবল । মনে মনে ভাবল সে গ্রামেই ফিরে যাবে। জানতে চাইবে কি ছিল তার অপরাধ, কেন সে নিরপরাধী হয়েও-জেলে আর অপরাধীরা খোলা আকাশের নিচে।
শহরে সে মাঝে মাঝে আসা জাওয়া করত, তাই রাস্তা কিছুটা চিনে, যদিও সব পালটে গেছে এই এক দশকে।তবুও সে কিছুটা জেনে, কিছুটা না জেনে পা বাড়াল। গাড়ি করে রেল-ইষ্টেসনে এসে সে রেলে চেপে বসলো।

রেল গাড়ি যত সামনের দিকে যাচ্ছে, সময় এ চড়ে সে যেন ততই পিছনে যাচ্ছে। একটা সময় ক্লান্তিতে তার চোখ যখন কিছুটা লেগে এলো, অতীত যেন তার সামনে নৃত্য করতে লাগল। তার মনে পরতে লাগল এক সময় সে যখন শহর থেকে গ্রামে ফিরত, কতি না আনন্দ লাগত তার। কত দিন পর সে তার প্রেয়সী কে আবার দেখতে পাবে। ভাবত যখন সে তার স্ত্রী কে তার কেনা চুড়ি দিবে সে কি ভাববে, কেমন হবে তার মুখ খানা। আর আজ, কিছু ভাবার ক্ষমতা তার নেই।

তার মনে পরে সে যেদিন শহর থেকে ফিরত, প্রতিমা সেদিন কত কিছুই না রান্না করত। তারপর রাত্রে দুজন একসাথে খাওয়ার সময় কতই না গল্প করত। সে শহরে কি দেখেছে, তাকেও-একবার শহরে নিবে, আরও কত কি। সে আর হল কই, আজ সেতো আর নেই।

যেবার তার মেয়ে জন্ম নিলো সেবারই তো প্রতিমা মারা গেল। একদিকে বাবা হওয়ার আনন্দ আর অন্য দিকে স্ত্রী হারানোর দুখ। মারা জাওয়ার আগে বলেছিল মেয়ে কে দেখে রাখতে। স্ত্রীর নামেই নাম রেখেছিল শুবল, ‘প্রতিমা’। সেই থেকে মা-বাবা দুজনই সে। এসব তো বিশ-পঁচিশ বচর আগের কথা। এখন তো এরা কেউ নেই, আছে শুধু শুবল একা।

গ্রামের লোকেরা তাকে কত বার বিয়ে করতে বলেছিল, কিন্তু সে তা করে নি। যদি তার মেয়ের কোন কষ্ট হয়। ধীরে ধীরে প্রতিমা বড় হোল, গ্রামের স্কুলে ভর্তিও করিয়ে দিল। শুবলের ইচ্ছা তার মেয়ে কে সে শিক্ষিত করে তুলবে। প্রতিমাও পড়া লেখায় খুব ভাল।

প্রতিমার বয়স যখন তের, সে তখন গানেও যথেষ্ট উন্নতি লাভ করল, পড়ার পূজায় কিংবা অন্য অনুষ্ঠানেও মাঝে-মাঝে গান করত। সারাদিন স্কুল আর এ পাড়া- ও পাড়া করেই সময় কাটত। সন্ধ্যা হলে পাখির মতই ঘরে ফিরে আসত। পরে, খেয়ে ঘুম। আবার সকালে পাখিদের সাথে উঠে বের হয়ে পরা। কখন এ নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি।

একদিন, পাখিরা সব ঘরে ফিরে গেল কিন্তু প্রতিমা ফিরল-না। শুবলের তো আর চিন্তা বাধ মানে না। সে খুঁজতে নেমে পরল। এ গ্রাম, সে গ্রাম, এর বাড়ি, ওর বাড়ি, কোথাও পেলে না। সে রাত তার কোন ঘুম ছাড়াই কেটে গেল।

পরদিন কাক-ডাকা ভোরে প্রতিমা ফিরে এলো। সেদিন শীত কাল ছিল না, বসন্ত ছিল। তবুও প্রতিমার সেই স্বভাব সুলভ আচরণ ছিল না, তার শরীরে কোন চাঞ্চল্য ছিল না। তার শরীরে যেন বিরাজ করছিল শীতের শীতলতা। সে কোন ভাবে ঢুকতেই তার গলা থেকে বেড়িয়ে এলো , ‘বাব’। য়র কিছু বলার আগেই তার কোমল দেহ টা মাটিতে পড়ে গেল।

ঘণ্টা খানেক পর প্রতিমার জ্ঞান ফিরল, ঘর ভরতি মানুষ। সে ইশারায় সবাই কে ঘর হতে বের হতে বলল, এমনকি তার প্রিয় বান্ধবী কেও।
বাবা।
বল মা।
তুমি মাতব্বর এর ছেলে জমির কে ছেঁড় না।
কেন মা।
ও আমার...
আর কোন কথা হোল না।
সেইদিন রাত্রেই প্রতিমা পুকুরে ঝাপ দিয়ে নিজের জীবন দিল। সকাল এ পুলিশ এলো। মাতব্বর এর বাড়িতে চুরির দায়ে তাকে ধরল। নিজের মেয়ের শেষ কৃত্য করতে পারল না। মেয়ের মৃত্যু তে শোক করার সময়ই পেল না শুবল । দুখ না পেয়ে কিছুটা খুশিই হোল, বেঁচে থাকলে মেয়ে কে এসব ও দেখতে হত।

টিটি এর ডাকে ঘুম ভাঙল শুবলের ।
টিকিট আছে নাকি।
আছে।
কই।
নেন।
সব অতীত যেন আবার দূরে সরে যেতে লাগল, না, কুণ্ডলী পাকিয়ে তার বুকের ভিতর জ্বলে উঠল। অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ‘প্রতিশোধ’।

রেল থেকে নেমে মাতাবর এর বাড়ীর দিকে রওনা হোল সে। গ্রামের বয়স্ক অনেকেই মারা গেছে। তাকে দেখে কেউ চিন্তেই পারে নি, তার যে শ্রী তাতে চিনার কথাও না। সে কোথাও থেকে একটা ছুরি যোগার করে চলতে লাগল। বৃদ্ধ মাতাবর বেঁচে নেই, জমিরই এখন মাতাবর। উঠানে বসে সে শিতের রৌদ্র পোহাচ্ছিল। শুবল ঢুকেই তার বুকে ছুড়ি বসিয়ে দেয়। তারপর টানতে টানতে নিয়ে যায় পুকুর পারে। উঠানের সামনেই পুকুর। জমির কে কে নিয়ে শুবল একসাথে ডুব দেয়, আহত জমির অনেক বাচার চেষ্টা করলেও পারেনি। সব কিছু এত তারা তারি হয়েছে যে অন্যরাও কিছু করে উঠতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর দুটি লাশ ভেশে উঠল। এবার আর আগের মত পাখিরা নীরব ছিল না বরং তারা মুক্তির গান গেয়ে উঠল।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৭ রাত ৮:৩০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×