আমার বন্ধু রুদ্র, ছোট বেলা থেকেই না কি কথা বলতে পারে না। হলে এসেই অর সাথে পরিচয়। কয়েক দিন দিন ধরেই দেখছি ও একটা মেয়ের ছবি আঁকছে। জিজ্ঞাস করতে বলল ওর মোনালিসা । তাই ভাবলাম অর ডাইরি টা একবার পরেই দেখি, ও ঘরে নাই। আর আ পড়লাম তাতো কোন প্রেম কাহিনী থেকে কম নয়।
জানুয়ারি ১৭,
জন্ম থেকেই আমি কথা বলতে পারি না। অবশ্য সেটা নিয়ে বিশেষ কোন আক্ষেপও আমার নেই। কারণ যারা বলতে পারে তারা সত্য বলে কই, তার চেয়ে আমি বলতে পারি না তাই ভাল, মিথ্যা তো আর বলতে হয় না । মা-বাবা দুজনেই গায়ক, তাই তাদের স্বপ্ন ছিল আমি গায়ক হব, তা আর হোল কই। তবে মাঝে ভায়োলিন টা একটু শিখেছিলাম। কিন্তু এখন আমার সঙ্গী বলতে আমার লেখার ডায়রি আর আমার স্কেচ-বুক। জীবন্ত সঙ্গী বলতে একটা বিড়াল ছিল, হলে আসব বলে আর আনি নি। চারুকলা প্রথম বর্ষ।সেই পনের বছর বয়স থেকে ডায়রি লিখছি, ৫ বছর এ এটা একটা নেশা হয়ে গেছে,তবে নিয়মিত লিখি না।
জানুয়ারি ১৮,
বেশ ভালই কাটছে। হল, ক্লাস আর লাইব্রেরী । মা কে খুব মিস করছি। আমি তো আর কথা বলতে পারি না, তাই ফোনে কথাও হয় না । মাঝে-মাঝে মেসেজ করা হয়। আসলে শরীর টা খারাপ হলে জেন মায়ের কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে।
তবু সব মিলিয়ে বেপার টা তেমন খারাপ না। বেশিভাগ সময় লাইব্রেরিতেই কাটে, বই পড়ে আর ছবি একে।
জুন ১২,
ছয় মাস হয়ে গেছে প্রায়, বন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই, কোন কালে ছিল না। তবে আমার রুমমেট আশিক এর সাথে ভালই বন্ধুত্ব হয়েছে। যদিও অ কথা বলতে পারে, আমার মত নয়, তবে অন্য যারা কথা বলে তাদের মতও নয়। খুবই হাসি-খুশি, কখন আমি ওর মন খারাপ হতে দেখি নি। বরং আমার কোন কারণ খারাপ থাকলে ও তা ভাল করবেই। আমিও প্রায় আমার সব কিছু অকে বলি, বলি বলতে লিখি, বোবাদের ভাষা টাও বেশ আয়ত্ত করেছে ও। সত্যই বলতে, মানুষ হিসেবে খুবই ভাল লাগে ওকে।
জুন ১৩,
বেশ আছি, খুবই বেশ আছি। পনি কে নি এসেছি, আমার বিড়াল। মন চাইছে মা কেও আনি। পনি আসায়, আশিক অবশ্য খুব বিরক্ত। আমার অবশ্য তাতে আনন্দই হয়। এইতো আজকে আশিকের এসাইনমেন্ট এর একটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলায় অকে আবার করতে হোল। ওয় সে কি রাগ। আমি কিন্তু খুশিই হলাম।
জুন ১৪,
ইদানীং লাইব্রেরি তে বেশি সময় তাকা হচ্ছে না, তার চে বেশি সময় লাইব্রেরীর বাইরে বসেই কাটছে। তার একটা কারণ আছে। এমন একটা কারণ যেটা আমার জীবনে আস্তে পারে কখন ভাবি নি, হয়তো ভাবার সময় পাইনি। একটা মেয়ে। জন্ম থেকেই মানুষ আমার তেমন পছন্দের নয়, যদিও আমি মানুষ। আর প্রেম ভালবাসা, সে আমার কাছে চিরকালই ছিল সময় এর অপচয়, আমি পরার আগ পর্যন্ত। আর এখন, এই সময় অপচয়ই যেন আমার প্রধান কাজ। আজ নীল পড়ে এসেছিল। ঘণ্টা খানেক ধরে ছবি আঁকলাম।
জুলাই ১০,
বোধহয়, মেয়েটাও প্রথম বর্ষ। সুস্মিতা, মেয়েটার নাম। আজ ওর বান্ধবীদের বলতে শুনলাম। রমের আমার পাশের দেয়াল টা যেন তার ছবিতেই ভরে গেছে। ডায়রি তেও এখন প্রতিদিনের ঘটনা থেকে তার রূপের বর্ণনাই বেশি। থাকবেই না কেন। আশিক বার বার জিজ্ঞাস কড়ছে মেয়ে টি কে। আমি বলি নি। হেঁয়ালি করে বললাম , আমার মোনালিসা।
জুলাই ১১,
আজ সকাল থেকেই থেক-থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। তবুও ঠিক বিকাল চারটায় ছাতা নিয়ে আমি তার জন্য যথা স্থানে অপেক্ষা করলাম। বৃষ্টি ছিল বলে হয় ত আসে নি। আচ্ছা আমি তাকে যেমনি রজ দেখি, সেও কি দেখে। দেখবেই তো, দেখবে না কেন, তার কি চোখ নেই। আচ্ছা সেও কি আমায় ভালবাসে। গত বিশ বছরে যা মনে হয় নি আজ তা মনে হচ্ছে, যদি আমি কথা বলতে পারতাম। একবার, একবার যদি তাকে বলতে পারতাম, ‘আমি তোমায় ভালবাসি।’ যেকোনো কিছুর বিনিময়। না, এ করেই হোক আমি ওকে বলব, আমার ভাষায়।
জুলাই ১২,
আজ ও একা আসছিল, একটা বাচ্চাকে দিয়ে ফুল সহ চিঠি দিলাম। আসবে তো, নাকি আসবে না। আজ ও খুব হাসছিল, সে হাসি যেন এখন আমার কানে বাজছে। আজ রাতে আর ঘুম হবে না। ভাবছি ওয় হাসি মাখা একটা ছবি আঁকব, দেড়শত এর মত একে ফেলেছি। হাজারটা আঁকলেও যেন কম হবে।
জুলাই ১৩,
সকালে রৌদ্র উঠেছে, আকাশে মেঘ নেই। সকাল থেকেই খুব কেমন-কেমন লাগছে। মা কে ফোন করেছিলাম, যদিও বলতে পারিনা, মায়ের গলার স্বর টা শুনলাম। অবশ্য তার গান শুনলেও চলত। সুস্মিতা কে চিঠি দিয়েছি, আজ দেখা করার কথা সকাল দশ টায়। জানি না করবে কিনা। আট বাজে, মন চাইছে এখনি বের হই।
“দশ টা ত্রিশ বাজে তবুও এলো না। হয়তো ভালবাসে না। নাই বা ভালবাসুক একবার কথা তো বলতে পারত।” আমি যখন এসব ভাবছি হঠাৎ দেখি ও আসছে।
ওর সাথে কথা গুল হুবহুই লিখে রাখলাম, ওটুকই তো আমার সম্বল।
-কি হয়েছে? ডেকেছেন কেন, জানতে পারি?
-আমি ইশারায় বসতে বললাম।
-বসছি। বলুন।
-আমি একটা কাগজ দিলাম। তাতে লেখা আমি ভালবাসি। যদি কথা বলতে পারতাম।
-কাগজই যখন দিবেন, ডাকার কি দরকার ছিল। একসাথে দিলেই পারতেন। আর আপনি আমায় ফুল দিয়েছিলেন কেন।
-আমি ইশারায় কাগজ টা পরতে বললাম।
-আপনি কি কথা বলতে পারেন না। চুপ করে আছেন কেন।
-আমি ইশারায় না বলতে ও কাগজ টা খুলে পড়ল। কোন কথা না বলে কাগজের টুকরো টা নিয়ে চলে গেল। অনেকবার ডাকার চেষ্টা করলাম, পারলাম না।
জুলাই ১৪,
আজ হঠাৎ একটা স্বপ্ন দেখে উঠেছি। সুস্মিতা আমার রুমে, বলছে তুমি আমায় এত ভালবাসো আগে বল নি কেন। আমি লিখে বললাম তুমিও কি আমায় ভালবাসো ? আমি তো কথা বলতে পারি না। ও বলল তাতে কি, বেশ ভাল হবে, আমার সাথে ঝগড়া করতে পারবে না।
ঘুম থেকে উঠে দেখি সত্যি সুস্মিতা এসেছে। আশিক ঘরে ছিল না, ভালই হয়েছে।
সবে প্রের পাতা টায় যাব আর অমনি রুদ্র আমার হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে নিল । আমি বলে উঠলাম তোর মোনালিসা না, তোর তো সুস্মিতা। পড়ে কি হোল রে।
ও যা ইশারা করল তার মানে দাড়ায়, নাই বা জানলে । আমার আর পরের অংসটা জানা হোল না। আমি ভাবলাম সে না হয় নাই বা জানলাম।